Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

কৃষ্ণরাম ও সত্যেন্দ্রনাথের সূত্রে যখন সাহিত্য-মানচিত্রে উঠে এসেছিল নিমতা

তন্ময় ভট্টাচার্য

এপ্রিল ১২, ২০২৫

Krishnaram Das
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close
(Krishnaram Das)

মধুসূদন ব্যানার্জি রোড ধরে বেলঘরিয়া থেকে বিরাটির দিকে যেতে যেতে, বাঁদিকে ঘুরে গেছে ছোট্ট এক রাস্তা। নাম: এস. এল. চ্যাটার্জি স্ট্রিট। জনপদ: নিমতা। সেই রাস্তা ধরে, খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছনো গেল এক ঠিকানায়। অবশ্য চিহ্নিত করা ছিল আগে থেকেই—১৯৮২ সালে, উত্তর দমদম পৌরসভা ও স্থানীয় নাগরিকদের উদ্যোগে স্থাপিত একটি ফলক। তাতে লেখা:
‘ছন্দের যাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এই গৃহে ১৮৮২ সালে ১২ই ফেব্রুয়ারি ভূমিষ্ঠ হন।’ (Krishnaram Das)

আরও পড়ুন: হারিয়ে-যাওয়া গির্জা, ভাঙা স্কুলবাড়ি তথা আগরপাড়ার মিশন-কাহিনি

সাহিত্যানুরাগী কিংবা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিমাত্রেই জানেন, বৃহত্তর পরিসরে অন্তত তিনজন লিখিয়ের আলোচনা-প্রসঙ্গে উঠে আসে একটিই জনপদের নাম— ‘নিমতা’। ওই তিনজনের মধ্যে আধুনিকতম সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। স্কুলপাঠ্য বই হোক কিংবা অন্য, কবির প্রত্যেক জীবনীরেখাতেই জন্মস্থান হিসেবে নিমতার উল্লেখ অবশ্যম্ভাবী। পার্শ্ববর্তী জনপদ অর্থাৎ বেলঘরিয়ার বাসিন্দা হওয়ায়, বর্তমান নিবন্ধকারও সে-চর্চার সঙ্গে আবাল্য পরিচিত। ২০২৫-এর এক বসন্তবিকেলে সেই ঠিকানাটিই খুঁজতে রওয়ানা দেওয়া। ঠিক কোথায় জন্মেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ? (Krishnaram Das)

Krishnaram Das
সত্যেন্দ্রনাথের মাতুলালয়ে প্রতিষ্ঠিত ফলক

দাদামশায় রামদাস মিত্রের বাড়ি ছিল নিমতায়। তাঁর কন্যা মহামায়ার সঙ্গে বিবাহ হয় কলকাতা নিবাসী রজনীনাথ দত্তের। এই দম্পতিরই সন্তান সত্যেন্দ্রনাথ। মামাবাড়িতে জন্ম তাঁর, ১৮৮২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। সত্যেন্দ্রনাথের অকালমৃত্যুর (১৯২২) পর, জন্ম ও শৈশব সম্পর্কে মামা কালীচরণ মিত্রের স্মৃতিচারণ:
“১২৮৮ সালের ২৯এ মাঘ, শনিবার, অমনই বাদল রজনীতে দ্বিপ্রহর রাত্রে শীর্ণ শিশু প্রথম বিস্ময়ের চাহনি দেখিল। কে জানিত নিম্‌তা গ্রামে মাতুলালয়ের সূতিকাগারে দেশমান্য ঋষি-কবির আবির্ভাব হইল।
‘তাহার পর উপর্য্যুপরি কয়দিন কেবল ঝড়। সকলেই তাই নাম রাখিল ‘ঝড়ি’। নামে ‘ঝড়ি’ কিন্তু প্রকৃতিতে কি শান্ত সংযত! শিশু আপন মনে হাসিত খেলিত, কাঁদিতে যেন জানিত না।”(Krishnaram Das)

Krishnaram Das
সত্যেন্দ্রনাথের মাতুলালয়ের প্রাচীন ছবি, ঋণ – দেশকাল

সেই মাতুলালয়ের খোঁজেই বেরিয়ে পড়া। এসএল চ্যাটার্জি স্ট্রিট ধরে খানিক এগোনোর পর, চোখে পড়ে সেই ফলক (যার বয়ান পূর্বেই উল্লিখিত), একটি দেওয়ালে বসানো। কিন্তু সংলগ্ন বাড়িটি নিতান্তই হাল আমলের। বস্তুত, ‘দেশকাল’-এর সৌজন্যে নিমতার মিত্র পরিবারের বসতভিটের যে প্রাচীন ছবিটি হস্তগত হয়েছে, তা দীর্ঘকাল লুপ্ত। সেই ছবিতে দেখা যায় আড়ম্বরপূর্ণ বহির্দালান ও তৎসংলগ্ন অন্দরমহলে প্রবেশের দুয়ার। সেসবের কিছুই আর নেই, অন্দরে প্রবেশের রাস্তাটি এখন একটি গলি মাত্র। সেখানে গিয়ে খোঁজখবর করতে করতে, অবশেষে হদিশ পাওয়া গেল এক প্রৌঢ়ার, রীতা মিত্র, যিনি এই তল্লাটে মিত্রবংশের শেষ প্রতিনিধি। অবশ্য বিবাহসূত্রে এখানে আগমন তাঁর। তাঁর স্বামী (বর্তমানে প্রয়াত) ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের অধস্তন তৃতীয় প্রজন্ম। রীতাদেবীর কাছ থেকেই জানা গেল, এককালে মিত্রদের ১৪ বিঘা জমি ও ৩টি পুকুর ছিল এ-তল্লাটে। সেই জমিতে ছড়ানো-ছিটানো বিশাল বসতভিটে ও বাগান। বিগত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হয় হস্তান্তর।(Krishnaram Das)

বর্তমানে বসতভিটের কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই, টুকরো-টুকরো করে বিক্রি হয়ে গেছে, গড়ে উঠেছে বহিরাগতদের বাড়ি। এমনকি, সত্যেন্দ্রনাথ ঠিক যেখানে জন্মেছিলেন, সেই আঁতুড়ঘরটিরও অস্তিত্ব নেই আর।

বর্তমানে বসতভিটের কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই, টুকরো-টুকরো করে বিক্রি হয়ে গেছে, গড়ে উঠেছে বহিরাগতদের বাড়ি। এমনকি, সত্যেন্দ্রনাথ ঠিক যেখানে জন্মেছিলেন, সেই আঁতুড়ঘরটিরও অস্তিত্ব নেই আর। থাকার মধ্যে রাস্তার বাইরের ফলক, প্রাচীন গৃহের ক্ষুদ্র ও অব্যবহার্য একটি অংশ, ‘মিত্রপুকুর’ নামে চিহ্নিত একটিমাত্র জলাশয় ও খোদ রীতা মিত্র— এতদঞ্চলে ‘মিত্র’ পদবিধারী শেষ জীবিত প্রতিনিধি। (Krishnaram Das)

Krishnaram Das
এখানেই অবস্থিত ছিল সত্যেন্দ্রনাথের মাতুলালয়

তারপরও, সত্যেন্দ্রনাথের জন্মস্থানটি সহজে চিহ্নিত করা যায় আজও। এবার খোঁজা যাক বাকি দু’জনের সংযোগ। এর মধ্যে একজনের জন্ম অবশ্য চুঁচুড়ায়, তবে পড়াশোনা করতে এসেছিলেন নিমতায়। তিনি, রামরাম বসু (১৭৫৭-১৮১৩)। বাঙালির লেখা প্রথম বাংলা মৌলিক গদ্যগ্রন্থ, ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত’-এর লেখক তিনি। সেইসঙ্গে জড়িত ছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে। অষ্টাদশ শতকে নিমতার কোথায় এসেছিলেন তিনি, তা জানা যায় না। তবে তৎকালীন শিক্ষা-মানচিত্রে নিমতার গুরুত্ব যে ফেলনা ছিল না, তার আন্দাজ মেলে। প্রসিদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা না-থাকলে চুঁচুড়া থেকে নিমতায় আসা অযৌক্তিক।

সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের মানুষ কৃষ্ণরাম; লিখেছেন কালিকামঙ্গল (১৬৭৬), ষষ্ঠীমঙ্গল (১৬৭৯-৮০), রায়মঙ্গল (১৬৮৬) প্রভৃতি কাব্য। তবে তাঁর পরিচয় মূলত সাহিত্যপিপাসু ও গবেষকদের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ

তবে আজকের এই লেখা নিমতার ইতিহাসে কোন সাহিত্যিক সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তা নিয়ে নয়। তাই কেবল সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত-এর কথা না বলে, জেনে নেওয়া যাক কৃষ্ণরাম দাস-এর কথাও। সত্যেন্দ্রনাথের জন্ম কেবলমাত্র নিমতায়, কিন্তু কৃষ্ণরামের জন্মের পাশাপাশি জীবনও কেটেছে এখানেই। বস্তুত, প্রাগাধুনিক যুগে, বর্তমান বারাকপুর মহকুমার দক্ষিণাংশের একমাত্র উল্লেখযোগ্য কবি তিনি— এ-দাবিও অত্যুক্তি হবে না। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের মানুষ কৃষ্ণরাম; লিখেছেন কালিকামঙ্গল (১৬৭৬), ষষ্ঠীমঙ্গল (১৬৭৯-৮০), রায়মঙ্গল (১৬৮৬) প্রভৃতি কাব্য। তবে তাঁর পরিচয় মূলত সাহিত্যপিপাসু ও গবেষকদের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ; তার বাইরে উত্তর-ঔপনিবেশিক সাধারণ পাঠককুল বিশেষ ওয়াকিবহাল নন।(Krishnaram Das)

ভগবতী দাসের সন্তান কৃষ্ণরাম। কালিকামঙ্গল লেখার সময় তাঁর বয়স ছিল কুড়ি বছর, কাব্যের আত্মপরিচয় অংশে লিখেছেন নিজেই ‘নিজ পরিচয় কই/ বয়ঃক্রম বৎসর বিংশতি’। এর থেকে বোঝা যায়, ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে জন্ম তাঁর। ‘নিমিতা জন্মস্থান’ সম্পর্কে তাঁর উচ্চারণ স্পষ্ট ও গর্বিত
‘অতি পুণ্যময় ধাম সরকার সপ্তগ্রাম
কলিকাতা পরগণা তার।
ধরণী নাহিক তুল জাহ্নবীর পূর্ব্বকুল
নিমিতা নামেতে গ্রাম যার।।
বসতি করয়ে তথি সদাচারী শুদ্ধমতি
ধীর ধরাদেবগণ সুখে।
হেন দেখি মনে লয় নারদ আদি মুনিচয়
অবতার হৈল কলিযুগে।।’
আবার, একই কাব্যের অন্যত্র কৃষ্ণরাম লেখেন—
‘গ্রাম নিমিতা গঙ্গার পূর্বকুল।
সাবর্ণচৌধুরী সব যাহাতে অতুল।।
গোমহিষ পশুপক্ষ বৃক্ষ পর টাট।
রম্য সরোবরতীর সানবান্ধা ঘাট।।
নগর রাজার হাট দেখিতে সুন্দর।
কৈলাস শিখরে যেন দেব পুরন্দর।।’
এরপর, নিমতা-বিরাটির সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশ সহ অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির গুণগান গেয়েছেন কবি। সেসব সরিয়ে রেখে জনপদে মনযোগ দিলে বোঝা যায়, তৎকালে (মোঘল আমল) সপ্তগ্রাম সরকারের অধীনে কলিকাতা পরগনার অন্তর্গত গ্রাম ছিল নিমতা। এছাড়াও নিমতার যেসব গুণগান গেয়েছেন কবি, ‘ধরণী নাহিক তুল’ ইত্যাদি ও বাসিন্দাদের পরিচয়, তা জন্মস্থানের প্রতি দুর্বলতা ও আবেগবশতই বোধকরি। এছাড়া, গ্রামের উল্লেখযোগ্য বিবরণী পাওয়া যায় দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটি থেকে। তাঁর হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে প্রথমবার নিমতা ভাস্বর হয়ে ওঠে। (Krishnaram Das)

হরপ্রসাদ এ-ও জানাচ্ছেন, নিমতার মিত্রদের (সত্যেন্দ্রনাথের মাতুলালয়) বাড়ির ‘অতি নিকটে’-ই অবস্থিত কৃষ্ণরামের ভিটে। ১৯৪০ সালে প্রকাশিত ‘বাংলায় ভ্রমণ’ বইয়ে উল্লিখিত ‘কবি কৃষ্ণরামের জন্মভিটা আজিও নিমতা গ্রামে বর্তমান আছে।’

কৃষ্ণরামের ভিটে চিহ্নিত করা আজ আর সহজসাধ্য নয়। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে, একটি প্রবন্ধে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখছেন ‘…তিনি যখন জীবিত ছিলেন, তখন কবি বলিয়া তাঁহার খ্যাতি ছিল। কারণ, এখনো নিমিতা গ্রামে দুই-একজন লোক কবি কৃষ্ণরামের নাম করে, এবং তাঁহার ভিটা দেখাইয়া দেয়। সে ভিটায় এক শত বৎসরেরও অধিক কাল কেহ বাস করে না, অথচ প্রাচীন লোকেরা বলিয়া থাকেন— উহা কৃষ্ণরামের ভিটা। কৃষ্ণরামের বংশ নাই, কিন্তু তিনি নিজে নিঃসন্তান ছিলেন কিনা কেহ বলিতে পারে না।’
হরপ্রসাদ এ-ও জানাচ্ছেন, নিমতার মিত্রদের (সত্যেন্দ্রনাথের মাতুলালয়) বাড়ির ‘অতি নিকটে’-ই অবস্থিত কৃষ্ণরামের ভিটে। ১৯৪০ সালে প্রকাশিত ‘বাংলায় ভ্রমণ’ বইয়ে উল্লিখিত ‘কবি কৃষ্ণরামের জন্মভিটা আজিও নিমতা গ্রামে বর্তমান আছে।’ বর্তমানে সেই ভিটের হদিশ মেলা কষ্টসাধ্য। সাহিত্যিক বাসব দাশগুপ্ত জানান, দু-দশক আগে তিনিও কৃষ্ণরামের ভিটে খোঁজ করতে গিয়ে বিফল হয়েছিলেন। বস্তুত, দেশভাগ-পরবর্তী সময়ে নিমতার ভূমি ও জনবিন্যাস এত দ্রুত পাল্টেছে যে, তার কবলে পড়ে হারিয়েছে সেই ঠিকানাও। (Krishnaram Das)

Krishnaram Das
সত্যেন্দ্রনাথের মাতুলালয় থেকে কৃষ্ণরামের সম্ভাব্য জন্মস্থানের দূরত্ব, ঋণ – গুগল ম্যাপ

তারপরেও হাল ছাড়িনি আমরা। অজস্র স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে কৃষ্ণরামের ভিটে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালিয়েছি। বলা বাহুল্য, সাহায্য করতে পারেননি কেউই। অবশেষে নিমতার বাসিন্দা তপন দাস একটি স্থানের কথা বলেন এবং জানান, ওই স্থানেই কৃষ্ণরামের ভিটে অবস্থিত ছিল— ছেলেবেলা থেকে এমনটাই শুনে এসেছেন তিনি। পুরোটাই জনশ্রুতি, পরম্পরাবাহিত। ওঁর পথনির্দেশ অনুযায়ী সেই স্থানে উপস্থিত হই আমরা। নিমতার প্রবোধ মিত্র লেন থেকে একটা গলি ঢুকে গেছে পুকুরের দিকে, সামনে বিক্ষিপ্ত কিছু বাঁশঝাড়। পুকুরের শেষপ্রান্তে উঁচু পাঁচিল। সেইসঙ্গে পুকুর-সংলগ্ন ভূমিতে সামান্য উঁচু মাটির ঢিপি। তপন দাসের বক্তব্য অনুযায়ী, এখানেই ছিল কৃষ্ণরামের ভিটে। (Krishnaram Das)

Krishnaram Das
কৃষ্ণরাম দাসের সম্ভাব্য জন্মস্থান, ঋণ – গুগল আর্থ

স্থান চিহ্নিত করা গেলেও, ভিটের উপযুক্ত ফাঁকা জমি আজ আর বিশেষ অবশিষ্ট নেই, আশেপাশে উঠে গেছে বাড়ি। পুকুর-সংলগ্ন উঁচু পাঁচিলটি করঞ্জাই ভবনের, যা নির্মিত হয় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে। পাঁচিলের অপর প্রান্তে আরও একটি পুকুর। আমাদের অনুমান, এই দুই পুকুরের পার্শ্ববর্তী অংশেই ছিল কৃষ্ণরামের জন্মস্থান। পাঁচিলটি তাঁর ভিটে বিভক্ত করেছে, সেইসঙ্গে ভিটের অর্ধাংশ ব্যক্তিগত সম্পত্তির (করঞ্জাই ভবন) সীমায় ঢুকে পড়ায়, স্থানীয় জনমানস থেকেও ধীরে ধীরে মুছে গেছে স্মৃতি। উল্লেখ্য, আলোচ্য অবস্থান থেকে সত্যেন্দ্রনাথের মাতুলালয়ের দূরত্ব মাত্র ১৬০ মিটার, অর্থাৎ হরপ্রসাদ-কথিত ‘অতি নিকটে’-র সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। নিমতা আদি কালীবাড়ি থেকেও প্রায় সমদূরত্বেই অবস্থিত স্থানটি। ফলে, সবদিক বিবেচনা করে অনুমান, আমাদের চিহ্নিত স্থানেই (22°39’53.6″N 88°24’31.0″E) ছিল কৃষ্ণরামের ভিটে, বর্তমানে পুকুর-সংলগ্ন বাঁশঝাড় ও খানিক উঁচু ঢিপি ছাড়া যার বিশেষ কোনও অস্তিত্ব অবশিষ্ট নেই।(Krishnaram Das)

Krishnaram Das
কৃষ্ণরাম দাসের জন্মভিটের সম্ভাব্য অবস্থান

কৃষ্ণরামেরও শতাধিক বছর আগে আরেক বাঙালি কবি জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ কাব্যে (১৫৬০) ‘নিমদা’ নামের এক জনপদের উল্লেখ মেলে। সে-কাব্যে নিত্যানন্দের ধর্মপ্রচারের স্থানের একটি বিস্তৃত তালিকা দিয়েছিলেন জয়ানন্দ, সেখানেই উল্লেখ এর। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় একে নিমতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, সেই সূত্র ধরে বিভিন্ন আঞ্চলিক ইতিহাসকারও। কিন্তু হিতেশরঞ্জন সান্যালের মতে এটি ‘কাটোয়া হইতে মাইল চৌদ্দ দক্ষিণপূর্বে নিমদা’, অর্থাৎ পৃথক এক জনপদের দিকে ইঙ্গিত তাঁর। সম্ভাব্যতার বিচারে আমাদেরও মনে হয়, এটি হিতেশরঞ্জন-কথিত নিমদা-ই, নিমতা নয়। তবে নিত্যানন্দ নিকটবর্তী আড়িয়াদহ আগরপাড়া বরানগর প্রভৃতি জনপদে হাজির হয়েছিলেন— তা তর্কাতীত। ফলে, আলোচ্য নিমতাতেও তাঁর আগমন অস্বাভাবিক নয়। (Krishnaram Das)

১৮৬২ সালে শিয়ালদহ-কুষ্টিয়া রেলপথ চালু হওয়ার পর, স্টেশন তথা জনপদ হিসেবে বেলঘরিয়ার গুরুত্ব বাড়তে থাকে, ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বিভিন্ন শিল্পও। বিপরীতক্রমে, বেলঘরিয়াও পরিচিত হতে থাকে নিমতার পরিচয়ে।

নিমতার যে অতীত-গৌরব, গ্রাম হিসেবে সমৃদ্ধি, তা আহত হয় উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এক মহামারীতে। পরবর্তীতে, উনিশ-বিশ শতকের সন্ধিলগ্নে, ক্ষেত্রবিশেষে নিমতা পরিচিত হতে থাকে বেলঘরিয়ার নিকটবর্তী এক গ্রাম হিসেবে। তার কারণও সহজবোধ্য। ১৮৬২ সালে শিয়ালদহ-কুষ্টিয়া রেলপথ চালু হওয়ার পর, স্টেশন তথা জনপদ হিসেবে বেলঘরিয়ার গুরুত্ব বাড়তে থাকে, ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বিভিন্ন শিল্পও। বিপরীতক্রমে, বেলঘরিয়াও পরিচিত হতে থাকে নিমতার পরিচয়ে। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘বাংলায় ভ্রমণ’ বইতে দেখা যায়, বেলঘরিয়া সম্পর্কে এক লাইন মাত্র বরাদ্দ। বাদবাকি ‘স্টেশনের (বেলঘরিয়া) এক মাইল পূর্ব্বদিকে নিমতা গ্রাম কবি কৃষ্ণরামের জন্মস্থান।’ এর পর, কৃষ্ণরামের সাহিত্যকীর্তির সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এভাবেই, বিশ-শতকে পরস্পরকে সাক্ষী মেনে পরিচিত হয়েছে সংলগ্ন দুটি জনপদ। তবে নিমতা যে বেলঘরিয়ার থেকে প্রাচীনতর, তা বলাই বাহুল্য। উনিশ শতকের আগে, যখন বেলঘর বা বেলঘরিয়া গ্রামের বিশেষ উল্লেখ মেলে না, নিমতা ততদিনে সমৃদ্ধ এক জনপদ। (Krishnaram Das)

Krishnaram Das
নিমতা হাই স্কুল-সংলগ্ন সত্যেন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি

সেই সমৃদ্ধিরই দুই উল্লেখযোগ্য চরিত্র কৃষ্ণরাম দাস ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। দুজনের জন্মভিটেই আজ বিলুপ্ত। সত্যেন্দ্রনাথের ঠিকানাটি তাও সহজে চিহ্নিত করা যায়, সম্ভবত সাম্প্রতিককালের বলেই। কৃষ্ণরামের ভিটের অবস্থান সম্পর্কে দৃঢ় কোনও প্রমাণ না-থাকা সত্ত্বেও, আপাতভাবে একটি স্থানকে চিহ্নিত করতে পেরেছি আমরা। স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও প্রশাসনের উদ্যোগে ওই স্থানে একটি ফলক প্রতিষ্ঠা করা আশু কর্তব্য, যাবতীয় অনুমান ও সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই। নইলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অবশিষ্ট থাকবে না কোনও স্মৃতিই। সে-ক্ষতি কি শুধু নিমতারই, আপামর সাহিত্যপ্রেমী বাঙালিরও নয়? (Krishnaram Das)

ঋণ:
কালীচরণ মিত্র, সত্যেন্দ্রনাথের কথা, প্রবাসী, শ্রাবণ ১৩২৯
তন্ময় ভট্টাচার্য, গঙ্গা-তীরবর্তী জনপদ, মাস্তুল, ২০২৩
তন্ময় ভট্টাচার্য, বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে, পরিবর্ধিত সংস্করণ, ধানসিড়ি, ২০২১
দেবপ্রসাদ ভট্টাচার্য সম্পাদিত, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড, নাথ পাবলিশিং, ১৯৮১
বাংলায় ভ্রমণ, প্রথম খণ্ড, পূর্ব্ববঙ্গ রেলপথের প্রচার বিভাগ হইতে প্রকাশিত, ১৯৪০
ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রামরাম বসু, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৩৪৭
মৌমিতা সাহা, স্বদেশী দমদম ১৭৪৭-১৯৪৭: প্রাক স্বাধীনতা পর্বে সামাজিক বিবর্তনে দমদমের অবদান, দেশকাল, ২০১৯
সত্যেন্দ্র কাব্যগুচ্ছ, সাহিত্য সংসদ, ১৯৬৪
রীতা মিত্র, বাসব দাশগুপ্ত, তপন দাস, মৌমিতা সাহা ও সুবর্ণকান্তি উত্থাসনী
ছবি: লেখক

Author Tanmoy Bhattacharjee
তন্ময় ভট্টাচার্য

জন্ম ১৯৯৪, বেলঘরিয়ায়। কবি, প্রাবন্ধিক ও স্বাধীন গবেষক। প্রকাশিত বই: বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে (২০১৬), আত্মানং বিদ্ধি (২০১৮), বাংলার ব্রত (২০২২), অবাঙ্‌মনসগোচর (২০২৩), বাংলার কাব্য ও মানচিত্রে উত্তর চব্বিশ পরগনা ও হুগলি জেলার গঙ্গা-তীরবর্তী জনপদ (২০২৩) ইত্যাদি। সম্পাদিত বই: না যাইয়ো যমের দুয়ার (ভ্রাতৃদ্বিতীয়া-বিষয়ক প্রথম বাংলা গ্রন্থ), দেশভাগ এবং (নির্বাচিত কবিতা ও গানের সংকলন), সুবিমল বসাক রচনাসংগ্রহ (২ খণ্ড)।

Picture of তন্ময় ভট্টাচার্য

তন্ময় ভট্টাচার্য

জন্ম ১৯৯৪, বেলঘরিয়ায়। কবি, প্রাবন্ধিক ও স্বাধীন গবেষক। প্রকাশিত বই: বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে (২০১৬), আত্মানং বিদ্ধি (২০১৮), বাংলার ব্রত (২০২২), অবাঙ্‌মনসগোচর (২০২৩), বাংলার কাব্য ও মানচিত্রে উত্তর চব্বিশ পরগনা ও হুগলি জেলার গঙ্গা-তীরবর্তী জনপদ (২০২৩) ইত্যাদি। সম্পাদিত বই: না যাইয়ো যমের দুয়ার (ভ্রাতৃদ্বিতীয়া-বিষয়ক প্রথম বাংলা গ্রন্থ), দেশভাগ এবং (নির্বাচিত কবিতা ও গানের সংকলন), সুবিমল বসাক রচনাসংগ্রহ (২ খণ্ড)।
Picture of তন্ময় ভট্টাচার্য

তন্ময় ভট্টাচার্য

জন্ম ১৯৯৪, বেলঘরিয়ায়। কবি, প্রাবন্ধিক ও স্বাধীন গবেষক। প্রকাশিত বই: বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে (২০১৬), আত্মানং বিদ্ধি (২০১৮), বাংলার ব্রত (২০২২), অবাঙ্‌মনসগোচর (২০২৩), বাংলার কাব্য ও মানচিত্রে উত্তর চব্বিশ পরগনা ও হুগলি জেলার গঙ্গা-তীরবর্তী জনপদ (২০২৩) ইত্যাদি। সম্পাদিত বই: না যাইয়ো যমের দুয়ার (ভ্রাতৃদ্বিতীয়া-বিষয়ক প্রথম বাংলা গ্রন্থ), দেশভাগ এবং (নির্বাচিত কবিতা ও গানের সংকলন), সুবিমল বসাক রচনাসংগ্রহ (২ খণ্ড)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com