(Lear)
শেক্সপিয়ারের কিং লিয়ার মঞ্চস্থ করলেন অঞ্জন দত্ত। জানালেন, ৭১ বছর বয়সে এটাই তাঁর শেষ থিয়েটার প্রযোজনা। স্বভাবত জ্ঞান মঞ্চে কিছু সময়ের ব্যবধানে পরপর দু’বার দেখলাম নাটকটি। থিয়েটার যেহেতু বিবর্তিত হতে হতে এগোয়, অতএব প্রথম শো ও পরের শো-তে ফারাক ছিল বিস্তর। ক্রমে যেন আরও ঘন হয়ে অঞ্জনের মঞ্চায়নে সমকালীন স্রোতে মিশে যাচ্ছেন শেক্সপিয়ার। (Lear)

লিয়ার আসলে এক পাগলপারা রাজার গল্প, যা দুনিয়াজুড়ে বারবার মঞ্চস্থ হয়েছে। বিশ্বাস ভেঙে গেছে রাজার। কাছের লোকেরা ঠকিয়েছে। রাজা এবার পাগল হয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। জীবনটা যেন ঘেঁটে গেছে রাজার।
সমকালের দুর্নীতির কথা বলতেই ‘আরো একটা লিয়ার’ মঞ্চস্থ করবেন বলেছিলেন অঞ্জন। প্রথম অভিনয়টি শীতের কুয়াশামাখা সন্ধায় দেখেছিলাম মনে আছে। দেখেছিলাম, অঞ্জনের জীবনের শেষ নাটক, ‘আরো একটা লিয়ার’। (Lear)
সমকালের দুর্নীতির কথা বলতেই ‘আরো একটা লিয়ার’ মঞ্চস্থ করবেন বলেছিলেন অঞ্জন।
সত্তর দশক থেকেই বিকল্প ধারার থিয়েটার করছেন অঞ্জন। দেখা যায়, গান বা সিনেমা যে অর্থে জনপ্রিয়, থিয়েটারকে সে অর্থে জনপ্রিয় করতে চাননি তিনি। তাই জঁ জেনে, সার্ত্রে, পেটার ভাইস, ব্রেখট, ম্যুলার, টেনেসি উইলিয়ামস, ক্রোয়েতসের মতো বিকল্প ধারার চিন্তকদের নিয়েই বরাবর কাজ করেছেন থিয়েটারে। বাদ যাননি রবীন্দ্রনাথ বা শেক্সপিয়ারও। কিন্তু সবটাই করেছেন তাঁর স্বকীয় ঘরানায়। যেখানে তাঁর নাট্যগুরু বাদল সরকারের কথা বারেবারে বলেছেন। (Lear)

এ দিন হলের বাইরে নানা পোস্টারে লেখা ছিল নানা কোটেশান। ছিল বিভিন্ন হাতে আঁকা ছবিও। সবই লিয়ার অনুপ্রাণিত। নানা বন্ধুজনের সঙ্গে দেখা হচ্ছিল পরপর। অনেকের স্মৃতিতেই এখনও বছর বারো আগের সুমন মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনা ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লিয়ার জ্বলজ্বল করছে। তবে, সুমনের লিয়ার যতটা গ্রাঞ্জারের ছিল, অঞ্জনের লিয়ার ততটাই মিনিম্যাল। দুটো দুই রকম। তাই ভাল লাগল। এই লিয়ার, ভোগী-কামুক। অনেকটা কুরোসাওয়া বা গদারের লিয়ারের মতো। শেক্সপিয়ারের আদর্শ থেকে যারা অনেকটাই সরে এসেছেন। (Lear)
আরও পড়ুন: সুমন মুখোপাধ্যায়ের সাথে আমার থিয়েটারের ভাষা
অঞ্জন যথারীতি দারুণ, বলাও বাহুল্য। দু’ঘণ্টা মঞ্চ দাপালেন, চিরায়ত পাগলপারা শৈল্পিক অনুভবে। ভাল লাগল বাকিদের অনেককেই, যেমন কমলিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুপ্রভাত দাস, লোকনাথ দে, সুদীপা বসু, শুভ্র সৌরভ দাস। সকলেই মঞ্চের দীর্ঘদিনের অভিনেতা। তবে বিশেষভাবে ভাল লাগল মঞ্চ আর মেক আপ, কারণ এ’দুটির কোনওটিতেই যেন বাস্তবতা নেই, রয়েছে বাস্তবকে ছাপিয়ে যাওয়া। পোশাক পরিকল্পনা করেছেন ছন্দা দত্ত। থিয়েটারের মঞ্চে সেট বলতে মাত্র একটা চেয়ার আর মেক আপ বলতে সকলেই যেন পরাবাস্তবতার রঙ মেখে আছেন। সমকাল যেমন বাস্তবতা-বিহীন, এই মানুষগুলোও কোথাও যেন এলোমেলো, বাস্তব বিচ্যুত কিছুটা পাগলপারা, অসুস্থ। (Lear)

ফেরার পথে মাথাটা হালকা লাগে। কলকাতায় অনেকদিন পর কোনও শিল্পকাজ দেখে আবার সুস্থ লাগল। সমকালের কালো দাগ খুঁজতে আবারও শেক্সপিয়ারকে দরকার হল এক প্রবীণ পরিচালকের। এই অভিনয় দেখে তাই বিশ্বাস বেড়ে যায়। থিয়েটারের মাঝে পর্দায় হঠাৎ শুরু হয়ে গেল আবিশ্ব পরিযায়ী শ্রমিকদের চিত্রায়ণ। থিয়েটারের অঞ্জনের শেষ অভিনয় মনে থাকবে, এটাই বারবার মনে হতে থাকল। (Lear)
আমরাও কি যাহোক করে একটা জীবন গড়তে চাইছি একটা বয়সের পর? সত্যিটা বুঝতে পারছে ক’জন?
আরও কিছু কথা ভেসে এল, যেমন- বড় অস্থির সময়ে অঞ্জন আবার মঞ্চস্থ করলেন লিয়ার। ভাবছিলাম, কেন করলেন? বন্ধুদের দিকে তাকালে দেখি কম বন্ধুরাই আজ সুখী, বাকিরা সুখ ব্যালেন্স করার চেষ্টায়। কিন্তু সত্যিকারের ভাল আছে ক’জন? বড় চাকরি, বড় সংসারই কি সুখের একমাত্র চাবিকাঠি? তবে কেন বন্ধুরা অনেকেই দুঃখে আছে! বড্ড তাড়াতাড়ি কি আমরা নিজেদের গোছাতে চাইছি? লিয়ারও যেমন চেয়েছিলেন? মেয়েদের বিশ্বাস করে রাজ্য ভাগ করে দিয়েছিলেন তাই দ্রুত? আমরাও কি যাহোক করে জীবন গড়তে চাইছি একটা বয়সের পর? সত্যি আমাদের বুঝতে পারছে ক’জন? ক’জন সত্যিকারের বন্ধুকে হাতের কাছে পাচ্ছি, চাইলেই? (Lear)

পাচ্ছি না। তবু পাওয়ার এই যে নাছোড় তাগিদ, সেখানেই হয়তো আগামী জীবনের অর্থ। এই অস্থিরতা আমাদের সময়ের। অঞ্জনের লিয়ারও যেমন বড় অস্থির। আশা করি এই অস্থিরতা পেরিয়ে আমরা আবার শান্ত হয়ে দু’দণ্ড বসব মুখোমুখি।
আমরা আবার সুস্থ হব। (Lear)
ছবি সৌজন্যে: শীলভদ্র দত্ত
পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।