Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

ইওসেফ ফ্রাউনহোফের এক অজানা গল্প: প্রথম পর্ব

শেখর গুহ

এপ্রিল ৩, ২০২৫

Joseph Fraunhofer
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close
(Joseph Fraunhofer)

আমাদের ধরা-ছোঁয়ার এই জগতটার সব কিছু আদতে কী দিয়ে গড়া, সে প্রশ্নটা নিয়ে মানুষ বহুদিন ধরেই চিন্তা করেছে। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক এম্পেডোক্লেস(Empedocles, 494 – 434 BC) প্রস্তাব করেছিলেন যে মাটি, জল, আগুন আর বাতাস– এই চারটে জিনিস দিয়েই আর সব কিছু বানানো যায়। তার শ’খানেক বছর পরে আরিস্ততল(Aristotle, 384 – 322 BC) মনে করলেন যে আকাশে দেখা সূর্য- তারাগুলি নিশ্চয়ই পৃথিবীতে পাওয়া কোনও জিনিস দিয়ে বানানো নয়– ধরে নেওয়া যাক ওইগুলি গড়া, ইথার নামে কোনও এক পদার্থ দিয়ে। ভারতীয় দর্শনে বিশ্বজগতের সব বস্তুর এই পাঁচটা মৌলিক উপাদানকে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুত আর ব্যোম– এই পঞ্চভূত নাম দেওয়া হয়েছে। (Joseph Fraunhofer)

ekhar Guha_Probondho_Fraunhofer_3.4.2025_AG (3)
একটি প্রাচীন টেলিস্কোপ

গত কয়েকশো বছরে ইওরোপের নানা দেশের বিজ্ঞানীদের অনেক চেষ্টায় জানা গেছে যে ওই পাঁচটি দিয়ে নয়, পৃথিবীর সব জিনিসই বিরানব্বইটি মতো মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি। আকাশের সূর্য, চাঁদ, গ্রহগুলি থেকে গোটা বিশ্বব্রম্ভাণ্ডের অনেক হাজার কোটি গ্যালাক্সিতে কোটি, কোটি তারাগুলিও প্রায় সবই ওই গোটা বিরানব্বইটি পদার্থ বা তাদের ভিতরের উপাদান দিয়েই তৈরি। সূর্য-তারাগুলির আর পৃথিবীর মালমশলাগুলি যে একই, আর সে মালমশলাগুলির ভিতরে কোন নিয়মকানুনগুলো খাটে তারও হদিস প্রথম পাওয়া গিয়েছিল যেসব বিজ্ঞানীদের কাজে, তাদের অন্যতম একজন হলেন ইওসেফ ফ্রাউনহোফের (Joseph Ritter von Fraunhofer, ৬ মার্চ, ১৭৮৭ – ৮ই জুন, ১৮২৬)। (Joseph Fraunhofer)

আরও পড়ুন: প্রাক-ফ্রাউনহোফের সময়ের দূরবীন

অনেক শিল্পী, বিজ্ঞানী, কবি বা লেখক তাঁদের জীবদ্দশায় প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি লাভ করেন না– তাঁদের অবদানের গুরুত্বটা মানুষ বোঝে মৃত্যুর পরে, তাঁদের রেখে যাওয়া কাজ থেকে। ফ্রাউনহোফেরের বেলায় বলা যায় যে সেটা আংশিক সত্যি হয়েছিল। তাত্ত্বিক ধারণা এবং সূক্ষ্ম হাতের কাজ, দুটোতেই তাঁর অসামান্য দক্ষতা ছিল। তা কাজে লাগিয়ে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের প্রযুক্তি ও কাচ বানানোতে তিনি বিপ্লব এনেছিলেন, যার জন্য গোটা ইওরোপেই তিনি সুপরিচিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর অতি নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ে সংগ্রহ করা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফল,  এবং তাঁর উদ্ভাবিত কয়েকটি যন্ত্র যে আধুনিক কালে, বিংশ ও একবিংশ শতকের বিজ্ঞানচর্চায় ও অগ্রগতীতে কতটা অপরিহার্য তা বোঝার মতো জ্ঞান তাঁর সমসাময়িকদের ছিল না। তা ভালো করে বোঝা গেছিল ফ্রাউনহোফেরের মৃত্যুর বছর পঁয়ত্রিশ পর থেকে। (Joseph Fraunhofer)

একবিংশ শতকের বিজ্ঞানচর্চায় ও অগ্রগতীতে কতটা অপরিহার্য তা বোঝার মতো জ্ঞান তাঁর সমসাময়িকদের ছিল না।

ইস্কুল, কলেজের প্রথাগত শিক্ষালাভ করার সুযোগ পাননি ফ্রাউনহোফের। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে দারিদ্র্য এবং চরম প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে। জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলে বাভারিয়া রাজ্যে, মিউনিখ শহর থেকে সত্তর মাইল উত্তরপূর্বদিকে ষ্ট্রাউবিং শহরে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন এক গরীব জানলা-মিস্ত্রি, পুরুষানুক্রমে কাচ বানানো ও বসানো ছিল তাঁদের পারিবারিক পেশা। মা-ও ছিলেন অনেক প্রজন্ম ধরে কাচের-কারিগর পরিবারের মেয়ে। দশম(মতান্তরে একাদশতম) ও কনিষ্ঠতম সন্তান ইওসেফকে ইস্কুলে পাঠিয়ে পড়াশোনা শেখাবার সঙ্গতি তাঁর বাবা মায়ের ছিল না। বাড়িতেই যা হোক একটু লেখাপড়া শিখিয়ে অল্পবয়সী ইওসেফকে তাঁর বাবার ছোট কারখানায় ভরতি করা হয়েছিল কাজ শেখার জন্য। কিন্তু এগারো বছর বয়সে এক বছরের মধ্যে ইওসেফ তাঁর মা ও বাবাকে হারালেন। অনাথ ছেলেটিকে দেখাশোনার জন্য নিযুক্ত অভিভাবক তাঁকে তখন একটি ছুতোরের কাছে শিক্ষানবীশের কাজে লাগিয়ে দিলেন– কিন্তু সে কাজে ইওসেফ বেশি দিন টিকলেন না। (Joseph Fraunhofer)

Sekhar Guha_Probondho_Joseph Fraunhofer_3.4.2025_AG (2)
ইওসেফ ফ্রাউনহোফের

(Joseph Fraunhofer) বারো বছর বয়সে প্রায় নিরক্ষর ইওসেফ বিনা বেতনে ও নানান অন্যায্য বাধা নিষেধ মেনেই মিউনিখ শহরে এক প্রধান দর্পন-নির্মাতা ও আলঙ্কারিক কাচ কাটার ওস্তাদ ফিলিপ ওয়াইখসেলবুর্গারের(Philipp Weichselburger) কাছে শিক্ষানবীশ হয়ে যোগ দিলেন। সম্ভবত কিছু টাকা দিয়ে ওয়াইখসেলবুর্গার ফ্রাউনহোফেরকে কিনেই নিয়েছিলেন কেন না প্রায় ক্রীতদাসের মতো কষ্ট সহ্য করে তাঁকে সেখানে প্রথম তিন বছর কাটাতে হয়েছিল। পড়াশোনা শেখার কোনও সুযোগ তিনি তো পেলেনই না, তার উপর ওয়াইখসেলবুর্গার তাঁকে অন্য শিক্ষানবীশদের সঙ্গে মিশতেও দিতেন না! তবে তাঁকে একটু-আধটু সাহায্য করতেন উলরিশ শিগ (Ulrich Schiegg, ১৭৫২ – ১৮১০) নামে একজন পাদ্রী, যিনি আবার জ্যোতির্বিদও ছিলেন। হয়তো তাঁর থেকে ফ্রাউনহোফের বিজ্ঞানের বিষয়ে প্রথম জেনে থাকবেন।

সম্ভবত কিছু টাকা দিয়ে ওয়াইখসেলবুর্গার ফ্রাউনহোফেরকে কিনেই নিয়েছিলেন কেন না প্রায় ক্রীতদাসের মতো কষ্ট সহ্য করে তাঁকে সেখানে প্রথম তিন বছর কাটাতে হয়েছিল।

১৮০১ সালের একুশে জুলাই চোদ্দ বছর বয়সী ফ্রাউনহোফেরের জীবনে একটি নাটকীয় ঘটনা ঘটল, যাকে ভাগ্যের পরিহাসই বলা যায়। ওয়াইখসেলবুর্গারের বাড়ি এবং কারখানা সেদিন হঠাৎ ভেঙে পড়েছিল– এবং সে বিরাট দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ওয়াইখসেলবুর্গারের স্ত্রী। কর্মরত ফ্রাউনহোফেরও সেই ধ্বংসাবশেষে চাপা পড়েছিলেন আর এই বিপর্যয়ে তাঁর বাঁচার কোনও আশা ছিল না। কিন্তু নেহাৎ বরাত জোরে একটা কড়িকাঠের তলায় আশ্রয় পেয়ে মোটামুটি অক্ষতদেহে বেঁচে গেলেন তিনি। বাড়িটা খুঁড়ে তাঁকে উদ্ধার করল মিউনিখের লোকে।

ফ্রাউনহোফেরকে তিনি তাঁর নিমফেনবুর্গ কেল্লায় দেখা করতে আসার আমন্ত্রণ জানালেন, ও সেখানে এলে তাকে আঠারোটি ডুকাট বা স্বর্ণমুদ্রা উপহার দিলেন।

এই দুর্ঘটনাটি ফ্রাউনহোফেরের জীবন বদলে দিল। তাঁর উদ্ধারকার্য দেখতে এসেছিলেন তো বটেই, সম্ভবত উদ্ধারে যোগও দিয়েছিলেন বাভারিয়ার তদানীন্তন শাসক ও প্রথম রাজা মাক্সিমিলিয়ান(Maximilian I, ১৭৫৬ – ১৮২৫)। মাক্সিমিলিয়ানের জীবনী পড়লে বোঝা যায় যে তিনি উদার, মুক্তমনা এবং জনপ্রিয় দেশশাসক ছিলেন। অনাথ, সহায়হীন আর ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া কিশোর ফ্রাউনহোফেরের উপর তাঁর একটু মায়া পড়েছিল মনে হয়। ফ্রাউনহোফেরকে তিনি তাঁর নিমফেনবুর্গ কেল্লায় দেখা করতে আসার আমন্ত্রণ জানালেন, ও সেখানে এলে তাকে আঠারোটি ডুকাট বা স্বর্ণমুদ্রা উপহার দিলেন। সেটা প্রায় সাড়ে পাঁচ ভরি খাঁটি সোনা- কিশোর ফ্রাউনহোফের তা হেলায় উড়িয়ে না দিয়ে কাজে লাগালেন একটি কাচ কাটার যন্ত্র ও আলোক-বিজ্ঞানের কিছু বই কিনে। (Joseph Fraunhofer)

Sekhar Guha_Probondho_Joseph Fraunhofer_3.4.2025_AG (4)
একটি প্রাচীন টেলিস্কোপ

(Joseph Fraunhofer) দেশশাসকের নজরে পড়া ছেলেটিকে ওয়াইখসেলবুর্গার আর উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করতে পারলেন না। এরপর থেকে ফ্রাউনহোফের অন্যান্য শিক্ষানবীশদের সঙ্গে মেশার ও নিজেও পড়াশোনা করার সুযোগ পেলেন। ভেঙে পড়া বাড়িটা খুঁড়ে তাঁকে উদ্ধার করার সময় সেটা দেখতে জড়ো হওয়া মিউনিখবাসীদের মধ্যে ছিলেন ইওসেফ উটৎশ্নাইডার (Josef Utzschneider, ১৭৬০ – ১৮৪০) নামে এক ধনী আইনজীবী- যিনি তুখোর ব্যবসায়ীও ছিলেন। জানা যায় মানুষ চেনার ব্যাপারেও তিনি পাকা ছিলেন। অল্পবয়সী এবং অনভিজ্ঞ ফ্রাউনহোফেরের মধ্যে তিনি সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন, ও তাঁকে সবচেয়ে ভাল বইগুলো থেকে বিজ্ঞান শেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। দু’তিন বছর ধরে ফ্রাউনহোফের কাজের বাইরে বাড়তি সমস্ত সময়টা কাজে লাগিয়ে আলোকবিজ্ঞানের তত্ত্ব এবং হাতে কাচ ঘসে চশমার লেন্স বানানো শেখায় দক্ষতা অর্জন করলেন। উটৎশ্নাইডারের সহযোগী এক দক্ষ লেন্সনির্মাতা ইওসেফ নিগ্‌ল (Josef Niggl) তাঁকে সে কাজ শিখতে সহায়তা করেন। (Joseph Fraunhofer)

ধাতুপাতের উপরে খোদাই করা সেরকম ভিসিটিং কার্ড বানানোর ব্যবসায় ঢুকলেন ফ্রাউনহোফের।

১৮০৪ সাল নাগাদ বাকি থাকা স্বর্ণমুদ্রার কিছু ওয়াইখসেলবুর্গারকে দিয়ে ফ্রাউনহোফের তাঁর শিক্ষানবীশী চুক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করে একটু স্বাধীন ব্যবসা করার চেষ্টা করেছিলেন। ফরাসীদেশে অভিজাত লোকেরা ১৭৬০ সাল নাগাদ ভিসিটিং কার্ডের প্রচলন শুরু করেছিল– সেটা ধীরে ধীরে গোটা ইওরোপ ও আমেরিকাতেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ধাতুপাতের উপরে খোদাই করা সেরকম ভিসিটিং কার্ড বানানোর ব্যবসায় ঢুকলেন ফ্রাউনহোফের। কিন্তু মাস ছয়েকের মধ্যে বোঝা গেল যে ওরকম ব্যবসা করা তাঁর ধাতে নেই– তা ছেড়ে তিনি আবার ফিরলেন ওয়াইখসেলবুর্গারের কারখানায়– এবারে ঠিকা-মজুর হয়ে। সেখানে আরও বছর দেড় দুই কাটিয়ে ১৮০৬ সালে উনিশ বছর বয়সে তিনি উটৎশ্নাইডারের আমন্ত্রণে নতুন কাজে ঢুকলেন মিউনিখ শহরে Mathematisches und Mechanisches Institut, মানে গাণিতিক ও কারিগরী সংস্থা নামে একটি প্রতিষ্ঠানে। (Joseph Fraunhofer)

১৮০৪ সালে সেই প্রতিষ্ঠানে উটৎশ্নাইডার সহ-মালিক হয়ে যোগ দিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্য ছিল জরীপ, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ইত্যাদির যন্ত্রপাতি বানানো। বিজ্ঞান-চর্চার জন্য যতটা না, তার চেয়ে সামরিক শক্তি বাড়ানোর জন্য গবেষণায় বাভারিয়ার সরকার সে সংস্থাটিতে অনেক টাকা ঢালত। জ্যোতির্বিদ্যায় ভাল দূরবীন অপরিহার্য, আবার জরীপের কাজেও তা খুব লাগে, তাই দূরবীন বানানোতেই উটৎশ্নাইডার মন দিয়েছিলেন। (Joseph Fraunhofer)

(ক্রমশ)

ফ্রাউনহোফের সংক্রান্ত তথ্যসূত্র মূলত দুটি –
১। Josef Fraunhofer (1787 – 1826), Ian Howard-Duff, British Astronomical Association Journal, Vol 97, Issue 6, 1987
২। The life and work of Joseph Fraunhofer (1787−1826), Alfred Leitner, American  Journal of Physics, Vol 43, 59–68 (1975)
পরিভাষা –
পদার্থবিজ্ঞানের পরিভাষা, দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৮১
তথ্যগুলি মোটামুটি সহজলভ্য– বহু পাঠ্যবইতে এবং ইন্টারনেটে রয়েছে।

Author Shekhar Guha

শেখর গুহ পেশায় আলোকবিজ্ঞানী। তাঁর শখ কলকাতা ও বাংলার ইতিহাস ঘাঁটা।

Picture of শেখর গুহ

শেখর গুহ

শেখর গুহ পেশায় আলোকবিজ্ঞানী। তাঁর শখ কলকাতা ও বাংলার ইতিহাস ঘাঁটা।
Picture of শেখর গুহ

শেখর গুহ

শেখর গুহ পেশায় আলোকবিজ্ঞানী। তাঁর শখ কলকাতা ও বাংলার ইতিহাস ঘাঁটা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস