(North Bengal)
১
প্রথম ধাক্কাটি দিয়েছিলেন আন্দুবস্তির তুনু রাভা। চিলাপাতা ফরেস্ট রেঞ্জের ভিতরে রাভাগ্রাম। সেখানেই তুনু রাভার ছোটোখাটো পুরনো কাঠবাড়ি। শালের খুঁটির ওপরে থাকার ঘর। একচিলতে বারান্দা। ঘরের নিচে জ্বালানি কাঠ জড়ো করে রাখা। মুরগি চড়ছে। চারপাশে সুপুরিগাছ। সে বাড়ির দাওয়ায় তেজপাতা ভেজানো চা খেতে খেতে তিনি বলছিলেন, “আমার বাপ-ঠাকুরদা বেগার দিয়ে এই জঙ্গল বানিয়েছে। কিন্তু যেটুকু যা পুরানা জঙ্গল ছিল, টিক আর শালের প্লান্টেশন খাইতে খাইতে সব শেষ হয়ে গেছে।” (North Bengal)

জঙ্গল। দুর্ভেদ্য, গহীন, বিরাট বিরাট গাছের জঙ্গল। দূরে আকাশের গায়ে জয়ন্তী রেঞ্জ আর ভুটানপাহাড়। আলো পড়ে এলেই হাতি বেরোয় যত্রতত্র। কখনও বা দিনদুপুরেও। এরই মাঝে, জঙ্গলের ভিতরে, পাশে ছোট-ছোট গ্রাম। বাহারি নাম, ফরেস্ট ভিলেজ। বনবস্তি। খেতের মাঠে হাতি তাড়ানোর জন্য উঁচু টং। ধানের বুকে দুধ এলে ওই টঙে বসে রাতপাহারা দিতে হয়। গ্রামে লেপার্ড ঢুকে আসে। দিনমান ওঁত পেতে বসে থাকে বনলাগোয়া ঝোপে। গরুর পালে নজর। দলছুট একটা গরু বনে ঢুকে পড়লেই, ব্যস। (North Bengal)
তুনু রাভা বলে দিলেন, ওই বিপদসঙ্কুল উঁচু উঁচু গাছের জঙ্গল আসলে প্লান্টেশন। তারপর সেভকের ভাঁটিতে লালটং গ্রামের সেই বুড়ো, নাম মনে নেই, তিনিও বলে বসলেন, “একে জঙ্গল বলে নাকি! এসব প্লান্টেশন। জঙ্গল কাটলে কি আর জঙ্গল লাগানো যায়! জঙ্গল যখন ছিল, তখন হাতির এত উৎপাত ছিল না। তখন জঙ্গলে অনেক বুনো জন্তু থাকত। তাদের খাবার ছিল। এখন খাবার কই? হাতি তাই গ্রামে ঢুকে আসে। ফসল খায়।”
একই কথা এরপর ভনভন ভনভন করে কানের পাশে ঘুরতে থাকে তরাই-ডুয়ার্স-পাহাড়ের বনে-জঙ্গলে। যা দেখছ, তা আসল জঙ্গল নয়। প্লান্টেশন। বানানো বন। মানুষের হাতে তৈরি করা নিসর্গ। (North Bengal)
মানুষেরই তৈরি করা সাজানো বাগিচাবনে, মানুষেরই অভয় পেয়ে বেঁচে-বর্তে থাকা কিছু প্রাণীদের ভিড়ে, সুষম, শোভন একটা বানানো নিসর্গকে নিয়ে আমরা বুঁদ হয়ে আছি!
এই যে এত এত বাহারি নামের জঙ্গল, সংরক্ষিত অরণ্য মায় ব্যাঘ্রপ্রকল্প, এত এত ট্যুরিস্ট, সাফারি, বিধিনিষেধ, এত এত ওয়াইল্ড লাইফ, মুগ্ধতা, ছবি, সেলফি, রিল, মুনাফা— এর কোনওটার কেন্দ্রে প্রকৃত বন নেই! মানুষেরই তৈরি করা সাজানো বাগিচাবনে, মানুষেরই অভয় পেয়ে বেঁচে-বর্তে থাকা কিছু প্রাণীদের ভিড়ে, সুষম, শোভন একটা বানানো নিসর্গকে নিয়ে আমরা বুঁদ হয়ে আছি! তাহলে প্রকৃত নিসর্গ কোথায় গেল? (North Bengal)
ছবি বদলের ছবি: সপ্তর্ষি রায় বর্ধন
জঙ্গল চিনতে গেলে মুর্শিদ লাগে। ভেজা মাটিতে, কাদায়, নদীপাড়ের বালিতে অসংখ্য ছোটবড় খুরের দাগ, থাবার ছাপ। এসব দেখে যিনি এক নিশ্বাসে বলে দেবেন, কোনটা চিতলের, কোনটা সম্বরের বা কোনটা বুনো শুয়োরের। কার কত বয়স, ওজন। মোক্ষম সময়ে ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে বলবেন, হুউশ। ওই যে ঝোপের ভিতর একটা লেপার্ড। চিতাবাঘ। কিছুতেই চোখে পড়ছে না, কিন্তু তিনি দেখিয়েই ছাড়বেন, উঁচু উঁচু ঘাসের ভিতরে বড় শিংঅলা হরিণ। বর্ষার আশপাশে কিলবিল করছে জোঁক। বনের ভিতর ছোটবড় নদী, আঁকাবাঁকা নালা৷ বুড়োগাছের গায়ে অর্কিড। একটা লাল-গলা পাখি উড়ে গেল। (North Bengal)
বক্সাদুয়ারের ঢেউ-খেলানো পাহাড়, জয়ন্তী পেরিয়ে আরও অনেকটা গেলে খানিক জঙ্গলমতো। নিভু নিভু সন্ধ্যেয় সেখানে দাঁড়িয়ে এমনই এক মুর্শিদ আমাকে ভাঙা বাংলায় বলেছিলেন, অনেকদিন আগে এখানে ছিল ঘন জঙ্গল। বেতঝোপ। ঘাসবন। অঢেল হরিণ ছিল, বুনো শুয়োর ছিল। তাই বাঘও ছিল অনেক। তারপর খানিক চুপ থেকে বলেছিলেন, বক্সার এই শাল-সেগুনের ভিজে জঙ্গলটা কিন্তু পুরনো নয়। একশো-দেড়শো বছর বয়স হবে খুব বেশি হলে। “সাহেবদের কথামতো ঘাসবন, বেতবন পুড়িয়ে, পুরনো গাছে কেটে টিক (সেগুন) আর শাল লাগিয়েছিল আমাদেরই পূর্বপুরুষরা। কী আর করবে! তাঁরা তখন প্রজা। বেগার দিতে হবে। নাহলে তাড়িয়ে দেবে। এখানকার সব বনেরই এক গল্প।” (North Bengal)
যাতায়াত ঘন হলে ক্রমে বুঝতে পারি, এ গন্ধ সহজে যাওয়ার নয়। বনবস্তিতে আসি যত না কাজে, তার চেয়ে বেশি নিসর্গের লোভে। আমাকে দেখে স্থানীয় মানুষরাও তা বোঝেন নিশ্চিত।
বনের গল্প মুর্শিদ ছাড়া চেনাশোনা হয় না। সে গল্প যেমনই হোক। তাছাড়া, আমি চিনবই বা কী করে! বাইরের লোক। গায়ে ভুরভুর করছে শহরের গন্ধ। যাতায়াত ঘন হলে ক্রমে বুঝতে পারি, এ গন্ধ সহজে যাওয়ার নয়। বনবস্তিতে আসি যত না কাজে, তার চেয়ে বেশি নিসর্গের লোভে। আমাকে দেখে স্থানীয় মানুষরাও তা বোঝেন নিশ্চিত। পাছে আমাকে ট্যুরিস্ট ভেবে না বসেন, কতকটা তাই যেন জবুথবু থাকি। রাভাগ্রামে যাকেই দেখি, তাকেই জিজ্ঞেস করি, ‘বিগিনা পাংতা?’ কেমন আছেন? পেনেম্ মান? বাহ বাহ, বেশ বেশ। লোকে হাসে, আমি পাল্টা প্রায় নতজানু হয়ে হাসি। আর দেখি, দূরে কখনও ভুটানপাহাড়, কখনও কালিম্পঙের শৈলশ্রেণি। কখনও কাঞ্চনজঙ্ঘা। আর দেখি দিকচক্রবালে, গ্রামের পাশে, রাস্তার দু’ধারে বন। তরাই জুড়ে উঁচু উঁচু শালগাছ। সেগুনগাছ। নাম না জানা কত গাছ। বক্সা, চিলাপাতা, জলদাপাড়া, নিমাতি, মহানন্দা, সিঞ্চল, সিঙ্গালিলা… দেখে মনে হয়, দুর্গম, আদিম। দেদার ছবি তুলি। রাতে কাঠবাড়িতে শুয়ে গা ছমছম করে। সুখের রোমাঞ্চ। আহ, এই জীবনই তো চেয়েছিলাম। জঙ্গল, পাহাড়, নদী, বন্যপ্রাণ। লুটনো নিসর্গ। (North Bengal)
যে চা-বাগান আর পাইনবন না দেখলে পাহাড় ঘুরতে আসা ব্যর্থ। এই নিসর্গটা, এই সৌন্দর্যের বানানো চোখটা ঔপনিবেশিক প্রভুদের আমদানি।
তুনু রাভা, মোরাঘাট লাগোয়া খুট্টিমারির সেই বুড়ো, বগোরার বিমল শেরপা, পানবাড়ির কঙ্কা মুর্মু, সেই মুর্শিদ আমাকে অতঃপর বললেন, এই সবই বানানো। নকল। বাবুদের বানানো সাফারি পার্ক। রংলি রংলিয়াটের চা-বাগানের ঢালে দাঁড়িয়ে আমার এক দাদা বলছিলেন, পাহাড়ের গোটা জঙ্গলটা সাফ করে ব্রিটিশ আমলে মনোকালচার হয়েছে। চা-বাগান আর ধুপি। ক্রিপ্টোমারিয়া জাপানিকা। যে চা-বাগান আর পাইনবন না দেখলে পাহাড় ঘুরতে আসা ব্যর্থ। এই নিসর্গটা, এই সৌন্দর্যের বানানো চোখটা ঔপনিবেশিক প্রভুদের আমদানি। আর, তার ভাগশেষ হিসেবে পড়ে আছে পাহাড়ের আদিম নিসর্গের মৃতদেহ। অতীতের আকাশচুম্বী ওকগাছের বন, সঙ্গে বার্চ, ম্যাপল, ম্যাগনোলিয়া, রডোডেনড্রন বা গুরাস। নিচে তরাই-মোরাঙে শাল, খয়ের, শিমূলবন। ওই ঢাল-উপুড় চা-বাগিচা, রহস্যাবৃত পাইনবাগানের মধ্যে, সংরক্ষিত বনের বানানো গল্পের তলায় পাহাড়-তরাইয়ের আসল নিসর্গ চাপা পড়ে আছে। সেদিন তাকদার সাহেববাংলোর ভিতরেও কনকনে শীত। স্যাঁতস্যাঁতে। সাহেবরা ভালোবেসে বলতেন, হোম ওয়েদার। (North Bengal)
জঙ্গলের আরেক মুর্শিদ বলেছিলেন, জঙ্গল চিনতে গেলে দেখা শিখতে হবে। যা নেই, তাকে দেখা। যা ছিল, তাকে দেখা। এই সাজানো জঙ্গলের গল্পে ভবি যেন না ভোলে। শুনে প্রথম কতক ধাঁধা লাগে। তারপর, দেখে-শুনে-বুঝে মনটা ভেঙে যায়। এতদিনের তৈরি হওয়া ভাল লাগা, সৌন্দর্যের গাঢ় দাগ— যে নিসর্গ দেখে উদ্বেল হয়েছি এতদিন, সেটা নকল! যে শিক্ষে দাগা দেয়, তা মানুষ সহজে ভোলে না। আমারও তাই হল। সে খানিক দুর্বোধ্য বোঝাপড়ার ব্যাপার। (North Bengal)

২
১৭৭২ সালে ভুটানরাজ দেব যুধুর কোচবিহারের রাজত্ব দখল করে নিলেন। কোচবিহারের রাজা সাহায্য চাইলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছে। হেস্টিংস চোখের সামনে দেখতে পেলেন মহার্ঘ সুযোগ। তিনি সেনাদল পাঠালেন, বহরে ছোট, কিন্তু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে ভারী। যুদ্ধে দেব যুধুর হেরে গেলেন। কোচবিহার রাজা রাজত্ব ফিরে পেয়ে ইংরেজদের অনুগত ‘বন্ধু’ হলেন। কিন্তু তার চাইতেও বড় ঘটনাটা ঘটল খানিক চুপিসারে। ১৭৭৪ সালে হেস্টিংসের দূত হয়ে তরুণ জর্জ বোগল ওই কোচবিহার, বক্সাদুয়ার পার করেই ঢুকে পড়লেন তিব্বতে। তিব্বত মানে ভুটান। ইংরেজদের কাছে সেটাই তিব্বতের দরোয়াজা। ব্রিটিশরা যে এত ঝক্কি করে, নদী-বন পার করে অধুনা উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে ঘরবাড়ি বানিয়ে গেঁড়ে বসেছিল, তার অন্যতম কারণ ওই তিব্বত। তিব্বত চিররহস্যের দেশ। অগাধ সোনাদানা-রত্নরাশি। কিন্তু সে দেশে ঢোকার আগে তো ভূখণ্ড ও তার মানুষগুলোকে চিনতে-বুঝতে হবে। সেই কারণেই বোগলকে দূত হিসেবে পাঠানো। (North Bengal)
উত্তরবঙ্গের নিসর্গ বদলের ইতিহাস লিখতে গেলে বোগলের এই যাত্রার গায়ে লাল দাগ দিয়ে রাখতে হয়। উত্তরবঙ্গের পাহাড়-বনের ওপর ঔপনিবেশিক প্রভুদের ক্রমে যে দখল থুড়ি শাসন প্রতিষ্ঠা হবে, এ তার সূচনাবিন্দু। বোগল তাঁর যাত্রাপথের বর্ণনা দিয়েছেন বিস্তারে। সেই গদ্য চমৎকার, মায়াময়। বক্সাদুয়ার থেকে যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শুরু হল, তাতে তিনি মুগ্ধ হলেন। বাংলা সরকারকে নোট লিখে প্রস্তাব দিলেন, বাংলা-তিব্বত অবাধ বাণিজ্যের স্বার্থে বক্সার আশপাশের সমস্ত দুয়ার অঞ্চল দখল করে নেওয়া হোক। বোগলের সেই ইচ্ছে পূর্ণও হয়েছিল, কিন্তু সে প্রায় একশো বছর পরে। ইঙ্গ-ভুটান যুদ্ধের পর।
এর মাঝের সময়টা ঔপনিবেশিক শাসনপর্ব জমাটি করার সময়। ইতিমধ্যে ১৮৫০-এ তরাই এলাকা ইংরেজদের হাতে চলে এসেছে। ডব্লু ডব্লু হান্টার ১৮৭৬-এ প্রকাশিত তাঁর ‘বাংলার সংখ্যাতাত্ত্বিক বিবরণ’-এর দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি খণ্ডে জানাচ্ছেন, পাহাড়-তরাই-মোরং সমেত দার্জিলিং মোটামুটি পাঁচভাগে ধাপে ধাপে ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৩৫ নাগাদ পাঙ্খাবাড়ি-ঘুম-জোড়বাঙলো থেকে দার্জিলিং অবধি অঞ্চল সিকিমরাজ স্বেচ্ছায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দান করছেন। তার কারণটা সহজ নয়, সেই ইতিহাসে বিস্তারিত ঢোকার প্রয়োজন নেই আপাতত। ১৮৫০-এ নানা পর্বে ঘুম-সান্দাকফু-ফালুট-নেপাল থেকে তিস্তা অবধি অঞ্চল এবং তরাই কোম্পানির হস্তগত হয়। বাকিটা, তিস্তার পুবে ভুটানপাহাড় অবধি অঞ্চল, বক্সাদুয়ার ইত্যাদি ১৮৬৪-তে ইঙ্গ-ভুটান যুদ্ধের পর। (North Bengal)
জানলা আমার মানে না আজ ধর্মের বিভেদ: আত্রেয়ী চক্রবর্তী
বোগল যখন বক্সা পেরিয়ে ‘তিব্বতে’ ঢুকছেন, তখন এবং তারও বেশ কিছুকাল পরে অবধি তরাই-ডুয়ার্সের অরণ্য বলতে ছিল পাহাড়তলি আর পাহাড়জুড়ে ঘন প্রাকৃতিক শালবন, সঙ্গে জলাভূমি আর বিস্তীর্ণ ঘাসবন। এর উল্টোদিকে সিকিমরাজের অধীনে থাকা দার্জিলিং-কালিম্পং পাহাড়ের নিজস্ব বন, বাস্তুতন্ত্র। যে নিসর্গ এরপর বদলে যাবে অবিশ্বাস্যরকমের দ্রুত গতিতে। প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র আপাদমস্তক এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাবে। পশ্চিমে নেপাল থেকে পূর্বে ভুটান এবং তারও অনেক দূর অবধি বিস্তৃত ঘাসবন পুড়িয়ে দেওয়া হবে। ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত হিমালয়ান জার্নালে জোসেফ ডালটন হুকার লিখছেন, তিঁতলিয়া থেকে মেচি অবধি যে মাঠ জুড়ে ঘাসবন ছিল শ’খানেক বছর আগেও, তা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হুকার বলছেন, এতে ভালই হয়েছে। ঘাসবন মানে বিপজ্জনক। সেখানে বুনো জন্তু লুকিয়ে থাকে। ঘাসবন সভ্যতার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। হান্টারও লিখছেন, জলা-জঙ্গল-ঘাসবনে অসভ্য, বুনো মেচ আর ধিমালরা থাকে। আর থাকে শিকারযোগ্য বুনো জন্তুর দল। বাঘ, গণ্ডার, হাতি, মহিষ, হরিণ, চিতা… তরাইকে যদি চাষযোগ্য করে প্রজা বসাতে হয়, তাহলে এসব নিকেশ করতে হবে। বন আর বুনো জন্তু সবই যাতে সাফ হয়। তার জন্য সরকারি ‘ইনাম’-এর ব্যবস্থাও ছিল। হান্টার বলছেন, বাঘ মারলে ২ পাউন্ড, হাতি আর চিতার মাথাপিছু ১ পাউন্ড পুরস্কার। সঙ্গে খেলাচ্ছলে শিকারও আছে, ইনামের লোভে না, এমনিই। (North Bengal)
অতএব, ব্রিটিশ রাজের সভ্যতায় তরাইয়ের ‘অপ্রয়োজনীয়’ ঘাসবন দ্রুত উবে গেল। সেইসঙ্গে উবে গেল ঘাসবনের ওপর নির্ভরশীল বন্যপ্রাণের অনেকটাই। তার জায়গা নিল চিরহরিৎ, আর্দ্র-পর্ণমোচী গাছের জঙ্গল। শুধু ঘাসবন নয়, তৎসহ উবে যাবে তথা কেটে দেওয়া হবে হিমালয়ের প্রাচীন পাহাড়ি জঙ্গল। বন না কাটলে কাঠ মিলবে না। কাঠ না এলে সভ্যতার প্রসার হবে না। রেললাইন বসবে না, টেলিগ্রামের খুঁটিও না। হান্টার সাহেবের লেখাতেই হিসেব মিলছে, ১৮৭০ সালের আশপাশেই দার্জিলিং জেলার জঙ্গলে দামি আর প্রয়োজনীয় কাঠ প্রায় শেষ। জঙ্গল প্রায় উধাও। সে এক অন্য বিপদ। জঙ্গল না থাকলে কাঠ কীভাবে আসবে? (North Bengal)
দৈত্যাকার ওক, চেস্টনাট, ম্যাগনোলিয়া, অর্কিডে ভরা বন, সারাবছর জলস্রোতে ছটফট করা ঝোরা—সব শেষ। ওই বনে আর সাদা ম্যাগনোলিয়া, গোলাপি হায়াড্রানজিয়া ফোটেনি কখনও। ইতিমধ্যে পাহাড়ে, পরে নিচের বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও শুরু হচ্ছে চা-বাগান তৈরির কাজ।
দার্জিলিং পাহাড়ের প্রাকৃতিক বন কীভাবে ধ্বংস হল, তার মর্মন্তুদ বিবরণ আছে লরেন্স ওয়াডেলের ‘অ্যামং দ্য হিমালয়াস’ বইতে। ওয়াডেল সাহেব দার্জিলিঙের প্রায় সব পাহাড়ে ঘুরেছিলেন পায়ে হেঁটে, পুরনো নিসর্গকে বাঁচিয়ে রাখার কথা লিখেছেন, বৌদ্ধতন্ত্র নিয়ে বইও লিখেছেন। তিনি লিখছেন, হুকার যবে এলেন, তারপর থেকে রঙ্গারুনের বন, দার্জিলিঙের নিবিড় বনের ধ্বংসাবশেষকেও নির্দয়ভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। দৈত্যাকার ওক, চেস্টনাট, ম্যাগনোলিয়া, অর্কিডে ভরা বন, সারাবছর জলস্রোতে ছটফট করা ঝোরা— সব শেষ। ওই বনে আর সাদা ম্যাগনোলিয়া, গোলাপি হায়াড্রানজিয়া ফোটেনি কখনও। ইতিমধ্যে পাহাড়ে, পরে নিচের বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও শুরু হচ্ছে চা-বাগান তৈরির কাজ। পশুচারণভূমি, জঙ্গল দখল করে মনোকালচার। অপূর্ব চা-বাগান। সেও এক নতুন, পরিকল্পিত নিসর্গ। (North Bengal)
এই বন ধ্বংসের আড়ালে ব্রিটিশদের একটা সরল মতাদর্শ ছিল আগাগোড়াই। জঙ্গলকে ব্যবহারযোগ্য উপাদানের ভাণ্ডার হিসেবে দেখা। সভ্যতার থুড়ি ভোগের প্রয়োজনে দেখা। পুঁজি প্রসারের জন্য তাই বন সাফ করে কাঠকে কাজে লাগাতে হয়, জমিতে প্রজাও বসাতে হয়। বন কাটো, কাঠ লাও। বন কাটো, প্রজা বসাও। সহজ নীতি, সন্দেহ নেই। বন-সংক্রান্ত সমস্ত পরিকল্পনাতে স্পষ্ট করে লেখা থাকত, এই পরিকল্পনার মুখ্য উদ্দেশ্য দুটো। এক, বনকে যথাসম্ভব উৎপাদনশীল করা ও সুষম মানে হোমোজিনিয়াস করা। কারণ, সুষম না হলে অপ্রয়োজনীয় গাছে বন ছেয়ে যাবে। তার কোনও ব্যবহারিক বা বাজারমূল্য নেই। (North Bengal)
বন কেটে ফেলার পরে অন্য বিপদ ফিরে আসে। কাঠের যোগান বন্ধ হয়ে যাবে। তাই নতুন বন তৈরি করা দরকার। প্রয়োজনের বন। ‘সভ্য’ ও কম বিপদের বন। যেখানে শিকারের উপাদান মিলবে কিন্তু বিপদ কম।
বন কেটে ফেলার পরে অন্য বিপদ ফিরে আসে। কাঠের যোগান বন্ধ হয়ে যাবে। তাই নতুন বন তৈরি করা দরকার। প্রয়োজনের বন। ‘সভ্য’ ও কম বিপদের বন। যেখানে শিকারের উপাদান মিলবে কিন্তু বিপদ কম। যেখানে চাইলে ঘুরতেও যাওয়া যাবে। তাই পাহাড়-তরাইয়ের আদি নিসর্গ লোপাট করে সেখানে লাগানো হল দামি কাঠের বন। পাহাড়ের শূন্য গায়ে ক্রিপ্টোমারিয়া জাপানিকা। পর্যটকপ্রিয় পাইন। পেশক রোড ধরে তিস্তানদী বরাবর সেগুন আর সেগুন। অথচ, এই পাইন আর সেগুন দুই-ই জঙ্গলের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর গাছ। পাইনের শিকড় পাহাড়ের মাটিকে আলগা করে দেয়। ধস নামে। মাটির নিচে জল শুকিয়ে যায়। পাহাড় জুড়ে জলের অভাব থইথই করে। মাটিতে অন্য গাছ গজায় না। ধুপিগাড়ির তলা তাই ভিজে, স্যাঁতস্যাঁতে ধুপিগাছের পাতায় ছাওয়া। অর্কিড, ফার্ন, বুনো ঝোপঝাড় নেই। পরিশীলিত, মনোরম, বাজারমুখী নিখুঁত প্লান্টেশন। (North Bengal)

তরাইতে, সঙ্কোশ নদী থেকে মেচি নদীর মাঝবরাবর সমতলে, বক্সা-চিলাপাতা-জলদাপাড়া জুড়ে সেগুনবাগিচা। নতুন করে লাগানো শালগাছ। আর, এসব গাছ লাগানোর জন্য, কাটা বনকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়োজনেও তো লোক লাগবে। তাই এককালে তাড়িয়ে দেওয়া জংলি জুমিয়াদের ফিরিয়ে আনা হল। ব্রিটিশরা এই অঞ্চলে ঢোকার পর প্রথমে অবাক হয়ে দেখেছিল, রাজত্ব আর রাজা থাকলেও এখানকার ‘জংলি প্রজা’-দের মধ্যে জমির মালিকানা-কেন্দ্রিক বোধ বিশেষ নেই। মেচ (কচারি), রাভা, গারো, লিম্বু, ধিমলের মতো আদিবাসীরা ঘাসবন পুড়িয়ে, অল্প বন সাফ করে জুম চাষ করে। দার্জিলিং পাহাড়ে জুম করে লেপচারা। এঁরা কেউই একজায়গায় স্থির থাকে না। আজ এখানে তো পরের বছর অন্যখানে। জুমিয়াদের জুমচাষ নিয়ে, তাঁদের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা আছে ব্রায়ান হাটন হজসনের বিখ্যাত বই ‘অন দ্য কোচ, বোরো অ্যান্ড ধিমাল ট্রাইবস’-এ, এল এ ওয়াডেলের বইতে, ক্যাম্পবেল সাহেবের নোটে, রিসলে সাহেবের সিকিম গেজেটিয়ারে। এই ‘অসভ্য’ জুমিয়ারা জঙ্গলকে ব্যবহার করত নিজেদের সামান্য প্রয়োজনমাফিক। তার চাইতে একচুলও বেশি নয়। তারা বন সাফ করে, মাটি তৈরি করে, কোনও বহিরাগত সার না দিয়েই নানাকিছু চাষ করতেন। তারপর জমি পুড়িয়ে দিয়ে সরে যেতেন অন্যত্র। কয়েকবছর পর ওই ফেলে যাওয়া জমিতে বন ফিরে আসত। (North Bengal)
বনভূমিতে এহেন জংলি জুমিয়ারা বহাল থাকলে ভূমি-রাজস্ব-মালিকানা অর্থাৎ সভ্য শাসনের নিয়ম প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। অতএব, জুমিয়াদের তাড়াতে হল। এরপর যখন বনে আগুন লাগা বন্ধ হওয়ায় কাটা গাছের জায়গায় নতুন গাছ জন্মাচ্ছে না, বন ফুরিয়ে আসছে, তখন বাধ্য হয়েই ব্রিটিশরা নিয়ে এল জার্মান ফরেস্টার ডিয়েট্রিচ ব্রান্ডিসকে। তিনি ঔপনিবেশিক বনবিভাগকে নতুন করে সাজালেন। জুমিয়াদের ফিরিয়ে আনলেন। তাদের বলা হল, টঙিয়া প্রথায় প্লান্টেশন তৈরি করতে হবে। টঙিয়া মানে গাছ কেটে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে, বীজ ফেলে বনের মতো বাগান বানানো। জুম ছিল গোষ্ঠির, টঙিয়া হল শাসকের। বনদপ্তর নতুন প্রজা পেল। বিনা মজুরির বেগার-খাটা প্রজা। যখন বলবে, তখন বেগার দাও। বুনো জন্তু, মশার সঙ্গে যুঝে, প্রায় ক্রীতদাস হয়ে বেঁচে থাকা। প্লান্টেশন করা। বিনিময়ে থাকার জায়গা। অধিকার নয়, কেবল জায়গা। প্রভুরা চাইলেই বিতাড়িত। সঙ্গে বনবাবুদের জুলুম। ‘জংলিদের’ শায়েস্তা করার নানারকম ফিকির। (North Bengal)
বদলের বিভিন্ন মাত্রা: রবীন্দ্রনাথ: শুভেন্দু দাশমুন্সী
এই ইতিহাস প্রবহমান। সাহেবরা দেশ ছেড়ে গেল, কিন্তু নিসর্গকে ব্যবহারিক সম্পত্তি হিসেবে দেখার এই চোখ বদলাল না। ইতিউতি, যেখানে পুরনো বন তাও খানিক বেঁচেবর্তে ছিল, সব লোপাট হয়ে গেল ক্রমে। মানেভঞ্জনের রাস্তায়, গুলমার ওপরে, ভুটানঘাটের গহীনে। এমনকি প্লান্টেশনের বানানো বনও উধাও হয়ে গেল অনেক জায়গায়। সেখানে কচি গাছ, ঝোপঝাড়। টঙিয়া বস্তি, এফডি হোল্ডিং হয়ে আজকের বনগ্রামের মানুষজনের ইতিহাসটাও এরই সঙ্গে পাক খেতে খেতে গেছে। দেশ স্বাধীন হলেও তাঁদের দাসত্ব ঘোচেনি। জমির ওপর অধিকার নেই, শ্রমের পয়সা নেই। উলটে বনবাবুদের অত্যাচার। মাঝে হইহই হল, প্রতিবাদ। গত শতকের সাতের দশকের গোড়ায়, বেগার বিরোধী আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালাল মোরাঘাট রেঞ্জের গোঁসাইঘাটে। পাঁচজন ভিলেজার মারাও গেলেন। ফরেস্ট বাবুরা বাধ্য হয়ে আলোচনায় বসলেন। শ্রমের বিনিময়ে ন্যূনতম মজুরি ঠিক হল। তারও পরে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর বনগ্রামের মানুষজন একটা আইনি অধিকার পেয়েছেন। বনের ওপর গ্রামসভার অধিকার জন্মেছে। কিন্তু কোন বন? কোন নিসর্গ? সংরক্ষিত বানানো সাফারি পার্ক?
তুনু রাভা বলছিলেন, “আর বনাধিকার! বনটাই তো নাই।” (North Bengal)
৩
প্রগতির জমানায় নিসর্গের ইতিহাস খোঁজা বাতুলতা। তস্য বাতুলতা হয়তো বনবাদাড়ের ইতিহাস খোঁজা। মানুষ যেদিন থেকে কৃষিকাজ শিখল, তবে থেকেই নিসর্গ বদলাচ্ছে। রোজ, প্রতিনিয়ত। বদলাচ্ছে মানুষের শর্তে, স্বার্থে। নগর গড়তে হলে তো বন কাটতেই হবে। এ কি আজকের কথা! কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র পড়োনি! কিংবা মুকুন্দরামের গুজরাট নগর পত্তন! (North Bengal)
নিসর্গের সমস্যা হল, তার ভূত নেই। ন্যায্য অধিকার নেই। নিসর্গ বদলানোর পরে যা পড়ে থাকে, তাও নিসর্গ। বন কাটার পরে যা লাগানো হয়, তাও খাতায়-কলমে ফরেস্ট। বন্যপ্রাণীর উধাও হয়ে যাওয়ার পরে, বাস্তু হারিয়ে উন্মত্ত হয়ে যাওয়ার পরে যা উচ্ছিষ্ট পড়ে থাকে, তাও ওয়াইল্ড লাইফ। তার তরেও গাড়িভর্তি ট্যুরিস্টরা যান। গাইড দেখায় জলার পাশে ভোরে বা সন্ধের মুখে হাতির পাল নুন চাটতে এসেছে। দেখায় বোকা বাইসন। মানুষ দেখলেই রেগে যাচ্ছে। হাতির দল যখন-তখন ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। মাথা বিগড়ে গেলে পিষে মেরেও ফেলছে কাউকে কাউকে। (North Bengal)

এই গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম। ডুয়ার্স থেকে পাহাড়। এক ফরেস্ট রেঞ্জ থেকে অন্য রেঞ্জে ঘুরতে ঘুরতে বহিরাগত, আদ্যোপান্ত শহুরে আমি বুঝে ফেলি, আমার আর বন চেনা হবে না। কারণ, বনই তো নেই। চিনতে গেলে অতীতে যেতে হবে। না থাকাকে চেনা। যে নিসর্গকে দেখছি, বুঝে নিতে হবে সেটা বানানো। ওই বনের মতো প্লান্টেশন, চা-বাগান, লাল-নীল-হলুদ-গোলাপি বাক্সবাড়ির ছোট-বড় পাহাড়ি শহর, জনপদ, ওই তিস্তা-রঙ্গিত সঙ্গমস্থল, মায় একের পর এক বাঁধে আটকা তিস্তা নদীটাও। সব বানানো। বা অপগৃহীত। বদলে নেওয়া। ভেঙেচুড়ে-দুমড়ে-মুচড়ে নেওয়া। একদা ‘বুনো’ রাভা, মেচ-রাও নিজেদের সেই জঙ্গলের উত্তরাধিকার হারিয়ে এই বাস্তব মেনে নিয়েছে। অধিকাংশ মানুষ এসব নিয়ে ভাবিতই নন। তাঁদের দোষ দিয়েই বা লাভ কী! অতীতটাই নেই। বুনো জন্তুর অধিকাংশই আর নেই। পুরনো নিসর্গের সঙ্গে তারাও উবে গেছে। তরাইয়ের বিখ্যাত রয়াল বেঙ্গল টাইগার আর নেই। নামে গালভরা ‘বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প’ থাকলেও বাঘ নেই। চোরা শিকার বাদ দিলেও একটা বাস্তুতন্ত্র তো লাগে! ঘাসজমি নেই, তৃণভোজী থেকে মাংশাসী খাদ্যশৃঙ্খল নেই। তাই বাঘও নেই। কোনও একভাবে হাতির পাল টিকে গেছে। কিন্তু তাদের খাদ্যাভ্যাস গেছে বদলে। বানানো জঙ্গলে খাবার পাওয়া যায় না, তাই গ্রামে ঢুকে পড়ে ফসল খেতে হয়। গরিবগুর্বো মানুষগুলোর সারা বছরের খাবারে টান পড়ে। তাঁরা হাতি তাড়াতে যান। হাতি পাল্টা দিলে প্রাণও যায়। (North Bengal)
এসবও দিব্বি মেনে নিয়েছেন কঙ্কা মুর্মু, লাল সিং ভুজেলরা। এমন তো হবেই। জঙ্গল-লাগোয়া জীবন। হাতির কত বড় পেট, কত ক্ষুধা। একবেলা না খেলে মানুষেরই যা কষ্ট, আর হাতির! কঙ্কা মানে খ্যাপা। বয়স আশির কাছাকাছি। তাঁর এই কথা শুনে আমি আমার মুর্শিদের দিকে চাই। মুর্শিদ হাসেন। এও তো একজাতের চেনা-জানা-বোঝা। যা আমার ইতিহাসে নেই, যা আমার আখ্যানে নেই, তাকে চেনা। কেউ কেউ দুঃখ করে বলেন, জঙ্গল নেই তাই দেশি ধানগুলো ক্রমে উধাও হয়ে গেল। কেউ বলেন, জঙ্গলের সঙ্গে ওই নদীটাও উবে গেল। সারাবছর জল থাকত যে নদীতে, তা এখন খটখটে। নদীর সঙ্গে আরও কত কী যে উবে গেল, তার হিসেব কে দেবে! অবশ্য, কেনই বা দেবে! (North Bengal)
জঙ্গলের শবাধারে ঘুরতে ঘুরতে, এক প্লান্টেশন থেকে অন্য প্লান্টেশনে, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, আমি শুনি এই একই দমচাপা আখ্যান উড়ে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়-বাতাসে। ইতিউতি হোম-স্টে, হোটেল, ঢালাও ট্যুরিস্ট। চিপসের প্যাকেট, মদের বোতল, সফট ড্রিঙ্কসের খোল।
জঙ্গলের শবাধারে ঘুরতে ঘুরতে, এক প্লান্টেশন থেকে অন্য প্লান্টেশনে, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, আমি শুনি এই একই দমচাপা আখ্যান উড়ে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়-বাতাসে। ইতিউতি হোম-স্টে, হোটেল, ঢালাও ট্যুরিস্ট। চিপসের প্যাকেট, মদের বোতল, সফট ড্রিঙ্কসের খোল। রাতে ডিজে, বনফায়ার, উল্লাস। গরিব মানুষদের পকেটে খানিক পয়সা, স্থানীয় গাইড-ড্রাইভার-দোকানির বছরভরের কাজ। এসব দেখে-শুনে মনে হয়, ভাগ্যিস এ দেশে ইংরেজ প্রভুরা এসেছিলেন। নিসর্গ-নির্মাণ বা ল্যান্ডস্কেপিং-এর ধারণাও নিয়ে এসেছিলেন। তাই, উত্তরবঙ্গ বললেই যে শ্যামল-সুন্দর-সাজানো-ছবির মতো নিসর্গ মনে ভেসে ওঠে, সেটা আমরা পেলাম৷ অপ্রয়োজনীয়, আগাছামর্মর, বুনো ঝোপঝাড়, নানা দেশীয় গাছে অবিন্যস্ত বনভূমির বদলে এই সাজানো নিসর্গ অনেক বেশি লোভনীয়। অনেক বেশি বাণিজ্যমুখী। (North Bengal)
আর তারই আড়ালে বা আশপাশে লুটিয়ে থাকা সেই মরা নিসর্গ বা নিসর্গের ভূত? যার ইতিহাস থেকেও নেই। বা যার ইতিহাস আসলে এমনই! তার আখ্যানেরও সম্ভবত বাজার আছে৷ হয়তো ওটুকুই বাজার। (North Bengal)
ছবি সৌজন্য – উইকিমিডিয়া
অনিতেশ চক্রবর্তী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র। গবেষক। পড়ানো ছেড়ে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ। অত:পর আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিলিতভাবে নিজস্ব সংস্থা। ভালোবাসেন তথ্যচিত্র বানাতে। বনগ্রাম ও বনাধিকার নিয়ে কাজের সূত্রে উত্তরবঙ্গ তথা ভারতের নানা বনাঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। সম্পাদনা করেছেন একাধিক পত্রিকা ও মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক দুটি বই। কবিতার বইও আছে একটি।