(Dwijen Mukhopadhyay)
তাঁর সংগীতজীবনের প্রথম যুগে পুজোর সময়, গ্রামাফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম রেকর্ডটি, তার এক পিঠে একটি গান ছিল, ‘জীবন নদীর দুই তীরে জাগে বিরহ মিলনও স্মৃতি’। গানটির গীতিকার আমার মাতামহ অমিয় বাগচী। (Dwijen Mukhopadhyay)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: নিমাইসাধন বসু
গানে সুরারোপ করেছিলেন সুধীরলাল চক্রবর্তী। প্রথম পরিচয় হওয়ার পরে দ্বিজেনদা আমার থেকে এই কথাটা জেনে বেশ খুশি হন। বলেন, ‘অতীতের অনেক পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল!’ আমার দুই পিসি দক্ষিণ কলকাতার ‘বাণিচক্র’ সংগীত শিক্ষায়তনে দ্বিজেনদার কাছে গান শিখত। ওঁর সঙ্গে প্রথম আলাপ হয় শান্তিনিকেতনের বাড়িতে। আমার আর এক কাকা অমরেশ মৈত্র, দ্বিজেনদার অনেকদিনের ছাত্র। কৈশোরে রেডিওতে দ্বিজেনদার গান শুনলে আমি ভাবতাম হেমন্তদাদু গাইছেন, বড়দের সামনে কথাটা বললে তাঁরা আমার ভুল শুধরে দিতেন। (Dwijen Mukhopadhyay)

দ্বিজেনদার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়, শ্যামপুকুর স্ট্রিটের বাড়িতে একটি সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে। তারপর থেকে মাঝে মাধ্যেই যোগাযোগ হত। দেশপ্রিয় পার্কের, ‘বাণীচক্র’ সঙ্গীত শিক্ষায়তনে, প্রতি মঙ্গলবার গান শেখাতে আসতেন। এক-একদিন ওখানে গিয়ে দেখা করতাম। দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ে, ‘টিউলিপ’ নামে একটা ফটোগ্রাফি স্টুডিও ছিল। ওই স্টুডিওর কর্ণধার দিলীপ সেন ছিলেন আমার বাবার ঘনিষ্ট। মাঝে-মধ্যে বিকেলে ওঁর ষ্টুডিওতে গিয়ে গল্প করতাম, তখন বাণিচক্র থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে দ্বিজেনদা সেখানে আসতেন। (Dwijen Mukhopadhyay)

একবার নন্দনে একটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে গাড়িতে শুধু দ্বিজেনদা আর আমি ছিলাম। অনেক বিষয়ে নিয়ে কথা বলতে বলতে চলেছি, হঠাৎ দ্বিজেনদা আমায় জিজ্ঞাসা করলেন বর্তমান সময় রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কীরকম বুঝছ? ততদিনে রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে আর সেই সঙ্গে দ্বিজেনদাও ওধার থেকে এধারে চলে এসেছেন! আমি কোনওরকম রাখঢাক না করে সরাসরি বলেই দিয়েছিলাম পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে বিশেষ করে বঙ্গীয় রাজনীতিতে এত কুকথার প্রচলন আগে হয়নি। (Dwijen Mukhopadhyay)
ওঁর বিধাননগরের বাড়িতে বসে একদিন অনেক গল্প হয়েছিল, সেইদিন ওঁর কাছে আকাশবানীর পুরোনো অফিস গার্সটিন প্লেসের ভূতের গল্প শুনেছিলাম।
বেশ গম্ভীর মুখে দ্বিজেনদা সেকথা স্বীকার করেছিলেন, তার আরও একটা কারণ ছিল, যেদিন আমাদের এই সব কথা হচ্ছিল, তার মাত্র কয়েকদিন আগে প্রয়াত তাপস পাল এক প্রকাশ্য রাজনৈতিক সভায় বিরোধী দলের নেতাদের উদ্দেশ্যে একাধিক অশালীন মন্তব্য করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গ তুলে দ্বিজেনদা নিজেই নিন্দা করেছিলেন। ওঁর বিধাননগরের বাড়িতে বসে একদিন অনেক গল্প হয়েছিল, সেইদিন ওঁর কাছে আকাশবানীর পুরোনো অফিস গার্সটিন প্লেসের ভূতের গল্প শুনেছিলাম। (Dwijen Mukhopadhyay)

বলেছিলেন, ‘সন্ধের পরে একটা অনুষ্ঠান করতে গিয়ে ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন! ওইদিন আর অনুষ্ঠান করা হয়নি। একবার কবিপক্ষে নন্দনে, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ছবির পূর্তি উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে দ্বিজেনদা আমার সঙ্গে গিয়েছিলেন। যাওয়ার পথে জিজ্ঞেস করলেন ‘সে কি অনুষ্ঠানে আসবে?’ সে মানে সৌমিত্রকাকু। আসলে তার কিছুদিন আগে সৌমিত্রকাকু বহুল প্রচারিত এক বিখ্যাত পত্রিকায় এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে দ্বিজেনদার বিরুদ্ধে কিছু কথা বলেছিলেন গোপন না করেই। (Dwijen Mukhopadhyay)

তাই ওই প্রশ্ন। অনুষ্ঠান শেষে আমাকে নিয়ে রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গনে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত অনুষ্ঠানে গেলেন গান শুনতে। আমি একবার সরাসরি দ্বিজেনদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনার সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্ক কেমন ছিল?’ উনি কিন্তু ভাল কথাই বলেছিলেন। আমায় বললেন, ‘ওই কণ্ঠের কি কোনও তুলনা হয়!’ মনে আছে একবার রবীন্দ্রসদনে আয়োজিত, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন’-এ দুজন শিল্পীই এসেছেন। হঠাৎ হেমন্তদাদু দ্বিজেনদাকে বললেন, ‘দ্বিজেনবাবু আপনার কাছে সিগারেট আছে?’ সঙ্গে সঙ্গে দ্বিজেনদা পকেট থেকে ৫৫৫ ব্রান্ডের সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিলেন। (Dwijen Mukhopadhyay)
মহালয়ার পরিবর্তিত অনুষ্ঠান সম্পর্কে বিভিন্ন চ্যানেলে দ্বিজেনদার বক্তব্যকে সমর্থন করতে পারিনি কারণ তাতে একটা দোষারোপের ইঙ্গিত ছিল আর সেটা ছিল অনুষ্ঠানের আয়োজকদের বিরুদ্ধে কিন্তু আমি আগের একটা লেখায় বলেছি যে পুরোনো অনুষ্ঠানের জায়গায় নতুন কিছু করার উদ্যোগটা ছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের আর দ্বিজেনদা নিজেও তো সেই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন! যেহেতু কেউই আজ আর নেই তাই বিতর্ক বাড়িয়ে লাভ নেই। (Dwijen Mukhopadhyay)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: অলোক আলপনায়
বর্তমান প্রজন্ম দ্বিজেনদাকে হয়তো শুধুমাত্র রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হিসেবেই জানেন, কিন্তু তাঁর ওই অসাধারণ কণ্ঠে পরিবেশিত অজস্র আধুনিক বাংলা গান শুনলে আজও মুগ্ধ হতে হয়। বিশেষ করে, ‘হাজার মনের ভিড়ে তোমার ঠিকানা আমি হারিয়ে ফেলেছি’, ‘একটি দুটি তারা করে উঠি উঠি’, ‘রেখো মা দাশেরে মনে’, ‘শ্যামল বরণী ওগো কন্যা’, ‘ক্লান্তি নামে গো’, ‘পল্লবীনি গো সঞ্চারিণী’, ‘ওগো সুন্দরী আজ অপুরুপো সাজে সাজো’, ‘একদিন ফিরে যাব চলে’ ইত্যাদি। (Dwijen Mukhopadhyay)
শীতের এক বিষণ্ণ অপরাহ্নকে দ্বিজেনদা বেছে নিয়েছিলেন, ফিরে যাওয়ার জন্য। একটাই সান্তনা, ওঁর গানগুলো আজও রয়ে গেছে… (Dwijen Mukhopadhyay)
ছবি সৌজন্য: লেখক
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।