নয় – চার – দের – এক – আধ না ষোলো – বার – চার -তিন!
না, এগুলি কোনও গুপ্তধনের গুপ্ত সংখ্যা কিম্বা জ্যোতিষের আকিবুকি নয়, এগুলো উড়ন তুবড়ি আর বসন তুবড়ির গোপন ফর্মুলা। পাড়ায় যেন পাঁচ কান না হয়! এই মিশ্রণের মাপেই লুকিয়ে আছে তুবড়ি কত উঁচুতে উঠবে তার রহস্য। (Firework)
এই মিশ্রণের মাপেই লুকিয়ে আছে তুবড়ি কত উঁচুতে উঠবে তার রহস্য।
“কে আমারে বলতে পারে রঙ মশালের মশলা কী” – সনৎ সিংহের এই বিখ্যাত গানকে একটু ঘুরিয়ে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় “কে আমারে বলতে পারে তুবড়ির মশলা কী?”
কেউ বলবে না। এটা তার পারিবারিক সিক্রেট।
আমাদের বাড়িতে কালী পুজোর সাত দিন আগে থেকেই সাজ সাজ রব পড়ে যেত – বাজার থেকে সোরা, গন্ধক, কাঠকয়লা, লোহাচুর ইত্যাদি আনা হত। সেগুলো রোদে শুকিয়ে শীল-নোড়ায় গুঁড়ো করে নিক্তিতে মেপে তৈরী হত মশলা।

আমাদের বয়স যখন বারো তেরো তখন পাড়ার মধ্যে দুটো ব্যাপারে খুব রেষারেষি ছিল – এক বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ির মাঞ্জা আর কালীপুজোয় তুবড়ি বানানো। মাঞ্জার মাল, মশলা আর তুবড়ির মশলার আলোচনা পাড়ার মোড়ে কখনই হত না। পাছে ফর্মুলা বেরিয়ে পরে।
আরও পড়ুন: হারিয়ে-যাওয়া গির্জা, ভাঙা স্কুলবাড়ি তথা আগরপাড়ার মিশন-কাহিনি
আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখতাম কাকারা বড় দাদাদের সঙ্গে তুবড়ি বানাতেন। আমাদের কাজ ছিল মশলা বাটা আর রোদে দেওয়া। বুড়ো আঙুলে কাপড়ের টুকরো বেঁধে চলত মশলা ঠাসা। তুবড়ির খোল আবার অনেক রকম – উড়নের জন্য ছোট, বসনের জন্য এক ছটাকি আর আধ ছটাকি। এটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যত ভাল ঠাসা হবে তত ফুলকি উপরে উঠবে – আর ঝাড় হয়ে পড়বে। এই নিয়ে পাড়ায় কম্পিটিশন হত – কার বাড়ির তুবড়ি তিনতলা অব্দি উঠল আর কতক্ষণ ধরে জ্বলল-এই জন্যই এত গোপনীয়তা।

একটু বড় হতেই আমরা বড়দের বললাম এবার মশলার ফর্মুলাটা আমাদের দাও – আমরাও শিখে নিই। ছোটকাকা মাথায় গাট্টা মেরে বললেন অ্যালজেব্রার ফর্মুলা মনে রাখতে পারিস না এসেছে তুবড়ির ফর্মুলা জানতে – যা ভাগ!
যাই হোক, অনেক কষ্টে জোগাড় করলাম মশলার মিশ্রণ – ১৬-১২-৪-৩, কিন্তু কোনটা কত? শুধু জানি সোরা, গন্ধক, কাঠ কয়লার গুঁড়ো, লোহা চুর লাগে। দাদারা কেউ বলবে না- আবার ছোটকাকার কাছে আবদার। তাহলে বৌদির কাছ থেকে পাঁচটা টাকা নিয়ে আয়। দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে অনেক কাকুতি মিনতি করে ছোটকাকাকে ঘুষ দিয়ে মাপ পাওয়া গেল। মাপ বলছে না, যেন গুরু শিষ্যকে মন্ত্র দিচ্ছে- পাড়ার কারুকে বলবি না, কোথাও লিখে রাখবি না- শুধু মনের মধ্যে রাখবি।
আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখতাম কাকারা বড় দাদাদের সঙ্গে তুবড়ি বানাতেন। আমাদের কাজ ছিল মশলা বাটা আর রোদে দেওয়া।
কাকাকে দেওয়া প্রতিজ্ঞা আমি আজও রেখেছি, কারুকে বলিনি কারণ মাপটা আমি ভুলে গেছি।
এই ছিল আমাদের সময় তুবড়ি বানানো। সেই মাপ মতো মশলা নিক্তিতে মেপে, মিশিয়ে, রোদে শুকিয়ে মাটির খোলে ভরা হল। তাতে মশলা ভরে মাটি ঠেসে আমাদের তুবড়ি রেডি। এবার আগুন দিলেই হয়।
তুবড়ি নিয়ে চুপি চুপি ছাদে গিয়ে কার্নিশ-এর উপর রেখে আগুন দেওয়া হল। আমাদের প্রথম প্রয়াস- খুবই উত্তেজিত। তুবড়ি সুন্দর জ্বলে উঠে প্রচুর ফুলকি ছড়িয়ে শেষ দিকে ফটাস করে ফেটে গেল।
সেই মাপ মতো মশলা নিক্তিতে মেপে, মিশিয়ে, রোদে শুকিয়ে মাটির খোলে ভরা হল। তাতে মশলা ভরে মাটি ঠেসে আমাদের তুবড়ি রেডি। এবার আগুন দিলেই হয়।
পাশের বাড়িতে থাকত এক মাদ্রাসী পরিবার। ফাটা তুবড়ির টুকরো গিয়ে পড়ল তাদের শুকোতে দেওয়া জামা কাপড়ের উপর। ওরা ভালই বাংলা জানত, কিন্তু রাগের চোটে এমন তামিল ভাষায় চিৎকার জুড়ে দিল, আমরা এক বর্ণ না বুঝলেও ভয়ে দৌড়ে নিচে পালালাম।
পরে জ্যাঠামশাইয়ের কাছে অল্প বকা খেয়ে আর কোনওদিন ছাদে বাজি পোড়াব না প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পেলাম।
জানি না, জ্যাঠামশাই হয়তো তাঁর ছেলেবেলার কোনও দুষ্টুমির কথা মনে করে আমাদের অল্প বকে মাপ করে দিলেন।
জন্ম: ২রা অক্টোবর, ১৯৫৬
আশুতোষ কলেজ থেকে স্নাতক। ভবন্স ম্যানেজমেন্ট কলেজ থেকে বিজ্ঞাপন ও বিপননে ডিপ্লোমা।
প্রথম জীবনে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করে পরবর্তী কালে নিজের ব্যাবসায় প্রতিষ্টিত।
শখ: বই পড়া,গাছের পরিচর্যা ও এন্টিক কালেকশান।
স্ত্রী : নিতাশা ও কন্যা : মেঘনা