(Kalyan Chattopadhyay)
কল্যাণদাকে প্রথম দেখি, কলকাতা দূরদর্শনের পুরোনো অফিস, মানে আগেকার রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে। আমার মা তখন সেখানে কর্মরত। ‘ইউথ টাইম’ নামে একটি অনুষ্ঠান হত। সেই অনুষ্ঠানে মুনমুন সেন এসেছিলেন অংশগ্রহণ করতে। মুনমুনদির সঙ্গেই কল্যাণদা এসেছিলেন। এক দেখাতেই চিনতে পেরেছিলাম কারণ অনেক জনপ্রিয় বাংলা ছবিতে উনি অভিনয় করে যথেষ্ট পরিচিত হন। (Kalyan Chattopadhyay)
তপন সিংহ পরিচালিত, ‘আপনজন’, ‘আঁধার পেরিয়ে’, ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, ‘সাগিনা মাহাতো’, ‘আদমি আউর অউরত’, সত্যজিৎ রায় নির্মিত, ‘প্রতিদ্বন্দী’, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের, ‘ধন্নি মেয়ে’, পীযুষ বসুর, ‘বিকেলে ভোরের ফুল’ ইত্যাদি ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে কাজ করলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় তাঁকে দেখা গিয়েছে। তপনদার সম্পর্কে কথা হলেই বলতেন, ‘উনি আমার কর্মগুরু’। যৌবনে পুনার ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট থেকে পাশ করে আসার পরেই কলকাতায় নতুন applicant-দের নির্বাচিত করা হয়। (Kalyan Chattopadhyay)
আরও পড়ুন: নবতিপর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
সেই কমিটিতে কানন দেবী, তপনদা সহ বহু গুণী মানুষ ছিলেন। ১৯৬৭ সালে আপনজন ছবির মধ্যে দিয়েই শুরু হয়েছিল চলচ্চিত্র জগতে কল্যাণদার পথচলা। আবার ‘সাগিনা মাহাতো’ ছবির হিন্দি এবং বাংলা, দুটি ভার্সনেই কল্যাণদা কাজ করেছিলেন। তপনদার বিষয়ে একটি বই সম্পাদনার কাজ করতে গিয়েই কল্যাণদার সঙ্গে আলাপ এবং ঘনিষ্ঠতা হয়। দক্ষিণ কলকাতার গোখেল রোডে এক কামরার একটা ছোট জায়গায় ছিল অকৃতদার কল্যাণদার সংসার। (Kalyan Chattopadhyay)

আমার কন্যা তখন গোখেল মেমোরিয়াল স্কুলে পড়ত। ওকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার এবং আসার পথে কল্যাণদার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হত। একেকদিন জোর করে ওঁর এক কামরার বাসায় নিয়ে যেতেন। অনেক গল্প হত, বেশিরভাগটাই অতীতের বাংলা ছবি সংক্রান্ত। বর্ষীয়ান অভিনেতা, অনিল চট্টোপাধ্যায়ের ভাইপো কল্যাণ চট্টোপাধ্যায় সেই অর্থে কোনওদিনও ছবিতে নায়কের ভূমিকায় কাজের সুযোগ না পেলেও চরিত্রভিনেতার কাজেই স্বতন্ত্রতার ছাপ রেখেছেন। (Kalyan Chattopadhyay)

তপনদাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন। বেশিরভাগ সময়ই আমাদের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতেন তপনদা। মাঝে-মধ্যে দুঃখ করে বলতেন বাড়ির কাছেই নন্দন, কিন্তু কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের একটাও আমন্ত্রণপত্র পাই না। এত বছর এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেও চলচ্চিত্র উৎসবের একটা কার্ডও কি পেতে পারি না! আমি বেশ কয়েক বছর ধরে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে ওঁর সেই আক্ষেপটা একটু হলেও কম করতে পেরেছিলাম। কন্যাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে পাশের রাস্তায় ওঁর বাড়ি গিয়ে গেস্ট কার্ড দিয়ে আসতাম। (Kalyan Chattopadhyay)
“গতকাল সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে আসা এক অতিথির কাছে জানতে পারি কল্যাণদা টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছেন। আর তার কিছুক্ষণের ভেতরেই ওঁর প্রয়াণের সংবাদ মনটাকে ভারাক্রান্ত করে তুলল।”
খুব খুশি হয়ে ছবি দেখতে যেতেন। তপনদা চলে যাওয়ার পরে ওঁর স্বরণসভার আমন্ত্রণ পৌঁছে দিয়েছিলাম কল্যাণদার বাড়ি গিয়ে। বালিগঞ্জের চৌধুরী হাউসে আয়োজিত সেই স্বরণসভায় এসেছিলেন কর্মগুরুকে প্রণাম জানাতে। গত তিন-চার বছর ধরে কল্যাণদার শরীর খুব একটা ভাল যাচ্ছিল না। পথ চলতে গিয়ে ওঁর ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে কুশল জিজ্ঞাসা করলে বলতেন ভাল নেই। দেখতামও নির্জন কোণে বিছানায় শুয়ে টিভি দেখছেন। যত দিন যাচ্ছিল, ততই হাঁটাচলার ক্ষমতা চলে যাচ্ছিল। (Kalyan Chattopadhyay)

গত বছর তপন সিংহর জন্মশতবর্ষে চলচ্চিত্র উৎসবের শেষদিনে রবীন্দ্রসদনে তপনদার ছবির অভিনেতা, কলাকুশলীদের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের পক্ষ থেকে সম্মান প্রদান করবার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। চলচ্চিত্র উৎসব কমিটির একজন সদস্য হিসেবে আমি নিজে গিয়ে কল্যাণদার হাতে সরকারি আমন্ত্রণপত্র দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু শারীরিক কারণে তিনি আসতে পারেননি। চলতি বছরের মার্চ মাসে তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে একটা বই প্রকাশ করেছিলাম। (Kalyan Chattopadhyay)

বইটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করতে কলকাতায় এসেছিলেন অমল পালেকার। এখানে আসার আগে পুনা থেকেই অমলদা আমাকে বলেছিলেন, ‘এই বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে কল্যাণকে ডেকো’, সেই কথা কল্যাণদাকে জানিয়েওছিলাম কিন্তু ওঁর ভগ্ন শরীর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। (Kalyan Chattopadhyay)
আরও পড়ুন: কাছে ছিলে দূরে গেলে
এর কয়েক মাস পরে শরীর আরও বেশি খারাপ হয়, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আর্থিক সমস্যা। একদিন ওঁর চিকিৎসকের দেওয়া একটা প্রেসক্রিপশন আমাকে হোয়াটস্যাপ করে পাঠান। বুঝতে দেরি হল না ওঁর প্রয়োজনটা। আমার পরিচিত কলকাতার কয়েকজন সংগ্রাহকদের কল্যাণদার অবস্থার কথা জানালে তাঁরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। মাস কয়েক এইভাবে চলার পরে গতকাল সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে আসা এক অতিথির কাছে জানতে পারি কল্যাণদা টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছেন। আর তার কিছুক্ষণের ভেতরেই ওঁর প্রয়াণের সংবাদ মনটাকে ভারাক্রান্ত করে তুলল। (Kalyan Chattopadhyay)
অতীতের বাংলা ছবির আরও একটা অধ্যায় শেষ হয়ে গেল কল্যাণদার চলে যাওয়ার সঙ্গেই।
চিত্র ঋণ- ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়া পুনে
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।
