(Anokha Bibi)
মার্চ মাসের একটি সকালে শান্তিনিকেতন থেকে আমরা ক’জন মানুষ এসেছি বীরভূম-মুর্শিদাবাদ-বর্ধমান এই তিন জেলার সংযোগস্থলে, প্রাচীন বাদশাহী সড়কের ধারে, উন্মুক্ত প্রান্তরের একপাশে, গাছপালায় ঢাকা ছায়াসুনিবিড় এক আশ্চর্য মাজারে। এই মাজারে যাঁর নামের নিশান বসন্তের হাওয়ায় সামনের বহু পুরনো অশ্বত্থ গাছটার ডাল থেকে পতপত করে উড়ছে তিনি এক অলৌকিক নারী। লোকে বলে “হজরতশাহী মা আনখা বিবি”। লোকমুখে “আনোখা”ই কখনও হয়েছে “আনখা”, কখনও বা “আনুখা”। যার অর্থ ‘অজ্ঞাত’। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধানেও এই কথারই সমর্থন পাই।
আরও পড়ুন: বাংলার পুতুলের শ্রমজীবী ধারা
“আনোখা বিবি” এক রহস্যাবৃতা সাধিকা। কেউ কেউ বলেন “পীর”। এই “আনোখা” শব্দটিই আমাদের টেনে এনেছে এইখানে। আমাদের দলে আছেন জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেইন স্টাডিজ বিভাগের খ্যাতনামা অধ্যাপক, ভারতবিদ মাসাহিকো তোগাওয়া এবং তাঁর স্ত্রী শান্তিনিকেতনের আশ্রমকন্যা সেৎসু মাকিনো, বাংলাদেশের শিল্পী-গবেষক আবু সাঈদ এবং শান্তিনিকেতন থেকে আমরা কয়েকজন। আমরা লাভপুরের পথে প্রথম এই স্থানের কথা শুনেছি এক গ্রাম্য চায়ের দোকানে। এও শুনেছি “আনোখা” মায়ের দরবারে হিন্দু-মুসলমানের কোনও ভেদাভেদ নেই। তাঁর মাজারে একদিকে বসে হিন্দু নাকি খঞ্জনি বাজিয়ে কীর্তন গায়, অন্যপাশে মুসলমানে কোরান তেলায়ত করে। হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনার এমনতর সম্মিলন চাক্ষুষ করতেই এখানে ছুটে আসা। (Anokha Bibi)
আগেই বলেছি বীরভূম-মুর্শিদাবাদ-বর্ধমান এই তিন জেলার সংযোগস্থলে এই স্থান। পাশ দিয়ে চলে গেছে মধ্যযুগের সুবে বাংলার অধীশ্বর হুসেন শাহের আমলে (শাসনকাল ১৪৯৩ – ১৫১৯) নির্মিত ঐতিহাসিক বাদশাহি সড়ক। এই বাদশাহী সড়ক তৎকালীন বাংলার রাজধানী গৌড় থেকে মুর্শিদাবাদ পেরিয়ে, বীরভূমকে স্পর্শ করে, বর্ধমান পেরিয়ে সুদূর তমলুক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই রাস্তাটি নির্মাণ প্রসঙ্গেও একটি চমৎকার গল্প প্রচলিত আছে।

শোনা যায়, তাঁর শাসনকালে কোনও এক সময়ে হুসেন শাহ একবার সাম্রাজ্য পরিভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। পথের মধ্যে জনৈক ব্যক্তির কাছে তিনি শাপগ্রস্ত হন যে, রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন মাত্রই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হবেন। তখন নাকি কোনও এক আশ্চর্য ফকির তাঁকে সড়ক নির্মাণ, জলাশয় খনন আর মসজিদ নির্মাণের পরামর্শ দেন। হুসেন শাহ সেইমতো “ক্রোশ-অন্তর দীঘি আর ডাক-অন্তর মসজিদ” নির্মাণ করান। (প্রসঙ্গত রাঢ়ের অবিস্মরণীয় কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের “আখড়াইয়ের দীঘি” গল্পে এই পথের বর্ণনা পাওয়া যায়) যার অনেকগুলি ভগ্নাবশেষ আজও দেখতে পাওয়া যায়। (Anokha Bibi)
“আনোখা বিবি”র মাজার ঘিরে তিনটি গল্প শোনা যায়। স্থানীয় লোকজন বলেন, এই পীর তলায় যাঁর সমাধি রয়েছে তিনি সম্পূর্ণই অজ্ঞাত পরিচয় এক মানুষ। তাই এই স্থানের নাম হয়েছে “আনোখা পীরতলা”। দ্বিতীয় গল্পটি শুনেছি লাভপুরের কবিয়াল সুভাষ চন্দ্র দাসের কাছে, কৈগড়া গ্রামের এক গোয়ালিনী মেয়ে গ্রামের সীমানার বাইরে এই স্থানে এক রোগগ্রস্ত মুসলমান ফকিরকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। ফলস্বরূপ তৎকালীন হিন্দু সমাজ, সেই মেয়েকে সমাজচ্যুত করে। পরে সেই মেয়ে এই ফকিরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে “আনোখা বিবি” নামে পরিচিত হন। (Anokha Bibi)
“আমদের দেশে আবহমান কাল ধরেই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চার বাইরে, লোকচক্ষুর আড়ালে বাউলের আখড়ায়, মাজারে, পীরের দরগায় যে সত্য, সুন্দর, সহজ মনুষ্যত্বের চর্চা হয়ে এসেছে সেই ধারায় “আনোখা বিবি”-র মাজার যেন একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।”
আর তৃতীয় গল্পটি শোনা হয় “আনোখা বিবি”র বাৎসরিক মহামিলন মেলা কমিটির সদস্য মহঃ শাহিদুল্লাহের কাছে। হুসেন শাহের আমলে এই জায়গাটি ছিল ধু-ধু প্রান্তর মধ্যে, একটি ছায়াঢাকা কুঞ্জ। এখানে কোনও এক অলৌকিক বুজুরগ সাধকের সঙ্গে দেখা হয় পার্শ্ববর্তী কৈগড়া গ্রামের এক হিন্দু সাধ্বী ধোপিনীর। কোনও এক ছোঁয়াচ রোগে আক্রান্ত হয়ে সে তখন গ্রাম, পরিবার এবং স্বামী পরিত্যক্তা। দয়াময় সেই সাধক মানুষটি এইস্থানে সেই নারীকে আশ্রয় ও শুশ্রূষা দেন। ধীরে ধীরে সেরে ওঠেন সেই রমণী। সাধকের কাছেই থেকে যান তিনি। সেই সাধকের হাত ধরে যেন নবজন্ম লাভ হয় তাঁর। (Anokha Bibi)
এই ঘটনাকে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে দেখলে রীতিমতো বিদ্রোহ বলে মনে হয়। সেই সময়ে সমাজের প্রচলিত সংস্কার, ধর্মবিশ্বাস আর গণ্ডির বাইরে এ যেন এক আশ্চর্য ভুবন। যেখানে মনুষ্যত্বই কেবলমাত্র সত্য। শোনা যায়, সেই বুজুরগ সাধক মানুষটি খুব বেশিদিন এখানে থাকেননি। সেই নারীকে এই প্রান্তর, প্রাচীন অশ্বত্থ গাছ, অনাগত মানুষ আর মাথার উপরকার নীল চাদরের খোলা আসমানের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে যান। সেই থেকে এই গাছতলা আঁকড়ে পড়ে থাকেন সেই রমণী, পরবর্তীতে তাঁর মৃত্যু ঘটলে তাঁকে এখানে সমাধি দেওয়া হয় এবং তিনি “আনোখা বিবি” নামে পরিচিত হন। (Anokha Bibi)

আমরা গল্প শুনছিলাম শীতল দাওয়ায় বসে এই পীরতলার খাদেমের কাছ থেকেও। গল্পে গল্পে যিনি খুব অনায়াসে দেখিয়ে দেন এই পীরতলার একদিকে মনসার থান আরেকদিকে সন্ন্যাসী ঠাকুরের বেদী। এখানে প্রতি বৃহস্পতিবার দিন আশেপাশের গাঁয়ের মানুষেরা ভিড় করে আসেন। হিন্দুরা নিয়ে আসে পূজার ডালা, মুসলিমরা এখানে বসে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের অতিরিক্ত নফল নামাজ আদায় করেন বিশ্বমানবের মঙ্গল কামনায়। (Anokha Bibi)
আজ আমাদের দেশের সবচাইতে গভীর অসুখের নাম যে ‘সাম্প্রদায়িকতা’, তা একটি শিশুও জানে। কিন্তু এই মাজারে এসে কিছুক্ষণের জন্য তা ভুলে যাই।
এছাড়াও প্রত্যেক বছর ১১ ই ফাল্গুন থেকে সাতদিনব্যাপী বাৎসরিক উরস এবং মহামিলন মেলা অনুষ্ঠিত হয় “আনোখা বিবি”র মাজারে। এ মেলায় যেমন হিন্দু সাধুসন্তরা আসেন ঠিক তেমনি মুসলমান ফকির-দরবেশেরা ভিড় করেন। প্রথমদিন মিলাদের পর রাতে অনুষ্ঠিত হয় সহভোজন। আক্ষরিক অর্থেই সহভোজন। খোলা আকাশের নিচে সারি সারি মানুষ, যখন পাত পেড়ে অন্ন গ্রহণ করেন তখন কে যে হিন্দু আর কে যে মুসলিম তা একমাত্র মা “আনোখা বিবি” ছাড়া আর কেউ জানেন না। মানুষে মানুষে ভালবাসা আর সম্প্রীতির বাঁধন এখানে অটুট। (Anokha Bibi)
“আনোখা বিবি”র এই মহামিলনমেলার আরও একটি চমৎকার নিয়মের কথা শোনা যায়, খাদেম বলছিলেন, “কোনও সাম্প্রদায়িক মনোভাবের মানুষ যদি এইখানে এসে কাউকে ধর্ম তুলে কটু কথা বলেন তাহলে তাঁর বিচারের ব্যবস্থা করেন তাঁরই গ্রামের মানুষেরা। তাই এখানে প্রতিটি গ্রামের নামে অসংখ্য কমিটি তৈরি করা আছে”। হিংসা নয়, মারপিট, হানাহানি নয়। এ যেন পরিবারের কোনও সদস্যের খারাপ আচরণ দেখে বাড়ির লোকজনদেরই তাঁকে বকে দেওয়ার মতো। (Anokha Bibi)

এসব শুনতে শুনতে কখন যে বেলা গড়িয়ে বিকেল, তা আমরা এতগুলি মানুষও ঠাহর করতে পারিনি। আসলে বহুদিন বাদে মানুষের নিজেদেরই তৈরি এমন রূপকথার মতো বাস্তবের গল্প আমরা শুনতে পাইনি, এই “আনোখা বিবি”র মাজারে এসে তাই যেন শোনা হল। আর এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে যায় ক্ষিতিমোহন সেনের সেই আশ্চর্য বইটির কথা, “ভারতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা”। সেখানে একটি অংশে তিনি বলছেন– (Anokha Bibi)
“…নিরক্ষর কবীর প্রচার করিতেন সহজ কথিত ভাষায়। অথচ গভীর সব সত্য তাহার মধ্যে। পণ্ডিতেরা জিজ্ঞাসা করিতেন, তুমি কী করিয়া এই সব সত্য পাও? কবীর বলিতেন– উঁচে পানী না টিকে নীচে হী ঠহরায়
আমি সবার নীচে বলিয়াই সত্যকে পাই। উচ্চে যে জল দাঁড়ায় না, সেই জল দাঁড়ায় নীচে।…”
আরও পড়ুন: বীরভূমের হারিয়ে যাওয়া নৌবন্দর সুপুরে
ভারতবর্ষের দেশধর্ম বলে যদি সত্যিই কিছু থাকে, তা বোধহয় এইই, যা সন্ত কবীরের বাণীকে ধরে আচার্য ক্ষিতিমোহন বলেছেন। আমদের দেশে আবহমান কাল ধরেই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চার বাইরে, লোকচক্ষুর আড়ালে বাউলের আখড়ায়, মাজারে, পীরের দরগায় যে সত্য, সুন্দর, সহজ মনুষ্যত্বের চর্চা হয়ে এসেছে সেই ধারায় “আনোখা বিবি”-র মাজার যেন একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আজ আমাদের দেশের সবচাইতে গভীর অসুখের নাম যে ‘সাম্প্রদায়িকতা’, তা একটি শিশুও জানে। কিন্তু এই মাজারে এসে কিছুক্ষণের জন্য তা ভুলে যাই। আর এই আবহে “আনোখা বিবি” মাজারে দাঁড়িয়ে যখন শুনতে পাই, সুভাষ কবিয়াল গান বেঁধেছেন– (Anokha Bibi)
“ও কেন ভাই করছ বড়াই? দেখছ না জাতের ছবি?
কে বা হিঁদু, কে বা মুসলমান ঘোচায় রে আনুখা বিবি!”
তখন চারপাশে বসন্তের বেলাটা ভারি মধুর হয়ে নেমে আসে। মৃদুমন্দ হাওয়া দেয়, গাছে গাছে পাখিরা ডেকে ওঠে। দূর থেকে মাগরিবের আজান আর শাঁখের আওয়াজ একসঙ্গে ভেসে আসে। (Anokha Bibi)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
চিত্র ঋণ- শুভময় রায়
শুভময় রায়ের জন্ম নব্বইয়ের দশকে উত্তরবঙ্গে। বেড়ে ওঠা কোচবিহার জেলার মেখলীগঞ্জে। সেখানেই কেটেছে স্কুলজীবন। কলেজ জীবনে শান্তিনিকেতনে পড়তে আসা সাঁওতালি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে। বর্তমানে একটি সাঁওতালি মাধ্যম স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি স্বাধীনভাবে লেখালিখি ও গবেষণার কাজ করেন। আগ্রহের বিষয়: সাঁওতাল জনজীবন, রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন, গ্রামীণ সংস্কৃতি।