কীর্ণাহারের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে রাষ্ট্রপতিভবন, এক দীর্ঘ যাত্রা কিন্তু পা তাঁর মাটিতেই ছিল। চিরকালীন কংগ্রেসম্যান প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কথা আলোচনা করব না আজ। বলব এক বইপ্রেমী, ভদ্র এবং বিচক্ষণ রাষ্ট্রপ্রধানের কথা, অবশ্যই তাঁকে কাছ থেকে যতটা দেখেছি ততটাই বলব। আমার মায়ের পিসি আকাশবানীর সংবাদপাঠিকা নীলিমা সান্যালের বাড়িতে দৈনন্দিন যাতায়াত ছিল প্রণবজায়া শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের। (Pranab Mukherjee)

নীলিমা সান্যাল তাঁকে ভীষণ স্নেহ করতেন। প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন দেশের অর্থমন্ত্রী। অদ্ভুত লাগত একটা ব্যাপার দেখে, সেটা হল দিল্লির ক্যানিং রোডের পতৌদি হাউজের নীলিমা সান্যালের বাড়িতে তিনি যখনই আসতেন, তখন বেশিরভাগ সময়ই অটো করে আসতেন। ফেরার সময় হলে আমায় ডাকনাম ধরে বলতেন একটা অটো ডেকে দিতে। তখন আমি বেশ ছোট। (Pranab Mukherjee)

প্রণব মুখোপাধ্যায়ও দু’একবার এসেছেন। সেই সময় প্রথম ওঁকে দেখি। সবাই জানেন যে উনি শ্রীমতি গান্ধীর বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন। শুভ্রামাসির কাছে খুব আগ্রহ নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর গল্প শুনতাম। এরপর অনেকগুলো বছর কেটে গেল। শুধু মাঝে একবার কলকাতার একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে শুভ্রা মাসির আঁকা ছবির প্রদর্শনীতে গিয়েছিলাম। সেই সব দিনগুলোতে কিন্তু প্রণব মুখোপাধ্যায়কে দেখলেও আলাপ বা পরিচয় হয়নি। আমার তখন সেই বয়সও ছিল না। এরপর আরও অনেকগুলো বছর কেটে গেল, প্রণব মুখোপাধ্যায় আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন। (Pranab Mukherjee)

অভিনন্দন জানাতে শুভ্রামাসিকে ফোন করলাম। বললেন ওদের বর্তমান বাসস্থান ছেড়ে অল্প কিছুদিনের ভেতরই ওঁরা রাষ্ট্রপতিভবনে চলে যাবেন। ওখানে যাওয়ার পরে যেন অবশ্যই যোগাযোগ করি কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি কারণ রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর হরেকরকম প্রোটোকল। আমি আমার আগের লেখায় উল্লেখ করেছি যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ৮০ তম জন্মদিন উপলক্ষে প্রণবদাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম কিন্তু সেই সময় উনি একদিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে দিল্লির সেনা হাসপাতালে ভর্তি হন এবং হার্টে স্টেন বসে। সেই কারণেই শেষ পর্যন্ত আসতে পারেননি, অনুষ্ঠানের জন্য শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন। এরপর থেকে নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হল। ইতিমধ্যে প্রণবদা রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসর নেন। (Pranab Mukherjee)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: চরিত্রের সন্ধানে…
বছরে এক বা দু’বার করে কলকাতায় এলেই ফোন করতাম। বলতেন সন্ধের পরে ওঁর দক্ষিণ কলকাতার সাউথ এন্ড পার্কের বাড়িতে যেতে। গিয়ে দেখতাম প্রচুর মানুষ ওঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। মনে হত মিনিট দুয়েক কথা বলেই চলে আসব কিন্তু প্রণবদার ঘরে ঢুকলে অনেকক্ষণ কথা হত। দেখতাম হাতে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই, সাহিত্য নিয়ে কথা হত। (Pranab Mukherjee)

একবার সজনীকান্ত দাসের নাতনি এবং অবধূতের নাতিকে নিয়ে গেলাম প্রণবদার সঙ্গে দেখা করতে। ওঁরা অনেক বই দিলেন। সেদিন শুধু বাংলা সাহিত্য নিয়েই কথা হল। কোনও কোনও সময় আমার লজ্জা করত, ভাবতাম ঘরের বাইরে কত মানুষ অপেক্ষা করেছেন দাদার সঙ্গে দেখা করার জন্য অথচ আমরা ভেতরে বসে ওঁর অনেকটা সময় নিয়ে নিচ্ছি কিন্তু ওঁর অনুমতি না নিয়ে তো বেরোতে পারতাম না। (Pranab Mukherjee)

আগেই বলেছি যে রাজনৈতিক বা প্রশাসণের উচ্চপদে থেকেও তাঁর পা কিন্তু মাটিতেই থাকত। একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি যে কী সহজভাবে মিশতেন, না দেখলে বিশ্বাস করাই কঠিন। একদিন ফোন করে বললাম বিশিষ্ট শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী গিরিজা দেবীর সাক্ষাৎকার এবং গানের একটা সিডি ওঁর হাতে তুলে দিতে চাই। বললেন পরেরবার কলকাতায় যখন আসবেন, তখন করবেন। সালটা ঠিক মনে নেই কিন্ত মাসটা ছিল নভেম্বরের শেষ দিকে। গেলাম আমার কন্যা এবং এক বন্ধুকে নিয়ে। (Pranab Mukherjee)

গিরিজা দেবীর সিডি এবং আমার দাদু কবি-গীতিকার অমিয় বাগচীর লেখা ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া আর একটা গানের সিডি ওঁর হাতে তুলে দিই। বললেন তার আগের বছরই উনি বিদুষী গিরিজা দেবীর হাতে পদ্মবিভূষণ সম্মান তুলে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে। সেইদিন মায়ের পিসি নীলিমা সান্যালকে নিয়েও অনেক স্মৃতিচারণ করলেন। আমার কন্যার ইচ্ছে হয়েছিল ওঁর সঙ্গে একটা ছবি তোলবার, সেই কথা দাদাকে জানাতেই ওকে পাশে বসতে বললেন এবং আমাকে ডেকে নিলেন। বসবার জায়গা করে দিতে ওঁর পাশে থাকা অফিসিয়াল ফাইলগুলো নিজের হাতে সরিয়ে রাখলেন। (Pranab Mukherjee)
আরও পড়ুন: শতবর্ষের আলোকে সুচিত্রা মিত্র
ছোট ছোট ঘটনা কিন্তু মন ছুঁয়ে যায়। কলকাতার একটি দৈনিক সংবাদপত্রের সিনিয়র সাব- এডিটর হিসেবে সেই সময় আমি কর্মরত ছিলাম, একদিন মনের একটি অভিপ্রায় দাদাকে জানালাম। বললাম ওঁর একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই কিন্তু কোনও রাজনৈতিক বিষয়ে নয়। প্রশ্ন করব ওঁর বই পড়ার এবং বইয়ের প্রতি আগ্রহ সম্পর্কে। এক কথায় রাজি হলেন। ওই বিশেষ দিনটিতে প্রাবন্ধিক, লেখক এবং সাংবাদিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য আর ওঁর সহধর্মিনী দূরদর্শনের সংবাদপাঠিকা ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য ছিলেন আমার সঙ্গে। (Pranab Mukherjee)
প্রণবদার কাছ থেকে সেদিন শুনলাম রাষ্ট্রপতি ভবনের গ্রন্থগারে লর্ড কার্জন, লর্ড ওয়েলেসলির বিভিন্ন নথি কীভাবে রাখা আছে।
আমি এবং শঙ্করদা ওঁকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছিলাম। প্রণবদার কাছ থেকে সেদিন শুনলাম রাষ্ট্রপতি ভবনের গ্রন্থগারে লর্ড কার্জন, লর্ড ওয়েলেসলির বিভিন্ন নথি কীভাবে রাখা আছে। বললেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সর্বোপল্লি রাধাকৃষ্ণানের মৃত্যুর পরে ওঁর পুত্র গোপাল দিল্লি এসে তাঁর বাবার সংগৃহীত বইগুলো নিয়ে যান, শুনেছিলাম আর এক প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালাম কী ধরণের বই বেশি পড়তেন। সেদিন প্রণবদার কাছে শুনেছিলাম শ্রীমতি গান্ধী যখন বিদেশ সফরে যেতেন, তখন নানানরকম বই নিয়ে এসে প্রণবদাকে উপহার দিতেন। (Pranab Mukherjee)

শুনিয়েছিলেন নিজের ডায়রি লেখার কথা। বললেন, ‘জানো, একবার দিল্লিতে জুলাই মাসে প্রচন্ড বৃষ্টি হয়, তার ফলে জল জমে গিয়ে গ্রেটর কৈলাশের বাড়ির নিচতলায় থাকা অনেকগুলো ডাইরি নষ্ট হয়ে যায়।’ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাও ওঁকে বলেছিলেন, ‘তোমার স্মৃতিশক্তি খুব ভাল, তুমি পুরনো কথা মনে করে করে আবার লেখো।’ সেইভাবে অনেক অতীত স্মৃতি উদ্ধার হয়েছিল। কলকাতায় এলে যখনই দেখা করতে যেতাম, আলোচনা করতেন আগেরবার যেসব বই দিয়ে আসতাম, সেগুলো নিয়ে। (Pranab Mukherjee)
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাও ওঁকে বলেছিলেন, ‘তোমার স্মৃতিশক্তি খুব ভাল, তুমি পুরনো কথা মনে করে করে আবার লেখো।
সারাজীবন মনে রাখার মতো এক একটা সন্ধ্যা কাটত। শেষবার যখন দেখা হয়, তখন অনুরোধ করছিলাম আমার সম্পাদনায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিষয়ে একটা বইয়ের যদি অনুষ্ঠানিক প্রকাশ প্রণবদা করেন। শুনে বললেন, ‘তুমি আমার সচিবের কাছে চিঠিটা রেখে যাও, পুজোর সময় যখন আসব তখন অনুষ্ঠানটা হতে পারে কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে ২০২০ সালের দুর্গাপুজো দাদা দেখতে পেলেন না। ভারতকে রত্নহীন করে ওই বছরের ৩১ অগাস্ট দিল্লির সেনা হাসপাতালে প্রণবদার জীবনাবসান হয়। আরও অনেক স্মৃতির কথা রয়ে গেল মনে। সব লিখলে আমার লেখাও শেষ হবে না এবং পাঠকরাও বিরক্ত হতে পারেন। (Pranab Mukherjee)
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।