(Homestay)
যুগের পর যুগ ধরে, বাংলা সাহিত্যে তা সে ভ্রমণ হোক বা সামাজিক গল্প, খাওয়া-দাওয়া এক বিশেষ জায়গা রাখে বইকি। আর আমার ব্যক্তিগত ধারণা নতুন জায়গা এক্সপ্লোর করতে সেই জায়গার বিশেষ বিশেষ কিছু খাবার তো চেখে দেখাই উচিত।(Homestay)
আমি আবার শুধু দুর্গম নয় এমন খুব পরিচিত জায়গায় থাকতে গেলেও হোমস্টেতে থাকাই প্রেফার করি। এর মূল দুটি কারণ হল জায়গাটির স্থানীয় মানুষের সান্নিধ্যে এসে জ্ঞান আহরণ করা, জায়গাটিকে জানা এবং তদুপরি স্থানীয় মানুষের হাতের তৈরি খাবার খাওয়া। এই শেষের বিষয়টি নিয়ে আমার বেশ কিছু মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে। (Homestay)
আরও পড়ুন: হোমস্টে: এসো আমার ঘরে এসো
এখানে একটা তথ্য বা বোঝাপড়া খুব জরুরি। ‘হোমস্টে’ কথাটি থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এটি একজনের বাড়িতে থাকা। এক্ষেত্রে এটাও সহজেই অনুমেয় যে এখানে হোটেলের মতো ‘পয়সা দিচ্ছি, তাই যা ইচ্ছে তাই খাব’ এই মানসিকতা নিয়ে থাকতে যাওয়া যাবে না। আর হোমস্টেতে সাধারণত চারটি মিল সহযোগে জনপ্রতি ভাড়া ধরা থাকে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই কোনওদিন বেড়ানোর কারণে দুপুরের খাবার না খেলে তারা দামে অ্যাডজাস্ট করে দেন। (Homestay)
আমার প্রথম হোমস্টেতে থাকা ও খাওয়ার অভিজ্ঞতা পশ্চিম সিকিমের ওখরেতে। সাঙ্গে শেরপার আস্তানায়। এখন যেরকম পর্যটকদের দাবীতে এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হোমস্টেগুলি আস্তে আস্তে হোটেলের দিকে যাচ্ছে, সেই ক্ষেত্রে সাঙ্গে শেরপার এই হোমস্টেটি ছিল বিরল ব্যতিক্রম। ধরাবাঁধা রুটিন খাবার। সকালে লুচি-তরকারি (ওরা বলে পুরি-সবজি) সঙ্গে দুধ বা চা, ছোটদের জন্য চাইলে টোস্ট-ডিম বা কর্নফ্লেক্স, দুপুরে ভাত, একটা সবজি, ডাল, চাটনি বা আচার, বিকেলে মোমো বা পেঁয়াজি (পোষাকি নাম অনিয়ন পকোড়া) এবং চা, রাতে রুটি বা ভাত তার সঙ্গে চিকেন বা ডিমের ডালনা। গড়পরতা প্রথমদিকের হোমস্টেগুলিতে এই ধরণের খাবার-দাবারই দেওয়া হত। এবং প্রত্যেকটি খাবার থাকত ধোঁয়া-ওঠা গরম। তাই খিদের মুখে এগুলিই লাগত অমৃত। (Homestay)

তবে ঐ যে বললাম হোমস্টের খাবারে স্থানীয় কিছু টপিং থাকবেই। সেবার ওখরের সঙ্গেই গেজিং বলে আর একটি জায়গায় গিয়েছিলাম আমরা। সানি গুরুঙের ওকে ভ্যালি রিট্রিট হোমস্টে। সেখানে দুপুরবেলা এমন সুন্দর একটি ছোলার তরকারি সানিজী রেঁধে দিয়েছিলেন যা আজও জিভে লেগে আছে। অনুসন্ধান করেছিলাম। জানিয়েছিলেন স্থানীয় একটি জায়গায় ঐ ছোলা পাওয়া যায়, উনি গেস্টদের জন্য আনিয়ে সবাইকেই একবেলা এটি খাওয়ান। আরও জানালেন আমি প্রথম নই যে এই ছোলার উৎস অনুসন্ধান করল। এই হোমস্টেতেই আমরা একটি অসাধারণ সুস্বাদু রোডোডেন্ড্রনের ওয়াইন খেয়েছিলাম। কাছেই বার্সে স্যাংচুয়ারি এটা ওখানকার সিগনেচার ডিশ। (Homestay)
“এবার আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে এইসব খাবার তো হোটেলেই পাওয়া যায়। ঘটা করে তার জন্য হোমস্টের কথা বলছি কেন!”
খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আমাদের এই বঙ্গদেশের মানে পশ্চিমবঙ্গের দুটি হোমস্টের কথা। দামের দিক দিয়ে একটু উপরের দিকে হলেও, খাবারের মান ছিল অতুলনীয়। প্রথমেই বলি সম্রাট ব্যানার্জির ‘শান্তিনিকেতন’ হোমস্টের কথা। এটি অবস্থিত পূর্ব বর্ধমানের একটি গ্রামে। দীর্ঘকাল বেশ বড় একটা কোম্পানিতে চাকরি করার পর, পৈতৃকসূত্রে পাওয়া জমিতে এই বাড়িটি নির্মাণ করেন সম্রাটদা। বেশ কয়েকটি ঘর। সবচেয়ে সুন্দর ছাদ-লাগোয়া ঘরদুটি। আমার মনে আছে পৌঁছানোর পর আমাদের ওয়েলকাম ড্রিংক হিসেবে দেওয়া হয়েছিল লেবুর সরবত। কিন্তু চিনি বর্জিত। হাল্কা নুন দিয়ে। এত রিফ্রেশিং, আর এত ভাল লেগেছিল তা আর বলার নয়। সম্রাটদা মূলত এখানে ভিলেজ টুরিজম প্রোমোট করেন। গরুর গাড়িতে করে গেস্টদের গ্রামে ঘোরান। পাশে একটা ছোট মাছের ভেড়ি এবং অর্গ্যানিক ফার্মিং-এর জায়গা। যা যা তরি-তরকারি খাইয়েছিলেন আমাদের সব ঐ ফার্মের। নিজেই আবার মেশিন কিনে সর্ষের তেল নিষ্কাশন করেন। তবে এই হোমস্টেতে সবচেয়ে মনে রাখার মতো ছিল কচি পাঁঠার ঝোলটি। এখনও তা আমরা মাঝে মাঝে রোমন্থন করি। (Homestay)

হলদিয়ার কাছে ‘খোলা আকাশ’ হোমস্টে। এখানকার খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দু’টি জিনিস। সকালবেলার চিড়ের পোলাও এবং বিকেলের স্ন্যাক্সে একটা প্ল্যাটার। ব্রেকফাস্টে চিড়ের পোলাওটা এখানে অভিনব। আর বিকেলের প্ল্যাটারে থাকে ফিস ফ্রাই, ফিস ফিঙ্গার, চিকেন পকোড়া এবং ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। (Homestay)
এবার আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে এইসব খাবার তো হোটেলেই পাওয়া যায়। ঘটা করে তার জন্য হোমস্টের কথা বলছি কেন! আমার ক্ষেত্রে সম্রাটদা আর খোলা আকাশে ঘানির সর্ষের তেলে রান্নার স্বাদ এবং হোটেলের চাকচিক্য নয়, বরং অগোছালো আতিথেয়তায় আন্তরিকতার ওম খুব উপভোগ্য হয়েছিল, যা আমি থ্রি স্টার বা ফোর স্টার হোটেলের সাজানো আতিশয্যের ফোর-কোর্স মিলে পাইনি। (Homestay)
আরও পড়ুন: হোমস্টে: পর্যটনের নয়া ঠিকানা হেরিটেজ হোমস্টে
এবার আবার একটু নর্থ বেঙ্গলে ফিরে যাই। ওই যে বললাম স্থানীয় খাবার চেখে দেখার ইচ্ছা আমার প্রবল। কাফেরগাঁওতে সুনীল তামাং-এর হোমস্টেতে খাইয়েছিলেন ওঁর ওখানে গাছের একটি লঙ্কা। বেঁটে ও মোটা। ছোট্ট এক কামড়েই বুঝেছিলাম নিজের নাম ভুলিয়ে দেওয়ার মতো ঝাল। জানিয়েছিলেন ঐ গাছ সমতলে হয় না। (Homestay)
আবার তাকদার প্রধানজীর হোমস্টেতে খেয়েছিলাম কালো জিরে ময়ান দেওয়া সুজির কচুরি। ক্যাসেরোল ভর্তি ভর্তি করে সামনে সেই কচুরি রেখে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে একটি স্থানীয় হার্বের আচার ও একটি আলুর তরকারি। এই সুজির কচুরির যা অতুলনীয় স্বাদ তা আর কী বলি… আমি নিশ্চিত অনেক নামী-দামী হোটেলও এই ছোট ছোট স্থানীয় বিষয়ে আমার ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে পারবে না। (Homestay)
এত অব্দি পড়ে মনে হতেই পারে আমি সাংঘাতিক রকমের ফুডি। না ঠিক তা নয়। আমি নতুন খাবার চেখে দেখি বটে, তবে তার পরিমাণ অল্পই থাকে। এবং খুব ছোট ছোট স্পেশাল ডিশ আমার মন ভাল করে দেয়। যেমন আন্দামানের হ্যাভলকে একটি হোমস্টে থেকে ব্যাম্বু চিকেন আনিয়েছিলাম। এত সিগনেচার একটা ডিশ নামী হোটেলের একটি লোকও বলতে পারছিল না কোথায় পাব। অনেক খুঁজে একটি পেয়েছিলাম। একটু বেশি ঝাল ছিল, কিন্তু খুব ভাল লেগেছিল। (Homestay)
হলফ করে বলতে পারি, প্রথম ফুলকো লুচি আঙুল দিয়ে ফাটিয়েই মনে আসবে, “Agar firdaus bar roo-e zameen ast,
Hameen ast-o hameen ast-o hameen ast.”
মেঘালয়ের ডাউকির এক হোমস্টেতে একটি আলুর পরোটা খেয়েছিলাম ব্রেকফাস্টে। নতুন কিছু না। কিন্তু নতুনত্ব ছিল সাইজে এবং অভিনবত্ব ছিল স্বাদে। আমাদের এখানে ভাতের স্টিলের থালার একথালা সাইজের আলুর পরোটা এবং ভিতরে নানা ধরনের স্থানীয় তরি-তরকারি দেওয়া। ঐরকম আমি এখনও পর্যন্ত কোথাও আর খাইনি। (Homestay)
ভারতের নানা জায়গায় এইরকম সব অনেক মনিমাণিক্যরা ছড়িয়ে আছে। এবার একটু সমুদ্র উপকূলে যাই। পশ্চিমে। আমার দৌড় গোয়া পর্যন্ত। এখানে একটি হোমস্টেতে নানা স্থানীয় সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার অভিজ্ঞতা অবিস্মরণীয়। সব কটি মাছের নাম না মনে থাকলেও, একদম কই মাছের মতো দেখতে পেট মোটা একটি মাছ ওরা দিয়েছিল। সারা ডিশ জুড়ে। খাব কী, সামলেই উঠতে খানিক সময় লাগল। (Homestay)

এইসব খাবারই বললে হোটেলে বা রিসর্টে বসেও খাওয়া যায় ঠিকই। কিন্তু অবশ্যই অধিক মূল্যে এবং আর একটি বড় বিষয়ের অভাব থাকে। তা হল আন্তরিকতা। হোমস্টের লোকজন বা কর্ণধারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সেইখানকার মাটিতে জন্ম নেওয়া নানা খাবারের রসাস্বাদন করা এই অভিজ্ঞতা হোটেলে বিরল। (Homestay)
যবনিকা পতনে বলব ভূস্বর্গে ছোট একটি অভিজ্ঞতার কথা। হোমস্টের ক্ষেত্রে শুধু খাবারের রকমফের নয়, তা কোথায় এবং কীভাবে পরিবেশিত হচ্ছে সেক্ষেত্রেও থাকে অভিনব অভিনবত্ব। আগের বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে আমরা ছিলাম পহেলগামে। সেখানে লিডার নদীর ধারে একটি হোমস্টে ছিল আমাদের দু’রাতের আস্তানা। প্যারাডাইজ হোমস্টে। লোকেশানের জন্যই এই হোমস্টেটির গুগল রেটিং অনেকটা উপরে। এদের বড় অভিনবত্ব হল এদের ব্রেকফাস্ট সার্ভ করার জন্য হোমস্টের পিছনে লীডার নদীর ধারে একটি পাথুরে ওপেন-এয়ার ডাইনিং এর ব্যবস্থা আছে। চেয়ার ও টেবিল সবই পাথরের। সেইখানে ওরা ব্রেকফাস্ট সার্ভ করেন। গরম ম্যাগি, ফ্রেঞ্চ টোস্ট, বাটার টোস্ট এমনকি লুচি তরকারিও। তবে একটাই কথা, দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেতে হবে। পাশে নদী, সামনে কাশ্মীরের বরফাবৃত শৈলশিরা। আর পাতে গরম ধোঁয়া ওঠা লুচি-তরকারি। (Homestay)
আরও পড়ুন: আলো: আলো: ফেলে আসা দেশের বাড়ি, হস্টেল, মেস জীবনের আলো
হলফ করে বলতে পারি, প্রথম ফুলকো লুচি আঙুল দিয়ে ফাটিয়েই মনে আসবে, “Agar firdaus bar roo-e zameen ast,
Hameen ast-o hameen ast-o hameen ast.” (আমির খসরুর কাশ্মীর নিয়ে বিখ্যাত উক্তি যার অর্থ “যদি পৃথিবীতে কোথাও স্বর্গ থাকে, তাহলে এটাই, এটাই, এটাই”) (Homestay)
পরিশেষে একটা কথাই বলার, কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, তাঁর “ছুটির হাওয়া” কবিতায় বলেছেন, “যেখানেই যাও ভালো থাকা চাই/ তার জন্যই তো যাওয়া”। ভাল না থাকতে পারলে বেড়াতে গিয়ে মজা নেই। এবং সেই মজা পাওয়ার একটি বড় অংশ হল দক্ষিণ হস্তের কাজ বা খ্যাটন। আমি বা আমার মতো কিছু বেড়ানো-পাগল লোকেদের হোমস্টেতে থাকা বা সেখানকার খাবারের স্থানীয় টুইস্ট ভাল লাগে বলে অধিকাংশ ভ্রামণিক আমার সঙ্গে একমত হবেন সে আশা আমার নেই। কিন্তু জীবনে এক কিংবা দু’বার তারাখচিত হোটেল থেকে একটু অবতরণ করে পাথুরে জমির সান্নিধ্যে এসে মাটির স্বাদ নিতে পারলে মন্দ লাগবে না, কথা দিলাম। (Homestay)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
পেশায় জৈব-প্রযুক্তিবিদ। শখ বই ও শাস্ত্রীয় নৃত্য। চেনা অচেনা জায়গায় বেড়াতে যেতে এবং স্থানীয় খাবার চেখে দেখতে ভালোবাসেন। ছুটি, রংরুট, চল যাই, ভ্রমণপিপাসু ইত্যাদি বিভিন্ন ছোট-বড় পত্রিকা, ওয়েবজিন ও ব্লগে ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন। এছাড়াও লিখেছেন ব্যক্তিগত গদ্য, রম্যরচনা এবং ছোট গল্প।
