(Kazi Nazrul Islam)
কাজী নজরুল ইসলাম
(১৮৯৯-১৯৭৬)
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান বাঙালি কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার ও সঙ্গীতজ্ঞ। তাঁর মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
বিদায় অভিশাপ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মিস্টার আজহার কলকাতায় নাম-করা তরুণ ব্যারিস্টার।
বাটলার, খানসামা, বঙ্গ, দারোয়ান, মালি, চাকর-চাকরানীতে বাড়ী তার হর্দম সরগরম।
কিন্তু বাড়ীর আসল শোভাই নাই। মিস্টার আজহার অবিবাহিত।
নাম-করা ব্যারিস্টার হ’লেও আজহার সহজে বেশী কেস্ নিতে চায় না।
হাজার পীড়াপীড়িতেও না। লোকে বলে, পসার জমাবার এও এক রকম চাল। (Kazi Nazrul Islam)
কিন্তু কলকাতার দাবা’ড়েরা জানে, যে, মিস্টার আজহারের চাল যদি থাকে-তা সে দাবার চাল।
দাবা-খেলায় তাকে আজো কেউ হারাতে পারেনি। তার দাবার আডডার বন্ধুরা জানে, এই দাবাতেই মিস্টার আজহারকে বড় ব্যারিস্টার হ’তে দেয়নি, কিন্তু বড় মানুষ ক’রে রেখেছে। (Kazi Nazrul Islam)
বড় ব্যারিস্টার যখন “উইকলি নোটস” পড়েন আজহার তখন অ্যালেখিন, ক্যাপারাঙ্কা কিম্বা রুবিনস্টাইন, রেটি, মরফির খেলা নিয়ে ভাবে, কিম্বা চেস-ম্যাগাজিন নিয়ে পড়ে, আর চোখ বুজে তাদের চালের কথা ভাবে। (Kazi Nazrul Islam)
সকালে আর হয় না, বিকেলের দিকে রোজ দাবার আড্ডা বসে। কলকাতার অধিকাংশ বিখ্যাত দাবা’ড়েই সেখানে এসে আড্ডা দেয়, খেলে, খেলা নিয়ে আলোচনা করে। (Kazi Nazrul Islam)
আজহারের সবচেয়ে দুঃখ, ক্যাপাব্লাঙ্কার মত খেলোয়াড় কিনা অ্যালে-খিনের কাছে হেরে গেল। অথচ এই অ্যালেখিনই বোগোল-জুবোর মত খোলোয়াড়ের কাছে অন্ততঃ পাঁচ পাঁচবার হেরে যায়। (Kazi Nazrul Islam)
মিস্টার মুখার্জী অ্যালেখিনের একরোখা ভক্ত। আজও মিস্টার আজহার নিত্যকার মত একবার ঐ কথা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলে, মিস্টার মুখার্জী ব’লে উঠলো- “কিন্তু তুই যাই বল আজহার, অ্যালেখিনের ডিফেন্স-এর বুঝি জগতে তুলনা নেই। আর বোগোল-জুবো? ও যে অ্যালেখিনের কাছে তিন-পাঁচে পনের বার হেরে ভূত হয়ে গেছে! ওয়ার্লড-চ্যাম্পিয়ানশিপের খেলায় অমন দু’চার বাজি সমস্ত ওয়ালর্ড-চ্যাম্পিয়ান হেরে থাকেন। চব্বিশ দান খেলায় পাঁচদান জিতেছে। তা ছাড়া, বোগোল-জুবোও ত যে সে খেলোয়াড় নয়!” (Kazi Nazrul Islam)
আজহার হেসে ব’লে উঠল, “আরে রাখ তোমার অ্যালেখিন। এইবার ক্যাপারাঙ্কার সাথে আবার খেলা হচ্ছে তার, তখন দেখো একবার অ্যালেখিনের দুর্দশা। আর বোগোল জুবোকে ত সেদিনও ইটালিয়ান মন্টিসেলি বগল-দাবা করে দিলে! হাঁ, খেলে বটে গ্রানফেল্ড্।” (Kazi Nazrul Islam)
বন্ধুদের মধ্যে একজন চটে গিয়ে বললে, “তোমাদের কি ছাই আর কোনো কাম নেই? কোথাকার বগলষুপো না ছাইমুও, অ্যালেখিন না ঘোড়ার ডিম- জ্বালালে বাবা।”
মুখার্জী হেসে বলল, “তুমি ত বেশ গ্রাবু খেলতে পার অজিত, এমন মাঃ ভাদর, চ’লে যাও না স্ত্রীর বোনদের বাড়ীতে। এ দাবার চাল ঢুকবে না তোমার মাথায়। (Kazi Nazrul Islam)
তরুণ উকিল নাজিম হাই তু’লে তুড়ি দিয়ে ব’লে উঠলে, “ও জিনিস মাথায় না ঢুকাতে বেঁচে গেছি বাবা! তার চেয়ে আজহার সাহেব দুটো গান শোনান, আমরা শুনে যে যার ঘরে চলে যাই।
তরুণ উকিল নাজিম হাই তু’লে তুড়ি দিয়ে ব’লে উঠলে, “ও জিনিস মাথায় না ঢুকাতে বেঁচে গেছি বাবা! তার চেয়ে আজহার সাহেব দুটো গান শোনান, আমরা শুনে যে যার ঘরে চলে যাই। তারপর তোমরা রাজা মন্ত্রী নিয়ে বস।” (Kazi Nazrul Islam)
দাবাড়ে দলের আপত্তি টিকল না। আজহারকে গাইতে হ’ল। আজহার চমৎকার ঠুংরী গায়। বিশুদ্ধ লক্ষ্ণৌ চং-এর অজস্র ঠুংরী গান তার জানা ছিল। এবং তা এমন দরদ দিয়ে গাইত সে, যে শুনত, সেই মুগ্ধ হয়ে যেত। আজ কিন্তু সে কেবলি গজল গাইতে লাগল। (Kazi Nazrul Islam)
আজহার অন্য সময় সহজে গজল গাইতে চাইত না।
মুখার্জী হেসে ব’লে উঠল, “আজ তোমার প্রাণে বিরহ উথলে উঠল নাকি হে? কেবল গজল গাচ্ছ, মানে কি? রংচং ধরেছে নাকি কোথাও?”
আজহারও হেসে বলে, “বাইরের দিকে একবার তাকিয়ে দেখ।” (Kazi Nazrul Islam)
এতক্ষণে যেন সকলের বাইরের দিকে নজর পড়ল। একটু আগের বর্ষা-বোওয়া ছলছলে আকাশ। যেন একটি বিরাট নীল পদ্ম। তারই মাঝে শরতের চাঁদ যেন পদ্মমণি। চারপাশে তারা যেন আলোক-ভ্রমর।
লেক-রোডের পাশে ছবির মত বাড়ীটি। (Kazi Nazrul Islam)
শিউলির সাথে রজনীগন্ধার গন্ধ-মেশা হাওয়া মাঝে মাঝে হলঘরটাকে উদাসমদির ক’রে তুলছিল।
সকলেরই চোখ মন দু’ই যেন জুড়িয়ে গেল:
নাজিম সোজা হয়ে বসে বলল, “ওই দাবার গুঠি নিয়ে বসে কি আর এসব চোখে পড়ত?”
আজহার দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যমনস্কভাবে বলে উঠল, “সত্যিই তাই!”
মুখাজী ব’লে উঠল, “মাঃ, এ শালার শিউলির ফুল আজ দাবা খেলতে দেবে না দেখছি?”
আজহার বিখিত হয়ে ব’লে উঠল, “তোমারও শিউলি ফুলের সঙ্গে কোনো-কিছু জড়িত আছে নাকি হে?”
তার কিছু বলবার আগেই অজিত ব’লে উঠল, “আরে ছোঃ। দাবাড়ের আবার রোমান্স! বেচারার জীবনে একমাত্র লাভ-অ্যাফেয়ার স্ত্রীর সঙ্গে। নিজের স্ত্রীর প্রেমে পড়াঃ রাম বলঃ তাও-সে স্ত্রী চ’লে গেছেন বাপের বাড়ী-ঐ দাবার জ্বালায়। ওর আবার শিউলি ফুল:”
সকলে হো হো ক’রে হেসে উঠল। মুখার্জী চ’টে গিয়ে ব’লে উঠল, “তুই থাম অজিত! পাগলের মত যা তা বল্লেই তাকে রসিকতা বলে না!”
অজিত মুখ চুন করার ভান করে বলে উঠল, “আমি ত রসিকতা করিনি দাদা। তুমি সত্যসত্যিই তোমার স্ত্রীর প্রেমে পড়েছ-দশজনে বদনাম দেয়, তাই আমিও বল্লাম। ওরা যদি তা শুনে হাসেন, তাতে আমার কি দোষ হ’ল?”
আজহার হেসে ব’লে উঠল, “এ কি তোমার অন্যায় অপবাদ অজিত? স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়া আর কারুর সঙ্গে দাবাড়ের কোনো কিছু দুর্ঘটনা ঘটতে পারে না, এ তুমি কি করে জানলে?”
অজিত বললে, “প্রথম মিস্টার মুখার্জী তারপর তোমাকে দেখে!” আজহার বলে উঠল, “আরে, আমি যে বিয়েই করিনি।”
অজিত ব’লে উঠল, “তার মানে, তোমার অবস্থা আরো শোচনীয়। ও বেচারা তবু অন্ততঃ স্ত্রীর সঙ্গে লভে পড়ল, তোমার আবার স্ত্রীই জুটল না?”
নাজিম টেবিল চাপড়ে চে’চিয়ে ব’লে উঠল, “ব্রাভো। বে’চে থাকুন অজিত বাবু! এইবার জোর বলেছেন!”
এমন সময় মালি শিউলিফুলের একজোড়া চমৎকার গো’ড়ে মালা টেবিলের উপরে রেখে চ’লে গেল। অজিত গম্ভীরভাবে মালা দু’টি র্যাকেটে বুলিয়ে রাখতেই সকলে হেসে উঠল।
এমন সময় মালি শিউলিফুলের একজোড়া চমৎকার গো’ড়ে মালা টেবিলের উপরে রেখে চ’লে গেল। অজিত গম্ভীরভাবে মালা দু’টি র্যাকেটে বুলিয়ে রাখতেই সকলে হেসে উঠল। অজিত অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে অভিনয় করার সুরে ব’লে উঠল, “হে র্যাকেট-সুন্দরী। আজি এই শুক্লা শারদীয়া নিশেতে এই সে উতি মালার-” (Kazi Nazrul Islam)
আজহার ম্লান হাসি হেসে বাধা দিয়ে বলল, “দোহাই অজিত। ও মালা নিয়ে বিদ্রূপ করিনে ভাই! ও মালা আমার নয়।”
অজিত না-ছোড় বান্দা। তার বিস্ময়কে চাপা দিয়ে সে ব’লে উঠল, “তবে এ মালা কার বন্ধু? থুড়ি-কার উদ্দেশে বন্ধু?”
নাজিম ব’লে উঠল, “দেখ, দাবাড়ের নাকি রোমান্স নেই?”
আজহার ব’লে উঠল, “আমি প্রতি বছর এমনি পয়লা আশ্বিন শিউলিফুলের মালা জলে ভাসিয়ে দেই। এ মালা জলের-অন্য কারুর নয়।” মুখে বিষাদ-মাখা হাসি।
মায় দাবাড়ের দল পর্যন্ত খাড়া হয়ে উঠে সবল। অজিত বয়কে হাঁক দিয়ে চা আনতে বলে ভাল করে কাপড়-চোপড় গুছিয়ে ব’সে আজহারের দিকে চেয়ারটা ফিরিয়ে বলে উঠল, “তারপর, বলত বন্ধু, ব্যাপারটা কি। সন্তীন নিশ্চয়ই। পয়লা আশ্বিন–প্রতি বছর শিউলি-মালা-জলে ভাসিয়ে দেওয়া চমৎকার গল্প হবে। ব’লে ফেল। নইলে, এইখানে সকলে মিলে সত্যাগ্রহ আরম্ভ করে দেবো?” (Kazi Nazrul Islam)
সকলে হেসে উঠল, কিন্তু সায় দিল সকলে অজিতের প্রস্তাবে।
অনেক পীড়াপীড়ির পর আজহার হেসে ব’লে উঠল, “কিন্তু তারও আরম্ভ যে দাবা খেলা দিয়ে!”
অজিত লাফিয়ে ব’লে উঠল, “তা হোক। ও পড়ার সুক্তো খেয়ে ফেলা যাবে কোনো রকমে, শেষের দিকে দই-সন্দেশ পাব।”
মুখার্জী ব’লে উঠল, এ দাবা-খেলায় নৌকোর কিস্তিই বেশী থাকবে হে! গজ ঘোড়া সব কাটাকাটি হয়ে যাবে। ভয় নেই।”
॥২॥
সকলের আর এক প্রস্থ চা খাওয়া হ’লে পর সিগার ধরিয়ে- মিনিটখানিক ঘুম উদ্গীরণ ক’রে আজহার বলতে লাগল।-
তখন সবেমাত্র ব্যারিস্টারী পাস ক’রে এসেই শিলং বেড়াতে গেছি। তখনো পূজার ছুটিওয়ালার দল এসে ভিড় জমায়নি। তবে আগে থেকেই দু’একজন ক’রে আসতে শুরু করেছেন। ছেলেবেলা থেকেই আমার দাবাখেলার ওপর বড্ড বেশী ঝোঁক ছিল। ও ঝোঁক বিলেতে গিয়ে আরো বেশী করে চাপল। সেখানে ইয়েট্রন, মিচেল, উইন্টার, টমাস প্রভৃতি সকল নাম-করা খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলেছি এবং কেমব্রিজের হয়ে অনেকগুলো খেলা জিতেওছি। শিলং গিয়ে খুঁজতেই দু’একজন দাবা-খেলোয়াড়ের সঙ্গে পরিচয়ও হয়ে গেল। তবে তারা কেউ বড় খেলোয়াড় নয়। তারা আমার কাছে ক্রমাগত হারত। একদিন ওরই মধ্যে একজন ব’লে উঠল, ‘একজন বুড়ো রিটায়ার্ড প্রফেসর আছেন এখানে, তিনি মস্ত বড় দাবাড়ে, শোনা যায়-
তাঁকে কেউ হারাতে পারে না- যাবেন খেলতে তাঁর সাথে?” আমি তখনি উ’ঠে প’ড়ে বললাম, “এখনই যাব, চলুন। কোথায় তিনি?”
সে ভদ্রলোকটি বলেন, “চলুন না, নিয়ে যাচ্ছি। আপনার মত খেলোয়াড় পেলে তিনি বড় খুশী হবেন। তাঁরও আপনার মতই দাবা-খেলার নেশা। অদ্ভুত খেলোয়াড় বুড়ো, চোখ বেঁধে খেলে মশাই।”
আমি ইউরোপে অনেকেরই “ব্লাইন্ড ফোন্ডেড্” খেলা দেখেছি, নিজেও অনেকবার খেলেছি। কাজেই এতে বিশেষ বিস্মিত হলাম না। (Kazi Nazrul Islam)
তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আকাশে এক ফালি চাঁদ, বোধহয় গুরুপঞ্চমীর। যেন নতুন আশার ইঙ্গিত। সারা আকাশে যেন সাদামেঘের তরণীর বাইচ খেলা শুরু হয়েছে। চাঁদ আর তারা তার মাঝে যেন হাবুডুবু খেয়ে একবার ভাঙ্গে একবার উঠছে।
ইউকালিপটাস্ আর দেওদারু তরুঘেরা একটি রঙীন বাঙলোয় গিয়ে আমরা উঠতেই দেখি, প্রায় ঘাটের কাছাকাছি বয়েস এক শান্ত সৌম্যমূর্তি বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটি তরুণীর সঙ্গে দাবা খেলছেন।
ইউকালিপটাস্ আর দেওদারু তরুঘেরা একটি রঙীন বাঙলোয় গিয়ে আমরা উঠতেই দেখি, প্রায় ঘাটের কাছাকাছি বয়েস এক শান্ত সৌম্যমূর্তি বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটি তরুণীর সঙ্গে দাবা খেলছেন। (Kazi Nazrul Islam)
আমাদের দেশের মেয়েরাও দাবা খেলেন, এই প্রথম দেখলাম।
বিষয়-শ্রদ্ধা-ভরা দৃষ্টি দিয়ে তরুণীর দিকে তাকাতেই তরুণীটি উঠে প’ড়ে, বললে, “বাবা, দেখ কা’রা এসেছেন!”
খেলাটা শেষ না হ’তেই মেয়ে উ’ঠে পড়াতে বৃদ্ধ ভদ্রলোক যেন একটু বিরক্ত হয়েই আমাদের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই হাসিমুখে উঠে বললেন,
“আরে, বিনয় বাবু যে। এরা কারা? এস, বস। এঁদের পরিচয়-“
বিনয় বাবু-যিনি আমায় নিয়ে গেছিলেন, আমার পরিচয় দিতেই বৃদ্ধ লাফিয়ে উ’ঠে আমায় একেবারে বুকে জড়িয়ে ধ’রে ব’লে উঠলেন, “আপনি-এই তুমিই আজহার? আরে, তোমার নাম যে চেস-ম্যাগাজিনে, কাগজে অনেক দেখেছি। তুমি যে মস্ত বড় খেলোয়াড়। ইয়েটসের সঙ্গে বাজি চটিয়েছ, একি কম কথা! এইত তোমার বয়েস! বড় খুশী হলুম- বড় খুশী হলুম! ওমা শিউলি, একজন মস্ত দাবা’ড়ে এসেছেন। দেখে যাও। বাঃ, বড় আনন্দে কাটবে তা হ’লে। এই বয়সেও আমার বড্ড দাবা-খেলার ঝোঁক, কী করি, কাউকে না পেয়ে মেয়ের সাথেই খেছিলুম।” বলেই হো হো ক’রে প্রাণ- খোলা হাসি হেসে শান্ত সন্ধ্যাকে মুখরিত ক’রে তুললেন। (Kazi Nazrul Islam)
শিউলি নমস্তার ক’রে নীরবে তাঁর বাবার পাশে এস বসল। তাকে দেখে আমার মনে হল, এ যেন সত্যই শরতের শিউলি।
গায়ে গোধূলি রং-এর শাড়ীর মাঝে নিষ্কলঙ্ক শুভ্র মুখখানি-হলুদ রং বোটায় শূদ্র শিউলিফুলের মতই সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমার চেয়ে থাকার মাত্রা হয়ত একটু বেশীই হয়ে পড়েছিল। বৃদ্ধের উক্তিতে আমার চমক ভাঙল।
বৃদ্ধ যেন খেলার জন্য অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছিলেন। চাকর চায়ের সরঞ্জাম এনে দিতেই শিউলি চা তৈরী করতে করতে হেসে বলে উঠল, “বাবার বুঝি আর দেরী সইছে না?” ব’লেই আমার দিকে তাকিয়ে ব’লে উঠল, “কিছু মনে করবেন নাঃ বাবা বড্ড দাবা খেলতে ভালবাসেন। দাবা খেলতে না পেলেই ওঁর অসুখ হয়।” ব’লেই চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল, “এইবার চা খেতে খেতে খেলা আরম্ভ করুন, আমরা দেখি।” (Kazi Nazrul Islam)
বিনয় হেসে বলল, “হাঁ, এইবার সমানে সমানে লড়াই! বুঝলে মিস চৌধুরী, আমাদের রোজ উনি হারিয়ে ভূত ক’রে দেন!”
খেলা আরম্ভ হ’ল। সকলে উৎসুক হয়ে দেখতে লাগল, কেউ কেউ উপরচালও দিতে লাগল। মিস চৌধুরী ওরফে শিউলি তার বাবার যা দু’একটি ত্রুটি ধরিয়ে দিলে, তাতে বুঝলাম-এও এর বাবার মতই ভাল খেলোয়াড়। (Kazi Nazrul Islam)
কিছুক্ষণ খেলার পর বুঝলাম, আমি ইউরোপে যাঁদের সঙ্গে খেলেছি-তাঁদের অনেকের চেয়েই বড় খেলোয়াড় প্রফেসর চৌধুরী। আমি প্রফেসর চৌধুরীকে জনতাম বড় কেমিস্ট ব’লে, কিন্তু তিনি যে এমন অদ্ভুত ভাল দাবা খেতে পারেন, এ আমি জানতাম না। (Kazi Nazrul Islam)
আমি একটা বেশী চাল কেটে নিতেই বৃদ্ধ আমার পিঠ চাপড়ে তারিফ ক’রে ডিফেন্সিভ্ খেলা খেলতে লাগলেন। তিনি আমার গজের খেলার যথেষ্ট প্রসংশা করলেন।
আমি একটা বেশী চাল কেটে নিতেই বৃদ্ধ আমার পিঠ চাপড়ে তারিফ ক’রে ডিফেন্সিভ্ খেলা খেলতে লাগলেন। তিনি আমার গজের খেলার যথেষ্ট প্রসংশা করলেন। শিউলি বিস্ময় ও প্রশংসার দৃষ্টি দিয়ে বারে বারে আমার দিকে তাকাতে লাগল। কিন্তু একটা চাল কম নিয়েও বৃদ্ধ এমন ভাল খেলতে লাগলেন যে, আমি পাছে হেরে যাই এই ভয়ে খেলাটা ড্র ক’রে দিলামঃ বৃদ্ধ বারংবার আমার প্রশংসা করতে করতে বললেন, “দেখলি মা শিউলি, আমাদের খেলোয়াড়দের বিশ্বাস, গজ ঘোড়ার মত খেলে না। দেখলি জোড়া গজে কি খেললে! বড় ভাল খেল বাবা তুমি! আমি হারি কিম্বা হারাই, ড সহজে হয় নাঃ” (Kazi Nazrul Islam)
শিউলি হেসে বলে, “কিন্তু তুমি হারনি কত বৎসর বল ত বাবা?”
প্রফেসর চৌধুরী হেসে বললেন, “না মা, হেরেছি। সে আজ প্রায় পনর বছর হ’ল, একজন পাড়গেয়ে ভদ্রলোক-আধুনিক শিক্ষিত নন- আমায় হারিয়ে দিয়ে গেছিলেন। ওঃ, ওরকম খেলোয়াড় আর দেখিনি!”
আবার খেলা আরম্ভ হ’তেই বিনয় হেসে ব’লে উঠল, “এইবার মিস চৌধুরী খেলুন না মিস্টার আজহারের সাথে!”
বৃদ্ধ খুশী হলে বললেন, “বেশ ত তুই-ই খেল মা, আমি একবার দেখি।”
শিউলি লজ্জিত হয়ে ব’লে উঠল, “আমি কি ওর সঙ্গে খেলতে পারি?” কিন্তু সকলের অনুরোধে সে খেলতে বসল। মাঝে চেস্-বোর্ড, একধারে চেয়ারে শিউলি- একধারে আমি। তার কেশের গন্ধ আমার মস্তিষ্ককে মদির ক’রে তুলছিল। আমার দেহে মনে যেন নেশা ধ’রে আসছিল। আমি দু’ একটা ভুল চা’ল দিতেই শিউলি আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নত ক’রে ফেললে। মনে হ’ল, তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা। সে হাসি যেন অর্থ-পূর্ণ। (Kazi Nazrul Islam)
আবার ভুল করতেই আমি চাপে প’ড়ে আমার একটা নৌকা হারালাম। বৃদ্ধ যেন একটু বিস্মিত হলেন। বিনয় বাবুর দল হেসে ব’লে উঠলেন-“এইবার মিস্টার আজহার মাত হবেন।” মনে হ’ল, এ হাসিতে বিদ্রূপ লুকানো আছে। (Kazi Nazrul Islam)
আমি এইবার সংযত হয়ে মন দিয়ে খেলতে লাগলাম। দুই গজ ও মন্ত্রী দিয়ে এবং নিজের কোটের বো’ড়ে এগিয়ে এমন অফেন্সিভ্ খেলা খেলতে শুরু ক’রে দিলাম যে, প্রফেসর চৌধুরীও আর এ-খেলা বাঁচাতে পারলেন না। শিউলি হেরে গেল। সে হেরে গেলেও এত ভাল খেলেছিল যে, আমি তার প্রশংসা না ক’রে পারলাম না। আমি বললাম- “দেখুন, মেয়েদের ওয়ার্লড্-চ্যাম্পিয়ান মিস মেন্টিকের সাথেও খেলেছি, কিন্তু এত বেশী বেগ পেতে হয়নি আমাকে। আমি ত প্রায় হেরেই গেছিলাম।” (Kazi Nazrul Islam)
দেখলাম, আনন্দে লজ্জায় শিউলি কমলফুলের মত রাঙা হয়ে উঠেছে। আমি বেঁচে গেলাম। সে যে হেরে গিয়ে আমার উপর ক্ষুব্ধ হয়নি-এই আমার যথেষ্ট সৌভাগ্য মনে করলাম। (Kazi Nazrul Islam)
প্রফেসর চৌধুরীর সঙ্গে আবার খেলা হল, এবারও ড্র হয়ে গেল। (Kazi Nazrul Islam)
বৃদ্ধের আনন্দ দেখে কে। বললেন, “হাঁ, এতদিন পরে একজন খেলোয়াড় পেলুম, যার সঙ্গে খেলতে হ’লে অন্ততঃ আট চা’ল ভেবে খেলতে হয়?”
কথা হ’ল, এরপর রোজ প্রফেসর চৌধুরীর বাসায় দাবার আড্ডা বসবে। (Kazi Nazrul Islam)
উঠবার সময় হঠাৎ বৃদ্ধ ব’লে উঠলেন, “মা শিউলি, এতক্ষণ খেলে মিস্টার আজহারের নিশ্চয়ই বড়ো কষ্ট হয়েছে, ওকে একটু গান শোনাও না?” আমি ততক্ষণ ব’সে পড়ে বল্লাম, “বাঃ এ খবর ত জানতাম না।”
শিউলি কুণ্ঠিতস্বরে ব’লে উঠল, “এই শিখছি কিছুদিন থেকে, এখনো ভাল গাইতে জানিনে!”
শিউলির আপত্তি আমাদের প্রতিবাদে টিকল না। সে গান করতে লাগল।
সে গান যারই লেখা হোক-আমার মনে হতে লাগল- এর ভাষা যেন শিউলিরই প্রাণের ভাষা- তার বেদনা নিবেদন।
এক একজনের কণ্ঠ আছে যা শুনে এ কণ্ঠ ভাল কি মন্দ বুঝবার ক্ষমতা লোপ ক’রে দেয়! সে কণ্ঠ এমন দরদে ভরা-এমন অকৃত্রিম যে, তা শ্রোতাকে প্রশংসা করতে ভুলিয়ে দেয়। ভালমন্দ বিচারের বহু ঊর্ধ্বে সে কণ্ঠ, কোনো কর্তব্য নেই, সুর নিয়ে কোন কৃচ্ছসাধনা নেই, অথচ হৃদয়কে স্পর্শ করে। এ প্রশংসাবাণী উৎলে উঠে মুখে নয়-চোখে! (Kazi Nazrul Islam)
এ সেই কণ্ঠ। মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কিছু বলবার ইচ্ছা ছিল না। ভদ্রতার খাতিরে একবার মাত্র বলতে গেলাম, “অপূর্ব!” গলার স্বর বেরুল নাঃ শিউলির চোখে পড়ল-আমার চোখের জল। সে তার দীর্ঘায়ত চোখের পরিপূর্ণ বিষয় নিয়ে যেন সেই জলের অর্থ খুঁজতে লাগল।
হায়, সে যদি জানত-কালির লেখা মুছে যায়, জলের লেখা মোছে না।
সেদিন আমায় নিয়ে কে কি ভেবেছিল-তা নিয়ে সেদিনও ভাবিনি, আজও ভাবি না। ভাবি- শিউলিফুল যদি গান গাইতে পারত, সে বুঝি এমনি ক’রেই গান গাইত। গলায় তার দরদ, সুরে তার এমনি আবেগ!
সুরের যেটুকু কাজ সে দেখাল, তা ঠুংরী ও টপ্পা মেশানো। কিন্তু বুঝলাম, এ তার ঠিক শেখা নয়- গলার ও কাজটুকু স্বতঃস্ফূর্ত। কমল যেমন না জেনেই তার গন্ধ-পরাগ ঘিরে শতদলের সূচারু সমাবেশ করে- এও যেন তেমনই। (Kazi Nazrul Islam)
গানের শেষে ব’লে উঠলাম, “আপনি যদি ঠুংরী শেখেন, আপনি দেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সুর-শিল্পী হতে পারেন। কি অপূর্ব সুরেলা কণ্ঠস্বর।”
শিউলিফুলের শাখায় চাঁদের আলো পড়লে তা যেমন শোভা ধারণ করে, আনন্দ ও লজ্জা মিশে শিউলিকে তেমনই ‘সুন্দর দেখাচ্ছিল।
শিউলি তার লজ্জাকে অতিক্রম ক’রে ব’লে উঠল, “না না, আমার গলা একটু ভাঙা। সে যাক, আমার মনে হচ্ছে আপনি গান জানেন। জানেন যদি, গান্ না একটা গান!”
আমি একটু মুশকিলে পড়লাম। ভাবলাম, ‘না’ বলি। আবার গান শুনে গলাটাও গাইবার জন্য সুড়সুড় করছে! বললাম, “আমি ঠিক গাইয়ে নই, সমঝদার মাত্র। আর, যা গান জানি, তাও হিন্দি।”
গান করলাম। প্রফেসর চৌধুরী তো ধরে বসলেন, তাঁকে গান শেখাতে হ’বে কা’ল থেকে। শিউলির দুই চোখে প্রশংসার দীপ্তি ঝলমল করছিল।
প্রফেসর চৌধুরী খুশী হয়ে ব’লে উঠলেন, “আহা হা হা। বলতে হয় আগে থেকে। তা হ’লে যে গানটাই আগে শুনতাম তোমার। আর গান হিন্দি ভাষায় না হ’লে জমেই না ছাই। ও ভাষাটাই যেন গানের ভাষা। দেখ, ক্লাসিকাল মিউজিকের ভাষা বাংলা হ’তেই পারে না। কীর্তন বাউল আর রামপ্রসাদী ছাড়া এ ভাষায় অন্য ঢং-এর গান চলে না।” আমি বললাম, “আমি যদিও বাংলা গান জানিনে, তবু বাংলা ভাষা সম্বন্ধে এতটা নিরাশাও পোষণ করি না।” (Kazi Nazrul Islam)
গান করলাম। প্রফেসর চৌধুরী তো ধরে বসলেন, তাঁকে গান শেখাতে হ’বে কা’ল থেকে। শিউলির দুই চোখে প্রশংসার দীপ্তি ঝলমল করছিল।
বিনয় বাবুর দলও ওস্তাদী গানেরই পক্ষপাতী দেখলাম। তাদের অনুরোধে দু’চারখানা খেয়াল ও টপ্পা গাইলাম। প্রফেসর চৌধুরীর সাধুবাদের আতিশয্যে আমার গানের অর্ধেক শোনাই গেল না। শেষের দিকে ঠুংরীই গাইলাম বেশী।
গানের শেষে দেখি, আমাদের পিছন দিকে আরো কয়েকটি মহিলা এসে দাড়িয়েছেন। শিউলি পরিচয় ক’রে দিল-ইনি আমার মা- ইনি মামিমা-এরা আমার ছোট বোন।”
তার পরের দিন দুপুরে প্রফেসর চৌধুরীর বাড়ীতে নিমন্ত্রিত হ’লাম। ফিরবার সময় নমস্কারান্তে চোখে পড়ল শিউলির চোখ। চোখ জ্বা’লা করে উঠল। মনে হ’ল, চোখে এক কণা বালি পড়লেই যদি চোখ এত জ্বালা করে- চোখে যার চোখ পড়ে তার যন্ত্রণা বুঝিঃ অনুভূতির বাইরে! (Kazi Nazrul Islam)
দেড় মাস ছিলাম শিলং-এ। হপ্তাখানেকের পরেই আমাকে হোটেল ছেড়ে প্রফেসর চৌধুরী বাড়ী থাকতে হয়েছিল গিয়ে। সেখানে আমার দিন-রাত্রি নদীর জলের মত বয়ে যেতে লাগলো। কাজের মধ্যে দাবা-খেলা আর গান।
মুশকিলে পড়লাম-প্রফেসর চৌধুরীকে নিয়ে। তার সঙ্গে দাবা-খেলা ত আছেই-তাঁকে গান সেখানোই হয়ে উঠল আমার পক্ষে সব চেয়ে দুষ্কর কার্য। (Kazi Nazrul Islam)
শিউলিও আমার কাছে গান শিখতে লাগল। কিছুদিন পরেই আমার তান ও গানের পুঁজি প্রায় শেষ হয়ে গেল।
মনে হ’ল, আমার গান শেখা সার্থক হয়ে গেল। আমার কণ্ঠের সকল সঞ্চয় রিক্ত ক’রে তার কণ্ঠে ঢেলে দিলাম।
আমাদের মালা বিনিময় হ’ল না-হবেও না এ জীবনে কোনদিন- কিন্তু কণ্ঠ বদল হয়ে গেল! আর মনের কথা-সে শুধু মনই জানে! banglaint
অজিত বাধা দিয়ে ব’লে উঠল, “কণ্ঠ না কণ্ঠী বদল বাবা? শেষটা নেড়ানেড়ীর প্রেম? ছো”
আজহার কিছু না ব’লে আবার সিগার ধরিয়ে ব’লে যেতে লাগল-একদিন ভোরে শিউলির কণ্ঠে ঘুম ভেঙে গেল। সে গাচ্ছিল-“এখন আমার সময় হ’ল
যাবার দুয়ার খোলো খোলো।”
গান শুনতে শুনতে মনে হ’ল- আমার বুকের সকল পাঁজর জুড়ে ব্যথা। চেষ্টা করেও উঠতে পারলাম না। চোখে জল ভ’রে এল।
আশাবরী সুরে কোমল গান্ধারে আর দৈবতে যেন তার হৃদয়ের সমস্ত বেদনা গড়িয়ে পড়েছিল! আজ প্রথম শিউলির কণ্ঠস্বরে অশ্রুর আভাস পেলাম।
ঠং ক’রে কিসের শব্দ হ’তেই ফিরে দেখি, শিউলি তার দু’টি কর-পল্লব ভরে শিউলি ফুলের অঞ্জলি নিয়ে পূজারিণীর মত আমার টেবিলের উপর রাখছে। চোখে তার জল।
আমার চোখে চোখ পড়তেই সে তার অশ্রু লুকাবার কোনো ছলনা না ক’রে জিজ্ঞাসা করল-আপনি কি কালই যাচ্ছেন?
উত্তর দিতে গিয়ে কান্নায় আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। পরিপূর্ণ শক্তি দিয়ে হৃদয়াবেগ সংযত ক’রে আস্তে বল্লাম-“হাঁ তাই?” আরো যেন কি বলতে চাইলাম। কিন্তু কি বলতে চাই ভুলে গেলাম। (Kazi Nazrul Islam)
শিউলি, শিউলি ফুলগুলিকে মুঠোয় তুলে অন্যমনস্কভাবে অধরে কপোল ছুঁইয়ে বললে, “আবার কবে আসবেন।”
আমি ম্লান হাসি হেসে বললাম, “তাও জানিনে ভাই। হয়ত আসা।” শিউলি ফুলগুলি রেখে চ’লে গেল। আর একটি কথাও জিজ্ঞেস করল না।
আমার সমস্ত মন যেন আর্তস্বরে কেঁদে উঠল- ওরে মূঢ়, জীবনের মাহেন্দ্রক্ষণ তোর এই এক মুহূর্তের জন্যই এসেছিল, তুই তা হেলায় হারালি; জীবনে তোর দ্বিতীয়বার এ শুভ মুহূর্ত আর আসবে না, আসবে না।
এক মাস ওদের বাড়ীতে ছিলাম। কত স্নেহ কত যত্ন, কত আদর। অবাধ মেলা-মেশা-সেখানে কোনো নিষেধ, কোনো গ্লানি, কোনো বাধাবিঘ্ন কোনো সন্দেহ ছিল না। আর এসব ছিল না ব’লেই বুঝি এতদিন ধরে এত কাছে থেকেও কারুর করে কর-স্পর্শটুকুও লাগেনি কোনোদিন। এই মুক্তিই ছিল বুঝি আমাদের সবচেয়ে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা। কেউ কারুর মন যাচাই করিনি। কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসার কথাও উদয় হয়নি মনে। একজন অসীম আকাশ-একজন অতল সাগর। কোনো কথা নেই- প্রশ্ন নেই, শুধু এ ওর চোখে, ও এর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। (Kazi Nazrul Islam)
কেউ নিষেধ করলে না, কেউ এসে পথ আগলে দাঁড়াল না। সেও যেন জানে- আমাকে চ’লে আসতেই হবে, আমিও যেন জানি- আমাকে যেতেই হবে।
নদীর স্রোতই যেন সত্য-অসহায় দুই কূল এ ওর পানে তাকিয়ে আছে-অভিলাষ নাই-আছে শুধু অসহায় অশ্রু চোখে চেয়ে থাকা।
সে চ’লে গেলে টেবিলের শিউলি ফুলের অঞ্জলি দুই হাতে তুলে মুখে ঠেকাতে গেলাম। বুঝি বা আমারও অজানিতে আমি সে ফুল ললাটে ঠেকিয়ে আবার টেবিলে রাখলাম। মনে হ’ল, এ ফুল পুজারিণীর-প্রিয়ার নয়। ভাবতেই বুক যেন অব্যক্ত বেদনায় ভেঙে যেতে লাগল। (Kazi Nazrul Islam)
চোখ তুলেই দেখি, নিত্যকার মতই হাসিমুখে দাড়িয়ে শিউলি বলছে- “আজ আর গান শেখাবেন না?”
আমি বললাম “চল, আজই ত শেষ নয়।”
শিউলি তার হরিণ-চোখ তু’লে আমার পানে চেয়ে রইল। ভয় হ’ল ব’লে তার মানে বুঝবার চেষ্টা করলাম না।
ও যেন স্পর্শাতুর কামিনী ফুল, আমি যেন ভীরু ভোরের হাওয়া-যত ভালোবাসা, তত ভয়! ও বুঝি ছুঁলেই ধূলায় ঝ’রে পড়বে।
এ যেন পরীর দেশের স্বপ্নমায়া, চোখ চাইলেই স্বপ্ন টুটে যাবে।
এ যেন মায়া-মৃগ- ধরতে গেলেই হাওয়ায় মিশিয়ে যাবে।
গান শেখালাম-বিদায়ের গান নয়। বিদায়ের ছাড়া আর সব কিছুর গান। বিদায় বেলা ত আসবেই-তবে ওর কথা ব’লে ওর সব বেদনা সব মাধুর্যটুকু নষ্ট করি কেন?
সেদিনকার সন্ধ্যা ছিল নিস্কলঙ্ক নির্মেঘ নিরাভরণ। আমি প্রফেসর চৌধুরীকে বললাম- আজকের সন্ধ্যাটা আশ্চর্য তালমানুষ সেজেছে তা কোনো বেশভূষা নেই।
বলতেই মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রফেসর চৌধুরী ব’লে উঠলেন,- “সন্ধ্যা আজ বিধবা হয়েছে?”
এক একটি কথায় ওঁর মনের কথা বুঝতে পারলাম। এই শান্ত সৌম্য মানুষটির বুকেও কি ঝড় উঠেছে বুঝলাম। মনে মনে বললাম-তুমি অটল পাহাড়, তোমার পায়ের তলায় বসে শুধু ধ্যান করতে হয়! তোমাকে ত ঝড় স্পর্শ করতে পারে নাঃ
বৃদ্ধ বুদ্ধি মন দিয়ে আমার মনের কথা শুনেছিলেন। ম্লান হাসি হেসে বললেন- “আমি অতি ক্ষুদ্র বাবা! পাহাড় নয়, বলাকস্তূপ! তবু তোমাদের শ্রদ্ধা দেখে গিরিরাজ হ’তেই ইচ্ছা করে।”
বৃদ্ধ বুদ্ধি মন দিয়ে আমার মনের কথা শুনেছিলেন। ম্লান হাসি হেসে বললেন- “আমি অতি ক্ষুদ্র বাবা! পাহাড় নয়, বালুকাস্তূপ! তবু তোমাদের শ্রদ্ধা দেখে গিরিরাজ হ’তেই ইচ্ছা করে।”
আমি কিছু উত্তর দেবার আগেই শিউলি আমদের সামনে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল “এই যে সন্ধ্যা দেবী?” বলেই লজ্জিত হয়ে পড়লাম! (Kazi Nazrul Islam)
শিউলির সোনার তনু ঘিরে ছিল সেদিন টকটকে লাল রং-এর শাড়ী। ওকে লাল শাড়ী পরতে আর কোনদিন দেখিনি। মনে হ’ল, সারা আকাশকে বঞ্চিত ক’রে সন্ধ্যা আজ মূর্তি ধরে পৃথিবীতে নেমে এসেছে। তার দেহে রক্ত-ধারা রং-এর শাড়ী, তার মনে রক্ত-ধারা,-মুখে অনাগত নিশীথের মান ছায়া। চোখ যেমন পুড়িয়ে গেল, তেমনি মনে পূরবীর বাশী বেজে উঠল। (Kazi Nazrul Islam)
শিউলির কাছে দু-একটা বাংলা গান শিখেছিলাম। আমি বললাম-একটা গান গাইব?” শিউলি আমার পায়ের কাছে ঘাসের উপর বসে প’ড়ল
আমি গাইলাম-
‘বিবাহের রঙে রাঙা হয়ে এল
সোনার গগন রে!”
প্রফেসর চৌধুরী উ’ঠে গেলেন। যাবার সময় ব’লে গেলেন, “বাবাজী, আজ একবার শেষবার দাবা খেলতে হবে!”
চৌধুরী সাহেব উঠে যেতে আমি বল্লাম- “আচ্ছা ভাই শিউলি, আবার যখন এমনি আশ্বিন মাস- এমনি সন্ধ্যা আসবে- তখন কি করব বলতে পার?”
শিউলি তার দু চোখ ভরা কথা নিয়ে আমার চোখের উপর যেন উজাড় ক’রে দিল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘শিউলি ফুলের মালা নিয়ে জলে ভাসিয়ে দিও!”
আমি নীরবে সায় দিলাম তাই হবে। জিজ্ঞাসা করলাম- “তুমি কি করবে।” সে হেসে বললে, “আশ্বিনের শেষে ত শিউলি ঝরেই পড়ে?”
আমাদের চোখের জল লেগে সন্ধ্যাতারা চিকিচিক ক’রে উঠল।
রাত্রে দাবা–খেলার আড্ডা বসল। প্রফেসর চৌধুরী আমার কাছে হেরে গেলেন। আমি শিউলির কছে হেরে গেলাম। জীবনে আমার সেই প্রথম এবং শেষ হার! আর সেই হারাই আমার গলার হার হয়ে রইল।
সকালে যখন বিদায় নিলাম- তখন তাদের বাঙলোর চারপাশে উইলোতরু তুষারে ঢাকা পড়েছে। (Kazi Nazrul Islam)
আর তার সাথে দেখা হয়নি- হবেও না! একটু হাত বাড়ালেই হয়ত তাকে ছুঁতে পারি, এত কাছে থাকে সে। তবু ছুঁতে সাহস হয় না। শিউলি ফুল–বড় মৃদু, বড় ভীরু, গলায় পরলে দু’দণ্ডে নুইয়ে যায়! তাই শিউলি ফুলের আশ্বিন যখন আসে- তখন নীরবে মালা গাথি আর জলে ভাসিয়ে দিই। (Kazi Nazrul Islam)
বানান অপরিবর্তিত
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।