(Motherland)
পৃথিবীর যে কোণেই আমরা যাই না কেন, ফিরি কিন্তু শুধুমাত্র বাড়িতেই। ‘ফেরা’ শব্দের ভেতর আকুতি জমা, যেন হু-হু করে উঠবে বুক। অথবা মন ভালো করা হাওয়ার ঝাপট এসে লাগে। ‘ফেরা’ শব্দের ভেতর মাতৃস্নেহ। পিছুটান। আমরা সকলেই কোথাও না কোথাও ফিরি, কারণ, আমাদের ফিরতে হয়। বাংলা ভাষার মাধুর্যের কাছে। এই আমাদের একমাত্র অহংকার। এই ভাষাতেই তাই ‘বাড়ি’ হয়ে ওঠে একটা আস্ত দেশ। যে যার মতো করে তাঁর বাড়ি ফিরতে চান। নিজের বাড়ি। (Motherland)
আরও পড়ুন: বদলে যাওয়া সংলাপের ভাষা
যাঁদের মাথার ওপর ছাদ আছে, তাঁর কাছে জীবন শুধু জীবন নয়, সব পেয়েছির দেশ। যারা পড়াশোনা বা অন্যান্য পেশার সূত্রে বাড়ি ছাড়া, তাঁরা বোঝেন বাড়ি ফেরার মর্ম। এ কেবল কোনও ভৌগলিক যাত্রা নয়, মাতৃভূমিতে ফেরা। বাড়ি ফেরার মতো এক শিকড়ের টানের অনুভূতি নিয়েই জন্ম আমাদের। তাই মৃত্যুকালে পৃথিবীর যেকোনও কোণা থেকে তুলে একবার অন্তত মাতৃভূমি স্পর্শ করানো, রেওয়াজ আমাদের। যে মাটিতে জন্ম, সেই মাটিতেই মৃত্যুর শান্তি। (Motherland)
এই দেশ রাজনীতিবিদদের তৈরি করা কাঁটাতার ঘেরা ভূখণ্ড নয়, এই দেশ হতে পারে এক নির্জন গ্রাম, একটা এলাকা, একটি পাড়া, কোনও এক উঠোন কিংবা কেবল একটি ঘর। আবার কখনও শুধু মায়েরাও হয়ে ওঠেন স্বতন্ত্র দেশ।
এবার আসা যাক এক প্রচলিত প্রশ্নের দিকে, যাঁরা কর্মসূত্রে বাড়ি ছাড়া, তাঁদের প্রতিনিয়ত শুনতে হয়, “তোমার দেশের বাড়ি কোথায়?”
এই দেশ রাজনীতিবিদদের তৈরি করা কাঁটাতার ঘেরা ভূখণ্ড নয়, এই দেশ হতে পারে এক নির্জন গ্রাম, একটা এলাকা, একটি পাড়া, কোনও এক উঠোন কিংবা কেবল একটি ঘর। আবার কখনও শুধু মায়েরাও হয়ে ওঠেন স্বতন্ত্র দেশ। ‘মা’ এমন এক দেশ, যেখান থেকে আমরা শিখে চলি ইশারা, ভাষা। পড়াশোনা করে বিদ্যান হই; আমার দেশমাতৃকা অন্ন জোগান। দেশ কি তাহলে কোনও আশ্রয়ের নাম? কর্মসূত্রে ঘর ছাড়া মানুষগুলিই জানেন কীভাবে একটা ঘর নিমেষে এক দেশ হয়ে ওঠে… (Motherland)
ঋত্বিক ঘটক ওঁর চলচ্চিত্রে বারবার মাতৃকল্প বা মাদার আর্কেটাইপকে ভেঙেছেন, গড়েছেন। ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-তে বঙ্গবালা ঋত্বিকের চোখে দেশ-মা। তার চেয়েও বড় কথা বাংলা মা। খণ্ডিত বাংলার প্রতীক এক বাংলা মা-কে কল্পনা করে নিয়েছিলেন ঋত্বিক, যে মাতৃরূপটি ওঁর ছবিতে আদিমাতার এক রূপকল্প হয়ে ফিরে আসে বারবার। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ কখনও দেখি তাঁর কল্যাণী জগদ্ধাত্রী রূপ, ‘সুবর্ণরেখা’-য় তিনি হয়ে ওঠেন ধ্বংসের কালী। ভাঙা দেশের মন বা মানচিত্রকে জোড়া লাগানোর উপকরণ হিসেবে ঋত্বিক বেছে নিয়েছিলেন ‘মা’-কে। তাঁর কাছেও মা সেই খণ্ডিত দেশেরই প্রতীক। (Motherland)
মাতৃভূমির প্রতি টান হয়তো শেকড়ে ফিরতে চাওয়ারই চিরন্তন বাসনা। একসময় মাটির বাড়িতে থাকা যেমন দৈনন্দিন যাপনের অঙ্গ ছিল, এখন সেই মাটির বাড়িই বিলাসিতা। প্রভূত অর্থ ব্যয় করে নিছক শখের বশে মানুষ মাটির বাড়িতে বাস করতে যান আজকাল।
মাতৃভূমির প্রতি টান হয়তো শেকড়ে ফিরতে চাওয়ারই চিরন্তন বাসনা। একসময় মাটির বাড়িতে থাকা যেমন দৈনন্দিন যাপনের অঙ্গ ছিল, এখন সেই মাটির বাড়িই বিলাসিতা। প্রভূত অর্থ ব্যয় করে নিছক শখের বশে মানুষ মাটির বাড়িতে বাস করতে যান আজকাল। শুধু কি তাই? স্টাডি বা ডাইনিং রুমে সিলিং বেয়ে ঝুলে পড়ছে হ্যারিকেন, ফিরছে হাত পাখা, মোড়া, আসন, মাদুরের মতো এক সময়ের দৈনন্দিন সামগ্রী। বাঙালির আবেগে ঘা দেওয়ার থেকেও এ-ছবি জানান দেয় শেকড়ের টানের মাধুর্য আসলে কোথায়। এও সেই পাকেচক্রে মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়া। (Motherland)

বিশ্ব যখন নিদ্রামগন, গগন অন্ধকার,
কে দেয় আমার বীণার তারে এমন ঝঙ্কার
নয়নে ঘুম নিল কেড়ে, উঠে বসি শয়ন ছেড়ে-
মেলে আঁখি চেয়ে থাকি, পাই নে দেখা তার
জীবনের চিরকালীন ওঠাপড়ায় যাঁরা নিরাপদ স্থান খোঁজেন, এ-বিশ্বব্যাপী ঘুরেও কোনও নিরাপত্তা পান না, তাঁরা হয়তো সেই ঘরেই ফিরতে চান। নিরাপদের সমস্ত সংজ্ঞা ওই চার দেওয়ালে বন্দি। কিন্তু যাঁদের মাথার ওপর ছাদ নেই? ছিন্নমূল সেই মানুষগুলো জানেন তাঁদের মাথার ওপর খোলা আকাশ হাজার স্বপ্নের সাক্ষী। ওই যে দূরের চাঁদ, তার আলো কি শুক্রগ্রহেও পৌঁছায়? বাস্তুহারা সেই মানুষের স্বপ্নে জ্যোৎস্না আলো দেয়, আঁচল পেতে দেয়। মা যেখানে হাঁটে, বাড়ি হয়ে ওঠে সেই উঠোনই। রাজপ্রাসাদ হোক, অথবা ফুটপাথ। সব বদলে যায়, মা বদলায় না। বদলায় না মায়ের পৃথিবী। (Motherland)
আরও পড়ুন: নীরবে নিতান্ত অবনত বসন্তের সর্ব-সমর্পণ
-তোমার দেশের বাড়ি কোথায়?
-কেন, ওই যে ফুটপাথ! অজস্র মানুষের ভিড়। শুয়ে শুয়ে মানুষের ব্যস্ত চলাচল দেখি। পা গুনি। এক দুই তিন…। মানুষ
এগিয়ে চলে। কেউ ধীর, কারোর ভীষণ তাড়া। মনে হয়, আমাদের বাড়িতে অনেক মানুষের যাতায়াত। কী উদার আমরা!
আমাদের ছাদ নেই তো কী হয়েছে! মস্ত বড় আকাশ আছে। আমরা তারা গুনি। সকালের প্রথম আলো আমাদেরই গায়ে
এসে পড়ে।
এই যে সংলাপ, তাতে এক সমান্তরাল পৃথিবী আর এক সমান্তরাল বাস্তবতার ছবি রয়েছে। করুণ হলেও সত্য। রাষ্ট্র জানে। যে শিশু দেশছাড়া, সহায়সম্বলহীন, সেই শিশুটির মুঠো শক্ত করে যদি ধরে থাকেন মা, তাহলে পথও মাতৃভূমি হয়ে ওঠে। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে এমন অজস্র পথ রচনা করে চলেছেন শ্রমজীবী মায়েরা। যেখানে নিহিত থাকে সমস্ত আদর। যাদের মা নেই, তারা সকলেই দেশ ছাড়া, ভিটে ছাড়া, ছিন্নমূল। (Motherland)

কয়েকবছর আগে দেশের রাজধানী থেকে একদল মানুষ হেঁটে হেঁটে ফিরতে চেয়েছিলেন দেশের বাড়ি। অথবা ঠিকানাহীন সেই হাঁটা। কিংবা রাস্তাই একমাত্র ঠিকানা। মাইলের পর মাইল। হাতে পুঁটলি। কোলে শিশু। হাঁটতে হাঁটতেই পরিচয় হয়ে যাচ্ছে পাশের অচেনা মানুষটির সঙ্গে। দেশ তাদের নাম দিয়েছে পরিযায়ী শ্রমিক। পরিযায়ী, খানিকটা পাখির মতো। গোটা দেশের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল সেই হাঁটাপথ। লকডাউন চলাকালীন প্রায় ৫০,০০০ পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ি ফিরছিলেন পায়ে হেঁটে। কিন্তু কীভাবে তাঁরা বাড়ি ফিরবেন, এ কথা রাষ্ট্র বলে দেয়নি। অতএব হাঁটাই ছিল তাঁদের একমাত্র পৌঁছানোর উপায়। ঘরে ফেরার এক প্রবল আকুতি। ফিরতে পারবেন কী না জানা নেই, কিন্তু মনে মনে ঘরে ফেরার যে অনুভূতি, তা জানান দিচ্ছিল শিকড়ের টান। (Motherland)
মা মানে এক নিরাপদ কোল, তা যে কেউ দিতে পারে। সেই সমস্ত কোলই ছড়িয়ে দিতে পারে উষ্ণতা, দিতে পারে ঘরের অনুভূতি। এ-ঘৃণার পৃথিবীতে আমাদের এটুকুই শান্তি। এটুকুই আমাদের সুখী গৃহকোণ।
‘মা’ শুধুমাত্র বিশেষ একজন নয়, ‘মা’ আসলে একটা ধারণা। বাবা, জ্যেঠু, জ্যেঠিমা, কাকিমা, ঠাকুমা, দাদু এমনকী অনাত্মীয় অথবা প্রিয়তম বন্ধু– সকলের মধ্যেই সসম্মানে বিরাজ করতে পারেন ‘মা’। মা মানে এক নিরাপদ কোল, তা যে কেউ দিতে পারে। সেই সমস্ত কোলই ছড়িয়ে দিতে পারে উষ্ণতা, দিতে পারে ঘরের অনুভূতি। এ-ঘৃণার পৃথিবীতে আমাদের এটুকুই শান্তি। এটুকুই আমাদের সুখী গৃহকোণ। (Motherland)

‘কেন চেয়ে আছ, গো মা, মুখপানে।
এরা চাহে না তোমারে চাহে না যে, আপন মায়েরে নাহি জানে।’
‘এরা’ কারা? পৃথিবীর কিছু বোকা মানুষ। যারা হাসতে ভুলে গেছে, ভালবাসোতে ভুলে গেছে, মৃদুমন্দ বাতাস উপভোগ করতে ভুলে গেছে। মাটি আমাদের মা। আমাদের দেশভাগ হয়, তবু মনভাগ হয় না। মানুষ পরিস্থিতির শিকার। তাই দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে মনও যে কবে ভাগ হয়ে গেছে, এতদিন বোঝা যায়নি। ছেলেবেলায় জেনেছিলাম প্রতিবেশীও অনেক সময় আত্মীয়ের চেয়ে আপন হয়ে ওঠে। তবু, দিন গড়িয়েছে, বছর ঘুরেছে, আর বেশি করে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ক্রমশ দূরত্বও বেড়েছে। তাহলে আর কীসের প্রতিবেশী! স্কুলে গিয়ে শিশুটি কী আর শিখবে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির ভূমিকা? (Motherland)
আন্তর্জাতিক মাতৃভূমি দিবসের মূল উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জ্ঞান তৈরি করা।
২২ এপ্রিলকে আন্তর্জাতিক মাতৃভূমি দিবস হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ স্বীকৃতি দিয়েছে। গাছ লাগানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান, পরিবেশ বিষয়ক আলোচনা, সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নানাভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে। মনে করিয়ে দিয়েছে, আমাদের নিজেদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ পরিবেশ রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। আন্তর্জাতিক মাতৃভূমি দিবসের মূল উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জ্ঞান তৈরি করা। এই এতকিছুর মধ্যে যে শেকড়ের টান আছে, তা হয়তো রাষ্ট্রব্যবস্থা হাতেধরে বোঝায়নি কোনওদিন। কিন্তু আমাদের মেনে নিতে অসুবিধা হয় না যে, সবের মধ্যেই মায়েদের তৈরি করা একটা মুক্ত পৃথিবী আছে, আছে দেশের বাড়ির প্রতি টান, যা শেকড়কে আরও মজবুত করে। (Motherland)

বরং পৃথিবীটা মায়েদের শাসনে থাক। সমস্ত বখাটে সন্তান হিংসা সীমানা মুছে তৈরি করুক নতুন এক ভোর। যে ভোরে মানুষ মানুষকে ভালবাসবে। ঘৃণার চেয়েও সংক্রামক হয়ে উঠবে ভালোবাসা। মাতৃভূমি ছেলেবেলা থেকে আমাদের সেই শিক্ষাই দিতে চেয়েছে, নয় কি? (Motherland)
ছবি সৌজন্য- ক্যানভা ডট কম-এর কপিরাইট ফ্রি ছবি
একজন কবি, গদ্যকার এবং সাংবাদিক। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘গওহর জান’, ‘উড়তে চললাম কমরেড’, ‘ঘুম হও অজস্র অপরাজিতা’, ‘বিলম্বিত দুপুর’, ‘ও ডার্লিং তুমি শুধু দৃশ্যমান হাওয়া’। একটি দৈনিক অনলাইন মিডিয়ার সহযোগী সম্পাদক ও বিষয়বস্তু প্রধান।