(Durga Puja)
সন্ধ্যের আলো মুছতে মুছতে আকাশে হালকা নীল থেকে ছোটবেলার সুলেখা কালির ঘন নীল পোঁচ। হাইওয়ের সন্ধ্যের যানজট পেরিয়ে আমাদের গাড়ি চলেছে আমাদের বাড়ি থেকে, আমার রাজ্য ম্যাসাচুসেটসের অপর প্রান্তে বস্টন দুর্গাবাড়ির পুজোতে। এই পুজো একটু বিশেষ, কারণ সপ্তাহান্তে না হয়ে এ পুজো হয় বিধি-নির্ঘণ্ট মেনে। ছোট্ট নিঝুম একটি শহরে পৌঁছে, আধা ঘুমন্ত বাড়ি, মেপলের ছোট ছোট বন, ইতস্তত খোলা দোকান, টাউন সেন্টার পেরোতে পেরোতে দেখি এসে পৌঁছেছি এক ট্রেন স্টেশনে। সেখানেই গাড়ি পার্ক করতে হবে। (Durga Puja)
গাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখি, নিঝুম সেই রেল স্টেশনে কোথাও কেউ নেই, দূরে দূরে টিমটিমে আলো, আরও দূরে একা এক রক্তচোখ সিগন্যাল। পায়ে পায়ে পেরোনো সেই প্লাটফর্মের পাশে গাছে ভরা জমি… আধা ঠান্ডা, আধা উষ্ণ এক অচেনা হাওয়া গায়ে মাখতে মাখতে মনে হল এ কোথায় এলাম? এ তো যেন বিমল করের কোনও গল্প উপন্যাসে পড়া জায়গা… যেখানে কখনও যাইনি। (Durga Puja)
তার মধ্যে আরও আশ্চর্য একটা খুদে জ্বলজ্বলে চিহ্ন- সাদা বেড়ার গায়ে আটকানো ‘বস্টন দুর্গাবাড়ীর পুজো’, তীর চিহ্ন দিয়ে দিক নির্দেশ করা। একটু হাসি এল মুখে। টাইম ট্রাভেল করছি নাকি? বিহার বা বাংলার সেই নাম জানা বা না জানা জায়গা, যেখানে হেমন্তর শুকনো পাতা আর লাল মাটির গন্ধ মাখা, বন্ধুত্ব আর আন্তরিকতায় উষ্ণ, সহজ আয়োজনের পুজো হত- তরুণ মজুমদারের সিনেমার মতো। কে যেন শুনতে পেলো মনের কথা। তিরিশ বছরের প্রবাসী জীবনে, আমেরিকার দুর্গাপুজোয় মোটামুটি বাঁধাধরা নিয়মে পৌঁছেছি স্কুলের বা কলেজের দরজায়। কিন্তু একি? এ তো একটা সাদা তাঁবু… প্যান্ডেল প্যান্ডেল লাগছে। ভেতর থেকে মাইকে ঘোষণা, কথাবার্তা। (Durga Puja)

ঢুকে দেখি তখনই শুরু হচ্ছে ছোটদের নাটক- একদম রাজা, রাণী, রাজপুত্র, রাজকন্যা, ডাইনি, প্রাণভোমরা। ইতিউতি তাকিয়ে চেনা কিছু হাসিমুখ দেখতে দেখতে বসে পড়লাম প্রোগ্রাম দেখতে। এ বোধহয় আমার ম্যাজিক সন্ধ্যে। বাচ্চাদের ওই হৈ হৈ করে করা নাটক, বলে না দিলে বিশ্বাস করা যায় না বাংলার বাইরে কোথাও হচ্ছে। আনন্দ, বিস্ময়ে আমরা কর্তা গিন্নী তো গদগদ। প্রশ্ন হল কেন গদগদ? ব্যাপারটা হল এই সুদূর প্রবাসে সন্তান বড় করা মা-বাবারা জানেন বাচ্চাদের বাংলা শেখানো এবং বলানো কতটা চ্যালেঞ্জ, আর সেই চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে বাংলা বললেও সেটা শোনায় ওই আমাদের সময়ে সিনেমা বা ছোট পর্দার শ্বেতাঙ্গ অভিনেতাদের উচ্চারণের মতো- যেটা নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম। (Durga Puja)
“আবছা আলোর মধ্যে বাইরে কাঠের বেঞ্চে খাওয়া দাওয়া, হাসাহাসি আড্ডা; দৃষ্টি এগোলেই জমাট বাঁধা অন্ধকারে শিরশিরে হাওয়ায় দুলছে হেমন্তের পাতাঝরা অরণ্য। কী এক আরামদায়ক উষ্ণতা ঘিরে ফেলছে আস্তে আস্তে।”
যদিও তাতেই আমরা যারপরনাই খুশি থাকি, কিন্তু ওইদিন সহর্ষ বিস্ময়ে দেখি দুর্গাবাড়ির অনুষ্ঠানের ছোট থেকে বড় সব বাচ্চা অভিনেতা, তাদের বাংলা শুনলে কে বলবে আমরা বাংলার বাইরে! নাটক দেখছি আর বলছি… দেখেছ কী সুন্দর পরিষ্কার উচ্চারণ? আহা বেঁচে থাক ওদের মা বাবাদের এই প্রচেষ্টা। আমরা পারিনি কিন্তু ওরা পারছে। (Durga Puja)

নাটক শেষে একরাশ ভাল লাগা, আর খাই খাই মন নিয়ে তাঁবুর পেছন দিয়ে চললাম রোল ঘুগনি আর চায়ের সন্ধানে, শুনেছি ওগুলো পাওয়া যাচ্ছে-চায়ে গরম স্টলে। সেখানে যারা রান্না করছেন তারা দিনে ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর, বৈজ্ঞানিক ইত্যাদি- কিন্তু পুজোয়, বীর বিক্রমে দু’বেলা পাঁচশো মানুষের রান্না করছেন। পৌঁছতে না পৌঁছতে ঘুগনি, ঝালমুড়ি গরম চা হাতে পৌঁছে গেল তারপর এগ্ রোলের অপেক্ষা। আবছা আলোর মধ্যে বাইরে কাঠের বেঞ্চে খাওয়া দাওয়া, হাসাহাসি আড্ডা; দৃষ্টি এগোলেই জমাট বাঁধা অন্ধকারে শিরশিরে হাওয়ায় দুলছে হেমন্তের পাতাঝরা অরণ্য। কী এক আরামদায়ক উষ্ণতা ঘিরে ফেলছে আস্তে আস্তে। রাত বাড়ছে, হঠাৎ মনে পড়ল প্যান্ডেলের ভেতরে কী সুন্দর পটচিত্র দিয়ে সেজে উঠেছে চারদিক। শুনেছিলাম দুর্গাবাড়ির এবারকার থিম বাংলার পটচিত্র। (Durga Puja)
“একরাশ ভাললাগা নিয়ে প্যান্ডেলে হতে থাকা অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় প্রজন্মের গলায় অনুপম রায়ের গান শুনতে শুনতে বস্টন দুর্গাবাড়ির পুজো থেকে বেরিয়ে এলাম।”
জিজ্ঞাসা করি তো সেটা কী ব্যাপার! ফিরে এলাম পুজোর প্যান্ডেলে দেখলাম মায়ের মূর্তির পাশে, সারা দেওয়াল জুড়ে জ্জ্বল জ্জ্বল করছে বাংলার পটচিত্রের বড় বড় প্রিন্ট। আলাপ হল শিল্পীর ছোট বড় ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণ দম্পতির সঙ্গে। ওরা শোনালো কীভাবে সুদূর পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা গ্রামের পটচিত্র শিল্পী চন্দন চিত্রকরের ছবি পাড়ি দিল এত হাজার মাইল। একটি হস্ত শিল্পের মেলায় আঁকছিলেন ছবি এই শিল্পী দম্পতি। কিন্তু আরও যেটা বিস্ময় তা হল, শুধু ছবি আঁকেন না তার সাথে ওঁর স্ত্রী পুতুল চিত্রকর গান গেয়ে ছবির গল্পটাও বলেন। যেমন আবহমানকাল ধরে গ্রামের সাধারণ মেয়ে-বৌরা তাদের পুজো, উৎসবের গল্পের সাথে মিশিয়ে নিয়েছেন দেব দেবীদের। (Durga Puja)

তাদের সন্তানধারণ, প্রেম বিয়ে, অভিমান, রাগকে নিজেদের গল্পের মতো করে রচনা করেছেন এক মাটির কাছের লোকগাথা। এরাও তেমনি। আঁকেন আর গানে গানে গল্প বলেন। আঁকার রং নেন গাছ, মাটি, ফুল, ফল থেকে- কী উজ্জ্বল সেই রং, কী মৃদু চোখ জড়ানো সেই রং, কত স্তর তাতে। শিল্পীদের সাথে সেই আলাপে যুক্ত হল বস্টন দুর্গাবাড়ি সংস্থার আরও মানুষজন। ঠিক হল চন্দন আর পুতুল চিত্রকরের আঁকা ছবিতে সেজে উঠবে উৎসব। (Durga Puja)
আরও পড়ুন: মহিষাসুরমর্দিনী: বাংলার আগমনী-আলো
মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলাম এই মানুষগুলোকে যারা এই শিল্পীদের খুঁজে বের করেছে। ভরপুর পূজামণ্ডপে নিজেদের হাতের আঁকা ছবি, এত মানুষের কাছে তাদের সমাদর দেখতে পেলে কী আনন্দ হবে শিল্পীদের মনে। কী ভাল এই উদ্যোগ। একরাশ ভাললাগা নিয়ে প্যান্ডেলে হতে থাকা অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় প্রজন্মের গলায় অনুপম রায়ের গান শুনতে শুনতে বস্টন দুর্গাবাড়ির পুজো থেকে বেরিয়ে এলাম। বয়স বাড়ছে। আজকাল মনের ভেতর কেমন নিঝুম হেমন্ত- হারানোর কাল। তাই সেই ফেলে আসা সময়ের সহজ আন্তরিকতা ভরা পুজোর সন্ধ্যের নির্যাসটুকু পুরে নিলাম বুকের মধ্যে। একটা মৃদু আলোয় ভরা প্লাটফর্মে… তীরচিহ্নের সংকেতে আঁকা পথের শেষে, এক আশ্চর্য তাঁবু-প্যান্ডেল যেখানে পরিশ্রম আনন্দে ঝলমলে মুখ- দিদি, ভাই, বোন সম বন্ধুদের দেখতে পাওয়া যায়, আর সেখানে গেলে যেন ম্যাজিক হয়… হারানো সময়ে ফিরে যাওয়ার ম্যাজিক। (Durga Puja)
ছবি ঋণ: লেখক
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায় বস্টন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। মূলতঃ ছোট গল্প এবং আর্টিকেল লেখেন। ছোট গল্প সংকলন ক্যালাইডোস্কোপ এবং অপরাজিতা প্রকাশিত হয়েছে, কমলিনী,দেজ পাবলিকেশন থেকে।একটি ছোট গল্পের অনুবাদ শর্টলিস্টেড হয়েছে, ‘Armory Square Prize for women writers in South Asian literature’ এ। অনুদিত গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত Words Without Borders এর পাতায় ।আনন্দবাজারের বিদেশ পাতার নিয়মিত লেখেন তাছাড়া রোববার-সংবাদ প্রতিদিন, বাংলা লাইভ, গুরুচণ্ডালী এবং আরো কিছু ম্যাগাজিনে গল্প এবং ছোট বড় প্রবন্ধ নিয়মিত লেখেন।