ভাষা, জাতি, পরিধান যতই নানা রকম হোক না কেন, বিবিধের মধ্যে ‘মিলন’ বরাবরই মহান। মিলন অর্থে কুন্দেরা নন। এ মিলন একেবারে শেষ দৃশ্যে ভিলেনের ডেড বডির ব্যাকগ্রাউন্ডে স্লো মোশনে নায়ক নায়িকার জড়িয়ে ধরার মতো মহান। বিয়ের কথা বলছি। ক্লাস নাইনের বল্টু ক্লাস সেভেনের বুলটিকে প্রেম নিবেদন করে দিদিমণি মাস্টারমশাইদের কাছে একসময় উত্তম-মধ্যম খেয়েছে। আবার বল্টুর যখন ৩৬ পেরিয়ে গেল অথচ বিয়ে করছে না, তখন পাড়াপড়শি বল্টুর মা’কে উত্তম-মধ্যম উপহার দেয়। অতএব সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে বিবাহ! (Wedding Photography)
ডিসেন্ট ইনটু মাইসেলফ – চিকিৎসা, সাহিত্য, এবং আত্মসমীক্ষার সমীকরণ – অনির্বাণ ভট্টাচার্য
গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এ আবহাওয়া বদলেছে, একইভাবে বদলেছে যুগের হাওয়াও। এখন ক্লাস ফাইভ এর বল্টু ক্লাস থ্রির বুলটিকে প্রেম নিবেদন করলেও আশ্চর্য হওয়ার উপায় নেই আমাদের। কারণ জীবনে কিছুই থাক বা না থাক আমাদের হাতে রইল মোবাইল। আর মাস্টার দিদিমণিদেরও উত্তম-মধ্যম দেওয়ার দায় ফুরিয়েছে অনেকদিন। ডাস্টার ও স্কেলে কাঠের বদলে জায়গা নিয়েছে প্লাস্টিক। ক্লাস থ্রির বুলটি, হাতের যন্ত্রটিতে এখন থেকেই দেখে নিচ্ছে সিদুর পরানোর সিনে কীরকম ভয়াবহ এক্সপ্রেশন দিতে হয়!
ট্রেনে বাসে বিছানায় বাথরুমে আমাদের চোখ সর্বক্ষণ যে পরিমাণে তথ্য কনজিউম করছে তার অনেকাংশ দেখা যাচ্ছে বিয়েবাড়ি কেন্দ্রিক। আর এইসব তথ্য দেখে আলিপুর থেকে আলিপুরদুয়ার সবাই জেনে গেছে যে বিয়েবাড়ি এখন নাক সিটকানো ছ্যাঁচড়ায় আটকে নেই, বরং বিয়েবাড়ি এখন বুমিং ইন্ডাস্ট্রি।
গোটা সমাজটাই যখন বিয়ে কেন্দ্রিক তখন বিয়েবাড়ি যে কারোর কারোর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। ট্রেনে বাসে বিছানায় বাথরুমে আমাদের চোখ সর্বক্ষণ যে পরিমাণে তথ্য কনজিউম করছে তার অনেকাংশ দেখা যাচ্ছে বিয়েবাড়ি কেন্দ্রিক। আর এইসব তথ্য দেখে আলিপুর থেকে আলিপুরদুয়ার সবাই জেনে গেছে যে বিয়েবাড়ি এখন নাক সিটকানো ছ্যাঁচড়ায় আটকে নেই, বরং বিয়েবাড়ি এখন বুমিং ইন্ডাস্ট্রি। আর বিশেষত যে রাজ্যে শিল্প মানে শুধু বছর বছর বিজনেস সামিট আর মউ স্বাক্ষর, কারখানার একটিও ইট গাঁথা নয়, সেখানে এই ইন্ডাস্ট্রিই বা খারাপ কী!
এ কথা স্পষ্ট যে একসময়ের গ্ল্যামারাস চাকরি এখন তার চাকচিক্য হারিয়েছে। ৯০ এর শেষ দিকের আইটি বুম এবং তাকে কেন্দ্র করে যেখানে সেখানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলি আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো বিয়ে বাড়িতেই ভাড়া দেওয়া হবে।
২০০৮ সালে নামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ দিয়ে যখন নামি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় চাকরি করতে ঢুকলাম তখন শুরুর প্যাকেজ ছিল তিন লাখ টাকার একটু বেশি। সেই সময় দক্ষিণ কলকাতার একটি পাইস হোটেলের মুরগির ঝোল ও ভাতের দাম ছিল ৩২ টাকা। এখন ওই হোটেলের মুরগির ঝোল ভাতের দাম ১৫২ টাকা। আর ওই কোম্পানির শুরুর প্যাকেজ সাড়ে তিন লাখ টাকা। কাজেই এ কথা স্পষ্ট যে একসময়ের গ্ল্যামারাস চাকরি এখন তার চাকচিক্য হারিয়েছে। ৯০ এর শেষ দিকের আইটি বুম এবং তাকে কেন্দ্র করে যেখানে সেখানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলি আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো বিয়ে বাড়িতেই ভাড়া দেওয়া হবে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে অনেক ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা ছাত্র-ছাত্রী চাকরি খোঁজার চেষ্টাও করছেন না, সরাসরি অন্য পেশায় যোগ দিচ্ছেন। বেসরকারি হাই প্রোফাইল ইঞ্জিনিয়ারের চাকরির বিকল্প হয়তো সমবেতনের সরকারি কোনও চাকরি। কিন্তু সরকারি চাকরির অবস্থাও গত দশ বছরে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা আপনারা ভাল করেই জানেন। আর আমাদের মহান নেতা-নেত্রীরা তো বলেই দিয়েছেন চাকরির চেষ্টা না করে চপ ভাজতে কিংবা পকোড়া ভাজতে। সেই চপ আর পকোড়া শিল্পের সফিস্টিকেটেড ভার্সন হল যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা নান্দনিক ক্যাফে কিংবা রিসোর্ট।
পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গঞ্জে ছোট শহরে দেখা যাচ্ছে পিএইচডি চা ওয়ালা, বিটেক কফি ওয়ালা ইত্যাদি চটকদার ব্যবসা। চটকের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে কর্মহীনতার কঠিন বাস্তব।
একসময় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার এত হিড়িক হয়েছিল তার কারণ হয়তো চাকরির নিশ্চয়তা। সেই ইঞ্জিনিয়ারিং-এই যদি চাকরির নিশ্চয়তা না থাকে তাহলে অন্যান্য মূলধারার পড়াশোনায় চাকরির কী অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। শুধু ক্যাফে-রিসোর্ট নয়, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গঞ্জে ছোট শহরে দেখা যাচ্ছে পিএইচডি চা ওয়ালা, বিটেক কফি ওয়ালা ইত্যাদি চটকদার ব্যবসা। চটকের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে কর্মহীনতার কঠিন বাস্তব। যাঁরা এসব চটকদার ব্যবসা করতে পারছেন না বা ব্যবসা করার পুঁজি নেই তাঁদের অনেকেই টোটো চালাচ্ছেন। এই ব্যবসা আর টোটো চালানোর মাঝখানের অংশে যাঁরা অবস্থান করছেন তাদেরকে আরও অভিনব পন্থা খুঁজতে হচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান, কেউ মেকাপ আর্টিস্ট।
মোটামুটি মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সামান্য সঞ্চয় ভেঙে ক্যামেরা ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি কিনে সহজেই যা শুরু করা যায়। আর এই অনলাইন বাজারের যুগে স্টুডিও অফিস এসব না হলেও চলে।
এইরকমই একটি ব্যবসা হল ফটোগ্রাফির ব্যবসা। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে হলে বিয়ে-বাড়ির ছবি তোলার ব্যবসা। মোটামুটি মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সামান্য সঞ্চয় ভেঙে ক্যামেরা ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি কিনে সহজেই যা শুরু করা যায়। আর এই অনলাইন বাজারের যুগে স্টুডিও অফিস এসব না হলেও চলে।
আমি নিজে যখন ছবি তোলা শুরু করি কখনও ভাবিনি যে বাণিজ্যিকভাবে বিয়ে বাড়ির ছবি তুলব। চাকরির পাশাপাশি শখ হিসেবে ছবি তোলার শুরু। রাস্তাঘাট-আকাশ-বাতাস-ফুল-পাখি-সমুদ্র-সূর্যাস্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর একদিন হঠাৎ করে এক ওয়েডিং ফটোগ্রাফারের কথা শুনলাম। উনি নাকি তখন পঞ্চাশ হাজার টাকা চার্জ করতেন। শুনে আমার চক্ষু চড়ক গাছ। শখের ছবি তুলতাম বলে নিজেকে এলিট মনে করতাম আর বিয়ে বাড়ির ফটোগ্রাফারকে নিচু নজরেই দেখতাম তখনও। পয়সার হাতছানিকে অবহেলা না করে আমিও একদিন বাজারে নেমেই পড়লাম। তখনও পাড়ার মাম্পি স্টুডিও, রিম্পা স্টুডিওদের রমরমা বাজার। আমাদের মতো ফেসবুকের ফটোগ্রাফারদের কেউ হায়ার করতে চায় না।
কাট টু ২০২৪। গত এপ্রিল মাসে ফেসবুকে একটি পোস্টে আমার নজর আটকে যায়। বিয়ে বাড়ির ক্যামেরাম্যান হওয়ার সুবাদে আমার ফেসবুক ফিডে মাঝে মাঝেই অমুক দিনে একজন ফটোগ্রাফার লাগবে জাতীয় পোস্ট ভেসে ওঠে। এই পোস্টটিও সেরকম একটি পোস্ট। কিন্তু চোখ আটকালো অন্য কারণে। একজন দু’জন নয়, পোস্টদাতা ৮০ জন ফটোগ্রাফার ও সিনেমাটোগ্রাফার চেয়েছেন পরবর্তী বিয়ে বাড়ির সিজনের জন্য। এক ঝলক দেখে মনে হল যেন বড় আইটি কোম্পানির প্লেসমেন্টের অ্যাড।
একজন দু’জন নয়, পোস্টদাতা ৮০ জন ফটোগ্রাফার ও সিনেমাটোগ্রাফার চেয়েছেন পরবর্তী বিয়ে বাড়ির সিজনের জন্য। এক ঝলক দেখে মনে হল যেন বড় আইটি কোম্পানির প্লেসমেন্টের অ্যাড।
কয়েক বছর আগে বিহারে কাজ করতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল এক ড্রোন অপারেটরের সঙ্গে। উনি মূলত ড্রোন অপারেটই করে থাকেন। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আর কিছু করেন কী না। উনি বললেন হ্যাঁ করি তো, ড্রোন চালানোর পাশাপাশি রসায়নে গবেষণাও করছি। আমি আমার এক রসায়ন গবেষক বন্ধুর হতাশার কথা মনে করলাম।
জীবে প্রেম করে যেই জন – গৈরিক গঙ্গোপাধ্যায়
কিছুদিন আগে কলকাতার একটি ফটোগ্রাফারের দল বিহারে ছবি তোলার কাজে গিয়ে ক্যামেরা ও যন্ত্রপাতি খুইয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে ফিরে আসে। অপরাধীরা ক্লায়েন্ট সেজে কিছু টাকা এডভান্স করে ফটোগ্রাফারদের ডেকে তাদের টুপি পরায়। অনুরূপ ঘটনা আরও কয়েকটি ঘটেছে, দিল্লি এনসিআর ও হরিয়ানা সন্নিহিত অঞ্চলে। বাঘ আসার মিথ্যে কথা বলে রাখাল হয়তো নিজের ক্ষতি করেছিল, কিন্তু বাঘের উপকার হয়েছিল। একইভাবে তাহলে কি আমরা বলতে পারি যে একসময় বিয়ে বাড়ির ছবি তোলার পেশাকে হেলাফেলা করে দেখলেও, এখন তেমন জায়গায় পৌঁছেছে যে অপরাধীরা তাঁদের টার্গেট করছে?
ইন্ডাস্ট্রি উন্নত যেমন হচ্ছে তার কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও দেখা যাচ্ছে। ধর্মতলার একটি বিখ্যাত ক্যামেরার দোকানে একদিনের অভিজ্ঞতা। একটি বেশ কম বয়সী ছেলে সদ্য সদ্য ক্যামেরা কিনে দোকানে বসেই প্রচণ্ড ভিড়ের মাঝে ক্যামেরার কার্যপ্রণালী বোঝার চেষ্টা করছে। তাকে জিজ্ঞেস করা হল যে এই ভিড়ের মধ্যে কেন করছ? বাড়ি গিয়ে করতে পারো তো। সে জবাব দেয় এক্ষুনি তাকে একটি বিয়ে বাড়িতে গিয়ে ছবি তুলতে হবে। ছেলেটি যাঁদের ছবি তুলবে সেই নবদম্পতির কথা ভেবে আমার কষ্ট হল। তবে এরকম ঘটনা আশ্চর্য হওয়ার নয়। নভেম্বর ডিসেম্বর মাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিয়ে বাড়ির দিনগুলিতে ফেসবুকে নজর রাখলেই এরকম পোস্ট হামেশাই চোখে পড়ে যে, গায়ে হলুদ শুরু হয়ে গেছে, ক্যামেরা নিয়ে কেউ একজন চলে আসো প্লিজ।
শিল্প ভালোবেসে কাজ করতে এসে সেই শিল্প কখন যে পয়সা কামানোর শর্টকাট হয়ে গেল ভাবতে আশ্চর্য লাগে।
শিল্প ভালোবেসে কাজ করতে এসে সেই শিল্প কখন যে পয়সা কামানোর শর্টকাট হয়ে গেল ভাবতে আশ্চর্য লাগে। দুঃখের বিষয় এটাই যে তরুণ ফটোগ্রাফাররা এইটা ভাবছেন না, যে রাজ্যের তথা ভাঁড়ে মা ভবানী, সেখানে কোনও শর্টকাটই কাজে আসবে না। তাহলেই ভাবুন, হবুদম্পতি বল্টু এবং বুলটি সাড়ে তিন লাখ টাকা প্যাকেজে ১৫২ টাকার মুরগির ঝোল ভাত খাবে না কি শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করবে?
সুখে থাকতে ভূতে কিলায়-এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সে সুখের চাকরি ছেড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ানো হোক কিংবা সমাজ মাধ্যমের বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়া হোক। শিক্ষায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। পেশায় বিয়েবাড়ির ক্যামেরাম্যান। আর নেশায় ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার।