(Hariprasad Chaurasia)
এলাহাবাদের এক পেশাদার কুস্তিগীর- ছেদীলাল, তাঁর এক মেয়ে, দুই ছেলে। বাবার ইচ্ছা ছেলেরা আখড়ায় যাক, কুস্তি করুক। মেজ ছেলের সেদিকে মন নেই, তাঁর গান- বাজনা ভাল লাগে। বাবা এবং পরিবারের অন্য সদস্যরাও ভাবতেন, গান বাজনা করে বাঈজী আর ব্যান্ড পার্টির লোকেরা। (Hariprasad Chaurasia)

তাও বাবার ভয়ে শিখলেন স্টেনোগ্রাফি এবং কুস্তি। যখন ১৫ বছর বয়স, চুপিচুপি গান শেখা শুরু করলেন স্থানীয় গায়ক রাজারামের কাছে। গান শেখাই চলছিল, হঠাৎ একদিন এলাহাবাদ রেডিওতে বেনারসের বাঁশিবাদক পণ্ডিত ভোলানাথ প্রসন্নর বাজনা শুনলেন। বাঁশিটা বাজাতে পারতেন। নিজেই বলেছেন “সেতার, সরোদ কেনার পয়সা ছিল না, তাই বাঁশি”।
নিজস্ব প্রতিভা তো ছিলই, তার সঙ্গে পণ্ডিত ভোলানাথ প্রসন্নর প্রথাগত তালিম পেয়ে কয়েক বছরের মধ্যে নিজেকে একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হিসাবে গড়ে তুললেন। আমরা পেলাম এই প্রজন্মের একজন কিংবদন্তি বাঁশিবাদক, পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়াকে। আজ পয়লা জুলাই যিনি ৮৭ বছরে পদার্পণ করলেন। (Hariprasad Chaurasia)
১৯৩৮ সালে জন্ম। গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে ভারত তথা বিশ্বের তাবৎ সংগীত প্রেমী শ্রোতাদের সুরের সুরধুনীতে অবগাহন করিয়ে আসছেন। বাঁশির প্রবাদ পুরুষ পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষ বাঁশের বাঁশিকে মেঠো সুরের আসর থেকে তুলে এনেছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীতের আঙিনায়, সেই বাঁশিকেই দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দেওয়ার পুরো কৃতিত্বটা হরিপ্রসাদজীর। ১৯৫৮ সাল নাগাদ আকাশবাণী কটকের সহকারী যন্ত্রশিল্পীর পদে যোগদান করেন। কটকে কাজ করার সময় ষ্টুডিও রেকর্ডিং ছাড়াও ওড়িষী নাচের প্রচুর অনুষ্ঠানে তিনি বাঁশি বাজাতেন। রেডিওতে প্রতিমাসে মাইনে পেতেন ১৬০ টাকা, কিন্ত বাইরের অনুষ্ঠান থেকে প্রায় ২০০ টাকা রোজগার করতেন। (Hariprasad Chaurasia)
এইরকম করে চার বছর কাটল। অফিসের কিছু লোকের ঈর্ষার কারণ হলেন পণ্ডিতজী। তাঁরা লিখিত অভিযোগ করল কেন্দ্র অধীকর্তা পি ভি কৃষ্ণমূর্তীর কাছে। তিনি সহৃদয় ব্যক্তি। হরীজীকে বললেন “আপনি ভাল শিল্পী, এখানে কাজ করতে পারবেন না, তাই আপনাকে আমি মুম্বাইতে বদলি করে দিচ্ছি”। (Hariprasad Chaurasia)

১৯৬৪ সাল নাগাদ চলে এলেন মুম্বাইতে। এরই মধ্যে গুরুর সন্ধান চলছিল। তালিম নিতে যেতেন বেনারসে, পণ্ডিত ভোলানাথ প্রসন্নর কাছে। ১৯৫৮ সাল নাগাদ পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষ আকাশবাণী বেনারসে বাজাতে এসেছেন (উনি ১৯৬০ এ প্রয়াত হন)। হরীজী দেখা করতে গেলেন ওঁর সঙ্গে, হয়তো শিক্ষা নেওয়ার জন্য! কিন্তু পান্না বাবুর কোনও একজন সহকারী/ ছাত্র ওঁকে দেখা করতে দিলেন না। দেখা হলে বাঁশির ইতিহাসটা হয়তো অন্যভাবে লেখা হত! পরে উনি বহু চেষ্টায় মাইহার ঘরানার শ্রীমতী অন্নপূর্ণা দেবীর কাছে বহু বছর প্রথাগত তালিম পান। মুম্বাই আসার পর বাজনা আর বাজনা! (Hariprasad Chaurasia)
১৯৬১-৬২র ঘটনা। কোনও এক স্টুডিওতে মদনমোহনজীর পরিচালনায় তালাতে মাহমুদের রেকর্ডিং চলছিল। নির্ধারিত বাঁশি বাদকের অনুপস্থিতিতে উনি হরিপ্রসাদজীকে বললেন বাজাতে। অসাধারণ বাজলেন হরীজী! রেডিওতে চাকরি করছেন শুনে মদনমোহনজী বললেন “চাকরি ছেড়ে দাও, আমার সব রেকর্ডিং-এ তুমি বাজাবে। রেডিওর থেকে বেশি রোজগার করবে”। সেই শুরু। তারপর সংগীত পরিচালক রৌশন, ও পি নাইয়ার, শঙ্কর জয়কিষণ আরও কত জনের নির্দেশনায় যে বাজিয়েছেন!হিন্দী ছাড়াও উড়িয়া, তামিল, তেলেগু, মালয়ালাম আরও কত ছায়াছবিতে যে ওঁর বাঁশি শোনা গেছে তা উনিও মনে করে বলতে পারবেন না! (Hariprasad Chaurasia)
“১৯৫৮ সাল নাগাদ পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষ আকাশবাণী বেনারসে বাজাতে এসেছেন (উনি ১৯৬০ এ প্রয়াত হন)। হরীজী দেখা করতে গেলেন ওঁর সঙ্গে, হয়তো শিক্ষা নেওয়ার জন্য! কিন্তু পান্না বাবুর কোনও একজন সহকারী/ ছাত্র ওঁকে দেখা করতে দিলেন না। দেখা হলে বাঁশির ইতিহাসটা হয়তো অন্যভাবে লেখা হত!”
তাঁর প্রথম সংগীত পরিচালনা ১৯৭৪ সালে ‘27 Down’ ছায়াছবিতে। সহকারী সংগীত পরিচালক ছিলেন শ্রী ভুবনেশ্বর মিশ্র।
তারপর বহু পথ পেরিয়ে ১৯৮১ সালে পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার সঙ্গে জুটি বেঁধে সুর দিলেন যশ রাজ ফিল্মিসের ব্লকবাস্টার ছবি “সিলসিলা”তে। অমিতাভ বচ্চনের গলায় গান “নীলা আসমা সো গায়া” এবং অমিতাভের ব্যারিটোন কণ্ঠে ভাষ্য পাঠের সঙ্গে হরিজীর বাঁশি আর শিবজীর সন্তুর সেই সময় আপামর বাঙালির সাথে আমাকেও পাগল করে দিয়েছিল। (Hariprasad Chaurasia)

এরপর যশরাজ ফিল্মের আরও একগুচ্ছ ছবিতে সংগীতায়োজন করেন। একই সঙ্গে চলতে থাকে শাস্ত্রীয় সংগীতের অনুষ্ঠান। গত ৫০ বছরে দেশের এবং বিদেশের হেন কোনও অনুষ্ঠান নেই যাতে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া অংশগ্রহণ করেননি। নিজের একটি স্বতন্ত্র বাদন শৈলী তৈরি করেছিলেন তিনি। পেয়েছেন পদ্মভূষণ (১৯৯২) এবং পদ্ম বিভূষণ (২০০০)। উৎসাহী শিক্ষার্থীদের জন্য মুম্বাই আর ভুবনেশ্বরে স্থাপন করেছেন “বৃন্দাবন গুরুকুল”। (Hariprasad Chaurasia)
এই সাতাশি বছর বয়সে পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত হওয়া সত্বেও একইভাবে বাজিয়ে চলেছেন এবং ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দিয়ে চলেছেন। ভগবানের কাছে ওঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি। (Hariprasad Chaurasia)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
চিত্র ঋণ- আন্তর্জাল
পণ্ডিত সুদীপ চট্টোপাধ্যায়, পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষের ঘরানার অনুসারী একজন বাঁশি বাদক। বর্তমানে আকাশবাণী কলকাতায় কর্মরত।