শীতকাল চলে এল, সুপর্ণা! রঙিন বেলুন উড়ছে। হরেক খেলনা। কত রকমের শীতের খাবার। বুড়ির চুল। ঘটিগরম। শিশুদের নিয়ে বাবা-মা ঢুকে পড়ছে গির্জায়। প্রেমিক প্রেমিকারাও হাত ধরে। ঢং বাজল। পাখিরা উড়ে গেল। আকাশে ধোঁয়ার চাদর। সাদা কুয়াশা। দ্বিতীয় হুগলি সেতুতে আলো জ্বলল। ময়দানে ভিড়। গঙ্গার ধারে গা ঘেঁষে বসল যুগল। ডালহৌসি পাড়ায় অফিস ছুটি। এবার প্রার্থনা শুরু হবে। শহরময় আলো। মদের দোকানে ভিড়। মাংসের রাং কিনছে অফিস-ফেরত বাবু। কারনানি ম্যানশনের তিনতলার পুরনো সাহেব বারান্দায় মায়াবি হলুদ আলো স্ট্রিটল্যাম্পের। অদ্ভুত আভা। (Winter)
আরও পড়ুন: সুমন মুখোপাধ্যায়ের সাথে ‘আমার থিয়েটারের ভাষা’
আসলে, শীতকাল যতই সাহেবি হোক, মধ্যবিত্ত তার নিজের মতো করে একটা শীতকাল বানিয়ে নিয়েছে। সেখানে পার্ক স্ট্রিটে গিয়ে হাফ পেগ বিয়ারে চুমুক দেওয়া যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে বড়দিনে দীপুদা বা দীঘা-পুরী-দার্জিলিং। তার সাথে রয়েছে বিয়েবাড়ি, জন্মদিনের হুল্লোড়। বা, পাড়ার মাঠে সান্ধ্য কার্নিভ্যাল বা ফুটবল ম্যাচ ও বইমেলা। সম্বচ্ছরের একবার হুডি, লেপ, তোষক, সোয়েটারের সাথে দেখা হওয়া। বাঙালির শীতকাল বলতে এটুকুমাত্র। বাঙালির শীতকালের সাথে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে বোরোলিনের নাম। এ ছাড়া অঞ্জন দত্ত আর পার্ক স্ট্রিটকে এক করে একটা নতুন সমীকরণ গড়ে শীতকাল। যেহেতু অঞ্জনের বেশিরভাগ গানেই নানাভাবে জড়িয়ে শীত, তা পার্ক স্ট্রিট অনুষঙ্গেই হোক বা দার্জিলিং। পুরোনো রক্ষণশীল বাঙালি বা এংলো সাহেবদের নিত্য লড়াই করে এ শহরে টিকে থাকার গল্পই গানে সিনেমায় বলেছেন অঞ্জন। যেমন, এই শীতের অনুষঙ্গেই অনিবার্য সংযোজন, রঞ্জনের লেখা বই ‘শীতে উপেক্ষিতা’।
বাঙালির শীতকালের সাথে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে বোরোলিনের নাম। এ ছাড়া অঞ্জন দত্ত আর পার্ক স্ট্রিটকে এক করে একটা নতুন সমীকরণ গড়ে শীতকাল।
এ ছাড়া শীত ও পার্কস্ট্রিট বললেই মনে পড়ে, চন্দ্রবিন্দুর গান, ‘অফিস টাইম’ বা ‘বন্ধু তোমায় এ গান শোনাবো বিকেলবেলা’। দু’টি গানেই শীত শেষের বিকেলের এক অসহায় প্রেমিকের কথা রয়েছে। রয়েছে, এ হেন আরও নানা অনুষঙ্গ বাঙালির শীতকালের। পার্ক স্ট্রিট আর শীতকাল। এ বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিক গবেষণা করতে গিয়ে দেখছিলাম, নানা প্রজন্মের শিল্পীদের বোহেমিয়ান হওয়ার আবহমান আঁতুড়ঘর মধ্য কলকাতার এই সাহেবপাড়া। প্রখ্যাত চিত্রকর থেকে কবি বা পরিচালক, সকলেই কোনও-না-কোনও সময়ে একটু ‘বেসামাল’ হয়েছেন এ রাস্তায়। অর্থাৎ, পা টলেছে। ইতিহাস ও জীবনের মোড়বদলে এ রাস্তার তাই আশ্চর্য ভূমিকা। অথচ নব্বইতে জন্মানো আমাদের এ পাড়ার গল্পগুলো আজও ধরা হয়নি! এদিকে, শীতের ফি-বিকেলে আমার-আমাদের অচেতন হাঁটা বেড়ে যায় আজও পার্ক স্ট্রিটের অলিগলিতে… মল্লিক বাজারে অটো থেকে নামতেই দেখি আলোয় আলো। মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসে। ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগে। জ্যাকেটটা গলাই। কবরখানার অন্ধকারে গা-ছমছম। হাওয়ায় তন্দুর আর কেকের গন্ধ। ভিখিরি-মা শীতার্ত সন্তানকে কাগজে মুড়ে নেন যত্নে। ধর্মতলায় গিজগিজ করে সোনালি চুল…

শীতের সাথে আজ প্রায় প্রবাদ হয়ে যাওয়া লাইন ভাস্কর চক্রবর্তীর ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’। তাঁর স্ত্রী বাসবী চক্রবর্তী জানাচ্ছেন,
‘-এ বই পড়েছিলাম এমএ পড়ার সময়। কবিকে চিনতাম না, তাঁর সাথে সংসার করব তাও জানতাম না। কবিতা পড়তাম পত্রিকায়৷ আমার এক বন্ধু আমায় পড়ান এ বই। আমার মনে হয়েছিল, এক যুবক এমনও ভাবতে পারেন? কিছু কিছু লাইন হন্ট করেছিল। তাই পরে বন্ধুর কাছ থেকে বইটা চাই। ৭৯ সালের কথা বলছি। তখন রানাঘাটে থাকতাম। জয় (গোস্বামী)র বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল। একদিন এ কবিতা ভালোলাগার কথা জানানোয়, জয় বলল, ‘আপনি ওঁর কবিতা পড়েননি!’ সে সময়ের রানাঘাটে শীতকালের চেহারাটা আর পাঁচটা মফস্বল শহরের মতোই ছিল। সন্ধ্যা হলেই দ্রুত জানলা-দরজা বন্ধ করে দিত সবাই, কুয়াশায় ভরে যেত রাস্তাঘাট…
আরও পড়ুন: হরিদ্বার-হৃষিকেশ-মুসৌরিতে দেড় হপ্তা
আর আমার ভেতর এই লাইনগুলো ঘুরত। দূর থেকে ছাতিমের গন্ধ, বাগান, গাছের ফাঁকে আলোছায়া আর এইসব লাইন মিলে একটা অপার্থিব অনুভূতি হত। শীতের এই আবহেই কলকাতায় এসে বইটা কিনলাম… কবির সাথে আলাপ হল ৮৩ সালে। এবং আমাদের বিয়েও শীতকালেই… যদিও খুবই শীতকাতুরে ছিলেন ভাস্কর(হাসি)। আমার চেয়ে অনেকটা লম্বাও ছিলেন। নিজের মনে ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যেতেন সামনে। হাঁটতে হাঁটতে হয়তো অনেক পরে মনে হত আমি পিছনে, তখন থেমে পিছন ফিরে দাঁড়াতেন।
দূর থেকে ছাতিমের গন্ধ, বাগান, গাছের ফাঁকে আলোছায়া আর এইসব লাইন মিলে একটা অপার্থিব অনুভূতি হত। শীতের এই আবহেই কলকাতায় এসে বইটা কিনলাম…
শীতের অনিবার্য সংযোজন বইমেলা। বাসবীদি জানাচ্ছেন,
‘শীতে বরানগর, পার্ক স্ট্রিটের বইমেলা নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম আমরা। বইমেলার ভিড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে, কোনও তরুণ কবিকে প্রশ্ন করতাম, ভাস্করদাকে দেখেছো-সেভাবেই আবার সংযোগ হত। তারপর দেখা হলে, একসাথে হাঁটতাম। কোনও কোনও স্টলে প্রচুর আড্ডা হত। ফেরার পথে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত হাঁটতাম। একবার জানতে চেয়েছিলাম, এই ‘সুপর্ণা’ কে? প্রাক্তন প্রেমিকা? হেসে বলেছিলেন, ‘ধুর। আমার কল্পনা। কীভাবে শীতকালের সাথে সুপর্ণা এসেছিল, আমি নিজেও জানি না।’ অনেক রাত পর্যন্ত লিখতেন, কখনও কখনও ছাতে হাঁটতেন ঠান্ডায়। আমি গিয়ে ডেকে আনতাম। লেখার সময়ে একা থাকতে চাইতেন। জোরে জোরে ছাতে মাঝে মাঝে পায়চারী করতেন। সে সময় নানা সমাজবিরোধীদের আখড়া ছিল বরানগর। তাই ছাতের ঘরে আলো জ্বালা থাকলে নানা অসুবিধে হত তাদের… বন্ধুরা এলে মাঝে মাঝে একটু পানাহার হত। ভাস্কর এই আড্ডার নাম দিয়েছিলেন, ‘উত্তর কলকাতা মদ্যপায়ী সমিতি'(হাসি)…’

মিলেনিয়ালদের (নব্বই দশকে জন্মানো প্রজন্ম) পার্ক স্ট্রিট মানেই শুধু ফ্লুরিস-অলিপাব আর মোক্যাম্বো না কিন্তু। আমাদের মধ্যবিত্ত ছোটবেলা জুড়ে আছে পিপিং রেস্তোরাঁ। আছে মিউজিক ওয়ার্ল্ড। দুটোরই এখন আর অস্তিত্ব নেই। আমাদের যৌবনের বিশেষ ডেটগুলো কেটেছে তুলনামূলক সস্তা কিন্তু সম্ভ্রান্ত চিনে রেস্তোরাঁ ‘গোল্ডেন ড্র্যাগন’ আর ‘সিলভার গ্রিল’ বারে। কখনও সখনও ‘স্যামস পাব’-এ। কত প্রেম কত বিচ্ছেদের স্মৃতি এসব রাস্তায়…। আজও এসব রাস্তায় একলা হাঁটলে অবাক হয়ে দেখি আর্মেনিয়ান বাড়িগুলো… কী অপার স্থাপত্যসৌন্দর্য! অথচ কেউ দেখভালের নেই…
সদ্যই প্রয়াত হয়েছেন শ্যামলকুমার গঙ্গোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন শ্যামলবাবু। পরের জীবনে লেখালেখির জন্য বহু দেশ বিদেশের পুরস্কার পেয়েছেন।
তাঁর স্মৃতিতে পার্ক স্ট্রিট ও শীতকাল বলতে, ‘-পার্ক স্ট্রিট ছিল খোদ সাহেবি এলাকা। সাদা চামড়ার লোক ছিল বেশি। তবে ছেলেবেলায় শুনতাম, ওই এলাকায় বাঙালি একটু ভয়েই যেত। গোরারা মার-টার দিয়ে দিত। একটা ম্যানসন ছিল, গলস্টন ম্যানসন। গলস্টন সাহেবের নামে ছিল এই ম্যানসন। খেলনার দোকান ছিল, এন্টিক দোকানও ছিল। নিউ মার্কেট মানে হগ সাহেবের বাজার। প্রচুর খেলনার দোকান ছিল সেখানে। গুরুজনেরা সেখান থেকে খেলনা কিনে দিতেন। ৩৭-৩৮ সালের কথা বলছি। কোনও দোকানে মেওয়া-টেওয়া পাওয়া যেত। ‘সাবির’র সামনে সারি সারি কাবলিওয়ালা বসে থাকত ভোরে। ওখানেই একটা বাড়িতে ওরা থাকত। মালাই-রুটি খেত ওরা। টাকা ধার দিত কিন্তু শোধ না দিলে জোর করে আদায় করেও নিত… এ ছাড়া কেদার-বদ্রি নিয়ে যাওয়ার জন্য পান্ডারা আসত…’
শীতের হাত ধরেই আসত ময়দানের সার্কাস। আজ সে দিন অনেকটাই বিগত। যেমন অতীত, সুস্থ জলসার দিন। আজ ২৫-৩০ হাজারের বিজাতীয় কনসার্ট কলকাতার জলভাত। কিন্তু বড় হওয়ার পথে নানা ধারার বাংলা গান শুনেছি আমরা নামমাত্র টাকায়। পার্ক স্ট্রিট আর শীতকাল… এ লেখা শেষ করব পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রির এক মজার ঘটনা দিয়ে। কবি ও অধ্যাপক অভীক মজুমদার ও তাঁর দামাল কবি বন্ধুরা তরুণ বয়সের কোনও এক আসন্ন শীতকালে এই পার্ক স্ট্রিট কবরস্থানেই মধুসূদন দত্তের কবরের পাশে কবিতা পড়েছিলেন। আশ্চর্য সে সন্ধার স্মৃতিতে তিনি জানালেন-
‘জয়দেব, অচ্যুত, প্রবীর আজ বেঁচে নেই। ভাবলে কেমন লাগে! কিন্তু সেদিনের প্ল্যানটা ছিল মূলত জয়দেবের। জানুয়ারি মাস। শীত। মৃণাল চক্রবর্তী নামের আরেক কবিও ছিলেন। ওঁদের সাথে আমরা সবাই। আরও অনেকে ছিল সেদিন। অভিজিৎ বসু ছবি তুলছিলেন, কবি ঋজুরেখ চক্রবর্তীও ছিলেন, ছিলেন কবি বিশ্বজিৎ পন্ডা, কবি সুমিতাভ ঘোষাল।
শীতের হাত ধরেই আসত ময়দানের সার্কাস। আজ সে দিন অনেকটাই বিগত। যেমন অতীত, সুস্থ জলসার দিন।
বাংলা কবিতায় ক্লাসিক্যাল ধরণ ফিরিয়ে আনা যায় কি না, এ নিয়ে আমাদের আলোচনা হত। সেদিনও তাই হচ্ছিল। সে সুবাদেই মধুসূদনকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল কবরের পাশে। আট থেকে নয়ের দশকে বাংলা কবিতার ব্যক্তিগত যাত্রার অভিমুখ লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। কবিতায় লিরিক্যাল মেজাজে ছোট ছোট চেহারা বেশি ধরা পড়ছিল। এটাকেই আমরা ভাঙতে চাইছিলাম। সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা বড় পটভূমিকার কবিতা লেখা যায় কি না, তা নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক করতাম। সেদিনও তাই হয়েছিল।

গোরস্থানের গার্ডকে রীতিমত মদের বোতল ঘুষ দিয়েছিল জয়দেব। তারপর আমরা ঢুকে পড়েছিলাম ভেতরে। গার্ড বুঝতে পারছিলেন না, অন্ধকারে আমরা কি করতে চাইছি! …ভাবছিলেন, কবরে ফুল দিতে এসেছি হয়তো!…(হাসি)..তারপর, সেদিনের সন্ধায় জয়দেব কবরের পাশে বসেই বলল, অশীরীরীদের উদ্দেশ্যে আমাদের প্রথমে মদ উৎসর্গ করতে হবে। নাহলে ওঁরা আমাদের ঘাড় মটকে দেবে! হেনরিয়েটা, মাইকেল-কে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা মোমবাতির আলোয় কবিতা পড়া শুরু করলাম। শীতকাল বলেই সাপের উপদ্রব ছিল না। এমন ঘটনা সত্যিই বিরল! অচ্যুত সেদিন ছিল না… শিলিগুড়িতে ছিল। কত বন্ধু ছিল সেদিন… শঙ্খবাবুর একটা কবিতা মনে পড়ছে, এক দশকে সঙ্ঘ ভেঙে যায়… সবাই এদিক ওদিক সত্যিই আজ ছড়িয়ে গেছে… তবু এই স্মৃতি আজও উজ্জ্বল…’
কলকাতার তাপমাত্রা এখন ১৬ ডিগ্রি চলছে। স্মৃতির শীতকাল পার্ক স্ট্রিট ধরে এসে মিশুক মল্লিক বাজারে। পরের পর্বে স্মৃতির সরণী ধরে আরও যাতায়াত জারি থাক…
পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।