(Clay Dolls)
বাংলার বিস্মৃতপ্রায় এক শিল্প, মাটির পুতুল। আর এই শিল্পের কথা বিস্তারে আলোচনা করলে দেখা যাবে কীভাবে সমাজের বিভিন্ন পেশা জড়িয়ে রয়েছে এই শিল্পের সংস্কৃতিতে। প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষের শ্রমজীবী ধারাকে অনবদ্য মিষ্টতা ও সারল্য দিয়ে বাংলার পুতুলে তুলে ধরা হয় অনেকদিন যাবৎ। খেটে খাওয়ার মধ্যে যে পবিত্রতা রয়েছে সেটাই বাংলার পুতুল নির্মাণের মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়েছে বারংবার। শ্রমিক মানুষের সংজ্ঞাকে শুধু কারখানা ও নির্মাণ শিল্পের মধ্যে আবদ্ধ রাখেনি বঙ্গের পুতুল। তাকে প্রসারিত করেছে সর্বত্র, সমস্ত স্তরে। বেলুন থেকে ঘুগনিওয়ালা সর্বত্রই বিরাজ করেছে বাংলার নিজস্ব শ্রমজীবী চেতনা। আর এই চেতনাই, শিশু মনকে আনন্দ দিয়ে চলেছে। পেশাগুলির সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে তাই বাংলার শিশুরা ছোটবেলা থেকেই খুব একাত্ম বোধ করে এই পুতুলগুলির সঙ্গে। আসুন আজ জেনে নেওয়া যাক তাদের কথা… (Clay Dolls)
আরও পড়ুন: পুতুল খেলার সেকাল একাল
বেলুন ও ঘুগনিওয়ালা পুতুল
হাঁটু পর্যন্ত খাটো ধুতি। কোমরে পেঁচিয়ে রয়েছে লাল রঙের কাপড়। শরীর জুড়ে আটোসাঁটো গ্রাম্য ফতুয়া। মাথা বের দেওয়া গামছা। কপালে সরু লাল টিকা। হাতের মধ্যে থাকা দন্ডে রয়েছে রংবেরঙের বেলুন। এভাবেই সরল আঙ্গিকে গ্রাম্য মেলার বেলুনওলার সাজ প্রস্ফুটিত হয়েছে কাটোয়ার এই মাটির পুতুলে। সরল আঙ্গিক ও লোকজ ছন্দে তৈরি হয়েছে কাঁচা মাটির দুই খোল ছাঁচের এই পুতুল। মুখের অভিব্যক্তিতে চিন্তান্বিত। কিছুটা দুঃখ প্রকাশ পেয়েছে বললেও ভুল হয় না। (Clay Dolls)

বেলুন বিক্রি করে সংসার জীবনের এই সীমাহীন সংগ্রাম অতিবাহিত করছে এই শ্রমজীবী পুতুল। পুতুলটির হাতে কাঠি রয়েছে এবং কাঠির ওপর মাটির ডেলা দিয়ে বেলুনের আকৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কলকাতার কালীঘাট পটুয়াপাড়ায় বেলুনওলা পুতুলের মধ্যে পটচিত্রের ছোঁয়া স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পরনে লাল ফতুয়া ও খাটো সাদা রঙের ধুতি, মাথায় ত্রিকোণ আকৃতির টুপি। কপালে বৈষ্ণবীয় শৈলীর টিকা। মুখের অভিব্যক্তিতে গাম্ভীর্যের ছোঁয়া। গায়ের রঙ হলুদ। ইট-কাঠ-পাথরের মহানগরীতে লোকজ ভঙ্গির এই পুতুল বাংলার গ্রামীণ জীবনের কথা বলে চলে। (Clay Dolls)
বেলঘরিয়ার নিমতা আলিপুর পটুয়া পাড়ার ঘুগনিওয়ালা পুতুলটির মধ্যে নাটকীয় ব্যঞ্জনা প্রবাহমান রয়েছে। মাটির দন্ডের ওপর গোলাকার চ্যাপ্টা বেদী তৈরি করা হয়েছে। তার ওপর ছোট মাটির ঘটি রাখা হয়েছে। তার চারিদিকে একাধিক মাটির দানা তৈরি করা হয়েছে।
অন্যদিকে বেলঘরিয়ার নিমতা আলিপুর পটুয়া পাড়ার ঘুগনিওয়ালা পুতুলটির মধ্যে নাটকীয় ব্যঞ্জনা প্রবাহমান রয়েছে। মাটির দন্ডের ওপর গোলাকার চ্যাপ্টা বেদী তৈরি করা হয়েছে। তার ওপর ছোট মাটির ঘটি রাখা হয়েছে। তার চারিদিকে একাধিক মাটির দানা তৈরি করা হয়েছে। এই মাটির দানা গুলোকেই বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে ঘুগনির বিন্যাস নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ওই চ্যাপ্টা বেদীর ওপরই উঁচু করে লাল রঙের শুকনো লঙ্কার মাটির প্রতিরূপ রাখা হয়েছে। ঘটিটি তেঁতুল জল রাখার বাস্তবিক প্রতীক হয়ে উঠেছে। মাটির দন্ডের পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘুগনিওয়ালা। খাটো ধুতি। গায়ে ফতুয়া। মাথায় গামছা জড়ানো। হাতের মুদ্রায় ব্যস্ততা। ঘুগনিওয়ালার শরীরজুড়ে প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষের শারীরিক বিন্যাস স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এইভাবেই ঘুগনি বিক্রেতার বাস্তবধর্মিতা শিল্পী তাঁর স্বকীয় সৃষ্টির আনন্দে নির্মাণ করেছেন। কলকাতার উল্টোডাঙার দক্ষিণদাড়ি কুমোর পাড়াতে ঘুগনিওয়ালা পুতুল নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নিমতার মতন এত নাটকীয় অভিব্যক্তি তার মধ্যে অনুপস্থিত। সেখানে মাটির লম্বা দণ্ডের ওপর গোলাকার চ্যাপ্টা আকৃতির মাটির থালার মধ্যে ছোট একাধিক গোলাকার মাটির দানা রয়েছে তার ওপর রঙ করেই ঘুগনির প্রতীক তৈরি করা হয়েছে। (Clay Dolls)
ঝাড়ুদার ও ভিস্তিওয়ালা
শৈশব থেকেই শিশু মনে শ্রেণীহীন সমাজের ভাবনা ভাবতে শেখানোটা প্রয়োজন। সকলকে সমান চোখে দেখাটা সামাজিক ঐক্যের পক্ষে একান্ত জরুরি। সমাজের প্রতিটা মানুষ তাদের কাজের মধ্যে দিয়ে সভ্যতাকে আরো সুন্দরতর করে তোলে। আর সেই চেতনা থেকেই উত্তর ২৪ পরগনার বেলঘরিয়া, নিমতা, আলিপুর, পটুয়া পাড়ায় ঝাড়ুদার পুতুল বানিয়ে চলেন বরিষ্ঠ মৃৎশিল্পী শিশুরানী পাল। এক খোল কাঁচা মাটির এই পুতুলের হাতে রয়েছে তারের তৈরি ঝাড়ু। (Clay Dolls)

পুতুলের শারীরিক আঙ্গিকে নাটকীয়তা বিদ্যমান। সে যেন ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করছে সেই অভিব্যক্তি পুতুলটিকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলেছে। যথারীতি মাথার মধ্যে কাপড় জড়ানো এবং পরিধানে প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষের ছোঁয়া। মুখের অভিব্যক্তিতে দুঃখী ভাব ফুটে উঠেছে। মূলত ঝু্লন পূর্ণিমা উপলক্ষে এই ধরনের সামাজিক পুতুল তৈরি করেন শিল্পী। (Clay Dolls)
পুতুলের শারীরিক আঙ্গিকে নাটকীয়তা বিদ্যমান। সে যেন ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করছে সেই অভিব্যক্তি পুতুলটিকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলেছে। যথারীতি মাথার মধ্যে কাপড় জড়ানো এবং পরিধানে প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষের ছোঁয়া।
অন্যদিকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর মজিলপুরে শম্ভুনাথ দাস প্রায় আট প্রজন্ম ধরে মাটির পুতুল বানিয়ে চলেছেন। তার তৈরি ভিস্তিওয়ালা পুতুলের মধ্যে পটচিত্রের ছোঁয়া লক্ষ্যণীয়। বাম কাঁধে চামড়ার ভিস্তি ঝোলানো। বাম হাত দিয়ে সেটির ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে ভিস্তিওয়ালা। ডানহাতে ভিস্তির মুখ। ধুতি খাটো করে পড়া। শারীরিক গঠনে দৃঢ়তা মনোভাব স্পষ্ট। (Clay Dolls)
আরও পড়ুন: বাংলার পুতুল – সোমা মুখোপাধ্যায়
নির্মাণ শ্রমিক ও ব্যান্ড পার্টির বাদক
শরীরে অপুষ্টির লক্ষণ স্পষ্টভাবে প্রস্ফুটিত। লজ্জা নিবারণের জন্য ভরসা কোমর থেকে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত কাপড় খণ্ড। মাথায় ইট নিয়ে চলেছে নির্মাণ শ্রমিক। গায়ের রঙ কৃষ্ণ বর্ণ। ইট এবং চুলের মধ্যবর্তী অঞ্চলে রয়েছে একটি কাপড় খণ্ড। এইভাবেই নির্মাণ শ্রমিকের দুর্দশার কথা নিজের পুতুল নির্মাণের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন শ্রীরামপুরের মৃৎশিল্পী সুরেশচন্দ্র পাল। এত পরিশ্রমের পরেও মুখে শান্ত ভাব। যেন কষ্ট করাটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে তাই অভিব্যক্তিতে কোনও শোক ও ক্লান্তি নেই। অন্যদিকে শ্রীরামপুরের নগা মাঠপাড়ার বরিষ্ঠ মৃৎশিল্পী খোকন পাল নিজের অনবদ্য তুলির টানে ব্যান্ড পার্টি পুতুল নির্মাণ করে থাকেন। উত্তর ভারতীয় শৈলীর কুর্তা পায়জামা পরা তাঁর তৈরি ব্যান্ড পার্টি পুতুলের মাথায় রয়েছে হরিয়ানা রাজ্যের শৈলীর পাগড়ি। গোঁফের বিন্যাসও উত্তর ভারতীয়। কপালে লাল টিকা। (Clay Dolls)
ব্যান্ড পার্টির বাদনদারদের ঝলমলে পোশাকের অন্তরালে থাকে সীমাহীন দুঃখ ও দারিদ্র্য। তাঁর খোঁজ, বিত্তশালী সমাজ রাখে না। তাই শিল্পী নিজের অপরূপ তুলির টানে সেই সকল শ্রমজীবী মানুষের দুঃখকে সরিয়ে রেখে এক সরল নান্দনিক অভিব্যক্তি তুলে ধরেছেন।
ব্যান্ড পার্টির বাদনদারদের ঝলমলে পোশাকের অন্তরালে থাকে সীমাহীন দুঃখ ও দারিদ্র্য। তাঁর খোঁজ, বিত্তশালী সমাজ রাখে না। তাই শিল্পী নিজের অপরূপ তুলির টানে সেই সকল শ্রমজীবী মানুষের দুঃখকে সরিয়ে রেখে এক সরল নান্দনিক অভিব্যক্তি তুলে ধরেছেন। ব্যান্ড পার্টির বাদনদারদের ঝলমলে পোশাকের অন্তরালে থাকে সীমাহীন দুঃখ ও দারিদ্র্য। তাঁর খোঁজ, বিত্তশালী সমাজ রাখে না। তাই শিল্পী নিজের অপরূপ তুলির টানে সেই সকল শ্রমজীবী মানুষের দুঃখকে সরিয়ে রেখে এক সরল নান্দনিক অভিব্যক্তি তুলে ধরেছেন। (Clay Dolls)
চপ বিক্রেতা ও রিকশা চালক
রাস্তায় বেরিয়ে তেলেভাজা খাওয়ার অভ্যাস স্বাধীনতার আগে থেকেই রয়েছে বাঙালির মধ্যে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সহ বহু বাঙালি মনীষীর এই তেলেভাজা প্রীতির কথা কলকাতার অলিগলিতে আজও শোনা যায়। কিন্তু সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষরাই এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। সেই তেলেভাজা বা চপ শিল্পের প্রতিনিধিকে নিজের পুতুল নির্মাণের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন উত্তর ২৪ পরগনার কাঁকিনাড়ার শিল্পী বিমল পাল। একটি সরা আকৃতির ভিতের ওপর বসে রয়েছে পুরুষ। পরনে তার খাটো ধুতি। শরীরের গঠনে, পরিশ্রমের ছাপ স্পষ্ট। গায়ের রঙ বাদামি। (Clay Dolls)

আসনে বসার ভঙ্গিতে বসা। গলায় কালো সুতো দিয়ে পেঁচানো মাদুলি। মুখে স্বস্তির হাসি। পুতুলটির সামনের দিকে একটি মাটির উনুন রয়েছে। তার ওপর কালো রঙের কড়াই রাখা রয়েছে। তাতে বেসন মেখে গরম তেলে ছাড়া হচ্ছে। অপর এক পাত্রে বেসন মাখা হচ্ছে এবং শেষ পাত্রে তেলেভাজা ভেজে তোলা হচ্ছে। পুতুলটি লোহার কড়াইতে বেসন ছাড়ছে। অদ্ভুত চলমানতা, শিল্পী এই পুতুল নির্মাণে তৈরি করেছেন। (Clay Dolls)
টোটো আসার আগে অল্প দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য বাঙালির ভরসা ছিল রিকশা। আর সেই রিকশা চালক পুতুলের দেখা পাওয়া যায় মালদহে। শিল্পী অঞ্জন পণ্ডিত তাঁর সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় এই পুতুল তৈরি করে থাকেন। কাঁচা মাটির এই পুতুলটি শিশু মনকে অনাবিল সারল্যে ভরিয়ে তোলে। মাটির বেদির ওপর একটি রিকশা বসানো রয়েছে। সেই রিকশা টানছেন চালক। রিকশার আসনে বর-বউ। এখানে বলে রাখা ভাল, রিকশাটি কিন্তু সাইলকেল রিকশা। (Clay Dolls)
“ঢাক বাজানোর এই শিল্পটাকে আজও ধরে রেখেছে প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষেরা। তাঁদের ঢাকের কাঠির বোলে মাতোয়ারা হয় মানুষ। নদীয়া জেলার শান্তিপুরের চৌগাছা পটুয়াপাড়ায় অনিন্দ্য সুন্দর ভঙ্গিতে ঢাকি পুতুল তৈরি হয়। “
ঢাকি পুতুল
বনেদি বাড়ির ঠাকুর দালান থেকে হাল আমলের থিমের দুর্গা পুজো সবেতেই রয়েছে ঢাকির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ঢাক বাজানোর এই শিল্পটাকে আজও ধরে রেখেছে প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষেরা। গ্রাম ও মফস্বল থেকে প্রতিবছর শহর কলকাতায় দুর্গাপুজো উপলক্ষে আসেন ঢাকিরা। তাঁরা বাকি বছর থাকেন অন্য কোনও পেশায়। তাঁদের ঢাকের কাঠির বোলে মাতোয়ারা হয় মানুষ। বাংলা সনাতনী ঐতিহ্যকে আজও বজায় রেখেছে এই সকল ঢাকিরা। নদীয়া জেলার শান্তিপুরের চৌগাছা পটুয়াপাড়ায় অনিন্দ্য সুন্দর ভঙ্গিতে ঢাকি পুতুল তৈরি হয়। উর্ধাঙ্গ অনাবৃত। কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত সাদা ধুতিতে মোড়ানো। ডান হাতের বগলের তলায় মাটি দিয়ে তৈরি করা ঢাক। (Clay Dolls)
ঢাক বাজানোর সময় যে শারীরিক বিভঙ্গ ঢাকিদের মধ্যে তৈরি হয়, সেটাই এখানকার শিল্পীরা নিজেদের পুতুল নির্মাণের শৈল্পিকতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। মুখের গঠন ও তাকানোর ভঙ্গিতে সেই নাটকীয়তা প্রকাশ পেয়েছে।
ঢাক বাজানোর সময় যে শারীরিক বিভঙ্গ ঢাকিদের মধ্যে তৈরি হয়, সেটাই এখানকার শিল্পীরা নিজেদের পুতুল নির্মাণের শৈল্পিকতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। মুখের গঠন ও তাকানোর ভঙ্গিতে সেই নাটকীয়তা প্রকাশ পেয়েছে। ঢাকের পেছনে তুলো দিয়ে সেটিকে আরো প্রসারিত করা হয়েছে। (Clay Dolls)
তাঁতি পুতুল
বস্ত্রশিল্পে বাঙালির খ্যাতি বিশ্বজোড়া। প্রাচীন বিশ্বে বাংলার বস্ত্র শিল্পের জনপ্রিয়তা ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এমনকি ব্রিটিশরা আসার আগে পর্যন্ত মসলিন, জামদানির খ্যাতি ছিল। আজও পশ্চিমবঙ্গের সমুদ্রগড়, গুপ্তিপাড়া, শান্তিপুর সহ হাতেগোনা কয়েকটি জনপদে তাঁত শিল্পটি টিকে রয়েছে। বাংলার সামাজিক সাহিত্য দর্পণে তাঁতি পাড়ার নাম বারবার উঠে এসেছে। মূলত মহিলারাই এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। সমাজ ধর্মের সেই ছাপই প্রস্ফুটিত হয়েছে শান্তিপুরের চৌগাছা পটুয়াপাড়ার তাঁতি পুতুলের মধ্যে দিয়ে। এক গৃহবধূ হাতে কাপড় নিয়ে তাঁত বুনছে। আর তার পাশে উঁচু করে রাখা রয়েছে একাধিক তাঁতের কাপড়। অনেক ক্ষেত্রে সেই পুতুল নির্মাণে গৃহবধূর জায়গায় পুরুষ পুতুলকেও দেখা যায়। (Clay Dolls)
আরো অন্যান্য সামাজিক পেশার পুতুলের সম্ভার
বাংলার পুতুলের মধ্যে আমরা দেখতে পাই কৃষক পুতুলকে। নদীমাতৃক এই দেশে কৃষিকাজ জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য অঙ্গ। তারই প্রতিচ্ছবি বাংলার মাটির পুতুলের মধ্যে দেখা যায়। বাংলার প্রায় প্রতিটি পটুয়া পাড়াতেই এই পুতুল শৈলী লক্ষ্য করা যায়। শান্তিপুরের চৌগাছা পটুয়া পাড়ায় এক ধরণের কৃষক পুতুল দেখা যায়, যেখানে পুতুলটির কাঁধে একটি মাটির কাপড় দেওয়া থাকে। মাথায় বেতের কৃষক টুপির মতো দেখতে গোলাকার মাটির টুপি থাকে। সারা শরীর অনাবৃত। শুধু লজ্জা নিবারণের জন্য কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত সাদা কাপড়। (Clay Dolls)

কৃষিকাজ করার ভঙ্গিমার অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে এই পুতুলটির মধ্যে। অন্যদিকে সাপুড়ে, ভাল্লুক খেলা, বাদর নাচ দেখানো পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষের প্রতিচ্ছবিও পুতুল নির্মাণের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এই তিন ক্ষেত্রেই মাটির একটি চতুষ্কোণ বেদীর ওপর মানব মূর্তি থাকে। ক্ষেত্র বিশেষে সে হয়ে ওঠে সাপুড়ে। আবার কখনও হয়ে ওঠে বাঁদর ও ভাল্লুক খেলা দেখানোর ব্যাক্তি। এর উল্টোদিকে থাকে মাটির তৈরি ফণা উদ্যত করা সাপ, ভাল্লুক ও বাঁদর। (Clay Dolls)
কৃষিকাজ করার ভঙ্গিমার অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে এই পুতুলটির মধ্যে। অন্যদিকে সাপুড়ে, ভাল্লুক খেলা, বাদর নাচ দেখানো পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষের প্রতিচ্ছবিও পুতুল নির্মাণের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এই তিন ক্ষেত্রেই মাটির একটি চতুষ্কোণ বেদীর ওপর মানব মূর্তি থাকে।
এছাড়া জুতো সেলাই করা পুতুলের দেখাও আমরা বাংলার পুতুলে পাই। সমাজের প্রতি এই দায়বদ্ধতা বাংলার বাস্তবধর্মী পুতুল শিল্পকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। একদিকে শিশুর সারল্য ও অন্যদিকে কঠোর বাস্তবতা এই দুইকে সুনিপুণ মনোরম ছন্দে অলংকরণ করেছেন বাংলার মৃৎশিল্পীরা। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বর্তমানে যে সকল পুতুলের দেখা আমরা পাই তার নির্মাণশৈলী, উনবিংশ শতাব্দী ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকের সমাজ জীবনের ছবিকে তুলে ধরেছে। শিল্পীরা বংশ পরম্পরায় সেই আবহমান ধারাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। (Clay Dolls)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
চিত্র ঋণ- শুভঙ্কর দাস
পেশায় সাংবাদিক। কলকাতা বিশ্বিদ্যালয়ের থেকে সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপনে স্নাতকোত্তর। বাংলার পুতুল শিল্পকে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। লেখকের, ‘আমাদের কথা’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। সেখানে বাংলার বিভিন্ন জেলার মাটির পুতুল নিয়ে ১৫০ টি পর্বে ভিডিও করেছেন তিনি। শিল্পীদের ঘরে গিয়ে শুনেছেন তাঁদের মনের কথা। এছাড়া শিবের মুখোশ, চালচিত্র, লক্ষ্মী সরা, মনসা ঘট, মনসা চালি, ছলনের ঘোড়া নিয়েও তিনি পর্ব তৈরি করেছেন তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে। লেখক নিজে পুতুল সংগ্রাহক। এই লেখায় ব্যবহৃত ছবিগুলো লেখকের নিজের সংগ্রহে থাকা পুতুলের।