(P C Sorcar)
জাদুসম্রাট পি সি সরকার তাঁর জীবদ্দশাতেই ছিলেন কিংবদন্তী। যদিও বিখ্যাত বাবার সন্তান হয়েও তাঁর ছেলেমেয়েরা ছোট থেকেই বড় হয়েছেন সাধারণের মধ্যে মিলেমিশে। ১৯৪৬ সালের ৩১ শে জুলাই বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের আশেকপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন প্রতুল চন্দ্র সরকারের মধ্যম পুত্র প্রদীপ চন্দ্র সরকার। তবে তাঁর বড় হয়ে ওঠা পশ্চিমবাংলার কলকাতা শহরে। পাড়ার সত্যভামা ইন্সটিটিউট, আশুতোষ কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষে করেন সম্মানের সাথে। (P C Sorcar)
আরও পড়ুন: সংগ্রাহক শিরোমণি পরিমল রায়
শৈশব থেকেই জাদুবিদ্যার ওপর ভীষণ ঝোঁক ছিল প্রদীপ চন্দ্র সরকারের। ১৯৬৪ সালে বাবা প্রতুল চন্দ্র সরকারের সঙ্গে প্রথম জাপান যাত্রায় গিয়ে, সাধ্যমতো নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ করে নিয়ে দেশে ফেরেন। বাবা বেঁচে থাকাকালীন, নিজে এককভাবে জাদু প্রদর্শন করেছেন অত্যন্ত সফলতার সাথেই। ১৯৭১ সালের শুরুতেই জাপানে বাবা জাদুসম্রাট, পি সি সরকারের প্রয়াণের পর পি সি সরকার জুনিয়র হিসাবে সকলের সামনে হাজির হয়েছিলেন তিনি। দিনের পর দিন জাদুবিদ্যা মঞ্চস্থ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন- বিশ্বের অগণিত দর্শককে। (P C Sorcar)

তাঁর এই কর্ম ব্যাস্ত জীবনের এক অনালোকিত দিক তাঁর শখের সংগ্রাহক জীবন। যদিও শৌখিন মানুষ হিসাবে তাঁকে দেখাও চমকপ্রদ বিষয়। সংগ্রাহক পি সি সরকার জুনিয়র যে বিশ্বের প্রথম সারির একজন শখের সংগ্রাহক তা তাঁর সংগ্রহের দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায়। “কোন বস্তু কি পেলাম, তার থেকেও বড় কথা আমার মনের আনন্দে এক অনাবিল খুশির জন্যই আমার এসব সংগ্রহ।” –এমন কথা তিনি খুব স্পষ্টভাবেই জানান। তাঁর সংগ্রহের ভাবনা পারিপার্শ্বিক অন্যান্যদের কে যে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলেছে, তার প্রতিফলন তো প্রতিনিয়তই চোখে পড়ে। (P C Sorcar)

এ প্রসঙ্গে বলতেই হয় শ্রী সরকারের পুতুল সংগ্রহ বা স্মারক সংগ্রহ তাঁর স্ত্রী জয়শ্রী সরকারের মধ্যেই এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে যে সংগ্রহগুলির গুরুত্ব কোনও একক মাপকাঠিতে আর সীমাবদ্ধ নেই। আবার কথা প্রসঙ্গে জানা যায় যে কোনও এক সময়ে ভারতের হায়দ্রাবাদ রাজ্যে জাদু প্রদর্শনের সময়ে তিনি যে নিজামের মুদ্রা সংগ্রহ করেন– তাতে তাঁর ও তাঁর সহকারি বাবুলাল ওরফে বাবর আলির রাতের ঘুম ছুটে যায়। সংগ্রাহক হিসাবে তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি– “কোনও নির্দিষ্ট সংগ্রহবস্তু স্পর্শের মাধ্যমে সে বস্তুর উৎসে পৌঁছে যাওয়ার যে ভাবনা তার মধ্যে কাজ করে তাতে এ বিশ্ব ভীষণ ক্ষুদ্র অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ।” একজন শখের সংগ্রাহক হিসাবে তাঁর এই জীবন দর্শন বৃহত্তর গবেষণার প্রেক্ষাপট। (P C Sorcar)
আরও পড়ুন: বিশ্বনাগরিক চার্লি চ্যাপলিন
বাবা প্রতুল চন্দ্র সরকারের কলম সংগ্রহ ছোটবেলায় তাঁকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে আজও তিনি কথায় কথায় বলেন– “অহঃমিদ্ধি পিতুস্পরি মেধা মৃতস্যঃ জগ্যভঃ” অর্থাৎ “আমি যা শিখেছি- আমার বাবার কাছে শিখেছি।” একেবারে যুবক বয়সের তাঁর মুদ্রা সংগ্রহের শখ আজ বেশ কিছুটা পিছনের সারিতে পড়ে গেছে তাঁর অন্যান্য সংগ্রহের গুরুত্বে। প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন যুগের রাজা-মহারাজাদের মুদ্রা, মুঘল বাদশাহদের প্রচলিত মুদ্রা, পরাধীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজাদের মুদ্রা, ব্রিটিশ শাসনকালের মুদ্রার চোখধাঁধানো সংগ্রহ আছে ওঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে। (P C Sorcar)

একটা সময়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দেওয়া রাজকুমারের রূপকথার গল্প থেকে প্রভাবিত হয়ে সেসবের ‘জল সংগ্রহ’ নেশা তাঁর মাথায় চেপে বসে। সেই থেকেই পৃথিবীর প্রায় সমস্ত নদ নদী, সমুদ্র, মহাসমুদ্র, হ্রদের জল তাঁর সংগ্রহে আজ বিশ্ব দর্শন নিশ্চিত হবেই। এই জলের সংগ্রহের সাথেই পৃথিবীর প্রায় সমস্ত মরুভূমি ও সমুদ্রোপকূলের বালির সংগ্রহও তাঁর কাছে আছে। সাহারা মরুভূমির তিন ধরণের বালির সংগ্রহ এপ্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৯৬০ সালের আশেপাশে সময়ে তাঁর অটোগ্রাফ সংগ্রহের বাতিক সাংঘাতিকভাবে বেড়ে ওঠে। তবে তাঁর অটোগ্রাফ সংগ্রহের পন্থা বেশ অনন্যতার দাবীদার। (P C Sorcar)

দৈর্ঘ-প্রস্থে দেড় ফুট মাপের কাঠের ট্রেতে এক ইঞ্চি পুরু সিমেন্ট ও প্লাস্টার অফ প্যারিস জমিয়ে অটোগ্রাফ সংগ্রহ করতেন বিশিষ্টজনেদের থেকে। তৎকালীন সময়ে সত্যজিৎ রায়, তাঁর এই সংগ্রহ দেখে বেশ আনন্দ পেয়েছিলেন। আবার জননেতা জ্যোতি বসু ঐরকম ট্রেতে সিমেন্টের ওপর একাধিকবার অটোগ্রাফ দেওয়ার চেষ্টা করেন তারপর সফল হন- কারণ শ্রী বসু এত ছোট ছোট অক্ষরে ঐ ট্রেতে অটোগ্রাফ করছিলেন যে অটোগ্রাফ শেষ হতে না হতেই তা পুরো জমে সমান হয়ে যাচ্ছিল- তাই অনেক চেষ্টার পর প্রদীপ সরকার নিজেই যখন শ্রী বসুকে অনেক বড় বড় অক্ষরে অটোগ্রাফ দিতে বলেন তখনই তা সফলতা পায়। (P C Sorcar)
এমন ধরণের শতাধিক বিশিষ্ট জনেদের অটোগ্রাফ তাঁর সংগ্রহে বর্তমানে রয়েছে। অটোগ্রাফ সংগ্রহের এমন পদ্ধতির ভাবনা সত্যই প্রশংসনীয়। ১৯৮০ সালের সমসাময়িক সময়ে তিনি ফসিল সংগ্রহে আগ্রহী হয়ে পড়লেন। তিনি প্রায় দুই শতাধিক ফসিল, নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করে ফেললেন। সামুদ্রিক প্রাণী, গাছ, অন্যান্য প্রাণীজ ফসিলের সাথেসাথে তাঁর ফসিল সংগ্রহের মধ্যে লম্বা ফার্ন পাতার ফসিল বা জাপানের ফুজিয়ামা থেকে পাওয়া আঁশ সহ মাছের ফসিল বেশ চমকপ্রদ। (P C Sorcar)

তবে এসব সংগ্রহের মাঝেও শেষ প্রায় বিশ বছর ধরে এক আজব সংগ্রহে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন তা হল ‘ইট’ সংগ্রহ। বিবিধ ভাষা, আকৃতি ও অক্ষর খোদাই করা ইটেরও যে কত বিভিন্নতা আমাদের আশেপাশে ছড়িয়ে আছে সে সংগ্রহ এক নজরে না দেখলে বুঝে ওঠা মুশকিল। এযাবৎ তাঁর অর্ধসহস্রাধিক ইটের সংগ্রহ অতি যত্নে তিনি রেখে চলেছেন। সংগ্রাহক প্রদীপ সরকারের ঝুলিতে আরও যে এক বিশেষ সংগ্রহ আছে তা হল তাঁর ‘পোকা জমানোর সংগ্রহ’। (P C Sorcar)

অবশ্যই স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু হওয়া পোকার দেহ ফরমালিনের মধ্যে রেখে প্রায় এক হাজারের ও অধিক সংখ্যায় পোকা তিনি সংগ্রহ করেছেন- বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। এছাড়াও প্রাচীন পুঁথি, পাণ্ডুলিপি, বিবিধ রত্ন উপরত্নের বিস্তৃত সংগ্রহ তাঁর কাছে সংরক্ষিত হচ্ছে। পৃথিবীর ১১৭ টি দেশে যাওয়ার সুবাদে বিভিন্ন স্মারক সংগ্রহের এক সুউচ্চ সংগ্রহ তাঁর কাছে সংরক্ষিত হচ্ছে। নানা দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও বিশিষ্টজনেরা তাঁকে যে সব মহার্ঘ উপহার সামগ্রী প্রদান করেছেন সেসবের শোকেস ভরা সংগ্রহও অবাক হয়ে দেখার মতোই। শৌখিন এই শিল্পী মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ির বহর ছিল দেখার মতো। (P C Sorcar)

একটা লাল রঙের হুড ফেলা জিপগাড়িতে চড়ে যুবক বয়সে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন শহর কলকাতার ওপর। তারপর পরিবার অনেক বড় হলে, এম্পালা গাড়ি চড়তেন। তবে ওঁর প্রথম গাড়ি জোঙ্গা, তাঁর সবথেকে প্রিয় গাড়ি। তাঁর সংগ্রহের পোষ্য প্রাণীর তালিকাও দীর্ঘ। সম্রাট সিংহ, হাতি, ঘোড়া, কুকুর এমন বিবিধ প্রাণীকে নিজের পরিবারের একজন করে লালন পালন করেছেন তিনি। সকলের সাথেই এক আত্মিক বন্ধনে জড়িয়েছেন তিনি নিজেই। তাঁর শখের সংগ্রহের তালিকায় এরা প্রত্যেকেই সম্মানের সাথে সহাবস্থান করতেন প্রদীপ চন্দ্র সরকারের সাথেই। ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীদের ভাষা উপলব্ধি করে তাদের সাথে দিব্বি নিজের সময় কাটিয়েছেন, সময়ে সময়ে তাদেরকে নিয়ে মঞ্চে খেলাও দেখিয়েছেন। (P C Sorcar)
আরও পড়ুন: সিনেমা যখন মানুষতন্ত্রের আয়না
নিজের মানসিক চেতনাকে সজীব রাখার জন্য সংগ্রহ যে কী অসাধারণ এক মাধ্যম, তা পি সি সরকার জুনিয়রের মতো এমন ‘শখের মানুষ’ দেখলে শুধুই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে হয়। সংগ্রাহক পি সি সরকার জুনিয়রের সংগ্রহ ভাণ্ডারে যা বিস্তৃত সংগ্রহ সংরক্ষিত, তা দিয়ে আন্তর্জাতিক মানের যে কোনও সংগ্রহশালা সহজেই গড়ে তোলা যায়, নিদর্শন সংগ্রহ ও সংরক্ষণে সত্যই তাঁর স্বার্থকতা স্বীকার্য। তিনি শুধু একজন শখের সংগ্রাহক নন সাথে সাথে সেসব বস্তু সম্পর্কে যে মনোজ্ঞ বর্ণনা বলতে থাকেন তা মুগ্ধ হয়ে শোনার মতো। প্রতিটি বস্তুই তাঁর সংগ্রহে মনেহয় প্রতিনিয়ত জীবন্ত। তিনি নিজ গুনে অসাধারণ হয়েও, সাধারণের মধ্যে মিশে গিয়ে যেসব সংগ্রহ করেছেন তা প্রশংসার থেকেও বেশি কিছু। আজ আশি বছরের জন্মদিন ছুঁয়েও প্রতিনিয়ত পরম যত্নে লালনপালন করে চলেছেন নিজের শখের সংগ্রহকে। (P C Sorcar)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
ছবি সৌজন্য- লেখক
সংগ্ৰাহক ও সুন্দরবন বিষয়ক গবেষক,
ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।