(Egg Shell Art) ছোটবেলায় স্কুলের ওয়ার্ক এডুকেশন ক্লাসে এমন কেউ নেই যে ডিমের খোলা দিয়ে পুতুল বানায়নি।
হাতের কাছেই পাওয়া যায় বলে ডিমের খোলা দিয়ে বহু শতক ধরে শিল্পীরা অনেক সুচারু শিল্পের জন্ম দিয়েছেন।
ডিমের খোলার শিল্পের ইতিহাস প্রাচীন মিশর থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং যুগের সাথে সাথে ছড়িয়ে গেছে দেশে বিদেশে। প্রায় ২৫০০ বছর আগে প্রাচীন মিশরে, মানুষ ডিমকে জীবন এবং উর্বরতার প্রতীক হিসাবে দেখত, তাই তারা ডিমের খোলা সুন্দর করে সাজিয়ে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহার করত। (Egg Shell Art)

তারপর মধ্যযুগে ইউরোপে, গির্জা এবং অন্যান্য ধর্মীয় ভবনের অভ্যন্তরে ডিমের খোলার এই শিল্প খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ঘরে ডিম খাওয়া হয় আর সেই ডিমের খোলা পাওয়া যায় সহজেই তাই সহজেই লোকশিল্প হয়ে উঠল এই ডিমের খোলার শিল্প। সুন্দর সব নকশা অনেকটা ঠিক আমাদের বাংলার পটচিত্র, বা আলপনার মতো দৃশ্যনন্দন হয়ে উঠল আর ঘরে ঘরে সমাদৃত হতে শুরু করল। (Egg Shell Art)

আঠেরো এবং উনিশ শতকে, ডিমের খোলা শিল্প ইউরোপ এবং আমেরিকায় জনপ্রিয় লোকশিল্প হয়ে ওঠে। ঘরে ঘরে ডিমগুলোকে নানান রকম সুন্দর আঁকা ও খোদাই করে সাজাতে শুরু করা হয়।
তারপর বিশ শতকেই, পেশাদারী শিল্পীরাও ডিমের খোলাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে নানান ভাবে পরখ করতে শুরু করেন। আর তাতেই এক সম্পূর্ণ সৃজনশীল শাখার সৃষ্টি হয়। (Egg Shell Art)

আজকের দিনে এগ শেল আর্ট (Egg Shell Art) বা ডিমের খোলার কাজের প্রচলন বিশ্বের অনেক জায়গাতে রয়েছে বটে, কিন্তু তুলনামূলকভাবে ভারতে এই কাজের প্রচলন প্রায় নেই বললেই চলে। ডিমশিল্পে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ডিম হলো উটপাখির ডিম। যার প্রধান কারণ, এটি আকারে বড় এবং তুলনামূলকভাবে অনান্য ডিমের চেয় কম ভঙ্গুর। তাই এই ডিমের খোলাতে শিল্পকর্ম করা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সহজ। সেই কারণেই বোধহয় ডিমের খোলার উপর কারুকাজের শুরুটা অস্ট্রিচের ডিমেই হয়েছিল। খোদাই করা অস্ট্রিচের ডিম প্রায় ৬০,০০০ বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকাতে পাওয়া গেছে। (Egg Shell Art)




পরবর্তী কালে ডিমশিল্প শুধুমাত্র অস্ট্রিচের ডিমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিভিন্ন রকমের ডিম যেমন এমু, হাঁস, রাজহাঁস, টার্কি, মুরগি প্রভৃতির মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। যেহেতু এইসব ডিম আকারে ছোট এবং অতিরিক্ত ভঙ্গুর, তাই এতে কারুকাজ করা তুলনামূলকভাবে একটু কঠিন। সেই কারণেই হয়তো এই কাজের বিশ্বব্যাপী প্রচলন তেমনভাবে হয়নি। আমাদের দেশে উটপাখির ডিম সহজলভ্য নয়, আর ছোট আকারের ডিম বিশেষত হাঁস, মুরগির ডিম খুবই ভঙ্গুর। তাই হয়তো ভারতে এই শিল্পকর্মের প্রচলন তেমনভাবে হয়নি। (Egg Shell Art)
আরও পড়ুন: পুতুল খেলার সেকাল একাল
ভাবতে অবাক লাগে আমাদের এই বাংলা, যা শিল্পকর্মের এক পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত সেখানেও ডিমশিল্পের প্রচলন প্রায় নেই বললেই চলে। হাঁস মুরগির মতো ছোট ডিমের খোলায় কারুকাজ করা একটু কঠিন ঠিকই, তাই বলে অসাধ্যও নয়, বিশেষ করে আমাদের মতো আর্ট এন্ড কালচার প্রিয় মানুষজনদের পক্ষে। আমরা যদি ডিমশিল্পের এই রূপটিকে জনপ্রিয় করতে পারি তাহলে এটি হয়তো একটি স্মল স্কেল ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে পরিগণিত হতে পারে, বিশেষ করে গ্রামে গঞ্জে এবং শহরতলিতে। (Egg Shell Art)

এবার ডিম-শিল্পের নানান ধরণের কাজের কথায় একটু আসা যাক।, ডিমের খোসা/ খোলা শিল্পের (Egg Shell Art) কিছু উল্লেখযোগ্য কৌশল/ শৈলী রয়েছে যেমন,
১. পেইন্টিং: ডিমের খোলার উপর হ্যান্ড-পেইন্টিং ডিজাইন এবং প্যাটার্ন বানানো, যা মূলতঃ নানা ধরণের রং এবং তুলির মাধ্যমেই করা হয়।

২. খোদাই (এনগ্রেভিং): ডিমের খোলার উপর নকশা খোদাই করা হয়, বিশেষ ধরণের খোদাইয়ের সরঞ্জাম ব্যবহার করে ডিমের খোলার উপরের লেয়ার তুলে ফেলে ডিজাইন বানানো হয়, এই ধরণের কাজ অস্ট্রিচের ডিমেই বেশি করা হয়, কারণ অস্ট্রিচের ডিমের খোলা পুরু হয়।

আমি ছোট মুরগির লাল ডিমের খোলার উপর এই কাজ করার চেষ্টা করেছি, লাল রঙের খোসা থেকে পাতলা লেয়ার তুলে ফেললে এইরকম সাদা অংশ বের হয় যা দিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে, কোনও রকম রঙের ব্যবহার করা হয়নি। এই কাজ বেশ কঠিন। উপরের পাতলা লেয়ারটি এমনভাবে তুলতে হবে যাতে ডিমের খোলাটিতে গর্ত না হয়ে যায় বা ফেটে না যায়।

ছবি গুলিতে ক্লিক করে ফুল স্ক্রিনে দেখুন
৩. ড্রিলিং এন্ড কাটিং: ডিমের খোলার মধ্যে ফুটোর কাজ অর্থাৎ ড্রিলিং এবং কাটিং করে নানা ধরণের ভাস্কর্য ফুটিয়ে তোলা, এর জন্য বিশেষ ধরণের ড্রিলিং এবং কাটিং মেশিন ব্যবহার করা হয়।
৪. মোজাইক: ডিমের খোলা/খোসার ছোট ছোট টুকরো ক্যানভাসের মধ্যে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দ্বিমাত্রিক ছবি তৈরি করা হয়।

এ ছাড়াও আছে একটি বিশেষ পদ্ধতি যা ঐতিহ্যগত ইউক্রেনীয় আর্ট বা “পাইস্যাঙ্কি” (Pysanky) হিসেবেই খ্যাত, যেখানে মোম এবং রঞ্জক ব্যবহার করে ডিমের খোলার উপর সুক্ষ্ম কারুকার্য করা হয়। “পাইস্যাঙ্কি” শব্দটি এসেছে ইউক্রেনীয় শব্দ “পাইস্যাটি” থেকে, যার অর্থ “লিখতে”।

এই প্রক্রিয়াটি অনেকটা আমাদের বাটিক প্রক্রিয়ার মতো। প্রথমে ডিমগুলিকে মোমের প্রলেপ দিয়ে ঢেকে তার উপর বিভিন্ন ধরণের নকশা/ কারুকার্য করে সেইসব জায়গার মোমের প্রলেপ আংশিক ভাবে তুলে ফেলা হয়। পরে তা নানান রকমের কৃত্রিম রঞ্জকে ডুবিয়ে রং করা হয়। পরবর্তী কাজ হিসেবে মোমের সমস্ত প্রলেপ সামগ্রিকভাবে অপসারণ করা হয়, যার ফলস্বরূপ রঙিন নকশার কাজ ডিমের খোলার উপর ফুটে ওঠে।

খোদাই অর্থাৎ এনগ্রেভিং-এর কাজ প্রধানত বড় ডিম অর্থাৎ অস্ট্রিচের ডিমেই করা হয়, করণ অস্ট্রিচের ডিমের খোলা একটু মোটা হয়। পেন্টিং এর কাজ যে কোনও ডিমের খোলাতেই করা যায়। তুলনামূলকভাবে এই কাজ একটু সহজ। তবে নানান ধরণের সূক্ষ্ম পেন্টিং এর কাজ বিশেষ করে “পাইস্যাঙ্কি” (Pysanky) এর কাজ যথেষ্ট কঠিন এবং প্রশংসার দাবি রাখে।

ড্রিলিং এন্ড কাটিং অর্থাৎ ফুটোর কাজ ,বড় ডিম অর্থাৎ অস্ট্রিচে করা সহজ হলেও হাঁস, মুরগির ডিমে করা বেশ কষ্টকর। কারণ এদের খোলা খুবই পাতলা এবং ভঙ্গুর হয়। মোজাইকের কাজে কিন্তু পাতলা ডিমের খোলা অর্থাৎ হাঁস মুরগির ভাঙা টুকরো ব্যবহার করেই করা হয়, এই কাজটি খুব কঠিন হয়তো নয়, তবে বেশ সময়সাপেক্ষ এবং দৃষ্টিনন্দন।
পরের পর্ব: ২১শে নভেম্বর, ২০২৪
ছবি সৌজন্য: লেখক, Pinterest, Pinterest
ভূপদার্থবিদ, ২০১৩ সালে রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানী (ওএনজিসি) থেকে জেনারেল ম্যানেজার পদে অবসর গ্রহণ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই আর্ট ও ক্রাফটের প্রতি অনুরক্ত। কাঠ, কাচ, মাটি এবং ডিমের খোলা দিয়ে নানান রকমের জিনিস বানাতে ভালবাসেন। বিগত প্রায় ১০/১১ বছর "এগ শেল আর্ট" নিয়ে কাজ করছেন, বাংলা তথা ভারতে যার চল নেই বললেই চলে। কলকাতার অ্যাকাডেমিতে কয়েকবার এক্সিবিশনও হয়েছে। ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় দুবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। লেখালেখিও করেন, মূলত রম্যরচনা। দেশ প্রত্রিকা এবং সংবাদ প্রতিদিনের পূজাসংখ্যায় তাঁর রচিত রম্যরচনা প্রকাশিত। রম্যরচনা সংকলনের দুটি বইও আছে।