(Short Story)
১)
– কী ব্যাপার বলো তো, দু’দিন ধরে তোমাকে এরকম উদাসীন লাগছে কেন? কালকে যে বললাম জ্বর এসেছে একবারও তো জিজ্ঞেস করলে না, আমি কেমন আছি?
– জানোই তো, এ ক’দিন ভীষণ চাপে ছিলাম।
– যাইহোক আজ ঠিকাছ তো?
– হ্যাঁ শরীর ঠিক থাকলে বিকেলে দেখা হচ্ছে। (Short Story)
খানিক এড়িয়ে যাওয়ার মতো করেই স্বল্প কথা সেরে ফোন রেখে দেয় রণ। মিতুল টের পায় সামথিং ইজ গোয়িং টু বি রং।
বাতাসে গরমের আস্ফালন ক্রমেই বাড়ছে। আর তার ওপর দিয়ে বাড়ছে এসি’র নিজেকে শক্তিশালী প্রমাণ করার কম্পিটিশন। আর এই দু’য়ের লড়াই অতিক্রম করে ঠোঁটের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে মিতুল আজ খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে নিজেকে, আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড় করিয়ে চেয়ে আছে, নিজের দিকেই। চোখে কাজল, কপালে কালো টিপ, গলায় অক্সিডাইজ চোকার, পরনে কালো শাড়ি সঙ্গে স্লিভলেস ব্লাউজ। কী যে মোহময়ী লাগছে ওকে! ও যেন মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, এভাবে সাজলে রণ চোখ ফিরিয়ে থাকতেই পারবে না। তাকাতে ওকে হবেই। রণর চোখে এক অদ্ভুত মায়া খুঁজে পায় মিতুল। সেই মায়ার জালে ভিজতে ভিজতে নেশা জাগে। তখন ভালবাসার মানুষটির মন পাওয়ার জন্য একজন নারী কত কী যে করতে পারে! রণ ডাকলে মিতুল যে না গিয়ে থাকতে পারে না। এ যেন এক অমোঘ টান! (Short Story)
– এই ক্লিনিকে পেশেন্ট দেখা, পিএইচডি’র পড়াশোনা সবটা সামলে বড্ড কাহিল হয়ে যাচ্ছিস বাবাই, চল কদিন কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসি।
– তোমরা যাও বাবা, মাকে নিয়ে দু’দিন পুরুলিয়া ঘুরে এসো, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। পাহাড়, ঝর্ণা, ড্যাম, লেক, ছৌ-নাচ… দেখবে তোমাদের খুব ভাল লাগবে। আমার এখন হবে না গো, খুব চাপ।
– কেন হবে না? দু’দিনের তো ব্যাপার। দেখ যা ভাল বুঝিস কর।
‘মা আমায় বেরোতে হবে, ভাত দিয়ে দাও, একেবারে খেয়ে বেরোব, ফিরতে রাত হবে’, বাবার কথার আর উত্তর না দিয়ে ফোনে টাইপ করতে করতে ঘরে চলে যায় মিতুল। (Short Story)

– কী যে হয়েছে ইদানীং মেয়েটার, সবসময় দেখি সময় পেলেই ফোনে মুখ গুঁজে বসে থাকে। সেদিন রাতে বাথরুম যেতে গিয়ে কানে এল হাসির আওয়াজ, মনে হয় কারুর সঙ্গে কথা বলছিল। মনীষা, মেয়েকে একটু খেয়াল রেখো, কার সঙ্গে মিশছে, কী করছে! এইসব করতে গিয়ে, না আবার কেরিয়ারটা নষ্ট হয়!
– থামো তো। অহেতুক চিন্তা করো না। মেয়ে আমাদের যথেষ্ট বড় হয়েছে। রোজগার করছে। ও যদি কাউকে পছন্দ করে, বুঝেই করবে। আমি জানি আমার মেয়ের বুদ্ধি, বিবেচনা বোধ আছে। ও যাকে-তাকে আস্কারা দেবে না। ভরসা রাখো। (Short Story)
“রোজ রাতে শোওয়ার আগে অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট ওষুধ খায় রনজিৎ। ওগুলো খাওয়া বন্ধ করলেই ইনসোমনিয়া, মাথা যন্ত্রণা, নানান সমস্যা দেখা দেয় ওর।”
ভেতরের ঘর থেকে মিতুল শুনছে ওর বাবা, ওর মা’কে সাবধান করছেন ওর বিষয়ে। মিতুলও বুঝতে পারে এ-কদিনে রণ কতটা জড়িয়ে গেছে ওর জীবনের সঙ্গে। এখন যেন একটা দিনও ওর সঙ্গে কথা না বলে থাকতে ইচ্ছে করে না। ঠোঁটের কোণায় অজান্তেই যেন এক চিলতে হাসি দানা বাঁধে মিতুলের। ও মনে মনে ঠিক করে, আজ রণর সাথে দেখা করে এসে বাড়িতে ওর কথা সব জানাবে বাবা-মা কে। (Short Story)
২
রোজ রাতে শোওয়ার আগে অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট ওষুধ খায় রণজিৎ। ওগুলো খাওয়া বন্ধ করলেই ইনসমনিয়া, মাথা যন্ত্রণা, নানান সমস্যা দেখা দেয় ওর। মিতুল রোজ রাতে চেষ্টা করে ওর সঙ্গে সময় কাটানোর। তাকে রোজ নানা ধরনের গল্প শোনায়, যাতে ওই ওষুধগুলো ওকে খেতে না হয়, গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ত রণ, তারপর নিঃশব্দে, ফোন রেখে দিত মিতুল। যদিও ওষুধগুলো মিতুল নিজেই ওকে প্রেসক্রাইব করেছিল, যখন ওর ডিপ্রেশন রিলেটেড সিরিয়াস ইস্যু দেখা দিয়েছিল। ও জানে ওই ধরনের মেডিসিন বেশি নেওয়া, স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল না। রণ যখন খুব ডিপ্রেশনে ভুগছিল তখনই গুগল সার্চ করে, রিভিউ দেখে ডঃ মিতুল রায়ের সাথে যোগাযোগ করে ও। (Short Story)
বালিগঞ্জের কাছে ‘পিস এন্ড কিওর’ নামের ক্লিনিকে ডক্টর রায় এর কাছে পেশেন্ট হিসেবে প্রথম অ্যাপয়েনমেন্ট করায় রণ। প্রথম প্রথম, বেশ কিছু সেশনে নানা বিষয়ে কনফ্লিক্ট হত। মিতুল ঠান্ডা মাথায় পেশেন্টলি ওর ট্রমাগুলো হ্যান্ডেল করার চেষ্টা করত। ও কখনও জোর করে অতীত মুছে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিল না। আর রণ চাইত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ও যেন ট্রমাটা কাটিয়ে উঠতে পারে। মিতুল বলত অতীত পড়ে থাক এক পাশে, তাকে প্রতি মুহূর্তে না ছুঁলেই দেখবেন ধীরে ধীরে আপনি অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। রণর মনে হত ধুর এই ডক্টর দেখিয়ে কোনও কাজ হচ্ছে না। কেবল বড় বড় বুলি আওড়ায়, ওতে কাজ হয় নাকি? (Short Story)
কোনও ওষুধই দেয় না। ধীরে ধীরে ওর মিতুলের ওপর একটা ডিপেন্ডেন্সি আসতে শুরু করেছিল। প্রথম প্রথম টের পায়নি। বসন্তের হাওয়ার মতো গায়ে মেখেছিল সবটুকু। ফুরফুরে নরম বাতাসের মতো। কিন্তু মিতুল? ওর কেন এমন হচ্ছে? ওর তো এমন হওয়ার কথা না। এটা তো ওর প্রফেশন। এরকম কত পেশেন্ট ও রোজ হ্যান্ডেল করে। কত মানুষ, কত ধরনের সমস্যা নিয়ে আসে, ট্রিটমেন্ট করায় দিনের পর দিন, আবার চলেও যায়। রিতমের সঙ্গে ব্রেক-আপের পর বহুকাল আর কোনও সম্পর্কে জড়ানোর কথা ভাবেনি মিতুল। (Short Story)

একদিন রাতে অন্বীর সঙ্গে ফোনে কথা কাটাকাটি হতে হতে খুব ব্রিদিং ট্রাবল শুরু হয়েছিল রণর। কী করবে বুঝতে না পেরে মিতুলকে ফোন করে বসে। সেইদিন সারারাত কথার জালে হাঁটতে হাঁটতে দু’জনেই দু’জনের অরণ্যশিবিরে ছায়ার সন্ধান পায়। হেঁটে যায় সবুজ শান্ত দিঘীর কাছে। সেই দিঘীর পাড়ে বসে থাকে চুপচাপ দু’জনে। অনুভব করে এ মায়ার জাল থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ তারা বন্ধ করেছে যুগ্ম ইন্ধনে। (Short Story)
অন্বী, অন্বী মুখার্জি আর রণজিৎ চক্রবর্তী দু’জনেই ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের রিক্রুটমেন্ট ডিভিশনে আছে। বছর ছয়েক আগে অন্বীকে ভালবেসেই বিয়েটা করেছিল রণ। অন্বীর কুষ্টি বিচার করিয়ে রণর মা দেখেছিলেন মেয়েটি মাঙ্গলিক। ফলে ওই বিয়েতে ওর মা’র ছিল ঘোর অমত। তা সত্ত্বেও প্রায় বাড়ির অমতেই বিয়েটা করেছিল রণ। অন্বী একজন কেরিয়ার ওরিয়েন্টেড, উচ্চাকাঙ্খী নারী। বিয়ের আগে ওর সঙ্গে সম্পর্কে থাকাকালীন ওর স্মার্টনেস, স্পষ্টকথা, নিজের মতে অটল থাকা, এই দিকগুলোই বেশ আকর্ষণীয় লাগত রণর। (Short Story)
“সম্পর্কের ভেতর দূরত্ব তৈরি হলেই বোধহয় তৃতীয় ব্যক্তি সেখানে ঢোকার জায়গা পায়। ঠিক তেমনই রণ আর অন্বীর মাঝে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল বলেই, সেই ফাঁকা জায়গা ভরাট করতে রণও যেন কেমন আঁকড়ে ধরেছিল মিতুলকে।”
অদ্ভুতভাবে দেখা গেল বিয়ের পর থেকেই খুঁটিনাটি সামান্য বিষয়ে ওদের মধ্যে ঝামেলা শুরু হল। অন্বীর বক্তব্য সংসার- সন্তান এসবে আবদ্ধ থাকার জন্য, সে এত কষ্ট করে পড়াশোনা করে চাকরিটা অর্জন করেনি। ফলে সন্তান মানুষ করতে গিয়ে কেরিয়ার জলাঞ্জলি দিতে সে পারবে না। ফলে সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কনফ্লিক্ট তৈরি হল দু’জনের। অন্বী সেপারেট থাকা শুরু করল। ধীরে ধীরে সে ফাটল বাড়তে বাড়তে কখন যে তাতে তৃতীয় ব্যক্তির অনুপ্রবেশ ঘটল নিজেরাও টের পেল না। (Short Story)

সম্পর্কের ভেতর দূরত্ব তৈরি হলেই বোধহয় তৃতীয় ব্যক্তি সেখানে ঢোকার জায়গা পায়। ঠিক তেমনই রণ আর অন্বীর মাঝে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল বলেই, সেই ফাঁকা জায়গা ভরাট করতে রণও যেন কেমন আঁকড়ে ধরেছিল মিতুলকে। মিতুল ওই আঁকড়ে ধরাটাকেই ভালবাসা ভাবতে চেয়েছিল। (Short Story)
আরও পড়ুন: ম্যাথিউ ব্লেক এর উপন্যাস ‘অ্যানা ও’: ভাষান্তর- মোহনা মজুমদার
৩
আজ আর চেম্বারে যায়নি মিতুল। বাড়ি থেকে সোজা ক্যাব বুক করে হিন্দুস্থান পার্কের একটা ক্যাফেতে চলে এসেছে, রণ পৌঁছনোর আগেই।
প্রায় পাঁচ বছর ধরে নানা উকিল আদালত ঘুরে দু’দিন আগে ডিভোর্সের ফাইনাল প্রসিডিওর কমপ্লিট হয়েছে বলে জানায় রণজিৎ। ডিভোর্সটা না পাওয়া অবধি কোনও সম্পর্ক বা কমিটমেন্টে জড়াতে চায়নি রণ। মিতুল যে বড়ই ইমোশনাল একটা মেয়ে। রণ বোঝে মিতুলের মতো করে কেউ কখনও ওকে এভাবে ভালবাসেনি, জড়িয়ে থাকতে চায়নি। কখন যে মেয়েটার ওপর মায়া পড়ে গেছে রণ নিজেও টের পায়নি। আইনি ঝামেলা মেটার পর রণই আজ মিতুলকে দেখা করার প্রস্তাব দেয়। তাই বোধহয় মিতুলের এত আনন্দ। যে প্রেমের আগুন থেকে এতকাল রণ নিজেকে সরিয়ে রেখেছে, সে আগুন আজ পুড়িয়ে ছারখার করবে দুটো শরীর-মন। মিশে যাবে বহুদূর থেকে ছুটে আসা দুটি নদী। তারপর এক হয়ে ভেসে যাবে যাবতীয় সীমারেখা। ক্যাপুচিনোর সাদা ফেনায় চোখ রেখে এ যেন এক দিবাস্বপ্ন দেখছে মিতুল। (Short Story)
– সরি একটু লেট হয়ে গেল। অনেকক্ষণ ওয়েট করছ?
– না, না, বসো। তোমার জন্য কী অর্ডার দেব?
– যা হোক একটা স্মুদি বলে দাও, এই গরমে আর অন্য কিছু ইচ্ছে করছে না।
– শরীর ঠিক আছে তোমার? এরকম অস্থির লাগছে কেন?
– ইয়ে মানে, কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না
– আরে বলো না, এত হেজিটেট করো না
– মিতুল, আই ওয়ান্ট টু সে সরি, সরি মিতুল।
– মানে?
– তোমার সঙ্গে এই রিলেশনশিপটা আমি কন্টিনিউ করতে পারব না। আই থিঙ্ক আই অ্যাম স্টিল ইন লাভ উইথ অন্বী। তাই আমি তোমার মন নিয়ে খেলতে চাই না। কারণ যত যোগাযোগ রাখব, তত তোমার মন দুর্বল হবে। প্লিজ আমায় ক্ষমা করো। (Short Story)

– মানে? কী বলছ কী এসব?
মিতুল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
– তাহলে ডিভোর্সটা দিলে কেন?
– ভালবাসার অর্থ তো জোর করে বন্দী করে রাখা নয়। ও চেয়েছে, আমি দিয়েছি।
– অথচ এই তুমিই একদিন ওকে ভুলতে চেয়ে আমার কাছে ছুটে এসেছিলে… (Short Story)
তারপর নিজেকে সামলে বলে ‘তবে তুমি যে কন্ডিশনে আমার কাছে প্রথম এসেছিলে, তার থেকে আজকের ‘তুমি’ র কন্ডিশন অনেকটা বেটার। আজকের তোমার মধ্যে একটা দৃঢ়তা লক্ষ্য করছি, তোমার বক্তব্যে, তোমার সিদ্ধান্তে। একজন ডক্টরের কাছে পেশেন্টের রিকভারি ছাড়া আনন্দের আর কী হতে পারে? ভাল থেকো রণ।’ (Short Story)
চেয়ার ছেড়ে উঠে যায় মিতুল। বলিষ্ঠ তার পদক্ষেপ। দূরে সরু ফালির মতো ক্ষিদে তিরতির করে বয়ে চলেছে, দীর্ঘ এক জ্বরের দিকে, গোপনে। হলুদ পাতার মতো ফ্যাকাশে হয়ে আসা ভালবাসার রঙে তখন এলোমেলো উড়ছে এক নারীর আর্তি। সে আর্তি কি চোখে পড়ে রণর? নাকি গোধূলি ধুলোয় ম্লান হয়ে যেতে থাকে একমুঠো রঙিন স্বপ্ন? (Short Story)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
মোহনা মজুমদারের জন্ম কলকাতায়। অঙ্কে স্নাতকোত্তর। প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ শব্দলেখা থেকে ''যতোটা অপ্রকাশিত'(ই-সংস্করণ)। ২০২২ এ বইতরণী থেকে প্রকাশিত হয়েছে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'বিহান আলোর লিপি' ও ২০২৩ আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় অক্ষর সংলাপ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'উৎসারিত ও সলিলোকুই'।
