(Poetry)

বুদ্ধ ১
অঙ্গুলিমালের বীভৎসতা রাজা বিম্বিসারের কানেও গেছে।
জালিনি বন দিয়ে যাওয়ার উপায় নেই মানুষের আর।
কোনও মানুষ গেলেই ঠিক ধরে ফেলে সেই রাক্ষস।
মানুষটির আর খোঁজ মেলে না।
রাজা প্রসেনজিতের থেকে এই খবর গেল বিম্বিসারের কাছে। (Poetry)
অসম্ভব চিন্তিত আর ক্রুদ্ধ অবস্থায়
রাজা গেলেন বুদ্ধের কাছে।
রাজা, তোমার ভ্রুটি এত কুঞ্চিত কেন আজ?
হে তথাগত, আপনার করুণাসিঞ্চিত বাণী হিংসা প্রকাশে বারণ করে।
আমিও ভেতর থেকে আর চাই না।
চাই না কোনও মানুষকে মারতে।
কিন্তু আর উপায় নেই।
আমাকেই নিতে হবে এ দায়িত্বভার।
প্রজাদের রক্ষা করা রাজার কর্তব্য।
অঙ্গুলিমালের কথা বলছ রাজা?
হ্যাঁ ভদন্ত। শুনেছি মানুষ মেরে তার একটি আঙ্গুল সে কেটে নিয়ে
গলায় ঝোলায়। এ কেমন নৃশংস রাক্ষস! (Poetry)
সেই তো রাজা। এ কেমন নিষ্ঠুরতা!
কেন ছেলেটি এমন করছে বলুন তো! (Poetry)
ছেলেটি! হে করুণানিধান! এমন এক রাক্ষসকে আপনি ছেলে বলছেন?
আপনার কণ্ঠে স্নেহ! এতগুল মানুষকে হত্যা করেছে যে,
তার জন্য, উদ্বেগ আপনার কণ্ঠে! নাকি এ আমার ভ্রম! (Poetry)
ঠিকই বুঝেছো বিম্বিসার। ছেলেটির জন্য বড় চিন্তা হচ্ছে আমার।
তোমাকে যেতে হবে না। আমি যাব। আর একাই যাব।
আপনি! একা! এ কখনও হতে দিতে পারি না আমি!
কেন বিম্বিসার? আমার উপর বিশ্বাস নেই তোমার?
স্মিত হাসলেন বুদ্ধ।
আছে ভদন্ত, কিন্তু এ একজন নৃশংস হত্যাকারী। আপনি…!
হাত তুলে রাজাকে থামালেন বুদ্ধ। হাঁটতে শুরু করলেন
সেই অরণ্যের দিকে।
অঙ্গুলিমালের মা, রাজা প্রসেনজিতের পুরোহিতের স্ত্রী,
তাঁর কানেও পৌঁছে গেছিল এই খবর।
তিনি স্বামীকে বলেছিলেন, আমার পুত্রকে সবাই রাক্ষস বলছে।
ওকে বাঁচাও! স্বামী মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
তাই তিনি নিজেই ঠিক করেছেন, ছেলেকে খুঁজে বার করবেন।
তাকে থামাবেন। কেন সে এমন নৃশংস হয়ে উঠল, তাও জানবেন।
অঙ্গুলিমাল অপেক্ষা করছিল।
আর একটা।
আর একটা মাত্র মানুষ।
আর একটা মাত্র আঙ্গুল। (Poetry)
তাহলেই গুরুর দক্ষিণা পূরণ হবে।
ওর গুরুই তো এই দক্ষিণা চেয়েছিলেন।
সন্দেহ করতেন যে তাকে।
ভেবেছিলেন তাঁর স্ত্রী বুঝি এই মেধাবী শিষ্যর প্রতি দুর্বল।
তাই এমন দক্ষিণা চাইলেন, যা মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো।
কিন্তু অঙ্গুলিমাল মরল না।
আর আজ তার সহস্রটি আঙ্গুল পূর্ণ হবে।
ওই তো, কে যেন আসছে!
আরে! মা যে!
হোক তবে!
মাকে মেরেই পূরণ হোক তার দক্ষিণা।
মায়ের সামনে ছুটে গেল সে।
তাকে দেখে একইসাথে ভয়ে স্নেহে কম্পিত সুরে
মা ডাকলেন, বাছা আমার! (Poetry)
সেই একই সময়ে সে শুনতে পেলো আরওো একটি গলার স্বর।
দৃপ্ত অথচ স্নিগ্ধ।
থামো অঙ্গুলিমাল। স্তব্ধ হও।
পেছন ফিরে সে দেখলো কাষায় বস্ত্র পরে এক দীর্ঘ পুরুষ।
কী অদ্ভুত শান্ত টানা দিঘল চোখ সেই পুরুষের।
এক মুহূর্ত যেন থমকে গেল সে। (Poetry)
বেশ।
ভালই হল। মাতৃহত্যা করতে হল না।
ছুটে গেল সে ওই পুরুষটির দিকে।
কিন্তু একী!
সে যত দ্রুত ছোটে, অবাক হয়ে দেখে সে তার
নাগাল পাচ্ছে না কিছুতেই।
একটা সময়, নৃশংস সেই হত্যাকারী, ক্লান্ত,
হতোদ্যম হয়ে বসে পড়ল।
বলল, হে ভদ্র, আপনি কে? আপনি এত দ্রুত কীভাবে হাঁটছেন?
আমি তো ধরতে পারছি না আপনাকে।
কারণ আমি শান্ত। স্থির।
তুমি অস্থির। অশান্ত। নিজের চক্রে নিজেই ঘুরপাক খাচ্ছো।
এবার থামো।
অনেক রক্ত ঝরিয়েছ। নিজেও রক্তাক্ত হয়েছ।
তোমার মনের বিষাদ অন্তহীন। আমি বুঝেছি তোমায়।
এবার তোমার বোঝার পালা। (Poetry)
কিছুদিন পরেই বিম্বিসার এলেন বুদ্ধর কাছে।
কী হল সেই নৃশংস লোকটার!
মহারাজ! দেখুন তো ওই যুবককে!
গাছে গাছে জল সিঞ্চন করে দিচ্ছে যে!
তাকালেন রাজা। দেখলেন অত্যন্ত সুদর্শন, আত্মস্থ,
দৃঢ়চেতা এক যুবক একমনে গাছেদের স্নান করিয়ে দিচ্ছে।
হে ভদন্ত, কে এই যুবক? এঁকে আগে তো দেখিনি!
অঙ্গুলিমাল, হে রাজা।
মানে! এ কেমন করে সম্ভব?
অপরের হিংসা, ক্রোধ, ভালোবাসার অভাব
ওকে অস্থির করে তুলেছিল রাজা।
আমি ওকে ভালোবেসেছি মাত্র।
বাকিটা… স্মিত হাসলেন বুদ্ধ।
বিম্বিসার প্রণত হলেন। (Poetry)

ধ্রুবপদে বাঁধা: অরূপ গঙ্গোপাধ্যায়

বুদ্ধ ২
ধর্ষিতা হয়েছে আজ এক শ্রমণা। শুনেছ তো?
কী বলছ? শ্রমণাকে ধর্ষণ? কার এত বড় দুঃসাহস!
কে জানে বাবা! নাকি ছোটবেলার প্রেম! এমনতরো প্রেম বুঝি না বাপু।
আমাদের তো বাপ মায়ে দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছে।
তাই নিয়েই আচি। (Poetry)
বাজে বকোনা দশরথ! নগরনটির গৃহের কাছে
তোমাকে ঘুরঘুর করতে দেকিনি বলচ!
হাতে গোড়ে মালাটি, গলাতেও ঝুলছে আরেকটি!
হুঁঃ! দেকেচ তো দেকেচ! পুরুষ মানুষের
অমন একটা আধটা লাগে।
এক মেয়ে মানুষ কদ্দিন ভাল লাগে বলো!
তা যা বলেছ! আমারটা আবার কেলেকালিন্দী।
তার ওপর বছর বিউনি। সব ঢিলে! ভাগ্যিস গণিকালয়টি ছিল।
আমার মালতি না থাকলে কী যে হত!
অ! তোমারটি মালতি? আমার আবার সুকেশি।
তা যার ধর্ষণ হয়েছে, তার নামটি কী?
পেছন থেকে আরেকজন উত্তর দিল, উপ্পলবোন্না গো।
শ্রাবস্তি নগরীতে বাস। বাপের নাকি অগাধ টাকাপয়সা
আর মেয়ের অগাধ রূপ। (Poetry)
তো বিয়ে দিয়ে দিলেই তো পারত!
আরে! সে মেয়েই বিয়ে করতে চায়নি!
নাকি বাল্য প্রেমিক ছাড়া কাউকে করবে না!
তাপ্পর কী জানি কী হল! তিনি শ্রমণা হলেন!
তা এমন জেদি মেয়ের তো এমনটাই হবে।
হ্যাঁ। বাপ মায়ের কথা শুনলে এমনটি হত না!
নিজেই কপাল নিজের পোড়ালে! (Poetry)
আজ নাকি বুদ্ধ তাকে নিয়ে কী সব বলবেন টলবেন।
নিঘ্ঘাত বার করে দেবেন সংঘারাম থেকে।
তাই তো উচিত। নোংরা হয়ে গেলে তাকে কী রাখা উচিত নাকি।
বাকিদের ওপর খারাপ প্রভাব পড়বে না বুজি?
আরে! পেছন থেকে গলা এল।
আপনারা একটু থামবেন? ওই দেখুন, তথাগত আসছেন। (Poetry)
বুদ্ধ ধীর পায়ে এসে বসলেন দেশনা স্থলে।
মুখখানি আজ সামান্য গম্ভীর।
সামনের কোলাহল শান্ত হল আপনিই। (Poetry)
ভদ্দ! ভদ্দে! সমনগণ! আপনাদের একটি প্রশ্ন করতে চাই আমি।
আচ্ছা, ধম্মো কোথায় থাকে?
মুখে? বক্ষে? হাতে? পিঠে? যোনিদেশে? না হৃদয়ে?
উত্তর দিন। যে হৃদয় ত্রিশরণ মন্ত্র উদগীত হয়েছে,
সেই মনকে কি কেউ ধর্ষণ করতে পারে?
সেই মনের কি ধম্মোনাশ সম্ভব? (Poetry)
আবার একটু কোলাহল উঠল।
সামনের জনতার মধ্যে, যেখানে শ্রমণরাও ছিলেন,
একটু যেন হিল্লোল উঠল।
তারপর শুধু নীরবতা।
সকলেই চুপ।
এভাবে তো কেউ কখনও ভাবেননি।
সত্যিই তো!
ধর্ম তো যোনিতে থাকে না। মনে থাকে।
আর এইভাবে তো মনকে ধর্ষণ করা যায় না।
বুদ্ধ বসে রইলেন শান্ত হয়ে।
আস্তে আস্তে সবাই চলে গেল সেদিনকার মতো।
এইবার বুদ্ধ উঠলেন।
উৎপলবর্ণার কাছে যেতে হবে যে।
মেয়েটির যন্ত্রণাকে নিয়ে যেতে হবে
আনন্দঘন সর্বকল্যাণকর ঐশ্বরিক প্রেমের কাছে।
এক প্রেমিক থেকে সেই প্রেমের দিকে।
যেখানে কোনও লিঙ্গ নেই, কোনও বিভেদ নেই,
কোনও একাকিত্ব নেই। (Poetry)
আছে শুধু
পরম শান্তিময় ক্ষমা আর করুণা। (Poetry)
(ডিজিটাল ও মুদ্রিত মাধ্যমে সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত)
ডঃ রোহিণী ধৰ্মপাল। রামকৃষ্ণ সারদা মিশন বিবেকানন্দ বিদ্যাভবন মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষাবিজ্ঞান বিভাগে পড়ান। পিএইচডি করেছেন পৌরাণিক অপরাধ ও বর্তমান অপরাধ এবং তার সংশোধনী প্রক্রিয়ার তুলনা নিয়ে। লিখেছেন ছোটদের জন্য ও বড়োদের জন্য বিভিন্ন বই। মূলত পৌরাণিক ও নারী বিষয়ক লেখা লিখতে ভালোবাসেন। সামাজিক বিভিন্ন কাজের সঙ্গেও যুক্ত। পুরোনোর সঙ্গে নতুনকে মিলিয়ে বিবাহ, শ্রদ্ধাজ্ঞাপন প্রভৃতি কাজ করে থাকেন।