(Single Screen)
ঝাঁ চকচকে মলের সামনে রত্নেশ্বর বোমকে গেল। চারিদিকে আলো আর আলো। এত আলোয় তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এসি ক্যাবের ড্রাইভার ছোকরা করিতকর্মা।
“কাকু এখানে নামবেন না, আমি একবারে পিছনের দিকে লিফটের কাছে নামিয়ে দিচ্ছি– মাল্টিপ্লেক্স যাবেন তো?”
রত্নেশ্বরের আবার অবাক হওয়ার পালা। জানল কী করে ছেলেটা যে সে আর ঝর্ণা আজ বহু বছর বাদে মাল্টিপ্লেক্সে রি-রিলিজ হওয়া একটা ছবি দেখতেই এসেছে! ভাবনাটা বসার আগেই ছানা কেটে গেল। বেশ কায়দা কসরত করে, একটা বাঁক নিয়ে গাড়িটা মলের পিছনের দিকে চলে এল। (Single Screen)
“কাকু এখানে নামবেন না, আমি একবারে পিছনের দিকে লিফটের কাছে নামিয়ে দিচ্ছি– মাল্টিপ্লেক্স যাবেন তো?”
“কাকু অনলাইন তো?”
এই হয়েছে মুশকিল! রত্নেশ্বর এতদিন ব্যাঙ্কে চাকরি করেও আজ অবধি এই অনলাইনের ব্যাপারটায় ঠিক ভরসা করতে পারে না। টেনেটুনে ক্রেডিট কার্ড অবধি এগিয়েছে বটে, কিন্তু এখনও চেক আর ক্যাশের ওপর তার ভীষণ মায়া। পেনশনের টাকা আনতে গেলে টেলার কাউন্টারের মেয়েটি মিষ্টি হেসে আনকোড়া নতুন নোট এগিয়ে দেয়। পরের মাস পয়লা অবধি দেখে শুনে খরচ করে সেগুলো।
“না ভাই আমি ক্যাশেই দেব– কত যেন হয়েছে?”
“এই তো একশ বাষট্টি…”
মানিব্যাগের তিন নম্বর পকেটে রাখা– কড়কড়ে দু’শ টাকার নোট আর একটা দুটাকার চকচকে কয়েন বাড়িয়ে দিল রত্নেশ্বর সামনের জানালা দিয়ে। (Single Screen)

“কাকু খুচরো তো নেই।”
“এই তো দু’টাকা খুচরো দিচ্ছি বাপু, চল্লিশ টাকা ফেরত দিতে পারবে না?”
“সেই দুপুরে গাড়ি বের করেছি। সবাই তো অনলাইন করছে। এই দেখুন না খানিক আগে কুড়ি টাকার ঝালমুড়ি খেতে গিয়ে কী বিপত্তি। ইউপিআই নাকি চটকে গেছে, পকেটে পইসা নেই, কী ঝামেলা মুড়িওয়ালার সঙ্গে…”
“দেখো তো একটা একশ হবে নাকি, আমার কাছে মনে হয় ষাট হয়ে যাবে”।
প্রশ্নটা করে রত্নেশ্বর এবার করুণ দৃষ্টিতে তাকায় ঝর্ণার দিকে। কারণ সে জানে ঝর্ণার এই ব্যাগটা মোটামুটি একটা গোলকধাঁধা। খাপ, পকেট, তস্য পকেট এবং তার সঙ্গে দু’এক পিস ছোট মাঝারি পার্স নিয়ে সে এক ভারী জটিল ব্যাপার। সুইস ব্যাঙ্কের চেয়েও নিশ্ছিদ্র সুরক্ষা আর নিরাপত্তার মধ্যে বসবাস করে ঝর্ণার ধন দৌলত। এর হদিশ তার নিজেরও অজানা। ছেলেটা এবার বুঝল ব্যাপারটা এত সহজে মেটার নয়। গাড়িটাকে একটা দেওয়ালের পাশে সাইড করে দাঁড় করাল সে। (Single Screen)
ছেলেটা এবার বুঝল ব্যাপারটা এত সহজে মেটার নয়। গাড়িটাকে একটা দেওয়ালের পাশে সাইড করে দাঁড় করাল সে।
বেশ খানিকক্ষণের চেষ্টায় অবশেষে ভাড়া চুকিয়ে রত্নেশ্বর আর ঝর্ণা ঢুকে পড়ল মলের প্রথম তলায়। আর দু’চারদিন পেরুলেই বাংলা নববর্ষ। ভিড়ে ভিড়াক্কার চারিদিকে। এখানে তারা আগে কখনও আসেনি। তাই মাল্টিপ্লেক্স কোন তলায় বুঝতে সময় লাগল। লিফট খুঁজে তাতে চেপে পৌঁছনো গেল দু’তলায়। এদিক সেদিক করে কোনওরকমে তারা এসে দাঁড়ায় টিকিট কাউন্টারের সামনে। কাচের জানালায় কচি একটা মেয়ের মুখ, লাল টি শার্টে বেশ সপ্রতিভ।
“গুড ইভিনিং স্যার, হাউ ক্যান আই হেল্প ইয়ু?”
পঁয়ষট্টি পেরুনো রত্নেশ্বর প্রথমে বুঝতেই পারল না মেয়েটার গলাটা এরকম অদ্ভুত শোনাল কেন। খেয়াল করে দেখল মিসিবাবা্র গলা আসছে একটা স্পিকারের ভিতর থেকে যেটা কাচের ওপরে লাগানো। (Single Screen)
আরও পড়ুন: বদলে যাওয়া সংলাপের ভাষা
“হ্যাঁ, ইয়ে মানে– আমার ঐ নাইট শোয়ের দু’টো টিকিট লাগবে…”
“স্যার ক্যান আই হ্যাভ দ্য মুভি নেম এন্ড শো টাইম?”
তাই তো আগের মতো আর এখন সেই নুন, ম্যাটিনি, ইভিনিং, নাইটের বিভাজন নেই। সারাদিনের মতো দরজা খুলে বসেছে সিনেমা হল, আধ ডজন ছবির পসরা সাজিয়ে। চার পাঁচখানা হল (আজকের ভাষায় “স্ক্রিন”) জুড়ে চলেছে বিনোদনের যজ্ঞশালা। সুতরাং শো টাইম আর সিনেমার নাম বাতলাতে হবে। বলল রত্নেশ্বর।
“স্যার– দুটো টিকিট টোটাল ফোর হান্ড্রেড; একটা স্পেশাল এফ এন্ড বি অফার আছে– একটা পপকর্ণ বাকেট আর দুটো কোল্ড ড্রিঙ্ক– এক্সট্রা থ্রি হান্ড্রেড, অ্যাড করে দেব স্যার?” (Single Screen)
সারাদিনের মতো দরজা খুলে বসেছে সিনেমা হল, আধ ডজন ছবির পসরা সাজিয়ে। চার পাঁচখানা হল জুড়ে চলেছে বিনোদনের যজ্ঞশালা।
(Single Screen) কাচের এপারে আঁতকে উঠল রত্নেশ্বর! বলে কী বাংলা ছবি, তাও পুরনো– দু’শ টাকা টিকিটের দাম, তারপরে আবার বলছে বালতি ভরা হাওয়ায় ওড়া পপকর্ণ, সেও দেড়শ টাকা। এক ঝলকে “পদ্মশ্রী” হলের সামনে হাবুলের দোকানের কথা মনে পড়ল রত্নেশ্বরের। হাবুল শুরু করেছিল পান, সিগারেট, পটাটো চিপস, লজেন্স, চানাচুর, বাদাম আর কোল্ড ড্রিঙ্ক বিক্রি করে। হাফ টাইমের আলো জ্বললেই সে একটা ঝুড়িতে চিপস, চানাচুর আর বাদামের প্যাকেট নিয়ে হানা দিত হলের ভিতরে। নিমেষে বিকিয়ে যেত। পরের দিকে হাবুল নানা ধরণের চপ আর রোল বেচা শুরু করল। তখন অনেকেই সে সব খাবার কিনে নিয়ে আসত হলের ভিতরে। গন্ধে মাতোয়ারা চারদিক আর তার সঙ্গে ঠোঙার খচমচ শব্দ। কেউ কিছু মনে করত না। সব্বাই মন দিয়ে সিনেমা দেখত। (Single Screen)
হঠাৎ রত্নেশ্বর দেখতে পায় কালুদাকে। এই মল থেকেই একটু এগিয়ে গেলে “নবীনা” হলের সামনে, বহু লোকের ভিড়। “ম্যাকেনাস গোল্ড” লেগেছে আজ এক হপ্তা হল।
কাউন্টারের নীচের ফোঁকর দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেওয়া টাকার বদলে টিকিট পেল রত্নেশ্বর। দুটো লম্বা মতো কাগজ। অনলাইনে টিকিট কাটলে নাকি এই একরত্তি কাগজও পাওয়া যায় না। ওটা পরিবেশ বান্ধব হয়ে ওঠার উপায়। সিনেমা শুরু হতে দেরি আছে। এক নম্বর হলে, থুড়ি স্ক্রিনে, তাদের ছবি। রত্নেশ্বর আর ঝর্ণা এসে বসে দুটো গদি আঁটা চেয়ারে। পকেট থেকে টিকিট দু’টো বার করে চোখের সামনে ধরে। হঠাৎ রত্নেশ্বর দেখতে পায় কালুদাকে। এই মল থেকেই একটু এগিয়ে গেলে “নবীনা” হলের সামনে, বহু লোকের ভিড়। “ম্যাকেনাস গোল্ড” লেগেছে আজ এক হপ্তা হল। প্ল্যান মতো আজ স্কুলে টিফিনের পরে পরেই জ্বর এসেছে তিনজনের– রত্নেশ্বর, ইন্দ্র আর জয়দীপের। ক্লাস টিচার বাঙলার অজয়বাবু ভারী চিন্তিত হয়ে পড়লেন। (Single Screen)

‘সেকি! না না বাপুরা তোমরা বাড়ি যাও– আমি হেড দিদিমণি কে বলে দেব’খন।”
তিনটের শো শুরু হতে এখনও মিনিট কুড়ি বাকি। ভাঙা কাউন্টারের গ্রিলে ঝুলছে হাউজ ফুল বোর্ড। অ্যাডভান্স কাউন্টারে পরের শো-এর টিকিট পাওয়া গেলেও বাড়ি ফেরবার তাড়া থাকবে, হবে না। যা করার এক্ষুনি করতে হবে। কে যেন কানের কাছে ফিস্ফিসিয়ে বলে “ব্যালকনি হবে, সাড়ে তিনেরটা দশ, লিবে?”
তিনটের শো শুরু হতে এখনও মিনিট কুড়ি বাকি। ভাঙা কাউন্টারের গ্রিলে ঝুলছে হাউজ ফুল বোর্ড।
এক ঝলক দৃষ্টি দেওয়া নেওয়া– মিশকালো দাঁতের মুচকি হাসি। নোংরা পকেটের ভাঁজে মোড়ানো সবুজ পাতলা টিকিট তিনটে কালুদা হাতে দেয় রত্নেশ্বরের। তিনটে দশ টাকার নোট নিয়ে মুহূর্তে মিলিয়ে যায় ভিড়ের মাঝে। সে বয়েসে ব্যালকনিতে বসে সিনেমা দেখা মানে বিলাসিতা। কিন্তু গ্রেগরি পেক আর ওমর শারিফের জন্য এটুকু করা যেতেই পারে। আদপে একজন টিকিট ব্ল্যাকার ছিল কালুদা। পরের দিকে পরিচয় হয়ে যাওয়াতে রত্নেশ্বর জানত কালুদা যতদিন আছে কোনও হাউজ ফুল্ বোর্ড তার জন্য বাধা হতে পারে না। যেদিন কালুদার ব্যবসা ভাল হত না সেদিন সে বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে থাকত টিকিট ঘরের এক কোণায়। চোখে চোখ পড়তেই ম্লান হাসি হেসে বলত “একটা টাকা দিবি, চা খাব!”
কোনওরকমে নাকে মুখে গুঁজে হলে পৌঁছনো গেছে এক্কেবারে ‘কাটিং’ থেকে দেখতে হবে। কী কারণে ছবির ট্রেলারকে তখন কাটিং বলা হত জানা নেই।
(Single Screen) কেমন যেন আপনার লোক ছিল সে।
“চল চল, লোকজন ঢুকছে ভিতরে”, তাড়া দেয় ঝর্ণা ।
সিটে ধপ করে বসে পড়ল রত্নেশ্বর। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বেশ মায়াময় একটা অনুভুতি। সিটের গদিতে তলিয়ে গিয়ে টের পেলেন আরামের আতিশয্য। ধবধবে পর্দায় ঝক ঝকে ছবি। মন আবার ফিরল পাড়ার সেই পুরোনো হলে। সাঁই সাঁই করে ঘুরছে দুদিকের দেওয়ালে লাগানো পাখাগুলো। কোনওরকমে নাকে মুখে গুঁজে হলে পৌঁছনো গেছে এক্কেবারে ‘কাটিং’ থেকে দেখতে হবে। কী কারণে ছবির ট্রেলারকে তখন কাটিং বলা হত জানা নেই। তারপরেই ফিল্মস ডিভিশনের ছবি, নিউজ রিল, যত নিরস, অপ্রয়োজনীয় সরকারী কাম কাজের সালতামামি আর খতিয়ান। মনের মাঝে তখন ঝর্ণার জলে খেলা করে কারেন লুনেল, লিরিল যৌবন পর্দা জুড়ে সাঁতার কাটে। সাদা পর্দার রঙ মনের গভীরে সুনামির জন্ম দেয়। (Single Screen)
তবে বলতে নেই এই ফিল্মস ডিভিশনই একবার বাঁচিয়েছিল সমূহ বিপদের হাত থেকে। অমিতাভ, রাখি আর বিনোদ মেহেরার ‘বেমিসাল’ ঝড়ে কলকাতা তখন কাবু । রত্নেশ্বর চুপি চুপি তীর্থ স্যারের কোচিং কেটে পৌঁছে গেল ‘কালিকা’ হলে । সে হলের ভিতরে উড়ে বেড়ায় রাশি রাশি পায়রা । প্রজেকশন শুরু হলেই ছবির আলোপথ ধরে তাদের ওড়াওড়ি লেগেই থাকত। কিন্তু ভবানিপুর চত্বরে, সস্তায় হিন্দি সিনেমা দেখবার অমন হল আর দুটি নেই। টিকিট কেটে সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরার পথে কিশোর– লতার গানের সুর তখনও মাথার মধ্যে হুটোপুটি করছে। “আমি সে ও সখা”–র উত্তম ভাল, না “বেমিসাল”–র অমিতাভ? ট্রামের ফার্স্ট ক্লাসে বসে ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফেরা। বাড়ির গলির মুখে ছোট বোন দোলার সঙ্গে দেখা। (Single Screen)
মুহূর্তে মাথা খুলে গিয়েছিল রত্নেশ্বরের। বাবার প্রশ্ন তাকে বেকায়দায় ফেললেও কাদায় ফেলতে পারেনি। কালিকায় নাকি পাঁচ মিনিটের নিউজ রিল দেখাচ্ছে। সেখানে এশিয়ান গেমসের রঙিন ছবি দেখতেই টিকিট কেটে ঢোকা আর বেরুনো!
গোল গোল চোখ কপালে তুলে সে শুধোয় “দাদা করেছিস কি তুই?”
পেট কামড়ে ওঠে রত্নেশ্বরের।
“তুই কালিকায় কী বই দেখছিলি রে দাদা? বাবার ড্রাইভার তেওয়ারি তোকে টিকিট হাতে ঢুকতে দেখেছে সেই কখন… বাবাকে মনে হয় বলে দিয়েছে খবরটা– বাবা কিন্তু খুব আপসেট– গম্ভীর মুখে বসে আছে!”
মুহূর্তে মাথা খুলে গিয়েছিল রত্নেশ্বরের। বাবার প্রশ্ন তাকে বেকায়দায় ফেললেও কাদায় ফেলতে পারেনি। কালিকায় নাকি পাঁচ মিনিটের নিউজ রিল দেখাচ্ছে। সেখানে এশিয়ান গেমসের রঙিন ছবি দেখতেই টিকিট কেটে ঢোকা আর বেরুনো! (Single Screen)

খেয়াল করেনি রত্নেশ্বর। “আরে ওঠ ওঠ, ন্যাশানাল এন্থেম হবে এবার”, একটা ঝটকা দিল ঝর্ণা বাঁপাশ থেকে। খুব সিরিয়াস মুখ করে মানুষজন দাঁড়িয়ে। রত্নেশ্বরের মনের কোণে উঁকি দিল রাঙাদাদুর কথা। সে সময় শো -এর শেষে জাতীয় সঙ্গীত বাজত। শীতের রাতে নাইট শো দেখে সবার তখন বাড়ি যাওয়ার তাড়া। কে আর অপেক্ষা করে? স্বদেশী করে জেল খাটা রাঙাদাদু টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন পর্দার সামনে। তাঁর চোখ মুখ উদ্ভাসিত। গান শেষ হলে দু’হাত কপালে তুলে প্রণাম করেন, তারপর ধীরে বেরিয়ে যান হল থেকে। আস্তে আস্তে ঝালর দেওয়া পর্দা নেমে আসে দিনের শেষে। (Single Screen)
রাঙাদাদু টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন পর্দার সামনে। তাঁর চোখ মুখ উদ্ভাসিত। গান শেষ হলে দু’হাত কপালে তুলে প্রণাম করেন, তারপর ধীরে বেরিয়ে যান হল থেকে।
শুরু হয় বিজ্ঞাপনী অত্যাচার। সারা পৃথিবীর হরেক মালের পাবলিসিটি করবার দায়িত্ব কি এই হলের, ভাবে রত্নেশ্বর! লক্ষ্মণের শক্তিশেলের সেই ধ্যা রা রা রা – ধ্যা রা রা রা- চলেছে যেন রেকারিং ডেসিমাল! কী নেই তাতে? হরেক মাল, হরেক চিজ– দেখুন, বাছুন, কিনুন। বড় পর্দা জুড়ে “লিভ লাইফ কিং সাইজ” এর বার্তা। আচ্ছা সিনেমার আগে বিজ্ঞাপন দেখানোর কি কোন নিয়মমাফিক সময়সীমা নেই? কে ঠিক করে এইসব? ভারী বিরক্ত লাগছে রত্নেশ্বরের। এখনও লোকজন এসেই চলেছে হলের ভেতর। স্ক্রিনের ওপরে একগাদা ছেলে মেয়ে অনবরত নেচে কুঁদে মাথা খারাপ করছে। চোখ ধাঁধানো ছবি– কান ফাটানো গান– আর ন্যাকা পুশু মার্কা ডায়লগ। (Single Screen)
“এক্সকিউস মি!”
অন্ধকারের মধ্যে দুটি সুবেশা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ায় রত্নেশ্বরের সামনে; তাদের মুঠোফোনের টর্চের আলো এসে পড়ে চোখে।
“আঙ্কেল, আমাদের বসার সীট দ্যাট সাই ডে !”
কথাটা কানে লাগে রত্নেশ্বরের। বাংলা ছবি দেখতে এসেছে– তবে বাঙালি নিশ্চয়ই। তো এরকম হাত পা ভাঙা বাংলা বলে কেন? রীতিমত পায়ে পায়ে ধাক্কা মেরে এগিয়ে গেল মেয়ে দুটি। পর মুহূর্তেই সেন্সরের সার্টিফিকেট ভেসে উঠল স্ক্রিন জুড়ে। নাম পড়ে বোঝা গেল, এতক্ষণে বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে। (Single Screen)
অন্ধকারের মধ্যে দুটি সুবেশা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ায় রত্নেশ্বরের সামনে; তাদের মুঠোফোনের টর্চের আলো এসে পড়ে চোখে।
(Single Screen) নয় নয় করে পঞ্চাশ বছর। সেই ১৯৭৪। কর গুণে দেখল রত্নেশ্বর ক্লাস থ্রিয়ের গণ্ডি পার হয়নি তখনও। বড় পর্দায় ‘গুগাবাবা’ আর ‘পথের পাঁচালী’ দেখা হয়েছে ততদিনে। ‘মহারাজা তোমারে সেলাম’ গলায় উঠেছে। কেউ গান গাইতে বললেই হাড়িচাঁচার মতো ওই গান শোনানোই হয়ে উঠেছিল দস্তুর। কী কান্ড করেছে পথের পাঁচালী বিশ্বজুড়ে জানা হয়নি তখনও। কিন্তু পর্দার এপার ওপার জুড়ে কালো ধোঁয়া ছাড়া ইঞ্জিন দেখে মন খুশিতে ভরে গেছে। না, ফেলু মিত্তিরের সঙ্গে সেভাবে পরিচয় হয়নি রত্নেশ্বরের, যদিও সে আত্মপ্রকাশ করেছে রত্নেশ্বর জন্মাবার এক বছর আগেই, সন্দেশের পাতায়। সোনার কেল্লা মুক্তি পেল ১৯৭৪ এর ডিসেম্বরে, দেখা হল ১৯৭৫ এর জানুয়ারিতে। শীতের ছুটিতে। একবার নয়। বারবার, অন্তত পাঁচবার তো বটেই। সে সময় রঙিন ছবি যেটুকু যা দেখা যেত তা বেশিরভাগই হয় ইংরেজি অথবা হিন্দি। হিন্দি সিনেমা দেখলে ছেলে গোল্লায় যাবেই যাবে সুতরাং ও পথ মারিওনি বাপু। আর ইংরেজি ছবি দেখতে হলে যেতে হত সাহেবপাড়ায়, থাকতে হবে রেস্তর জোর। অপ্রাপ্ত আর প্রাপ্ত বয়স্কের সূক্ষ্মসীমা মেপে জুপে ফিল্ম বাছা। ব্যাপারটা জটিল। (Single Screen)
আরও পড়ুন: প্রতিবেশী: চলচ্ছবির প্রতিবেশীরা
এ সবের মধ্যেই সোনার কেল্লা একটা খোলা হাওয়া। স্মার্ট, ঝকঝকে রঙিন ছবি। ফেলুদা, তোপসে, জটায়ু, সিধুজ্যাঠা, ভবানন্দ, হাজরা এবং অবশ্যই জাতিস্মর মুকুলের চরিত্র বৈচিত্র্য। অদেখা রাজস্থান- তার কেল্লা, বালিয়াড়ি, সোনার পাথরবাটি, লোকগানের মন-কেমন-করা সুর আর উটের পাল মনের মাঝে দাগ কাটে। এর এক বছর আগেই রত্নেশ্বর বাবার হাত ধরে “ইন্দিরা”তে দেখে এসেছে “পথের পাঁচালী”। “সোনার কেল্লা” দেখে তার মনের মাঝে অজপাড়াগেঁয়ে নিশ্চিন্দিপুর আর জনমানবহীন রাজস্থানের ঊষর প্রান্তর মিলেমিশে যায়। আকাশের গায়ে কালো ধোঁয়ার আঁকিবুঁকি কাটে ধাবমান লৌহদানব স্টিম ইঞ্জিন। তফাৎ শুধু এটুকু– একটা সাদা কালো ক্যানভাস– অপরটা রঙিন। (Single Screen)

আজ এত বছর পরে এই বদলে যাওয়া সময়ে, মাল্টিপ্লেক্সের অন্ধকারে রত্নেশ্বর হেঁটে চলেছে অপু আর মুকুলের হাত ধরে। তিনজন যেন খুঁজতে বেড়িয়েছে তাদের ফেলে আসা দিন। সে দিনগুলো হয়তো ডিজিটাল প্রিন্টের মতো এত ঝকঝকে নয়, তাদের বুক জুড়ে সময়ের আঁচড় পর্দার ওপরে আঁকিবুঁকি হয়ে ফোটে পলে-অনুপলে। সব কিছু ছাপিয়ে বার বার সে প্রতিধ্বনি শোনে “মিস্টেক মিস্টেক- তুমি দুষ্টু লোক, তুমি দুষ্টু লোক…!” (Single Screen)
যে সময়ে আমাদের চাওয়া–পাওয়ার হিসেব ছিল অন্যরকম, সাদা সিধে। মুকুলের মতোই বোধহয় জাতিস্মর আমরা– পর জন্মের নয়, এ জন্মেরই!
ষাট পেরোনো রত্নেশ্বর বোঝবার চেষ্টা করে কার ভুল, কেই বা দুষ্টু লোক। বয়স হলে অন্য অনেক দোষের সঙ্গে নস্টালজিয়ার চাপ বাড়ে। উৎসাহ বসত মাঝে মধ্যেই চরিত্রের মুখে সংলাপ আসবার আগে রত্নেশ্বর তা বলে ফেলছে, আবহ সঙ্গীতের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গেয়ে উঠছে হঠাৎ! পিছনে বসা এক ষোড়শী, সঙ্গে তাঁর মা– বোধহয় খানিক বিরক্তই হচ্ছে থেকে থেকে। কী করে রত্নেশ্বর বোঝায় তাঁদের, আমরা ঠেকে গেছি ভাই– সময়ের কাছে ঠেকে গেছি। যে সময়টা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে আমাদের। যে সময়ে আমাদের চাওয়া–পাওয়ার হিসেব ছিল অন্যরকম, সাদা সিধে। মুকুলের মতোই বোধহয় জাতিস্মর আমরা– পর জন্মের নয়, এ জন্মেরই! (Single Screen)
Image Source: Canva royalty free images
সপ্তর্ষি রায় বর্ধনের জন্ম, কর্ম এবং বর্তমান ঠাঁই তার প্রাণের শহর কলকাতায়। প্রথাগত ছাত্রজীবন কেটেছে কলকাতার পাঠভবন স্কুল, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে। লেখাজোকা, ছবি তোলা, নাট্যাভিনয় আর হেরিটেজের সুলুক সন্ধানের নেশায় মশগুল। সঙ্গে বই পড়া, গান বাজনা শোনা আর আকাশ পাতাল ভাবনার অদম্য বাসনা। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন- "রূপকথার মতো- স্মৃতিকথায় প্রণতি রায়", "খেয়ালের খেরোখাতা" এবং "চব্য চোষ্য লেহ্য পেয়"।