১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৮। মস্কোর হাসপাতালে ডাক-মারফত পুরনো দোমড়ানো মোচড়ানো প্রেসক্রিপশনের পেছনে লেখা একটি চিঠি পেয়েছিলেন ডক্টর বোমগার্ড। প্রেরক সুহৃদ, তরুণ চিকিৎসক ডক্টর সার্গেই পোলিয়াকভ। চিঠিতে তাঁকে খুব তাড়াতাড়ি তাঁকে দেখতে আসার অনুরোধ লেখা ছিল পোলিয়াকভের। সেই সময়, আর পাননি বোমগার্ড। কিছু দিনের মধ্যেই মস্কো হাসপাতালের ক্যাজুয়াল্টি ওয়ার্ডে জেরেলিভো ক্লিনিক থেকে বুলেটে আত্মঘাতী আক্রমণে প্রায়-নিস্পন্দ একটি শরীর আসে। স্পন্দন ক্রমশ কমে আসা ডক্টর(Doctor) পোলিয়াকভ, বোমগার্ডকে তাঁর শেষ ডায়েরি পড়তে দিয়েছিলেন। মরফিন আক্রান্ত এক বীভৎসতার কথা। বুলেটের ফেটাল শট ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না পোলিয়াকভের।
পথ্যসূত্র : জীবে প্রেম করে যেই জন – গৈরিক গঙ্গোপাধ্যায়
গল্পের নাম ‘মরফিন’। প্রেক্ষিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন রাশিয়া। চরিত্রের নামগুলি কাল্পনিক হলেও ঘটনা ভয়ঙ্করভাবে বাস্তব। বইয়ের নাম ‘দ্য কান্ট্রি ডক্টর্স নোটবুক’। লেখক মিখাইল বুলগাকভ। তখনও ‘দ্য মাস্টার অ্যান্ড মার্গেরিটা’ লেখা হয়নি। তবে ‘দ্য কান্ট্রি ডক্টর্স নোটবুক’-এর গল্পগুলি অধিকাংশই বুলকাভের খ্যাতির প্রাইম পয়েন্টেই প্রকাশিত। গল্পগুলি লেখা যদিও কেরিয়ার তৈরির মুহূর্তে।

চিকিৎসা এবং সাহিত্য। সম্পর্কের বুনন। এক এক করে বাস্তবের রক্ত-মাংস’দের কথায় আসি। মিখাইল বুলগাকভকে দিয়ে কথার শুরু। কিয়েভ ইউনিভার্সিটি থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়া। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রেড ক্রসের হয়ে স্বেচ্ছাসেবক চিকিৎসকের দায়িত্বপালন এবং ইউক্রেনের চারনোভস্কি থেকে সেই সময়েই আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ফিজিসিয়ানের কাজ। মেডিকেল পরীক্ষায় অস্বাভাবিক সাফল্যের পর পশ্চিম ইউক্রেনের একটি সামনের সারির হাসপাতালে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ পান। ১৯১৬ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর স্মলেন্সক ওব্লাস্ট প্রভিন্সের নিকোলস্কোয়ে গ্রামে চিকিৎসক-জীবনের ঘটনাবহুল অধ্যায় শুরু। ১৯১৮ সালে কিয়েভে ফিরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করার এক বছরের মধ্যে অ্যান্টি-বলশেভিক ‘হোয়াইট আর্মি’-র হয়ে সেনা-চিকিৎসকের দায়িত্ব পাওয়া এবং নর্দার্ন ককেশাসে বেশ কিছুদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা। এইসময়েই প্রায়-মারণ টাইফাস রোগের সংক্রমণ, যা থেকে বেরিয়ে এসে সুস্থ হয়ে চিকিৎসক জীবন পাকাপাকিভাবে শেষ করে লেখালেখিতে ডুবে যান বুলগাকভ। কুঁড়ি পায় ‘দ্য মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা’। তবে চিকিৎসক-জীবনের স্মৃতি বারবার উঠে এসেছে লেখায়। প্রসঙ্গত, নিকোলস্কোয়ে গ্রামের চিকিৎসক-দিনগুলিতে লেখা গল্পগুলি নিয়ে ১৯২৫-১৯২৬-এ প্রকাশিত হয় ‘দ্য কান্ট্রি ডক্টর্স নোটবুক’। এই সময়েই একটি শিশুর চিকিৎসা থেকে সংক্রামিত হয়। অ্যান্টি ডিপথেরিয়া ড্রাগ থেকে তৈরি হওয়া অ্যালার্জি রিয়্যাকশন হয় বুলগাকভের শরীরে এবং সেই অ্যালার্জি কাটানোর জন্য একদিন হঠাৎ মরফিন নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। নেওয়াই কাল হল। দীর্ঘকালীন মরফিনের নেশার ভয়ঙ্কর সেই সময় – শ্বশুরের পরামর্শে ডিস্টিলড ওয়াটার ইনজেক্ট করে ধীরে ধীরে নেশা থেকে মুক্তি পান মিখাইল। এই ঘটনাই ‘দ্য কান্ট্রি ডক্টর্স নোটবুক’-এর সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত এবং ট্র্যাজিক গল্প ‘মরফিন’-এর পটভূমিকা। ডক্টর সার্গেই পোলিয়াকভ আসলে বুলগাকভের অল্টার ইগো। মাইকেল গ্লেনি-র অনুবাদে পোলিয়াকভ, নাকি বুলগাকভের নিজের সেইসমস্ত আর্তনাদ – ‘I’m not afraid of rifle fire now. After all, what can possibly frighten a man obsessed by one thing only – the divine, wonder-working crystals?’

রাশিয়া থেকে স্কটল্যান্ড। আর কয়েক বছর পরের সময়। বুলগাকভ থেকে এ.জে.ক্রনিন। সেই ক্রনিন যাঁর ‘বিয়ন্ড দিজ প্লেস’ থেকে ছবি ‘কালিপানি’, ‘দ্য জুডাস ট্রি’, গুলজারের ছবি ‘মৌসম’ এবং ‘দ্য সিটাডেল’, ‘জীবন সৈকতে’ বা ‘তেরে মেরে সপ্নে’ তৈরি হয়। ১৯১৯ সালে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি থেকে মেডিসিনে গ্র্যাজুয়েশনের পর একটি জাহাজের সদস্যদের চিকিৎসকের দায়িত্ব পেয়ে ভারতে আসেন ক্রনিন। ১৯২৪ সালে গ্রেট ব্রিটেনের মেডিকেল ইনস্পেক্টর অফ মাইনস পদে উঠে আসা। একাধিক কয়লাখনি সার্ভে করে কয়লাখনি শ্রমিকদের ফুসফুসের অসুখের সম্পর্ক নিরূপণ সংক্রান্ত একাধিক মাইলস্টোন পাবলিকেশন। এছাড়াও চক্ষুচিকিৎসায় অত্যন্ত আসক্তি। চিকিৎসার কথা, খনির শ্রমিকদের জীবনের সরাসরি ছবি উঠে আসে ‘দ্য স্টার্স লুক ডাউন’ (১৯৩৫) এবং তার পরের যুগান্তকারী ‘সিটাডেল’ (১৯৩৭) উপন্যাসের ভেতর। ডক্টর আন্ড্রিউ ম্যানসনের জীবনের গ্রাফ – দুর্নীতি, আমলাতন্ত্র এবং ব্রিটেনের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক ছবি – ক্রনিন প্রায় নিখুঁত চিকিৎসা-সাহিত্যের ক্রনোলজি তৈরি করেছিলেন।

বিংশ শতকের শুরুর আরেক দিকপালের কথা। চিকিৎসক এবং লেখক-জীবনের যুগপৎ সাফল্য এবং নিষ্ঠা। কিভাবে সামলান দুদিক? উত্তরে হেসে মানুষটি বলেছেন – ‘They are two parts of a whole, that it is not two jobs at all, that one rests the man when the other fatigues him.’ – আবার কখনও সলিলোকি – ‘It’s no strain, in fact I find that one often informs the other.’ হ্যাঁ, চিকিৎসক-কবি উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের কথা বলছি। নিউ জার্সির রাদারফোর্ডের কিংবদন্তী অবস্টেট্রিসিয়ান এবং শিশুরোগ-বিশেষজ্ঞ। ১৯০২ সালে ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভ্যানিয়ার পেরেলম্যান স্কুল অফ মেডিসিনে ভর্তি হয়ে ১৯০৬ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন। ক্রমে নিউইয়র্কের ফ্রেঞ্চ হসপিটাল ও চাইল্ড‘স হসপিটালে ইন্টার্নশিপ শেষ হয়। শিশুচিকিৎসা সংক্রান্ত পড়াশুনোর জন্য জার্মানির লিপজিগে চলে গিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। চিকিৎসাকে প্রায় মূলমন্ত্র করে নিয়ে দীর্ঘ জীবনে তাকে সাহিত্য থেকে আলাদা করেননি উইলিয়াম। রোগীদের সঙ্গে মিশে যেতেন, গল্প শুনতেন একাধিক। ‘প্র্যাকটিস’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে লিখছেন – ‘My business, aside from the mere physical diagnosis, is to make a different sort of diagnosis concerning – patients – as individuals.’ আত্মজীবনীতে সোচ্চারে বলেছিলেন – ‘Medicine is the very thing that made it possible for me to write’। এখানেই প্রাসঙ্গিক, অনুজ বন্ধু, চিকিৎসক ডক্টর রবার্ট কোলেসের উদ্যোগে এবং সংকলনে উইলিয়ামের চিকিৎসা সংক্রান্ত একাধিক গল্প, কবিতা, স্মৃতিকথা নিয়ে তৈরি আশ্চর্য সংগ্রহ ‘ডক্টর্স সিরিজ’। ‘দ্য ইউজ অফ ফোর্স’, ‘ইনসেন’, ‘ওল্ড ডক রিভার্স’-এর মতো গল্পের সঙ্গে অসামান্য কিছু কবিতা বা ‘ল্যাট্রোভার্সালিয়া’। প্রসঙ্গত এই ‘ল্যাট্রোভার্সালিয়া’ শব্দের অর্থ চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত কবিতা, শব্দের প্রণেতা স্পেনীয় চিকিৎসক-কবি পাসকুয়াল ইনিয়েস্তা।

ডক্টর উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের স্বতন্ত্র কবিতা, সংক্ষিপ্ত অথচ মেডিকেল স্ক্যালপেলের মতো ধারাল, নিখুঁত, প্রয়োজনীয় সঞ্চালন, শব্দনিক্ষেপ, এবং স্পেসের ব্যবহার। নিজের পিতামহীর নাম আশ্চর্য সমাপতনে ছিল এমিলি ডিকেনসন ওয়েলকাম। কবিতাকে সম্বল করা এই গ্রহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক মানুষীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে পিতামহীকে এমিলি ডিকিনসন বলেই ডাকতেন উইলিয়াম। সেই বৃদ্ধার অসুস্থতা এবং শেষজীবনের ওপর অসামান্য একটি কবিতা ‘দ্য লাস্ট ওয়ার্ডস অফ মাই ইংলিশ গ্র্যান্ডমাদার’। উইলিয়াম লিখছেন –
‘We passed a long row
of elms. She looked at them
awhile out of
the ambulance window and said
What are all those
Fuzzy-looking things out there?
Trees? Well, Im tired
of them and rolled her head away.’
অথবা এক শিশুর মৃত্যুর হন্টিং টোন ‘দ্য ডেড বেবি’ কবিতার শরীরে –
‘Hurry up! any minute
they will be bringing it from the hospital –
a white model of our lives
a curiosity –
Surrounded by fresh flowers.’
এবং যে স্পেসের কথা বলছিলাম, তাকে ব্যবহার করেই উইলিয়ামের চিকিৎসক-জীবনের অসামান্য ডিটেইল, ছোট ছোট মুহূর্তের আশ্চর্য সাক্ষী ‘বিটউইন ওয়ালস’ কবিতাটি –
‘the back wings
of the
hospital where
nothing
will grow the
cinders
in which shine
the unbroken
pieces of a green
bottle.’

এই উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস এক ব্যক্তিত্বকে ট্রিবিউট দিয়েছিলেন এভাবে – ‘I turn to him all the time; stories like ‘Anyuta’ and ‘Enemies’ remind me of the danger around the corner, in this doctoring life: smugness, and one of the consequences, callousness, and then the decline into being a big shot, full of oneself (the occupathional hazards of our trade) – Chekhov knew of all that, saw it in others, and thereby saw himself in danger.’ হ্যাঁ, স্মরণে, ট্রিবিউটে আন্তন চেকভ। আড়ালে-প্রত্যক্ষে অসংখ্য গল্প। ১৮৮৪ সালে আই এম সেচেরেভ ফার্স্ট মস্কো স্টেট মেডিকেল ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশনের পর অধিকাংশ সময় বিনা অর্থেই দরিদ্র চিকিৎসায় সময় কাটত চেকভের। ১৮৮৯ সালে ভাই নিকোলাস টাইফয়েডে চলে গেলে জেলবন্দিদের ওপর সেই ভাইয়ের আইনসংক্রান্ত অসম্পূর্ণ কাজ সংক্রামিত হয় চেকভের ওপর। তবে এখানে আইনের বদলে প্রেক্ষিত চিকিৎসাবিজ্ঞান। ১৮৯০ সালে মস্কো ছেড়ে ছ’সপ্তাহব্যাপী জার্নি করে সাখালিন দ্বীপে গিয়ে তিন মাস ধরে জেলবন্দি এবং দ্বীপবাসিন্দাদের ওপর গবেষণা করে সেখানকার স্বাস্থ্য ও সামাজিক অবস্থানের ওপর লেখেন ট্রাভেলগ-প্রবন্ধ-মেডিকেল রেফারেন্স-বুক ‘দ্য আইল্যান্ড অফ সাখালিন’। সাখালিন থেকে ফিরে ১৮৯৯ পর্যন্ত মেলিখোভো এস্টেটে চিকিৎসা শুরু করেন। ঘটনাবহুল এই মেলিখোভো এস্টেটেই এক এক করে আসে ‘দ্য সিগাল’, ‘আঙ্কল ভ্যানিয়া’-র মতো মাইলস্টোন। গোটা দিন চিকিৎসার পর রাত জেগে লেখার পরিশ্রম। সমাপতনে ঠিক এইসময় ১৮৯২-৯৩-এর কুখ্যাত রাশিয়ান কলেরা মহামারীর দাপট। ভোর পাঁচটা থেকে রোগীদের লাইন – শীর্ণকায় হাত, পা, মুখ ডক্টর চেকভের দরজার বাইরে। এবং প্রায় অধিকাংশ চিকিৎসাই বিনা অর্থে। ২৬টি গ্রাম, ৭টি কারখানা এবং একটি মনাস্টেরির দায়িত্ব ছিল চেকভের ওপর – হিসেব বলছে ১৮৯১ সালের প্রথম পাঁচ মাসে চেকভ জেলা হাসপাতালে দেখেছিলেন ৪৫৩ জন রোগী এবং ৫৭৬টি হাউসকলে গেছিলেন। এবং এ-সমস্তের পরিণতি নিজেকে অবহেলা, শরীরে ঢুকে যাওয়া যক্ষ্মার বীজ। মেডিকেল ছাত্র থাকা অবস্থায় প্রথম রক্তকাশি, শেষদিকে অস্বাভাবিক অসুস্থতার ভেতরে ইয়াল্টায় অন্যান্য যক্ষ্মা রোগীদের জন্য স্যানাটোরিয়াম তৈরিতে উদ্যোগ নিলেন তিনি। ১৯০৪-এ মাত্র চুয়াল্লিশে নিভে যান এই কিংবদন্তী।

বন্ধু, সম্পাদক আলেক্সেই সুভেরিনের সঙ্গে একাধিক চিঠিতে চিকিৎসক জীবন উঠে এসেছে চেকভের। সুভেরিন বারবার বলেছিলেন চিকিৎসা ছেড়ে সরাসরি লেখায় চলে আসতে। চেকভের উত্তর ছিল – ‘I don’t see what’s so impossible about chasing two hares at once.. Medicine is my lawful wedded wife and literature my mistress. Where one gets my nerves, I spend the night with the other.’ সাহিত্য চিকিৎসাকে এবং চিকিৎসা সাহিত্যকে ধারণ করছে, এই প্রসঙ্গেই আরেক চিঠিতে সুভেরিনকে বলছেন – ‘If a man knows the theory of the Circulatory System, he is rich … We are dealing entirely in pluses.’। ‘আঙ্কল ভ্যানিয়া’, ‘দ্য ব্ল্যাক মঙ্ক’, ‘ইভানভ’, বা ‘আ ডক্টর্স ভিজিট’-এ একাধিকবার উঠে এসেছে মানসিক অসুস্থতার প্রসঙ্গ। চিকিৎসকদের নিজেদের জীবনের গ্রাফ, টানাপোড়েন এসেছে ‘দ্য গ্রাসহপার’-এর ডক্টর ডাইমভ, ‘দ্য হেড গার্ডেনার্স স্টোরি’-র ডক্টর টমসন, ‘এনিমিজ’-এর ডক্টর গিরিলভ বা ‘আ ডক্টর্স ভিজিট’-এর ডক্টর কোরোলিয়ভের ভেতর। প্রসঙ্গত এই সমস্ত গল্প নিয়েই প্রকাশিত হয় চেকভের ডাক্তারি-জীবন সংক্রান্ত গল্প-সংকলন – ‘চেকভ’স ডক্টর্স’। চেকভ চরিত্রের ভেতর দিয়ে দেখেছেন সামাজিক রাশিয়ার ছবি, টিকে থাকার গল্প। বন্ধু সুভেরিনকে ১৮৮৮ সালের ৩০ মে এক চিঠিতে লিখছেন – ‘The artist should not be a judge of his characters and what they say, but only an objective observer.’ প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে আরেক দিকপাল লেখক-চিকিৎসক ডক্টর ওয়াকার পার্সি-র কথা – ‘I think of chekhov as the deservedly reserved father of all of us who have turned to the typewriter to let others know what goes on when you’re dueling with death, hoping to win for the sake of yourself as well: Chekhov is the master of letting us all know that!’

জীবনযন্ত্রণার ছবি, মানুষের জীবনের কাছাকাছি গিয়ে শাটার ক্লিক করার ছবি সমারশেট মমের লেখাতেও। তখনও ‘হিউম্যান বন্ডেজ’ তৈরি হতে অনেক দেরি। ১৮৯৭ সালে ব্রিটেনের ল্যামবেথের সেন্ট টমাস হসপিটাল মেডিকেল স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন। টেমসের ধারে ওয়েস্টমিনিস্টারে একটি নিভৃত ঘর নিয়ে লেখালেখি, সঙ্গে চিকিৎসার জন্য ব্রিটেনের শ্রমিক শ্রেণিকে চেনা, তাদের জীবনের আখ্যানের ভেতর স্ক্যালপেল, ফরসেপ। প্রথম উপন্যাস ‘লিজা অফ ল্যামবেথ’-এ উঠে আসে অবস্টেট্রিক্স হিসেবে চিকিৎসক চরিত্রের কলমে দক্ষিণ লন্ডনের তস্য-তস্য জীবনের অন্তরঙ্গ এবং বীভৎসতার গল্প। প্রসঙ্গত এই ‘লিজা অফ ল্যামবেথ’-এর প্রকাশবছরেই মমের গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি, এবং এই বছরই চিকিৎসাকে বিদায় জানিয়ে পরবর্তী ৬৫ বছরের সাহিত্যজীবনের শুরু – মমের নিজের কথায় ‘I took to it as a duck takes to water’। এবং চিকিৎসা এমনই এক পেশা যেখান থেকে সাহিত্যের উঠোনে এলে বারবার ছাপ ফেলে স্মৃতি, অসুখ, মানুষের মুখ। স্মৃতিকথায় মম বলেছেন – ‘I was in contact with what I most wanted, life in the raw … I saw how men died. I saw how they bore pain.’

এবং শেষে এক বিরলতম জিনিয়াসের কথা। ১৮১০ সালে এডমন্টনে পারিবারিক চিকিৎসক, ঔষধনির্মাতা ডক্টর টমাস হ্যামন্ডের কাছে অ্যাপ্রেনটিসশিপ শুরু করে ১৮১৫ সালে কোর্স শেষ। অ্যাপ্রেনটিস ল অনুযায়ী আগামী অন্তত ছ’মাস কোনও হাসপাতালের সঙ্গে নিয়মিত সার্জারি বা চিকিৎসায় যুক্ত থাকলে তবেই ডাক্তারির ডিগ্রি পাওয়া যাবে। ১৮১৫-র ১ অক্টোবরে লন্ডনের কিংস কলেজের অন্তর্গত গ্রে’স হসপিটালে কঠোর, আশ্চর্য নিষ্ঠুর হাত চালানোর অধিকারী সার্জেন ডক্টর উইলিয়াম লুকাস জুনিয়রের অধীনে ড্রেসার বা আজকের কথায় জুনিয়র হাউস ডক্টরের ভূমিকা পালন। লন্ডনের ঘুপচি, জীর্ণ, অন্ধকার আটাশ নম্বর টমাস স্ট্রিটের ঘরে অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটানো। ১৮১৬ সালে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে অ্যাপোথেকারি লাইসেন্স পেয়ে চিকিৎসা পেশাকে জীবনে জড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ। আরও এক বছর গ্রে’স কলেজে কাজ করে শেষমেশ ১৮১৭ সালে চিকিৎসা ছেড়ে কবিতাকে ধারণ করা। হ্যাঁ, জন কিটসের কথা বলছি। গ্রে’স কলেজে আশ্চর্য তন্ময় হয়ে শুনতেন ডক্টর অ্যাশলে কুপারের লেকচার। মন অন্য কোথাও থাকত কি? কবিতায়? মাত্র পাঁচটা বছর হাতে পেয়েছিলেন কিটস। রক্ত, শরীর, অসুস্থতা উঠে এসেছে লেখায়, তীব্রতম আবেগে। অসম্পূর্ণ কবিতা ‘দ্য ফল অফ হাইপেরিয়ন’-এ লিখছেন – ‘A poet is a sage, / a humorist, a physician to all men.’

এইসমস্তই কয়েকটা দিক। মানুষকে প্রত্যক্ষভাবে জানার জন্য চিকিৎসার চেয়ে সফল কোনও পেশা থাকতে পারে না। এবং এই জানা, চেনা সাহিত্যের উঠোনে লাগানো টব – গাছ বাড়ে হুহু করে। চিকিৎসাজীবনকে টেনে নিয়ে গেছেন অনেকেই আজীবন, যাঁরা ছেড়ে দিয়েছেন, ভেতর থেকে, লেখার বিষয়ে ফেলে আসতে পারেননি চেম্বার, রক্ত, হাসপাতাল বেড, রোগীর মুখ – সব মিলিয়ে এক বড়সড় আয়না চিকিৎসা। এবং অবিশ্বাস্য প্রাসঙ্গিক আত্মজীবনী থেকে উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের সেই কথাগুলো –
‘There’s nothing like a difficult patient to show us ourselves. I would learn so much on my rounds, or making home visits. At times I felt like a thief because I heard words, lines, saw people and places — and used it all in my writing. I guess I’ve told people that, and no one’s surprised! There was something deeper going on, though, — the force of all those encounters. I was put off guard again and again, and the result was — well, a descent into myself.’
তথ্যসূত্র:
১ https://wordsworth.org.uk/blog/2023/06/21/i-shall-try-what-i-can-do-in-the-apothecary-line-john-keatss-apothecary-years/
২ https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4953434/#ref1
৩ https://levineartstudio.com/jeff-levine-visits-dr-chekhov-in-moscow/
৪ https://wecanreaditforyouwholesale.com/1900-1945/a-country-doctors-notebook-mikhail-bulgakov/
৫ https://sunittaraman.medium.com/a-j-cronin-a-doctor-who-became-a-prolific-writer-ab07f87e4cd0
৬ https://www.cidjournal.com/article/S0738-081X(17)30044-5/fulltext
৭ https://www.theintima.org/re-embodying-medicine-william-carlos-williams-and-the-ethics-of-attention
৮ https://liverpooluniversitypress.blog/2020/02/03/a-day-in-the-life-of-john-keats-medical-student-and-assistant-surgeon/
অনির্বাণ ভট্টাচার্য পেশায় প্রসারভারতীর অধীনে দিল্লি দূরদর্শন কেন্দ্রের প্রোগ্রাম একজিকিউটিভ। লিখেছেন গদ্য, কবিতা, প্রবন্ধ। বিশেষ আগ্রহ - চলচ্চিত্র, প্রাচীন স্থাপত্য, মন্দির-শিল্প এবং ক্রীড়াজগত।