(Bengali Novel)
মায়ের ফোন রাখার পর মোহনার মনটা একটু ঘেঁটে গেল। কী যে হয় তার মাঝে মাঝে! অযথা মাকে এতগুলো কথা শোনাবার কোনও দরকার ছিল না। এখন সে নিজেও বোঝে চব্বিশ ঘণ্টা বাড়িতে থেকে কী রান্না, কে কী খাবে, কী পরবে, বাচ্চার সব আবদার, জেদ, তাকে পড়াশোনা করানো, তার সঙ্গে নানা দায়দায়িত্ব এক নাগাড়ে পালন করা কী ভীষণ চাপের! (Bengali Novel)
ওয়াশিংটনে থাকাকালীন প্রথম দিকে সব একা সামলাতে গিয়ে সে বুঝেছিল, এভাবে বেঁচে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব। যেন বহু আড়ম্বর, উচ্চ পদস্থ সরকারি আধিকারীকের স্ত্রীর আড়ালে তার নিজস্ব পরিচয় মুছে যাচ্ছিল। রাইয়ের বেড়ে ওঠা, তাকে প্রতিমুহূর্তে চোখে চোখে রাখা, তার ব্যথায় সাময়িক প্রলেপ ছিল। কিন্তু তার বাইরে! কী নিদারুণ শূন্যতা! নাহ! মাকে এভাবে বলাটা ঠিক নয়। নিজের মনেই বিড়বিড় করল। তারপর পরবর্তী নাম্বারে ডায়াল করল। (Bengali Novel)
আরও পড়ুন: জলকে চল: পঞ্চম পর্ব
-বলো, কতদূর এলে?
-এই তো সবে বেরোলাম।
-উঁহু ঘড়ির কাঁটা কিন্তু বলছে তুমি অফিস থেকে ঠিক সাত মিনিট দূরে আছো।
-আরে তুমি দেখতে পাচ্ছ নাকি?
-সামনাসামনি হয়তো পাচ্ছি না। কিন্তু এতদিনে এটুকু বুঝতে পারি। মাসিমা ফোন করেছিলেন নিশ্চয়ই।
-তুমি দেখছি বেশ বুদ্ধিমান হয়ে উঠছ ধীরে ধীরে।
-সঙ্গ দোষ। তোমার মতো বুদ্ধিমতী, মেধাবী, মহিয়সীর সঙ্গে থাকতে থাকতে এইটুকু উন্নতি হয়েছে। (Bengali Novel)

হা হা করে হেসে উঠল মোহনা। অন্য প্রান্ত থেকেও হাসির শব্দ ভেসে এল।
-তারপর বলো আজ কী কাজ?
-একটা মিটিং আছে দুটো থেকে। আর বাকি রোজ যা কাজ থাকে। তুমি কী করছিলে?
-যা রোজ করি এই সময়। তোমার ধ্যান। বলে হেসে উঠল রূপাঞ্জন।
-ধ্যান মনের জন্য খুব দরকার। এর বাইরে আর কোনও খবর? (Bengali Novel)
-খবর? না, তেমন কোনও খবর নেই। সারাদিন বইপত্র ঘাঁটছি। কাল থেকে স্বর্ণকুমারী দেবীকে নিয়ে পড়েছি। কত কাজ করেছিলেন তিনি। যত পড়ছি অবাক হচ্ছি। তিনি একদিকে যেমন লিখতেন, তেমনি সম্পাদকও ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পারিবারিক যে পত্রিকা তা নিজে বেশিদিন সম্পাদনা করেননি। তাঁর লেখার পথে অন্তরায় ছিল এই সম্পাদনার কাজ। কিন্তু স্বর্ণকুমারীদেবী দুটোই সমান তালে সামলেছেন। তুমি নিশ্চয়ই জানো এগুলো।
“১৮৭৬ সালে স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্বাণ’ প্রকাশিত হয়। এর আগে ১৮৫২ সালে হানা ক্যাথরিন মুলেনস ফুলমণি ও করুণার বৃত্তান্ত লেখেন। কিন্তু স্বর্ণকুমারী দেবীই ছিলেন প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক।”
মোহনা হাসল।
-না, আমি জানি না। তুমি ভাল করেই জানো আমি সাহিত্যের ছাত্রী নই। তবে প্রতি মুহূর্তে জানছি কাজের প্রয়োজনে। তুমি বলো, আমি শুনছি। (Bengali Novel)
রূপাঞ্জন মোহনার কথায় উৎসাহ পেয়ে বলতে শুরু করল- জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পারিবারিক পত্রিকা ‘ভারতী’ চালু করলেন। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি সাত বছর সম্পাদনা করেছিলেন। এরপর এগারো বছর সম্পাদনা করেন স্বর্ণকুমারী দেবী। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যারাও বারো বছর ও রবীন্দ্রনাথ এক বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। নয় বছরের ব্যবধানে আবার স্বর্ণকুমারী দেবী। দুই বছর পর অবশ্য তিনি পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। ভারতী যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল মাত্র ষোলো। প্রথম সংখ্যা থেকেই এই পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখা তুমি পড়েছ?
-না সেভাবে পড়া হয়নি। মোহনা জানালো। (Bengali Novel)
-১৮৭৬ সালে স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্বাণ’ প্রকাশিত হয়। এর আগে ১৮৫২ সালে হানা ক্যাথরিন মুলেনস ফুলমণি ও করুণার বৃত্তান্ত লেখেন। কিন্তু স্বর্ণকুমারী দেবীই ছিলেন প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক।শুধু প্রকাশনা আর পত্রিকা সামলালে হবে ম্যাডাম? বিভিন্ন জায়গায় আপনার ডাক পড়ছে সাহিত্য নিয়ে বলার জন্য। জানতে হবে তো! ওপাশ থেকে রূপাঞ্জন বলল। (Bengali Novel)
-জানানোর জন্য তুমি আছো।
-এখন আছি। কিন্তু যখন থাকব না তখন তো নিজেকেই জানতে হবে।
-এই শুরু হল বাজে কথা বলা। (Bengali Novel)

-বাজে কথা? আচ্ছা বেশ বলব না। কিন্তু ভেবে দেখো,আমারও বয়স হল। ষাট পেড়িয়ে গেলাম। একটা আশংকা তো থাকেই। প্রতিদিন যে পরিমান মানুষ না হয়ে যাচ্ছে, পরিচিত বন্ধু বান্ধব আত্মীয় পরিজন… রোজ খালি চলে যাওয়ার খবর। তাই যদিও বা ভাবি আমি টিকে যাব, সবরকম সাবধানতা মেনে চলছি, তবু যখন বাইরে বেরব কোন পৃথিবীতে গিয়ে দাঁড়াব! কারা থাকবে কারা থাকবে না কে জানে।
-সে যা হবে দেখা যাবে। এখন এসব ভেবে লাভ নেই।
“একশো বছরের বেশি পুরোনো ঐতিহ্যময় সংস্থার বর্তমান কর্ণধার তুমি এসে থেকে চেষ্টা করেছ ডুবন্ত একটা জাহাজকে ডাঙায় টেনে তুলতে। হ্যাঁ, সে বিষয়ে তুমি অনেকটাই সফল। কিন্তু গুটিকয় নাম নিয়ে দাদাগিরি করলে তোমার ভেতরটা যে একেবারেই ফাঁপা তা ধরা পড়ে যাবে।”
-আচ্ছা শোনো একটা বাংলা লিটল ম্যাগাজিন স্বর্ণকুমারী দেবীকে নিয়ে বিশাল সংখ্যা করেছিল। ‘একান্তর’। সম্পাদক অরূপ আচার্য। তোমার দরকার হলে পাঠিয়ে দিতে পারি। আমার কাছে আছে। বহু বিখ্যাত মানুষ ওনাকে নিয়ে তো লিখেইছেন, তার সঙ্গে স্বর্ণকুমারীর লেখাও রিপ্রিন্ট হয়েছে। জুলাই মাসে তাঁর মৃত্যুদিন, অগস্টে জন্মদিন। তোমাকে ঠিকই কোনও না কোনও কলেজ ডাকবে বলার জন্য। তার আগে এটা পড়ে নিলে তোমাকে আর বেশি পরিশ্রম করতে হবে না। (Bengali Novel)

-জো হুকুম আকা। এখন রাখি। এবার নামব।
-সাবধানে থেকো। এই অধমকে মনে রেখো। ফেরার পথে সম্ভব হলে ফোন কোরো। (Bengali Novel)
‘হু’, মোবাইল রেখে দিল মোহনা। এই রূপাঞ্জন না থাকলে সাহিত্যের এত সম্ভার দ্রুত পড়া সম্ভব ছিল কী না –সে নিজেও সন্দিহান। সে একেবারেই কর্পোরেট সেক্টর থেকে এসে সংস্থার হাল ধরেছে। আজ তার নাম হয়েছে। কিন্তু এটা ঠিক সাহিত্য সম্পর্কে সে একেবারেই অজ্ঞ। মূলস্রোতের জনপ্রিয় লেখকদের লেখা বাদে তেমন কিছুই আর জানা নেই। এমনকি নিজেদের প্রকাশনী সংস্থা হওয়া সত্ত্বেও চার বছর আগে অবধি কী কাজ হয়েছে, সে ভাল করে জানেই না। (Bengali Novel)
আরও পড়ুন: জলকে চল: তৃতীয় পর্ব
একশো বছরের বেশি পুরোনো ঐতিহ্যময় সংস্থার বর্তমান কর্ণধার তুমি এসে থেকে চেষ্টা করেছ ডুবন্ত একটা জাহাজকে ডাঙায় টেনে তুলতে। হ্যাঁ, সে বিষয়ে তুমি অনেকটাই সফল। কিন্তু গুটিকয় নাম নিয়ে দাদাগিরি করলে তোমার ভেতরটা যে একেবারেই ফাঁপা তা ধরা পড়ে যাবে। তার চেয়ে প্রতিদিন পড়া শুরু করো নিয়ম করে। পুরোনো বই যা ছিল, সেগুলো দিয়েই শুরু হোক। ভাবতে ভাবতেই তার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি চলে এল। সেই সময়ের জনপ্রিয় লেখক লেখিকাদের বইগুলো রিপ্রিন্ট করলে কেমন হয়! এর একটা সাহিত্যগত ভ্যালু যেমন প্রতিষ্ঠা করা যাবে, তেমন এই উপলক্ষে প্রেস, মিডিয়া, কো-পার্টনার সব মিলিয়ে একটা ভাল মাইলেজ পাওয়া যাবে। মনে মনে রূপাঞ্জনকে ধন্যবাদ জানালো সে। (Bengali Novel)
তারপর অফিসে ঢুকে চারদিক একবার দেখে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল জনপ্রিয় পত্রিকা ‘সাগরিকা’র বর্তমান সম্পাদক মোহনা চৌধুরী।
(ক্রমশ)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
বিতস্তা ঘোষাল ঔপন্যাসিক, গল্পকার, কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। আধুনিক ইতিহাসে এম এ, লাইব্রেরি সায়েন্সে বিলিস। কলেজে সাময়িক অধ্যাপনা। প্রকাশনা সংস্থা ভাষা সংসদের কর্ণধার। ও অনুবাদ সাহিত্যের একমাত্র পত্রিকা ‘অনুবাদ পত্রিকা’-র সম্পাদক।
'বাংলা আকাডেমি', 'সারস্বত সম্মান', 'বিবেকানন্দ যুব সম্মান', ‘একান্তর কথাসাহিত্যিক পুরস্কার', 'কেতকী' কবি সম্মান, ‘চলন্তিকা’, 'দুই বাংলা সেরা কবি সম্মান', 'বিজয়া সর্বজয়া', 'মদন মোহন তর্কালঙ্কার সম্মান', 'বই বন্ধু সেরা লেখক ২০২৪' সহ একাধিক পুরস্কার ও সম্মান প্রাপ্ত।
বিতস্তার প্রকাশিত বই ৩৪টি। তাঁর কবিতা ও গল্প হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও ইংরেজি,ইতালি, গ্রীক ও স্প্যানিশে অনুবাদ হয়েছে। সম্প্রতি ওড়িয়া ভাষায় প্রকাশিত তার গল্প সংকলন রূপকথার রাজকন্যারা।
দেশ বিদেশে কবিতা ও গল্প পড়ার ডাক পেয়েছেন একাধিকবার।বাংলা সবকটি জনপ্রিয় পত্রিকা ও সংবাদপত্রে তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত।
নিজের কাজের গণ্ডীর বাইরে অফিস ও পরিবারেই স্বচ্ছন্দ বিতস্তা কাজের ফাঁকে অবসর সময় কাটান নানান সামাজিক কাজে।
ভালোবাসা ছাড়া বাকি সব কাজ গুরুত্বপূর্ণহীন। তার নিজের কথায় ভালোবাসা ছাড়া কেউ কি বাঁচে?