(Radhika Yadav)
‘জিনিসটা মোটেই ভাল নয়, যূথি। এসব আসকারা তুই দিবিনে। এ এক ধরনের কমপ্লেক্স!’
বিমল করের ‘আত্মজা’ থেকে প্রথম যখন এই লাইনগুলো পড়েছিলাম, তখন আমার বয়স, বছর বারো, ‘ইলেকট্রা কমপ্লেক্স’ সম্পর্কে কোনও ধারণাই হয়নি তখনও। গল্পের হিমাংশু তার মেয়ে পুতুলকে নিয়ে যে-মুগ্ধতার ছোঁয়া ইতিমধ্যেই রেখে এসেছে গল্পের গোড়া থেকে, তাকে তখনও পর্যন্ত বেয়াড়া মনে হয়নি আমার। বস্তুত, নয়ের দশকের যে-সময় জুড়ে আমাদের বেড়ে-ওঠা, তাতে পিতাপুত্রীর সম্পর্কের মধ্যে আদ্যিকালের আড়ষ্ট জড়তার ছায়া আমরা পাইনি কোনওদিনই। (Radhika Yadav)
আরও পড়ুন: বিস্মৃত বিপ্লবী কল্পনা দত্ত
আদর-আবদার, কিংবা মায়ের অতিশাসনজনিত অভিযোগ নিয়ে কথায়-কথায় বাবার দ্বারস্থ হওয়া, জ্বরের রাতে মাথার পাশে জেগে থাকা থেকে শুরু করে বইমেলার যাবতীয় দাবি মেটানো, সবেতেই বাবা। তাই গোড়া থেকেই গল্প যে বেসুরে বাজতে শুরু করেছে, সে-কথা টের পাচ্ছিলাম, কিন্তু সচেতন সতর্কতায় বিশ্বাস করতে পারিনি গল্পের শেষ যবনিকা ওঠার পর হিমাংশুর সেই আত্ম-উপলব্ধি: ‘পুতুলের বুকে মুখ গুঁজে হিমাংশু হাসছিল বটে, কিন্তু কোথায় একটা সুধার স্পর্শ যেন ছিল। ঠিক, ঠিক– পুতুলের হাঁটুর ওপর থেকে বস্ত্র সরিয়েছে ও কিন্তু চোখে পড়েছে– একটি অন্য আকাশ, কী ফুল, কী পাপড়ি। অস্বীকার করবে কি হিমাংশু, পুতুলের চুল, চোখ, সর্বাঙ্গের ঘ্রাণ ওর চিত্তে যে শিহরণ জাগিয়েছে তার মধ্যে কোনও আনন্দের স্বাদ ছিল না?’ (Radhika Yadav)

পিতা এবং কন্যা। ঔরসজাত, বিপরীত লিঙ্গসম্পন্ন সন্তান। আত্মজা, তাই একাত্মতার বোধ আছে। আবার যৌনপরিচয়ে সে সম্পূর্ণ ভিন্ন, সেই পার্থক্যও একটা দূরত্বরেখার মতো ঘিরে আছে সবসময়। একটি অচ্ছ মসলিন পর্দা যেন নিয়ত ঝুলে রয়েছে দু’জনের মাঝে, তাকে ভুলে থাকার ছল ধরা পড়লেই মুশকিল। মা-ঘেঁষা ছেলে আর বাবার ন্যাওটা মেয়ের একটা অতিজনপ্রিয় প্রচলিত ইমেজ এই সীমানারেখাটির অস্তিত্বের খুব ধারকাছ দিয়েই যদিও ফিরে ফিরে আসে। কিন্তু নারীকে চালনা করার যে নিত্যপ্রবৃত্তি পুরুষরক্তের অন্তর্গত প্রণোদনার ছোবল হয়ে উঠতে চায় বারবার, তাকে কি কন্যাসন্তানের বাবারা অস্বীকার করার মতো সবলতা দেখাতে পারেন সবসময়? (Radhika Yadav)
মৎস্যপুরাণের বহু বিতর্কিত প্রসঙ্গটিকেই যদি টেনে আনা যায়, দেখা যাবে, সেখানে ব্রহ্মা তাঁর স্ত্রী সাবিত্রীকে প্রথমে হৃদয়ে ধারণ করছেন, অতঃপর তাঁর মুখ থেকে সৃষ্টি হল দেবী সরস্বতীর। ব্রহ্মার অঙ্গজাত, তাই তিনি ব্রহ্মাকন্যা।
এই প্রসঙ্গে একটু পৌরাণিক কিংবা প্রাক্-পৌরাণিক প্রসঙ্গও টেনে আনা প্রয়োজন, কারণ পুরাণকাহিনি বহুক্ষেত্রেই আধুনিক সংকোচময় শালীনতার অপেক্ষা না-রেখে এই ধরনের প্রবণতাগুলিকে স্পষ্টত ধরে রেখেছে নিজেদের ইতিহাসগন্ধী শরীরে। দীর্ঘকালের যৌথ সামাজিক নির্মাণ এই গল্পগুলো তাই বহু বেসামাল মানুষী দুর্বলতার স্মারক। (Radhika Yadav)
মৎস্যপুরাণের বহু বিতর্কিত প্রসঙ্গটিকেই যদি টেনে আনা যায়, দেখা যাবে, সেখানে ব্রহ্মা তাঁর স্ত্রী সাবিত্রীকে প্রথমে হৃদয়ে ধারণ করছেন, অতঃপর তাঁর মুখ থেকে সৃষ্টি হল দেবী সরস্বতীর। ব্রহ্মার অঙ্গজাত, তাই তিনি ব্রহ্মাকন্যা। কিন্তু তাঁকেই কামনা করছেন ব্রহ্মা। এক আশ্চর্য দর্শকামের অপূর্ব বর্ণনাও রয়েছে এই প্রসঙ্গে। সরস্বতীর রূপে মোহিত তাঁর পিতা, ঘুরেফিরে তিনি আত্মজাকে নিরীক্ষণ করতে চান সর্বত্র। মেয়েকে দেখার প্রবল বাসনায় তৈরি হল তাঁর চারটি মাথা, চতুর্দিকে নিবদ্ধ আটটি চোখ! (Radhika Yadav)
“আত্মজাকে সেখানে সরাসরি এক পিতা বলছেন, ‘দেখিয়া তোমার ঠান/ কামে দহে মোর প্রাণ।/ মদন অনলে প্রাণ ইহার উপায় কি।।’”
এ বঙ্গের কবি বিজয়গুপ্ত ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে শিবকন্যা মনসার প্রতি শিবের যে-মনোভঙ্গির কথা বেঁধে রেখেছেন পয়ারের ছন্দে, সেখানে কামের তাড়না নিয়ে বিন্দুমাত্র লুকোছাপা নেই। আত্মজাকে সেখানে সরাসরি এক পিতা বলছেন, ‘দেখিয়া তোমার ঠান/ কামে দহে মোর প্রাণ।/ মদন অনলে প্রাণ ইহার উপায় কি।।” কাহিনিতে অবশ্য মনসা আত্মপরিচয় দেওয়ার পরে শিবের লজ্জিত হওয়ার প্রসঙ্গও আছে, কিন্তু কন্যার প্রতি পিতার এই অনিয়ন্ত্রিত রতিভাবনার নিদর্শনটি কবিকল্পনায় যেভাবে উসকে উঠেছে, সেখানে এই লাগামছাড়া শিশ্নপরায়ণ পুরুষের অজাচারপ্রবৃত্তির চেয়েও বড় হয়ে পড়েছে শিবের বিড়ম্বিত রূপ, কন্যার পরিচয় জানার পর পিতার আত্মগ্লানি। (Radhika Yadav)
কাব্যের পরবর্তী অংশেও, স্নানরতা কন্যার প্রতি শিবের দৃষ্টিপাত এবং সংকুচিত হওয়ার প্রসঙ্গ আছে– ‘জলমধ্যে মনসা করেন জল খেলা।।/ উদলা মাথায় কেশ বুকে বস্ত্র নাই।…জলকেলি করে পদ্মার আর নাহি চিত।/ পদ্মার মুখ দেখিয়ে শঙ্কর লজ্জিত।।/সম্পূর্ণ যৌবন কন্যার রূপের নাহি সীমা।’ তার অব্যবহিত পরেই, এই লজ্জা প্রশমনের চেষ্টায়, সম্ভবত শিব পরমুহূর্তেই মনসার বিবাহ-উদ্যোগ শুরু করবেন। একসময় যাকে নিজশয্যায় আহ্বান করলেন, পরে তাঁকেই তিনি উদ্যোগী হয়ে প্রত্যর্পণ করছেন অন্য এক পুরুষের যৌনসঙ্গিনী হিসেবে– এই উদাহরণই বুঝিয়ে দেয়, নারীর প্রতি পুরুষের নিয়ন্ত্রণভাবনার মূল শিকড়টা কোথায়। (Radhika Yadav)
তদন্তে উঠে আসছে একের-পর-এক সূত্র। কখনও জানা যাচ্ছে মেয়ের রোজগারে দিন চলছে বাবার, এই অপবাদ তিনি মেনে নিতে পারেননি। কখনও শোনা যাচ্ছে, মেয়ের টেনিস অ্যাকাডেমি শুরু করার সিদ্ধান্তে তাঁর মত ছিল না।
হরিয়ানার গুরুগ্রামে টেনিস খেলোয়াড় রাধিকা যাদবকে যে গুলি করে নিজের বাড়ির রান্নাঘরে মেরে ফেলেছেন তার খুনি বাবা, সেই মৃত্যু ঘিরেও যে-ক’টি প্রশ্ন উঠে আসছে, তার প্রত্যেকটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই এক নিয়ন্ত্রণকামিতার দুর্বহ পাথর। তদন্তে উঠে আসছে একের-পর-এক সূত্র। কখনও জানা যাচ্ছে মেয়ের রোজগারে দিন চলছে বাবার, এই অপবাদ তিনি মেনে নিতে পারেননি। কখনও শোনা যাচ্ছে, মেয়ের টেনিস অ্যাকাডেমি শুরু করার সিদ্ধান্তে তাঁর মত ছিল না।
এমনকী, স্বাধীনচেতা মেয়ের নিজস্ব জীবনযাপনের ধরন নিয়েও বারবার আপত্তি জানিয়েছেন তিনি, এ-কথাও সংবাদমাধ্যম প্রচারের আলোয় টেনে এনেছে বারবার। কিন্তু আঠেরোটি সোনা জিতে আসা একটি পঁচিশ বছরের মেয়েকে নিজের কবজায় বাঁধার জন্য কতটা ভয়াবহ কনট্রোলফ্রিক হলে, মায়ের জন্মদিনের রাতে সে মেয়ে যখন মায়ের জন্য নিজের হাতে রান্না করবে বলে বাজারপত্র করে এনে রান্নাঘরে ঢুকেছে, তখন পরপর তিনটে গুলি চালিয়ে মেয়ের মৃত্যু নিশ্চিত করা যায়! (Radhika Yadav)
“ঠান্ডা মাথায় রান্নঘরের ছুরিতে শান দিয়ে রেখেছিলেন খুনি এই বাবা। মা দেখেছিলেন সবটাই, কিন্তু কল্পনাও করতে পারেননি ছুরির ধার বাড়ানো হচ্ছে মেয়েকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলার অভিপ্রায়ে।”
লখনউয়ের বিজ্ঞানপুরী কলোনিতেও কিছু দিন আগেই জনৈক বিকাশচন্দ্র পান্ডে ছুরি দিয়ে আঠেরোবার কুপিয়ে খুন করেছেন মেয়েকে, কারণ, বাবার না-পসন্দ একটি ছেলের সঙ্গে নিয়মিত বাক্যালাপ চালাচ্ছিল সে। ঠান্ডা মাথায় রান্নঘরের ছুরিতে শান দিয়ে রেখেছিলেন খুনি এই বাবা। মা দেখেছিলেন সবটাই, কিন্তু কল্পনাও করতে পারেননি ছুরির ধার বাড়ানো হচ্ছে মেয়েকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলার অভিপ্রায়ে। মেয়ের যৌনসঙ্গী নির্বাচনের এই স্বাধীনতা যে যৌনভাবে বাবাকে কতদূর তাড়িত করে ফেলেছিল, তা বোঝা গেছে মৃত মেয়েটির ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পর। ঘৃণ্য বিবমিষাময় সে রিপোর্ট বলছে, উন্মত্ত বাবা ছুরি চালিয়েছেন মেয়ের ঘাড়ে, পেটে, ফালাফালা করে দিয়েছেন তার যৌনাঙ্গ, এবং তার পরে মৃত মেয়ের দেহের ওপরে উঠে রীতিমতো তাণ্ডব করেছেন তিনি! সত্যি বলতে কী, এই ঘটনার সঙ্গে না চাইতেও কী ভয়ানক মিল দক্ষ-সতীর পুরাণকাহিনির! দক্ষা নিজের হাতে হত্যা করেননি, কিন্তু সেখানেও ঠিক একইরকমভাবে অননুমোদিত পুরুষের ঘর করতে চলে যাওয়া মেয়ের মৃত্যুর কারণ হয়ে থাকেন এক পিতা, দক্ষযজ্ঞ বেধে যায় সেই নারীদেহ ঘিরে আর-এক পুরুষের উন্মত্ত তাণ্ডবে! (Radhika Yadav)

আবার সব ঘটনাতেই যে যৌন নিয়ন্ত্রণের দৃষ্টিকোণ এত স্পষ্ট, তাও নয়, তবে একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, দ্বিতীয় শ্রেণির যৌন পরিচয় নিয়ে বেড়ে ওঠা এই মেয়েরা কীভাবে প্রতিমুহূর্তে লড়াই করে চলে তাদের জীবনের প্রথম পুরুষলিঙ্গধারী মানুষগুলোর ‘মেল ইগো’-র সঙ্গে। মাসখানেক আগেই যেমন, মহারাষ্ট্রের সাঙ্গলিতে নিজের সতেরো বছরের মেয়েকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন বাবা, কারণ নিট পরীক্ষার্থী মেয়ের ফল তাঁর মনোমতো হয়নি এবং তর্কাতর্কির সময়ে মেয়েও বাবার ‘অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল! দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় ৯৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাস করা মেধাবী মেয়েটিকে মারতে-মারতে অজ্ঞান করে ফেলে রেখে নিজের যোগমণ্ডলীর অধিবেশনের কাজে বাড়ি থেকে বেরিয়েও যান তিনি, অসুস্থ মেয়েকে যতক্ষণে কোনওরকমে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন মা, ততক্ষণে সে মৃত। এই বীরপুঙ্গবটি আবার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ! একে তাঁর নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষার জুড়িগাড়িতে মেয়ে সওয়ার হতে পারছে না, তাই আবার সে তাঁর যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে! এই অধিকারের স্পর্ধা তৎক্ষণাৎ গুঁড়িয়ে না দিলে বাবার মর্যাদা থাকে কোথায়? (Radhika Yadav)
এ-দেশের বহু ভৌগোলিক পরিসরে এমন সব গল্পই লুকনো আছে, যেখানে কন্যাসন্তান আসলে একটি বিশেষ যৌনপরিচয়সম্পন্ন সম্পত্তি, তাকে খরিদ করা দাসের মতো খুঁড়ে-রাখা পথেই চলতে হবে, বাইরে পা পড়লেই শাস্তি অনিবার্য। কখনও অপছন্দের পাত্রকে বিয়ে করায় নিজের মেয়ের শ্রাদ্ধ করে ভোজসভা ডেকে লোক গেলাচ্ছেন এই হাওড়ারই এক বাবা, আবার কখনও পরিবারে শান্তি ফেরাতে তান্ত্রিকের পরামর্শে নিজের দুই বছরের শিশুকন্যাকে বলি দিচ্ছেন মুজফফরনগরের আর-এক বাবা। নিজের ভাগ্যদোষ খণ্ডন করতে গ্রিক পুরাণের অ্যাগামেমনন-ও তো দেবী আর্টেমিসের কাছে বলি দিতে দেয়েছিলেন তাঁর মেয়ে ইফিগেনিয়াকে! অথচ, কন্যাসন্তানের চরম ভালবাসা আর পরম আনুগত্যের নজির অ্যাগামেমননের মতো করে আর কেই বা কবে পেয়েছিল! এই অ্যাগামেমননের কন্যা ইলেকট্রা, একাধিক সাহিত্যকর্মের প্রণোদনা, বিখ্যাত চরিত্র, যার নামে জুড়ে গেছে ‘ইলেকট্রা কমপ্লেক্স’-এর নাম! বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধে নিজের মা ক্লাইটেমনেস্ট্রা-কে পর্যন্ত হত্যা করেন ইলেকট্রা। (Radhika Yadav)
“পুরাণ ও বাস্তব, জিঘাংসা ও অহং, আধিপত্য ও অভীপ্সা তখন এক হয়ে গিয়ে আমাদের স্থাপন করে বাস্তবোত্তর এক পরিসরে, যেখান থেকে বাস্তবের দিকে তাকাতেই ছমছম করে ওঠে বুক!”
বাবা-মা-সন্তানের এই জটিল ত্রিকোণ কাহিনির সূত্র ধরেই আরও একটি মাতৃঘাতী পুরাণকাহিনির কথা মনে পড়ে, যেখানে পুত্রসন্তান নিজের হাতে কুড়ুল চালিয়ে মা-সহ নিজের তিন ভাইকেই মেরে ফেলছেন, বাবার আদেশে। পরশুরামের এই গল্পে, তাঁর মা রোহিণীকে ছেলের হাতে মরতে হয়েছিল, কারণ জল আনতে গিয়ে হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ে যায় রাজার সস্ত্রীক জলবিহারের দৃশ্য। মোহিত হয়ে সে দৃশ্যে মজে যান রেণুকা, কিন্তু ভয়্যারিজমে বুঁদ এই লগ্নে স্বামী জমদগ্নির সন্ধ্যাহ্নিকের জল আনতে বড় দেরি হয়ে যায় তাঁর। ক্রুদ্ধ ঋষি তাঁর পুত্রদের আদেশ দেন, কেটে ফেলতে হবে স্পর্ধিতার মাথা! একে-একে তিন পুত্রই প্রত্যাখ্যান করেন তাঁকে, কিন্তু কনিষ্ঠ পরশুরাম। ক্ষত্রিয়কন্যা রেণুকার বংশজ বীরত্ব সবচেয়ে বেশি বর্তেছিল তাঁর ছোট ছেলের ওপরেই, সেই ক্ষাত্রবীর্যের প্রকোপেই মাথা কাটা পড়ল তাঁর, ছেলের হাতে। (Radhika Yadav)

এই মাতৃহন্তা পুত্রের পুরাণকাহিনিটি অবশ্য এতক্ষণের ভেবে পাওয়া আর একটি সমীকরণকেও ধসিয়ে দিয়ে যায়। পিতা হোক অথবা পুত্র, নারী চিরকাল সম্পত্তি, দাসজাতীয়। যৌন পরিচয়ে সে ইতরশ্রেণি, তাই তার গতিবিধি, ক্রিয়াকলাপ, যৌনাকাঙ্ক্ষা– সবেরই নিয়ন্ত্রক পুরুষ। লিঙ্গপরিচয়ের এই প্রবল প্রতাপ ধাক্কা খেলেই পিতৃপরিচয়ের মুখোশ খসে গিয়ে তার আড়াল থেকে খুনি পুরুষের জিঘাংসু চেহারাটা তাই বারবার বেরিয়ে পড়ে। অথচ, এর ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে কখনও যদি এই মেয়েরাই তাদের পিতার প্রতি অশাস্ত্রীয় সম্পর্কের স্পৃহা প্রকাশ করে ফেলেছে দুর্বলতম মুহূর্তে, কোনও ইতিহাস, কোনও পুরাণ তাদের ক্ষমা করেনি। রাজা থিয়াসের মেয়ে মিরহা যেমন পড়েছিল নিজের বাবার প্রেমে। কিন্তু সে-কথা স্বীকার করার সাহস হয়নি তার। পরপর নয়টি আঁধার রাত জুড়ে আবছায়ার আড়ালে থিয়াসের কণ্ঠলগ্না হয় সে, গর্ভে আসে অ্যাডোনেইস। সব জানতে পারার পর অগ্নিশর্মা থিয়াস ছোটেন মেয়েকে মেরে ফেলবেন বলে। দেবতাদের দয়ায় মিরহা ততক্ষণে লুকিয়ে পড়েছে, হয়ে উঠেছে একটি ছোট্ট মিরহা গাছ। (Radhika Yadav)
এই অবস্থাতেই জন্ম হল অ্যাডোনেইসের। এই অ্যাডোনেইসের প্রেমে পাগল হলেন দেবী অ্যাফ্রোদিতি। বাবার আসঙ্গকামনার অপরাধে মিরহা-কে অভিশাপ দিলেন তিনি, আর মিরহা-র চোখের জল ফোঁটা ফোঁটা কষ হয়ে ঝরে পড়তে লাগল গাছের গা বেয়ে। তাই দিয়েই নাকি তৈরি হয় গুগ্গুল, এমনই কিংবদন্তি জড়িয়ে আছে গুগ্গুল গাছের সঙ্গে। মিরহা-র সেই ঘনীভূত অশ্রুর মালা সুগন্ধি ধোঁয়া ছড়িয়ে পুড়ে যেতে থাকে অহরহ, একলা গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অবাধ্য অভিশপ্ত মেয়ের নিশ্চুপ কান্না এভাবেই শুধু মিশে-মিশে যায় খেয়ালি হাওয়ায়। (Radhika Yadav)
আরও পড়ুন: বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে
পুনশ্চ: অপরাধ করা, আর অপরাধ করার কথা ভাবা– নিশ্চয় এক নয়। রাধিকার বাবা অপরাধ করে এই নিবন্ধের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন, কিন্তু যখন বলিউডের সুপারস্টার সঞ্জয় দত্ত হাসতে হাসতে অবলীলায় সাক্ষাৎকারে বলেন– আমার মেয়ে যদি প্রেম করে, তাহলে দরকারে আরও একবার আমি জেলে যেতে রাজি– আমরা সেই ইঙ্গিতের ভয়াবহতা লহমায় বুঝতে পারি– ধরতে পারি এই গূঢ় সত্য যে– কখনও কখনও অপরাধ করার কথা ভাবা-ই আসলে অপরাধের দিকে ঠেলে দেয় সম্ভাব্য অপরাধীকে। পুরাণ ও বাস্তব, জিঘাংসা ও অহং, আধিপত্য ও অভীপ্সা তখন এক হয়ে গিয়ে আমাদের স্থাপন করে বাস্তবোত্তর এক পরিসরে, যেখান থেকে বাস্তবের দিকে তাকাতেই ছমছম করে ওঠে বুক!
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অরুন্ধতী দাশ। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক। গবেষণার বিষয় মনোভাষাবিজ্ঞান। লেখালিখি করেন মূলত ভাষা, নারীবাদ আর সাহিত্য নিয়ে।
5 Responses
সাহসী লেখা। আমাদের চক্ষুলজ্জার মেকি আবরন সরিয়ে দেখলাম।
একটি সত্যিকারের বলিষ্ঠ সংস্কারমুক্ত লেখা।
চমৎকার লেখা। তবে পিতা-পুত্রী, মাতা-পুত্র, ভ্রাতা-ভগ্নি প্রভৃতির মধ্যে যৌন সম্পর্ক প্রবণতার ওপর নির্ভর করে। হয়তো সে কারণে এগুলিকে সব সমাজে, সব ধর্মে taboo বলে গণ্য করা হয়। এ সব বোধহয় চিরকালই ছিল, পুরাণগুলি সে সাক্ষ্যই দেয়। এখন সংবাদ মাধ্যমের শকুন দৃষ্টির ফলে বহু ঘটনা নজরে আসছে।
অনবদ্য বাস্তব তুলে ধরেছেন
অনবদ্য।কঠিন বাস্তব তুলে ধরেছেন