(Street Performance)
পথে পথে কত মানুষ শুধু গান গেয়েই জীবন চালান গোটা দুনিয়ায়। কেউ কেউ আলোয় আসেন, তারকা হয়ে ওঠেন। কেউ আঁধারেই থেকে যান। তাতে তাঁদের কিছু এসে যায় না। গান শুধু চিরকাল থাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মল জীবিকা বোধহয় পথে গান গেয়ে যাওয়া। এই স্ট্রিট সিঙ্গারদের নিয়ে সিনেমাও হয়েছে, আঁকা হয়েছে বিশ্বখ্যাত ছবি। এই সপ্তাহে ডাকহরকরার চিঠিতে সেই গান অন্তপ্রাণ মানুষগুলোকে নিয়েই লেখা। (Street Performance)
আরও পড়ুন: ডাক-হরকরার চিঠি: আজও রহস্যের মাঝে চিরবিপ্লবীর দুই বিদেশিনী স্ত্রী
রাসবিহারী মোড় থেকে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছি বালিগঞ্জ। ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের কাছে হঠাৎই দেখি, রাস্তার ধারে ফুটপাতে বসে অত্যন্ত নিচু গলায় গান গাইছেন এক প্রবীণ।
কোথায় বলুন তো? মহানির্বাণ মঠ পেরোনোর ঠিক পরেই। টুপি পরা ভদ্রলোকের হাতে মাইক্রোফোন। মাথা নিচু। সামনের কৌটোয় লেখা, ‘গান ভাল লাগলে কিছু সাহায্য করবেন।’ (Street Performance)

‘গান’ শব্দটা অনেক বড় করে লেখা।
দৃশ্যটা পার্ক স্ট্রিট থেকে শ্যামবাজার, গড়িয়া থেকে বেহালা— প্রচুর রাস্তাতেই এখন এ ধরনের দৃশ্য দেখা যায়। তরুণ কেউ। কেউ প্রবীণ। দৃষ্টিহীন কেউ। স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গেও দেখা যায় অনেককে। পার্ক সার্কাসের ওদিকে একজনকে দেখেছি নিজের গানই বক্সে চালিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন। সঙ্গে স্ত্রী। (Street Performance)
পার্ক স্ট্রিটে নিজে দেখেছি, গান গাওয়ার জন্য ফুটপাতে জায়গা পেতে দু’পক্ষের ঝামেলা। দিন কয়েক আগেই পার্ক স্ট্রিটের এক তরুণ গায়কের জন্য একটা ফাংশানের ব্যবস্থা করেছিলেন সমাজমাধ্যমের কিছু অচেনা মানুষ। অনেকের সেই সৌভাগ্য হয় না। (Street Performance)
“সকালের দিকে হকারি করেন, তাতে সংসার খরচ হয় না বলে গান নিয়ে ঘুরছেন মাস কয়েক হল। একেক দিন একেক জায়গায় বসা।”
এসব জানার পরেও সেদিন দাঁড়িয়ে পড়ি ফুটপাতে। পাশেই মনিহারি জিনিসের একটা ছোট স্টল। সেই ভদ্রলোক বাঘাযতীন থেকে প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে ট্র্যাঙ্গুলার পার্কে আসেন হকারি করতে। রাত দশটায় ফিরেও যান সাইকেলে। ভদ্রলোকের তখন ক্রেতা নেই। বেশ সমীহের সুরে তাঁকে বলতে শুনলাম, ‘গলায় কিন্তু ভাল সুর আছে। আগে কখনও দেখিনি। আজই প্রথম দেখছি।’ গান এমন বস্তু, ভাল লাগলে যে কোনও লোককে টেনে নিয়ে যায় সেখানে। ফুটপাথের হকারও অতি আগ্রহ নিয়ে গান শুনতে থাকেন প্রতিবেশী গায়কের। (Street Performance)
প্রবীণ গায়কের হাতের সামনে একটি বহু পুরোনো খাতা। তাতে পরপর বাংলা হিন্দি মিশিয়ে অন্তত গোটা তিরিশ গানের লাইন। সেই গানের খাতা থেকেই গান গেয়ে চলেছেন তিনি। কখনও ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’। কখনও ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’। তারপরেই হয়তো ধরলেন, ‘তু মিলে দিল খিলে’।
দু’টো স্তবক গেয়ে নিজেই নিজেকে শোনানোর ভঙ্গিতে বলছেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ। ভাল লাগলে কিছু সাহায্য করুন।’ (Street Performance)
কথা বলে বুঝলাম, ভদ্রলোকের বাড়ি বাঁশদ্রোণী। সকালের দিকে হকারি করেন, তাতে সংসার খরচ হয় না বলে গান নিয়ে ঘুরছেন মাস কয়েক হল। একেক দিন একেক জায়গায় বসা। কত রোজগার হয় দাদা? খুব ম্লান গলায় বললেন, ‘৫০০ থেকে হাজার হয়ে যায় এক একদিন।’ মাথা নিচু করেই কথা বলা। সোজাসুজি তাকিয়ে নয়। হঠাৎ মনে হল, চেনাশোনা কেউ যাতে দেখতে না পান, সে জন্যই কি মাথা নিচু তাঁর? (Street Performance)
“সেখানে সকাল হলেই রাস্তায় ঢোল নিয়ে গান ধরেন। বড় মায়া জেগে ঢোল নিয়ে গান করার সেই ভঙ্গিতে।”
এ পর্যন্ত লিখে ভাবি, কী আর নতুন লিখলাম? হাওড়া বা শিয়ালদার যে কোনও লোকাল ট্রেনে উঠলে অনেককে এভাবে গাইতে দেখব। চমকে দেওয়া গলা অনেকের। লোকাল ট্রেনগুলোতে স্বামী-স্ত্রী, বা বাবা-মেয়ে অহরহ গান শুনিয়ে যান। কামরা পালটে যান অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে। দমদম স্টেশনে একদিন এক বালিকা এমনভাবে গেয়েছিল ‘বনমালী তুমি পরজনমে হইও রাধা’, মনে হয়েছিল আমি অনন্ত সুরের সাম্রাজ্যে ভেসে গেছি। ওই স্টেশনের আন্ডারপাসে গৌতম গায়েন নামে এক রাজমিস্ত্রিকে গান করতে শুনেছিলাম গিটার হাতে। পাশে শিশু সন্তান। চমকে দিয়ে গাইছিলেন, ‘আমারও মন ভাঙে, চোখে জল আসে, অভিমান হয়।’ (Street Performance)
দেখেছেন নিশ্চয়ই, নদীয়ার শিমুরালিতে কিশোরকণ্ঠী গায়ক রমেন হালদারের গান নিয়ে এই মুহূর্তে কত হইচই সমাজমাধ্যমে। স্টেশনে গান গেয়ে ভাইরাল হওয়ার পরে রমেন গাওয়ার মঞ্চ পেলেন। তরুণকে দেখলে অসুস্থ দেখায়, গান ধরলে একেবারে স্বর্গীয়। তিনি গান করেন শুধু অভাবের তাড়নায়। (Street Performance)
জয়রামবাটির কাছের এক গ্রামের বাসিন্দা দৃষ্টিহীন কালীকিঙ্কর সেন। এখন থাকেন আরামবাগে বোনের বাড়িতে। সেখানে সকাল হলেই রাস্তায় ঢোল নিয়ে গান ধরেন। বড় মায়া জেগে ঢোল নিয়ে গান করার সেই ভঙ্গিতে। গেদে লোকালে উঠলে দেখা যায়, হারমোনিয়াম নিয়ে গান ধরেন মধ্যবয়সিনী। ইন্টারল্যুড, প্রিল্যুডগুলো কী চমৎকার, কী নিখুঁত! সাঁইথিয়ার অস্থায়ী রং মিস্ত্রির কথাই জুড়ে দেওয়া যাক এখানে। চোখে কম দেখেন। অথচ দাপটের সঙ্গে লোককে গান শুনিয়ে যান ক্যারাওকে নিয়ে। সবাই ডাকে গুপী কাকা। (Street Performance)
“উরোপ-আমেরিকায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান করে, গিটার-বেহালা-চেলো বাজিয়ে অর্থ উপার্জন কোনও ব্যাপার নয়। সেখান থেকেই উঠে এসেছেন অজস্র সুপারস্টার। টাটকা উদাহরণ আজকের এড শিরান।”
পথে পথে ঘুরে গানই যখন জীবিকা হয়ে ওঠে, তখন মনে হয়, এর চেয়ে স্বর্গীয় জীবিকা আর হতে পারে না কিছু। নির্মলতম পেশাগুলির, একটা। আমাদের লাল-নীল আলো জ্বলা মঞ্চে, মাচা শোতে অনেকেই তো গান গাইতে আসেন। তাঁদের পারিশ্রমিক কত! আর এঁরা, এই পথের গায়করা একেবারে সাধারণ মানুষ। শুধু সুর এঁদের সারাদিনের সঙ্গী, সুর এঁদের লড়াইয়ের অস্ত্রও। (Street Performance)

এঁরা কারও কাছে গান শেখার সুযোগ পাননি। হয়তো কেউ বলতেই পারবেন না, কোনটা দেশ রাগ, কোনটা দরবারি কানাড়া, কোনটা মল্লার। তবু গান গাওয়ার ইচ্ছে প্রবল। সেখানেই গান ইনিংসে জিতে যায়। সেখানেই জিতে যায় জীবন। রানু মণ্ডল বা ভুবন বাদ্যকর পর্যন্ত এসে ভাবনাটা থেমে যায় না। সাম্প্রতিক বাংলার সবচেয়ে পরিচিত দুই ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’ এখন আবার আলো থেকে আঁধারে, সুতীব্র অবসাদের সঙ্গী। আজকের কথাবার্তা শুনলে কষ্ট হয় খুব। তখন বরং ভাবার চেষ্টা করি, বাংলা থেকেই হয়তো উঠে আসবেন কোনও কুন্দনলাল সায়গল বা ভীমসেন যোশী। কোনও এড শিরান বা কৈলাস খের বা ট্রেসি চ্যাপম্যান। (Street Performance)
রাস্তায় গাইতে গাইতে জনতার প্রাণের গায়ক হয়ে উঠেছেন, এমন অনেক নাম সত্যিই চমকে দিয়ে যেতে পারে। জম্মুর ছেলে সায়গলের বাবা ছিলেন পাঞ্জাবি, মা কেশরবাই হিন্দু। গানপাগল কেশরবাই নিজে ধর্মপ্রাণা ছিলেন। ছেলেকে নিয়ে যেতেন বিভিন্ন গ্রামে কীর্তন, ভজন, শাবাদের অনুষ্ঠানে। (Street Performance)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: আলী আকবর খান
আজ থেকে প্রায় ৯৭ বছর আগে বিখ্যাত ফণী মজুমদার যখন সায়গল ও কানন দেবীকে নিয়ে ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’ সিনেমা করেন (বাংলায় একই সিনেমা হয় ‘সাথী’ নামে), তার মূল কাহিনি ছিল দুই তরুণ তরুণীর রাস্তায় গান গেয়ে বেড়ানোর ওপর ভিত্তি করে। গ্রামে গ্রামে গাইতেই সিনেমার জুটি সায়গল ও কানন দেবী কলকাতায় আসেন। সেখানে মেয়েটি সুযোগ পায় থিয়েটারে, ছেলেটি রেডিওয়। তার আগে আমেরিকায় (১৯১২) ও ব্রিটেনে (১৯২৪ ও ১৯৩৭) ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’ নামে দুটো ছবি ও মিউজিক্যাল হয়ে গিয়েছে। যদিও সেখানে কাহিনি একটু অন্য। (Street Performance)
ভীমসেন যোশী এবং কৈলাশ খের, দুজনেই শৈশবে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন গান শিখবেন বলে। বিভিন্ন ছোট ছোট জায়গায় গান শুনিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়। দুটোই উত্তরণের হীরক সমান উদাহরণ। মুদ্রার সম্পূর্ণ উল্টো পিঠও রয়েছে। পুণের কেশবলাল মূলচাঁদ। একটা সময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও ভি শান্তারামের সঙ্গে কাজ করা কেশবলাল কদিন আগেও পথে পথে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে হারমোনিয়াম কাঁধে ঝুলিয়ে হিন্দি ছবির গান বাজিয়ে যেতেন। সর্বভারতীয় কাগজ বা ইউটিউবে তাঁর অনেক ইন্টারভিউ দেখেছি। আশি পেরিয়েও অক্লান্ত। জানি না, এখন তিনি কোথায়। (Street Performance)
ইউরোপ-আমেরিকায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান করে, গিটার-বেহালা-চেলো বাজিয়ে অর্থ উপার্জন কোনও ব্যাপার নয়। সেখান থেকেই উঠে এসেছেন অজস্র সুপারস্টার। টাটকা উদাহরণ আজকের এড শিরান। ১৬ বছর বয়সে চলে এসেছিলেন লন্ডন। পাবে, রাস্তায় নানা অনুষ্ঠান করতেন। বছরে অন্তত ৩০০। সেখান থেকেই তাঁর অজস্র ফ্যান তৈরি। বহুবার তাঁকে বলে দেওয়া হয়েছে, তোমাকে দিয়ে হবে না, তোমার গান চলবে না। এসব শুনতে শুনতেও আত্মবিশ্বাস হারাননি। ‘আমার কোনও প্ল্যান বি ছিল না। শুধু মিউজিকই ছিল মনে। আমি জানতাম, আমাকে গেয়ে যেতে হবে। যতই কঠিন হোক না রাস্তা।’ (Street Performance)
“আপনার প্রিয় গায়ক কে? গায়ক ভদ্রলোক নাম করলেন লতা মঙ্গেশকর ও কিশোর কুমারের।”
আমেরিকান ট্রেসি চ্যাপম্যান এখন সুপারস্টার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ম্যাসাচুসেটসের হার্ভার্ড স্কোয়ার ও মেট্রো স্টেশনে গান গেয়ে বেড়াতেন।
গানই এমন একটা জিনিস, যা শুনলে লোকে কিছু অর্থ দিয়ে যায়। সেটা রোমের রাস্তায় হোক বা নিউইয়র্ক বা দিল্লির। যে লোকটা মোটা অঙ্কের অর্থ গায়কের হাতে গুঁজে দিয়ে চলে গেল, তাঁকে দেখে আমি কিছুক্ষণ আগেও ভেবেছিলাম, গুণ্ডা ধরনের কেউ হবে। অথচ গান তাঁর সংবেদনশীল মনটাকে পাপড়ির মতো খুলে দিয়ে চলে গিয়েছে। (Street Performance)
ধরা যাক, আমি রাস্তায় বসে কবিতা বলছি। আমি রাস্তায় বসে গল্প শোনাচ্ছি। কে টাকা দেবে? গান আর কবিতার মধ্যে আরও একটা বড় ফারাক এখানেই। সাধারণ মানুষের প্রত্যেকের মনে অজস্র গানের লাইন মনে রয়েছে। অথচ বিখ্যাত কবিদের লাইন তাঁরা বলতে পারবেন না। গানই বেশি মনে থাকে, কবিতা নয়। কবিরা রেগে যেতে পারেন, তবে বাস্তব এটাই এবং সারা পৃথিবীতে এটাই নিয়ম। কেউ হয়তো ফাংশনে গিয়েছেন। গায়ক গাইছেন। দেখবেন, কত লোক তাঁর সঙ্গে আনমনে গেয়ে চলেছে। হয়তো সে সেভাবে গান গাইতে পারে না। অথচ তার ঠোঁট নড়ে চলেছে।
সমস্ত ভাষায়, সমস্ত দেশে এই একই ছবি। (Street Performance)

কলকাতার ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের যে ছবিটা দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম, ফিরে যাই ওখানে।
আপনার প্রিয় গায়ক কে? গায়ক ভদ্রলোক নাম করলেন লতা মঙ্গেশকর ও কিশোর কুমারের। এই দুই গায়ক-গায়িকা শুধু জনপ্রিয়তায় এক নম্বর নন, আমাদের দেশে এখনও একটা ইন্ডাস্ট্রির কাজ করেন এঁরা। নিজেই একটা ইন্ড্রাস্ট্রি যদি বলতে হয়, তা হলে তাঁরা কিশোর-লতা। ভেবে দেখুন, দু’জনের গান গেয়ে কত লোক রোজগার করে বেড়ান প্রতিদিন প্রতি পল। কোন গান যে কাকে বিদ্ধ করবে, কেউ জানে না। (Street Performance)
“ভদ্রলোক নিজে গান করেন না। কিন্তু তাঁর ফুটপাথের দোকানে সারাক্ষণ বেজে চলে গান। এমন চরিত্র অনেক জায়গায় পাবেন। কেউ শুধু কিশোর বা রফির গানই বাজিয়ে যায়, কেউ শুধু মান্না-হেমন্তের।”
বহু যুগ আগে চেন্নাই থেকে কোচি যাওয়ার পথে ট্রেনে একবার শুনেছিলাম, এক দম্পতি ভিক্ষে করতে করতে গাইছেন, ‘আজা সনম মধুর চাঁদনি মে হাম’। তার দু’দিন পরে টিভিতে দেখলাম জয়ললিতার একটা ইন্টারভিউ। তিনি তখনও বেঁচে। সিমি গাড়োয়ালকে বলছেন, “আমার প্রিয় গান ‘আজা সনম মধুর চাঁদনি মে হাম।” ভাবতে ভাবতে আশ্চর্য হয়ে যাই, একটা গান কী করে মিলিয়ে দেয় পথের ভিখিরি ও রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষকে। এভাবে গান কাউকে তুলে নিয়ে আসে হাজার লোকের ভিড়ে। আবার ওই গান কাউকে ভাসিয়ে দেয় জনসমুদ্রে। তাকে আর দেখা যায় না। (Street Performance)
সেদিন রাসবিহারীর ফুটপাতে ওই গায়কের সঙ্গে যেখানে দেখা হল, তার সামান্য আগে একটি চায়ের দোকান রয়েছে।সেখানে সারাক্ষণ ধরে গান বাজে। ভদ্রলোক নিজে গান করেন না। কিন্তু তাঁর ফুটপাথের দোকানে সারাক্ষণ বেজে চলে গান। এমন চরিত্র অনেক জায়গায় পাবেন। কেউ শুধু কিশোর বা রফির গানই বাজিয়ে যায়, কেউ শুধু মান্না-হেমন্তের। ওটাই তাঁদের সারা দিনের মোটিভেশন। (Street Performance)
আর যাঁরা গান গেয়ে চলে এলেন, তাঁদের মোটিভশেন অন্য।
আজকের দিনে গান গেয়ে লোকের নজরে আসা একদিক দিয়ে ভয়ঙ্কর কঠিন। আর একদিক দিয়ে ভয়ঙ্কর সোজা। কঠিন কেন? আজকের দিনে বাংলা সিনেমায় গান ব্যবহার প্রায় উঠেই গিয়েছে, পুজোর সিডিও আর হয় না। নামী কোম্পানিগুলোও উঠে গিয়েছে। ফাংশানও কমে গিয়েছে চিটফান্ড বিতর্কের পর, স্পনসর নেই। নিজেকে তুলে ধরার জায়গা কম। (Street Performance)
“আমাদের দেশে যে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় গাইতে নামেন, তাঁদের অধিকাংশেরই লক্ষ্য থাকে একটা। প্রতিষ্ঠা নয়, জনপ্রিয়তার শিখরে অরিজিৎ সিং বা শ্রেয়া ঘোষালের পাশে পৌঁছনো নয়। সংসার চালানো।”
সহজ কেন? সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে আপনি বাড়িতে গান করেও দেশ বিদেশের মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারেন নিজেকে। রিয়ালিটি শো-তে একবার অডিশনে পাস করলে কেল্লা ফতে। টিভিতে কদিন ধরে আপনার গান শোনানো হবে। চ্যাম্পিয়ন না হলেও ভাল প্রচার। (Street Performance)
তবু বলতে হবে, শুধু ফাংশানে গান গেয়ে জীবন চালানো খুব কঠিন আজকের দিনে। এমন উদাহরণও খুব কম। বাংলার অধিকাংশ নামী শিল্পীকেও গান গাওয়ার পাশে শিক্ষকতা করতে হয়। নইলে সংসার চালানো তীব্র সমস্যা। আর এখন তো লাইকের যুগ, লাইকেই সব বিচার। এক বিখ্যাত বাঙালি শিল্পী ফেসবুকেই আক্ষেপ করেছেন, ‘আমার গান আপলোড করলে বড়জোর শপাঁচেক লাইক পড়ে। এখন তো অনেক তরুণ তরুণীর একটা গানেই লাখখানেক লাইক।’ রিয়ালিটি শোয়ে চ্যাম্পিয়ন রানার্স হয়েও হারিয়ে গিয়েছেন, এমন সংখ্যা অনেক। ‘ওয়ান সং ওয়ান্ডার’ এখন বাংলা বা ভারতের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতেই অনেক। স্ট্রিট সিঙ্গারদের মধ্যে সংখ্যাটা তো বেশি হবেই। (Street Performance)

আমাদের দেশে যে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় গাইতে নামেন, তাঁদের অধিকাংশেরই লক্ষ্য থাকে একটা। প্রতিষ্ঠা নয়, জনপ্রিয়তার শিখরে অরিজিৎ সিং বা শ্রেয়া ঘোষালের পাশে পৌঁছনো নয়। সংসার চালানো। পেট চালানোর সুরাহা। রাত নেমে এলে, যখন সামনের পাত্র থেকে পথের গায়ক বা গায়িকা গুনতে থাকে টাকা-পয়সা, তখন তাঁদের মুখে হাসি চওড়া হবে, না ম্লান হবে, তা ঠিক করে দেয় টাকা-পয়সার অঙ্কটা। আজ রাতে তা হলে বাড়িতে কী খাব? (Street Performance)
কৈলাশ খের যেমন বাড়ি থেকে বেরিয়ে খুঁজে বের করেছিলেন বেশ কিছু গুরু। চলত তাঁদের কাছে শিক্ষা নেওয়ার কাজ। তাতে তো পেট চলবে না। অনেক গানের প্রতিযোগিতা, অনেক অনুষ্ঠানে গান গাইতেন। তাতেও টাকায় কুলোচ্ছে না দেখে নানা রকম কাজ করেছিলেন। চা বিক্রেতা, সেলসম্যান, রেডিও জকি। একটা সময় গলায় এমন সমস্যা হল যে গান গাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সেখান থেকে এসে তিনি গাইলেন, আল্লা কে বন্দে। (Street Performance)
“পথের কোণে বসে থাকা, রেলগাড়ি বা বাসস্ট্যান্ডে আকুল হৃদয়ে গাইতে থাকা অজানা অচেনা গায়ক-গায়িকারাও সেই কথা বুঝিয়ে দিয়ে যান প্রতিদিন। তাঁদের বুকে যে প্রতি মুহূর্তে বয়ে যায় সুরের নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা!”
জম্মুর ছেলে কুন্দন লাল সায়গলও ছোটবেলায় নানা অনুষ্ঠানে গেয়ে বেড়াতেন। তারপর পেটের তাগিদে হলেন রেলের টাইমকিপার, রেমিংটন টাইপ রাইটার কোম্পানির সেলসম্যান। লাহোরের আনারকলি বাজারে তাঁর মেন্টর মেহরচাঁদ জৈনের সঙ্গে আলাপের পর চলে এলেন কলকাতায়। সেখানেও অনেক মেহফিল এ মুশায়েরায় গাইতে লাগলেন। তার ফাঁকে হোটেল ম্যানেজারের চাকরি। তবু বুকের ভিতরে সেই প্রদীপটা জ্বলে ছিল সারাক্ষণ— গায়ক হতেই হবে। (Street Performance)
পথে-ঘাটে গান গাওয়ার সোনালি অতীত সে সময় আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল ভারতীয় গানের দুই প্রজন্মকে।
সায়গলেরও সাম্রাজ্যের বহু আগে ১৮৬২ সালে বিখ্যাত ফরাসি চিত্রশিল্পী এদুয়াদ মানে একটি ছবি এঁকেছিলেন। নাম ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’। একদিন মানে এবং ফরাসি সাংবাদিক আন্তোনা প্রাউস্ত হেঁটে যাচ্ছিলেন শিল্পীর স্টুডিওতে। এক ক্যাবারে হাউসের সামনে মানে হঠাৎ দেখেন এক অপূর্ব সুন্দরী গিটার হাতে বেরিয়ে আসছেন। তাঁর অন্য হাতে চেরি। বোঝাই যাচ্ছে, গান শেষ করে ফিরে যাচ্ছেন বাড়ি। মানে তাঁকে প্রস্তাব দেন, এই ছবিরউ মডেল হতে। তরুণী একটু হেসে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে চলে যান। মানে শেষ পর্যন্ত ছবির কাজটি শেষ করেন তাঁর পরিচিত মডেল ভিক্তোরিনকে দিয়ে। কল্পনা থেকে বাস্তব হয়ে ওঠেন সেই গায়িকা। (Street Performance)

সেই তরুণী গায়িকা পথেই হারিয়ে গিয়েছেন। বিশ্বখ্যাত হয়ে গিয়েছে ভিক্তোরিনের আদলে তৈরি সেই ছবিটি।
গানও সেই ছবির মতো হয়ে যায় বারবার। গান শুধু চিরকাল থাকে। আগেই একবার লিখেছি, তবু আবার লিখি— গান কোথাও কাউকে অমর করে তুলে দেয় পাহাড়ের একেবারে মাথায়। কাউকে আবার সাগরের ঢেউয়ে অজানা দেশে ভাসিয়ে দিয়ে চলে যায়। উত্তর কলকাতার কুমার শানু এবং দক্ষিণ কলকাতার গৌতম ঘোষ যখন মহানগরে কিশোরকুমারের গান করে বেড়াচ্ছেন, তখন অধিকাংশ লোকে বলতেন, গৌতমের গলাতেই ভালো ফুটে ওঠে চিরকিশোর। বাস্তবে শানু হয়ে উঠলেন দেশের এক নম্বর, কোথায় হারিয়ে গেলেন সুভদ্র, সুকণ্ঠ গৌতম! (Street Performance)
আরও পড়ুন: ম্যান ইটার্স অফ সাভো থেকে প্যালেস্তাইন ক্যাম্পেন
গান কোনও নির্দিষ্ট অঙ্ক মেনে জনপ্রিয়তা দেয় না গাইয়েদের, সর্বত্র গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ভাগ্যও। তবে গান পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত সম্মোহিত শক্তি হয়ে জেগে থাকে। বারবার ডাকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, পাহাড়ি পথের মেঘ ও পাইন বনের মতো। নিশির ডাকের মতো। সেই ডাক থেকে মুক্তি নেই কারও। সে ডাক ভুলিয়ে দেয় বিষাদ, অবসাদের যাত্রাপথ। (Street Performance)
পথের কোণে বসে থাকা, রেলগাড়ি বা বাসস্ট্যান্ডে আকুল হৃদয়ে গাইতে থাকা অজানা অচেনা গায়ক-গায়িকারাও সেই কথা বুঝিয়ে দিয়ে যান প্রতিদিন। তাঁদের বুকে যে প্রতি মুহূর্তে বয়ে যায় সুরের নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা! (Street Performance)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
বিশিষ্ট সাংবাদিক। এই সময় সংবাদপত্রের প্রাক্তন সম্পাদক ও ক্রীড়া সম্পাদক। উত্তরবঙ্গ সংবাদের প্রাক্তন কার্যনির্বাহী সম্পাদক। আনন্দবাজার পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে কভার করেছেন একাধিক বিশ্বকাপ ফুটবল ও অলিম্পিক গেমস। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, খেলা, গান, সিনেমা, ভ্রমণ, খাবারদাবার, মুক্তগদ্য— বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখতে ভালবাসেন।