(Jyotirindranath Tagore) “গঙ্গার পশ্চিম পারে আমাদের কোন্নগরের বাগান, জ্যোতিকাকামশায় সেখানে আছেন। কোনদিন এপার থেকে বাবামশায়ের পানসি যায়, কোনদিন বা ওপার থেকে জ্যোতিকাকামশায়ের পানসি আসে ; এমনি যাওয়া আসা। বন্দুকের আওয়াজ করে সিগনেলে কথা বলতেন তাঁরা। একবার আমায় দাঁড় করিয়ে আমার কাঁধের উপর বন্দুক রেখে বাবামশায় বন্দুক ছোঁড়েন । পেনিটির বাগান থেকে ওপারে, জ্যোতিকাকামশায় তার সাড়া দেন। গুলি চলে কানের পাশ দিয়ে, চোখ বুজে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি“ , বাবা গুণেন্দ্রনাথ এবং কাকা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গল্প লিখেছেন স্বয়ং অবন ঠাকুর। (Jyotirindranath Tagore)
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে প্রতিভাধর বলতে যে দু-তিনজনকে বোঝায়, নিঃসন্দেহে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথের আদরের ‘জ্যোতিদাদা’, তাঁদের অন্যতম। শিল্পীসত্তার প্রায় সব প্রাঙ্গণেই তাঁর অনায়াস পদচারণা – সে নাট্যরচনা হোক বা অভিনয় , সঙ্গীতরচনা বা গায়ন, চিত্রশিল্প অথবা বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল একজন সমাজসেবক ও ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর ব্যতিক্রমী ভূমিকা। (Jyotirindranath Tagore)
ভিডিও: লীলা-আলেখ্য – জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য
ঠাকুরবাড়িতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হওয়ার সাত বছর পরে ১৮৪৯ সালে তাঁর পঞ্চম পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জন্ম। দিনটা ৪ঠা মে। অনুজ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে ছিলেন তাঁর জ্যোতিদাদা। মাত্র আঠারো বছর বয়সে প্রথাগত শিক্ষার পাটে দাঁড়ি টেনে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পাড়ি দেন মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে বোম্বাই শহরে। সত্যেন্দ্রনাথ তখন সেখানে সিভিল সারভেন্ট হিসেবে সরকারি পদে আসীন। মেজবউঠাকুরাণী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর কাছে শুনেছিলেন বোম্বাইয়ের গল্প, সমুদ্রের বর্ণনা। তারই আকর্ষণে জোড়াসাঁকো থেকে বোম্বাই! (Jyotirindranath Tagore)
ছোট ভাই “জ্যোতি” যে মনের আনন্দে সেতার, চিত্রাঙ্কন এবং ফরাসী ভাষা শেখা শুরু করেছেন সে কথা খুড়তুতো ভাই গণেন্দ্রনাথকে সত্যেন্দ্রনাথ চিঠিতে জানালেন। এক হিসেবে বোম্বাইয়ের প্রবাস কালে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাংস্কৃতিক এবং শৈল্পিক জীবনের হাতেখড়ি হয়েছিল বলা যায়। (Jyotirindranath Tagore)
খোলা মনের মানুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের জ্যোতিদাদা। “পুরনো কায়দার ভিড়ের মধ্যে জ্যোতিদাদা এসেছিলেন নির্জলা নতুন মন নিয়ে”,“ছেলেবেলা”-র স্মৃতিকথনে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বারো বছরের ছোট এই ভাইটির প্রতি ছিল তাঁর অসীম মমত্ববোধ এবং রীতিমত গুরুত্ব দিতেন তাঁর মতামতের – জ্যাঠামি বা ছেলেমানুষি বলে মুখ চাপা দিতেন না কখনই।
জমিদারির কাজ দেখতে প্রায়ই তাঁকে যেতে হত শিলাইদহে – একবার সঙ্গে নিলেন – “আকাশ-বাতাসে–চড়ে-বেড়ানো“ মনের রবিকে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের শিকারের হাত ছিল ভাল। তাই শিলাইদহে বাঘ বেরোনোর খবর পেয়ে বন্দুক বাগিয়ে বিশ্বনাথ শিকারি ও দলবলসহ যখন জঙ্গলে যাওয়া ঠিক করলেন, বাদ পড়ল না রবি। আবার সে যখন বায়না করল ফুলের রস বার করবার জন্য পেষাই কল দরকার, ছুতোর ডেকে তা বানিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করলেন বিনা প্রশ্নে, গুরুত্ব সহকারে।
শিবনাথ শাস্ত্রী— বাঙালির বোধের উত্তরণের অন্যতম ‘নায়ক’
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অসামান্য সাঙ্গিতিক বোধ, মনন এবং ব্যুৎপত্তি ঠাকুরবাড়িকে সমৃদ্ধ করেছিল । সে বাড়ির তেতলার ছাদের ঘরে পিয়ানোয় হাত চালিয়ে সৃষ্টি করতেন নতুন নতুন সুর – পাশে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ যাঁর কাজ ছিল “সেই ছুটে চলা সুরে কথা বসিয়ে বেঁধে রাখবার“! কখনো বা সূর্যাস্তে চন্দননগরের গঙ্গাবক্ষে নৌকায় ভেসেছেন – জ্যোতিরিন্দ্রনাথের হাতে উঠেছে বেহালা – রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠ জুড়ে গান। পরবর্তীকালে নিজেই স্বীকার করেছেন জ্যোতিদাদার প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার কথা। “ সাহিত্যের শিক্ষায় , ভাবের চর্চায় , বাল্যকাল হইতে জ্যোতিদাদা আমার প্রধান সহায় ছিলেন“।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাহিত্য কীর্তির সাক্ষ্য বহন করে তাঁর স্বরচিত সঙ্গীত ভাণ্ডার এবং নাটক ও প্রহসন। আবার তাঁর লেখা থেকেই জানা যায় “সরোজিনী” নাটকে “জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ, পরাণ সঁপিবে বিধবাবালা…” রচয়িতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ; সুর যদিও নাট্যকারের। পেশাদার থিয়েটারের আদিকাল অবধি জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে পাওয়া যায় একজন সফল নাট্যকার হিসেবে। তাঁরই উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল “জোড়াসাঁকো নাট্যশালা”। সম্পাদক হিসেবেও তিনি তাঁর সাহিত্যসত্তার মুনশিয়ানা রেখেছেন “ভারতী”, “বীণাবাদিনী” ইত্যাদি পত্রিকার পাতায়।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ স্বাদেশিকতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। একদিকে স্বদেশের শিল্পে দেশলাই, কাপড় ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর উৎপাদন – অপর দিকে গঙ্গার বুকে সস্তায় জাহাজ পরিবহণ ব্যবস্থার প্রচলন – এ সবই ছিল তাঁর মস্তিস্ক প্রসূত। যদিও কোনটিতেই সেভাবে সাফল্য আসেনি – বরং সে সব উদ্যোগ ভেসে গেছে “ঋণে এবং সর্বনাশে”!
স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর আকস্মিক মৃত্যু জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বাকি জীবনে নিয়ে আসে এক ধরণের হতাশা। রাঁচির কাছে “শান্তিধাম” বাড়িতে শুরু হয় তাঁর নিভৃতবাস। ১৯২৫ সালের ৪ঠা মার্চ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনজ্যোতি নিভে যায়। আজ তাঁর জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য। (Jyotirindranath Tagore)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।