(Saroj Ghose)
মিউজিয়ামের পোশাকী বাংলা ‘সংগ্রহশালা’ কিন্তু যে নামটা আমাদের সবার চেনা, তা হল ‘যাদুঘর’। জানি না এই নামের উৎপত্তি কোথা থেকে, হয়তো প্রাচীন জিনিস, আদিমকালের মানুষ আর ডায়নোসরের মতো জীবজন্তু ইত্যাদিদের প্রায় জ্যান্ত করে আমাদের সামনে এনে ধরলে আমরা মুগ্ধ হই, ভাবি বোধহয় কোনও যাদুবলে এসব সম্ভব হচ্ছে। এদের প্রত্যেকটির সংগ্রহ থেকে প্রদর্শন আর তারপরে রক্ষণাবেক্ষণের পিছনে যে মানুষগুলির অক্লান্ত পরিশ্রম থাকে তাঁদের কথা আমরা কেউ জানতেও পারি না। (Saroj Ghose)
বিজ্ঞানে মিলায় বস্তু: শেখর গুহ
তবে অন্যান্য যাদুঘরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্রের তিনটি যাদুঘর গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের দেশে গড়ে ওঠে, এরা বিজ্ঞানের যাদুঘর। নেহরু, ঘনশ্যামদাস বিড়লা, খ্যাতনামা পদার্থবিদ কৃষ্ণন এবং বিধানচন্দ্র রায়ের উৎসাহে ১৯৫৬ সালে রাজস্থানের পিলানিতে, দিল্লীর ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরিতে আর ১৯৫৯ সালে কলকাতায় এদের প্রতিষ্ঠা হয়। কলকাতার যাদুঘরটি আমাদের সকলের পরিচিত ‘বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়াম’, সংক্ষেপে ‘বিড়লা মিউজিয়াম’। ১৯৭৮ অবধি এরা এবং এদের পরে গড়ে ওঠা সব বিজ্ঞান যাদুঘরগুলি কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ বা সিএসআইআরের অধীনে ছিল, পরে ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ সায়েন্স মিউজিয়ামস বা এন.সি.এস.এমের পত্তন হলে এরা সবাই তার অধীনে চলে যায়। (Saroj Ghose)

বিড়লা মিউজিয়ামের সঙ্গে কলকাতার মানুষের প্রত্যক্ষ যোগ প্রায় তার জন্মলগ্ন থেকে। কলকাতার যাদুঘর, সেখানে যা কিছু দর্শনীয় তারা সবাই দূরে দাঁড়িয়ে থাকে, দেখে অবাক হওয়া যায় কিন্তু ছোঁয়া যায় না, নড়ানো চড়ানো তো দূরস্থান। বিড়লা মিউজিয়াম যাঁর নেতৃত্বে আকার নিচ্ছিল সেই অমলেন্দু বসুর চিন্তাভাবনা ছিল গোড়া থেকেই একেবারে অন্যরকমের, তিনি চাইতেন এই যাদুঘর মানুষকে বিজ্ঞান নিয়ে মুগ্ধ না রেখে বিজ্ঞানকে বরং তাদের কাছে নিয়ে আসবে, বিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমকে বইয়ের পাতায় আটকে না রেখে জীবন্ত করে তুলবে। (Saroj Ghose)
হাতে কলমে বিজ্ঞানের প্রয়োগ, মডেলের সাহায্যে বিজ্ঞানকে বোঝানো, ইত্যাদি ব্যাপারে তাঁর বরাবরের আগ্রহ ছিল, এবার তিনি সঠিক ক্ষেত্র পেলেন।
এই কাজে তিনি যেসব নবীন বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, ডিজাইনারদের সহযোগী হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য ইলেক্ট্রিক্যাল কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক তেইশ বছরের তরুণ সরোজ ঘোষ। ১৯৫৮ সালে টেকনিক্যাল অফিসার পদে যোগ দিয়েই তিনি নেতার স্বপ্নকে সার্থক করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। হাতে কলমে বিজ্ঞানের প্রয়োগ, মডেলের সাহায্যে বিজ্ঞানকে বোঝানো, ইত্যাদি ব্যাপারে তাঁর বরাবরের আগ্রহ ছিল, এবার তিনি সঠিক ক্ষেত্র পেলেন। বিড়লা মিউজিয়ামে কাজের অভিজ্ঞতা এবং মানুষের কাছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে নিয়ে যাওয়ার ঐকান্তিক আগ্রহ চরিতার্থ করতে পরবর্তীকালে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ারিং’-এ স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাস নিয়ে স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিট্যুশনে গবেষণা করেছেন, অবশেষে ১৯৭৪ সালে ভারতে বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফের ইতিহাসের উপরে থিসিস লিখে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেটে ভূষিত হয়েছেন। (Saroj Ghose)

তাঁর এবং তাঁর সহকর্মীদের হাতে পড়ে বাংলার স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিড়লা মিউজিয়াম হয়ে দাঁড়াল বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির জগতে ঢোকার চাবিকাঠি। টু-স্ট্রোক আর ফোর-স্ট্রোক ইঞ্জিন, খনি থেকে তোলা দিয়ে শুরু হয়ে ব্লাস্ট ফার্নেসের মধ্যে দিয়ে লোহার ইস্পাতে বিবর্তন, গিয়ার, পুলি, চাকা ইত্যাদি মৌলিক যন্ত্রের আশ্চর্য কুশলতা, বিভিন্ন ধরণের লেন্সের মধ্যে দিয়ে আলোর বিভিন্ন গতি, তরঙ্গের সঙ্গে তরঙ্গ মিশলে কী হয়, শক্তির রূপান্তর, একটা একটা সুইচ টিপলেই সব একেবারে সামনে এসে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে! আজকের কত বিজ্ঞানীর, কত ইঞ্জিনিয়ারের হাতেখড়ি যে এই বিড়লা যাদুঘরে এসে হয়েছে তার হিসাব নেই। (Saroj Ghose)
১৯৬৫ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে সরোজ ঘোষ বিড়লা মিউজিয়ামের নির্দেশক বা ডিরেক্টর হলেন। এই পদে আসা মাত্রই তিনি এমন এক কাজ শুরু করলেন যা আমাদের দেশে এর আগে হয়নি। একটি গাড়ির মধ্যে ৩০টি মডেল বসিয়ে এক ‘ভ্রাম্যমান বিজ্ঞান যাদুঘর’ তৈরি করে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে বিজ্ঞানকে নতুন প্রজন্মের আরও কাছে নিয়ে যাওয়ার সূচনা করলেন।
১৯৬৫ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে সরোজ ঘোষ বিড়লা মিউজিয়ামের নির্দেশক বা ডিরেক্টর হলেন। এই পদে আসা মাত্রই তিনি এমন এক কাজ শুরু করলেন যা আমাদের দেশে এর আগে হয়নি। একটি গাড়ির মধ্যে ৩০টি মডেল বসিয়ে এক ‘ভ্রাম্যমান বিজ্ঞান যাদুঘর’ তৈরি করে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে বিজ্ঞানকে নতুন প্রজন্মের আরও কাছে নিয়ে যাওয়ার সূচনা করলেন। এরপরে ১৯৬৬তে একটি বাসকে উন্নততর কাঠামোয় সাজিয়ে তার নাম দেওয়া হল ‘মিউজিওবাস’ বা ‘ভ্রাম্যমান বিজ্ঞান প্রদর্শনী’। বিগত বছরগুলিতে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এরকম পঞ্চান্নটি বাস চালু হয়েছে, ত্রিশ থেকে চল্লিশ লক্ষ ছাত্রছাত্রী সেগুলি দেখতে এসেছে। (Saroj Ghose)

সরোজের জীবনে নতুন দিগন্ত খুলে গেল ১৯৭৮ সালে। মুম্বাইয়ের ওর্লিতে একটি বিরাট বিজ্ঞান যাদুঘর গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হল, তার নাম স্থির হল ‘নেহরু বিজ্ঞান কেন্দ্র’ বা ‘নেহরু সায়েন্স সেন্টার’। যে জমিটা পাওয়া গেল সেটা আদতে মিউনিসিপালিটির জঞ্জাল ফেলার জায়গা। সরোজ বুঝলেন এই জমিতে বিজ্ঞান কেন্দ্র গড়ে তুলতে যে দীর্ঘ সময় লাগবে তাতে মানুষের আগ্রহ হারিয়ে যাবে। তাঁর উদ্ভাবনীশক্তির প্রকাশ আবার দেখা গেল। ওই জমিতেই ১৯৭৯ সালে, আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষে, নেহরু বিজ্ঞান কেন্দ্রের ছত্রছায়ায় তিনি এমন এক ‘শিশু বিজ্ঞান উদ্যান’ বা ‘চিল্ড্রেন্স সায়েন্স পার্ক’ গড়ে তুললেন যার জুড়ি শুধু এদেশে নয়, পৃথিবীর কোথাও নেই। অবশেষে ১৯৮৫ সালে এই বিজ্ঞানকেন্দ্রের যখন উদ্বোধন হল ততদিনে মুম্বাইয়ের মানুষ, বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীরা তার জন্যে উন্মুখ হয়ে উঠেছে। (Saroj Ghose)
এই কেন্দ্র গড়ে ওঠার পাশাপাশি ১৯৮০তে সরোজ দিল্লীতে নতুন আরেকটি বিজ্ঞান কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করে দেন। ‘জাতীয় বিজ্ঞান কেন্দ্র’ বা ‘ন্যাশনাল সায়েন্স সেন্টার’ নামের এই কেন্দ্রে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের ইতিহাস, বিশেষতঃ ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ঐতিহ্যের উপরেও জোর দেওয়ার কথা তিনি ভাবেন, বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে চর্চার ফলে এই চেতনা তাঁকে নতুনভাবে প্রেরণা দিয়েছিল।
এই কেন্দ্র গড়ে ওঠার পাশাপাশি ১৯৮০তে সরোজ দিল্লীতে নতুন আরেকটি বিজ্ঞান কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করে দেন। ‘জাতীয় বিজ্ঞান কেন্দ্র’ বা ‘ন্যাশনাল সায়েন্স সেন্টার’ নামের এই কেন্দ্রে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের ইতিহাস, বিশেষতঃ ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ঐতিহ্যের উপরেও জোর দেওয়ার কথা তিনি ভাবেন, বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে চর্চার ফলে এই চেতনা তাঁকে নতুনভাবে প্রেরণা দিয়েছিল। ১৯৯২ সালে এই কেন্দ্রটির উদ্বোধন হয়। এই চিন্তারই আরও দুই ফসল ১৯৮২তে ব্রিটেনে ছয়মাসব্যাপী ‘ফেস্টিভ্যাল অফ ইন্ডিয়া’ বা ভারত উৎসব আর ১৯৮৫-৮৬তে আমেরিকা জুড়ে আঠারোমাসব্যাপী ভারত উৎসব, যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ‘ইন্ডিয়া– এ ফেস্টিভ্যাল অফ সায়েন্স’। এখানে আমাদের দেশে বিজ্ঞানের সাড়ে চারহাজার বছরের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছিল। (Saroj Ghose)

১৯৭৯ সালে সরোজ ঘোষ এন.সি.এস.এমের নির্দেশক নির্বাচিত হলেন। তারপর ১৯৮৬ তে হলেন মহা নির্দেশক বা ডিরেক্টর-জেনারেল এবং ১৯৯৭এ এই পদ থেকেই অবসর গ্রহণ করেন। কর্মজীবনের শেষ পাঁচ বছরে তিনি তাঁর সবচেয়ে বড় স্বপ্নটি বাস্তবায়িত করেন। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় গড়ে ওঠে ভারতের বৃহত্তম বিজ্ঞান কেন্দ্র, কলকাতার ‘সায়েন্স সিটি’ বা ‘বিজ্ঞান নগরী’। ১৯৯৭ সালে পয়লা জুলাইয়ে উদ্বোধন হওয়া এই কেন্দ্র আয়তনে এবং দর্শনার্থী সংখ্যায় পৃথিবীর প্রথম পনেরোটির মধ্যে পড়ে। বছরে কমপক্ষে দেড় লাখ লোক এটি দেখতে আসেন। (Saroj Ghose)
অবসর গ্রহণের পরেও সরোজ ঘোষের কর্মজীবনে ছেদ পড়েনি। তাঁরই উপদেশে একে একে গড়ে উঠেছে গুজরাত সায়েন্স সিটি, কলকাতার টাউন হলে কলকাতা প্যানোরামা, পার্লামেন্ট মিউজিয়াম ও রাষ্ট্রপতি ভবন মিউজিয়াম।
অবসর গ্রহণের পরেও সরোজ ঘোষের কর্মজীবনে ছেদ পড়েনি। তাঁরই উপদেশে একে একে গড়ে উঠেছে গুজরাত সায়েন্স সিটি, কলকাতার টাউন হলে কলকাতা প্যানোরামা, পার্লামেন্ট মিউজিয়াম ও রাষ্ট্রপতি ভবন মিউজিয়াম। সম্মানও তিনি পেয়েছেন প্রচুর। ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অফ মিউজিয়ামসের বিভিন্ন বিভাগে সহসভাপতি থেকেছেন ১৯৭৪ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত। তারপরে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত ওই আন্তর্জাতিক সংস্থার সভাপতির পদে থেকেছেন, ভারতীয় হিসাবে তিনিই প্রথম। অন্যান্য অনেক পুরস্কারের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ১৯৮৯ সালে পদ্মশ্রী এবং ২০০৭ সালে পদ্মভূষণ। (Saroj Ghose)
যাদুঘরের এই যাদুকরের জীবনের অবসান ঘটল ৮৯ বছর বয়সে, ১৭ই মে ২০২৫, আমেরিকার সিয়াট্লে, আন্তর্জাতিক যাদুঘর দিবসের ঠিক একদিন আগে। এরচেয়ে আশ্চর্য সমাপতন আর কীই বা হতে পারে, তাঁর কর্মকাণ্ডের প্রতি এটাই সবচেয়ে বড় কুর্নিশ। (Saroj Ghose)
বিশেষ কৃতজ্ঞতা- স্বপ্নসোপান দত্ত
আলোকময় দত্ত ২০১৭ সালে সিনিয়র প্রফেসর পদে সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স থেকে অবসর নেওয়ার পর রাজা রামান্না ফেলো হিসাবে সেন্ট্রাল গ্লাস অ্যান্ড সেরামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটে তিন বছর অতিবাহিত করেন। বর্তমানে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এমেরিটাস অধ্যাপক।