(Uttam Kumar)
“আচ্ছা ছবিটার মধ্যে আছে টা কি– এক তুই ছাড়া?”
“আমি তো আছি, ইজিন্ট নট এনাফ?”
এই সংলাপ “নায়ক” ছবিতে, রূপালি পর্দার ম্যাটিনি আইডল অরিন্দম মুখার্জির, যিনি নিজের অভিনয় দক্ষতায় একাই পার করে দিতে পারেন যে কোনও সিনেমার বৈতরণী। কোথাও যেন এই আত্মবিশ্বাস মিলিয়ে দেয় নায়ক আর মানুষ উত্তমকুমারকে, যিনি সেলুলয়েডের ঘেরাটোপের বাইরে এসে সংগোপনে বাসা বেঁধেছেন বাঙালির হৃদয় মন জুড়ে এক চির সজীবতার আইকন হয়ে। (Uttam Kumar)
আরও পড়ুন: আসলেই শোলে: ঘটনার ঘনঘটা
৩রা সেপ্টেম্বর, ১৯২৬-এ জন্ম উত্তমকুমারের অর্থাৎ আগামী বছর তাঁর জন্মশতবার্ষিকী। শহর কলকাতার সংগ্রাহকের দল “কলকাতা কথকতা” তাই এ বছরে, তাঁর জন্মদিনেই সূচনা করলেন প্রাক শত বর্ষের উদযাপন। (Uttam Kumar)
১৯৪৮ থেকে শুরু করে আশির দশকের শেষ অবধি, মহানায়কের সুদীর্ঘ পথ চলার যে বর্ণময় ইতিহাস এবং ধারাবাহিকতা তাঁকে কেন্দ্র করে এক ভিন্নধর্মী প্রদর্শনী “শুধুই উত্তম” শুরু হল কলকাতার “নেহরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম”-এর যৌথ উদ্যোগে। (Uttam Kumar)

আসলে উত্তমকুমার নামে বাঙালি এতটাই মোহিত হয়ে ওঠে যে তাঁর অভিনয়, সংলাপ, ম্যানারিসম এবং সবার উপরে তাঁর সিনেমাটিক ক্যারিসমার এই ধারাবাহিকতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হয়েছে ফল্গুধারার মতো যার প্রভাব অনেক গভীরে। বাঙালি পরিবারের সঙ্গে তাঁর অভিনিত চরিত্ররা যেন বাঁধা পড়েছে স্বজন, সুজনের বাঁধনে– মনে হয়েছে হ্যাঁ, এ তো আমার দেখা, চেনা, জানা সেই মানুষটি। সুপুরুষ হিসেবে কেড়েছেন বহু নারীহৃদয়, সাদা-কালো ছবির ক্যানভাসে এঁকে দিয়েছেন বর্ণিল প্রেমকে যা কখনও সংলাপের, কখনও বা সঙ্গীতের অনুরণনে আজও তৈরি করে নস্টালজিয়া।

উত্তকুমারের মৃত্যুর পরে, দুই কুড়ি বছর পেরিয়েও স্মৃতি এবং আবেগ তাড়িত হই আমরা। আর “শুধুই উত্তম” যেন সেই স্মৃতিপথে হাত ধরে নিয়ে যায় আমাদের। প্রদর্শনীতে সংগ্রাহকদের সংগ্রহ থেকে উত্তমকুমার অভিনীত হিন্দি ও বাংলা ছবি মিলিয়ে প্রায় ২০০টি চলচিত্রের বুকলেট স্থান পেয়েছে। শোনা যায়, একটা সময়ে মহিলা মহলে সমাদৃত ছিল তাঁর এই ছবির বুকলেট। এছাড়াও আছে ছোট-বড় রঙিন পোস্টার, উত্তম অভিনীত পঞ্চাশটি বাংলা ছবি এবং তিনটি হিন্দি ছবির। (Uttam Kumar)
“সিনেমা জগতে এর সাবেকি পরিচয় “লবি কার্ড” হিসেবে। সাদা–কালো এবং রঙিন প্রচুর লবি কার্ড শোভা পাচ্ছে প্রদর্শনী কক্ষের দেওয়াল জুড়ে। রয়েছে খবরে কাগজে প্রকাশিত উত্তম-অভিনীত সিনেমার বিজ্ঞাপন, তাঁর ছবি যেখানে মুক্তি পেয়েছে সেইসব সিনেমা হলের টিকিট।”
যেদিকে তাকানো যায় সেগুলো মনে করিয়ে দেয় তাঁর বিখ্যাত ছবিগুলো– “রাইকমল“, “সন্ন্যাসী রাজা“, “সাহেব বিবি গোলাম“, “চিড়িয়াখানা”, “অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি”, “ইন্দ্রাণী“, “অমানুষ”, “সপ্তপদী”, “সাগরিকা”, ”মরুতীর্থ হিংলাজ”, “ওগো বধু সুন্দরী”, “মায়ামৃগ”, “ঝিন্দের বন্দি”, “চৌরঙ্গী” বা হিন্দিভাষিক ছবি “আনন্দ আশ্রম“, “দেশপ্রেমী“, “দুঁরিয়া” প্রভৃতি। একসময় সিনেমা হলে টিকেট কাউন্টারের আশেপাশে দর্শকদের আকৃষ্ট করবার জন্য, শোভা পেত যে ছবি চলছে তার নানা দৃশ্যের ফটোগ্রাফ। (Uttam Kumar)

সিনেমা জগতে এর সাবেকি পরিচয় “লবি কার্ড” হিসেবে। সাদা–কালো এবং রঙিন প্রচুর লবি কার্ড শোভা পাচ্ছে প্রদর্শনী কক্ষের দেওয়াল জুড়ে। রয়েছে খবরে কাগজে প্রকাশিত উত্তম-অভিনীত সিনেমার বিজ্ঞাপন, তাঁর ছবি যেখানে মুক্তি পেয়েছে সেইসব সিনেমা হলের টিকিট। বহু পুরনো ফিল্ম ফেয়ার, প্রসাদ, উল্টোরথ, নবকল্লোল, পরিবর্তন, আনন্দলোক, দেশ এবং অন্যান্য ম্যাগাজিন যার প্রচ্ছদ জুড়ে তাঁর ছবি বা তাঁকে নিয়ে মলাট কাহিনি। এর মধ্যে দেখা গেল অভিনেতার মৃত্যু পরবর্তীকালে “শিল্পী সংসদ“ থেকে প্রকাশিত তাঁকে নিয়ে স্মারক পত্রিকাটিও। (Uttam Kumar)

বাঙলা ছায়াছবির গানের স্বর্ণযুগে একটা বড় অংশ অবশ্যই উত্তমকুমার অভিনীত ছবির গান। পর্দার নেপথ্যে গীতিকার, সুরকার এবং কণ্ঠ শিল্পীর ত্র্যহস্পর্শে তৈরি হত যে সঙ্গীত, পর্দায় তাঁর ঠোঁট সঞ্চালনে এবং অভিব্যক্তিতে তা যোগ করত এক নতুন মাত্রা। সেইসব গান পরবর্তীকালে গ্রামোফোনের কালো ডিস্কে পৌঁছে যেত আপামর জনসাধারণের কাছে। “শুধুই উত্তম” প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে এরকমই প্রচূর এল পি, ই পি রেকর্ডের জ্যাকেট, ক্যাসেট। (Uttam Kumar)
“এক কথায় মহানায়কের পেশাদার এবং ব্যক্তিগত জীবনের বিশাল কর্মকাণ্ডের সাগর থেকে সন্ধান করে অমৃত তুলে আনতে পেরেছেন “কলকাতা কথকতা”-র সংগ্রাহকেরা।”
“শ্যামলী“ নাটকে দীর্ঘদিন অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমার। এই নাটকের দুস্প্রাপ্য পুস্তিকা, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সেই নাটকের সমালোচনা এবং মায়ামৃগ ছবির চিত্রনাট্য দেখা গেল প্রদর্শনীতে। এছাড়াও আকর্ষণীয় উপাদান হিসেবে রয়েছে উত্তম কুমারের লেখা কিছু ব্যক্তিগত চিঠিপত্র, তাঁর জন্ম জন্ম কুণ্ডলী, সুপ্রিয়াদেবীর কন্যা সোমার বিবাহের নিমন্ত্রণপত্র, উত্তমকুমারের নাগরিক সম্বর্ধনার আমন্ত্রণপত্র, তাঁর প্রযোজনা সংস্থার শেয়ার সার্টিফিকেট এবং ১৯৭৬ সালে “ওয়েস্ট বেঙ্গল প্যারাসাইকলজি সোসাইটির“ যে সদস্যপদ তিনি গ্রহণ করেছিলেন, সেই সংক্রান্ত নথি। (Uttam Kumar)
সত্যজিৎ রায়ের দুটি ছবি – “নায়ক” এবং “চিড়িয়াখানা”–এ অভিনয় করেছিলেন উত্তম। স্মারক হিসেবে স্থান পেয়েছে “নায়ক”-এ ব্যবহৃত স্যুট ও টাই এবং “চিড়িয়াখানা”–র সেই কালো ডায়ালের টেলিফোন। (Uttam Kumar)

এক কথায় মহানায়কের পেশাদার এবং ব্যক্তিগত জীবনের বিশাল কর্মকাণ্ডের সাগর থেকে সন্ধান করে অমৃত তুলে আনতে পেরেছেন “কলকাতা কথকতা”-র সংগ্রাহকেরা। একটা সামগ্রিক অধ্যবসায় বা টিম ওয়ার্ক ছাড়া যা বাস্তবায়িত হওয়া অসম্ভব। এর মধ্যমণি অবশ্যই চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় যিনি প্রায় এক দশক ধরে লালন করে আসছেন এই দলটিকে। তাঁর সঙ্গে সঙ্গদান করেছেন ফাল্গুনী দত্ত রায়, উজ্জ্বল সর্দার, অরিন্দম রাউত, জয়ন্ত ঘোষ, মলয় সরকার, শৌভিক মুখার্জি, শীর্ষেন্দু মুখার্জি, জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য প্রমুখ সংগ্রাহকেরা তাঁদের ঈর্ষণীয় সংগ্রহ প্রদর্শনীর পরিধিতে নিয়ে এসে। (Uttam Kumar)

বর্ষণ ভারাক্রান্ত বিকেলে ভারী আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি প্রথিতযশা অভিনেতা তথা “কলকাতা কথকতা”–র সভাপতি চিরঞ্জিত চক্রবর্তীর পৌরোহিত্যে। মঞ্চে তখন উপবিষ্ট প্রবীণ অভিনেত্রি সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সুরকার কল্যাণ সেন বরাট, অভিনেত্রি চৈতি ঘোষাল, পৌলমী চট্টোপাধ্যায়, বিধায়ক দেবাশিস কুমার, শিক্ষাবিদ মানসী রায় চৌধুরী, বাচিক শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, উত্তমকুমারের পুত্রবধূ মহুয়া চট্টোপাধ্যায়, অভিনেতা অভিজিৎ গুহ প্রমুখ। সঞ্চালক হিসেবে চন্দ্রনাথ প্রত্যেক অতিথির সামনেই রাখলেন দুটি প্রশ্ন- “এতদিন পরেও কেন উত্তমকুমার” এবং “উত্তমকুমার অভিনীত প্রিয় ছবি কোনটি”। (Uttam Kumar)
“পৌলমী শোনালেন উত্তমকুমারের প্রতি তাঁর বাবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার ছোট্ট কাহিনি। মহুয়া চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণে উঠে এল তাঁর শ্বশুরমশাই “বাবি”-র কথা।”
উত্তমকুমার কেন আজও এতটাই জনপ্রিয় এই সম্পর্কে বলতে গিয়ে উপস্থিত গুণীজনেরা জানালেন ব্যক্তি উত্তমকুমারের জীবনের নানা অজানা তথ্য। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় সাদা-সিধে ভাষায় বর্ণনা করলেন শুটিং-এর সময় “উত্তমবাবু“-র সঙ্গে তাঁর রসায়ন। চোখের সামনে এক লহমায় যেন দেখা গেল স্টুডিও ফ্লোরের আলো আঁধারি পেরিয়ে ক্যামেরার সামনে দুটি মানুষকে যাঁদের অভিনয়ের ফসল গলি থেকে রাজপথ, সেই চোখ, কুহক, রাজা সাজা, দুই ভাই, ধন্যি মেয়ে, মৌচাক– এমন সব ছবি যা আজও আমাদের মনকে নাড়া দিয়ে যায়। (Uttam Kumar)
পৌলমী শোনালেন উত্তমকুমারের প্রতি তাঁর বাবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার ছোট্ট কাহিনি। মহুয়া চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণে উঠে এল তাঁর শ্বশুরমশাই “বাবি”-র কথা। ‘যদুবংশ’, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘স্ত্রী’, ‘অগ্নিশ্বর’, ‘রাইকমল’, ‘বাঘবন্দি খেলা’, ‘অমানুষ’, ‘মন নিয়ে’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘নায়ক’, ‘সপ্তপদী’ এবং আরও আরও নানা সিনেমার নাম উঠে এল অতিথিদের মুখে মুখে। (Uttam Kumar)

অনুষ্ঠানের প্রান্তিকভাগে বাচিক শিল্পী সতীনাথের মুখে শোনা গেল মহানায়কের প্রয়াণের দিনে লেখা বীরভূমের কবি বিজয় কুমার দাসের কবিতা–
‘সাজ ঘরে আজ রাজা তো নেই
মুকুটখানি ফেলে সেই যে গেছেন চলে
ফেরেননি আর কারো ডাকে…
ছায়া ছবির মানুষ বলে সবাই করে ভুল
তবুও তিনি ফুল ফুটিয়ে গেলেন, রাজার মত চলে
কেউ ভোলেনি, কেউ কখনো ভোলে?’ (Uttam Kumar)
এই কয়েকটি পঙক্তি বুঝিয়ে দিল উত্তমকুমার দর্শকের স্মৃতির মণিকোঠায় আছেন এবং থাকবেন, শুধুই “উত্তম” হয়ে!
প্রদর্শনী চলবে আগামী ৭ ই সেপ্টেম্বর ২০২৫ অবধি। নির্ধারিত সময় দুপুর তিনটে থেকে রাত আটটা। শেষদিনে থাকবে উত্তমকুমারকে কেন্দ্র করে এক আকর্ষণীয় প্রশ্নোত্তরের আসর, জানালেন “কলকাতা কথকতা”–র সম্পাদক চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। (Uttam Kumar)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
ছবি সৌজন্য- শ্রেয়সী লাহিড়ী
সপ্তর্ষি রায় বর্ধনের জন্ম, কর্ম এবং বর্তমান ঠাঁই তার প্রাণের শহর কলকাতায়। প্রথাগত ছাত্রজীবন কেটেছে কলকাতার পাঠভবন স্কুল, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে। লেখাজোকা, ছবি তোলা, নাট্যাভিনয় আর হেরিটেজের সুলুক সন্ধানের নেশায় মশগুল। সঙ্গে বই পড়া, গান বাজনা শোনা আর আকাশ পাতাল ভাবনার অদম্য বাসনা। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন- "রূপকথার মতো- স্মৃতিকথায় প্রণতি রায়", "খেয়ালের খেরোখাতা" এবং "চব্য চোষ্য লেহ্য পেয়"।