(Nirmal Kumar)
নির্মলকুমার, নামটা বলতেই বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের অনেক ছবির নাম একসঙ্গে মনে পড়ে যায় যেমন লালপাথর, আগুন, লৌহকপাট, ছায়াসূর্য, আপনজন, শেষের কবিতা ইত্যাদি কিন্তু ক্ষণিকের অতিথি ছবিতে বীরভূম জেলার এক অখ্যাত গ্রামে ডাক্তারের ভূমিকায় তাঁর অভিনয়, যেন আর সব ছবিতে তাঁর কাজকে ছাড়িয়ে গেছে! (Nirmal Kumar)
উত্তমকুমার যখন খ্যাতির শিখরে, তখন অনেক অভিনেতাই তাঁদের অভিনয়গুণে নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে নির্মলকুমার অন্যতম। শুধু সুন্দর দেখতে রোমান্টিক নায়কের চেহারা দেখে দর্শকরা তাঁর প্রতি আকর্ষণবোধ করেছেন বলে মনে হয় না। আমার ব্যক্তিগত মত, তাঁর মধ্যে ছিল এক আভিজাত্য। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে যেমন আমরা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখি বৈচিত্র্যময় একাধিক চরিত্রে, তেমনই নির্মলকুমারকে তপন সিংহের ছবির নানান ভূমিকায় দেখেছেন দর্শকেরা। তপনবাবুর উপহার, আপনজন, আদালত ও একটি মেয়ে, বাঞ্ছারামের বাগান, আঁধার পেরিয়ে, রাজা, বৈদুর্য্য রহস্য, আতঙ্ক, হুইল চেয়ার, আজব গাঁয়ের আজব কথা, অন্তর্ধান, সবুজ দ্বীপের রাজা ইত্যাদি ছবিগুলিতে। নিজের সম্পর্কে কোনওদিনই তিনি প্রচার করে বেড়াননি। (Nirmal Kumar)

যখন যে কাজ এসেছে, সেটা করেছেন। পরিণত বয়েসের একটা সময়ে পৌঁছে চলচ্চিত্র জগৎ থেকে অবসর নিয়েছেন। এমনকি নিজের বিষয়ে কোনও মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতেও সহজে রাজি হতেন না। তপনদা মানে তপন সিংহর মাধ্যমেই নির্মলদার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ২০০০ সালে। তপনদার বিষয়ে, ‘অনুভবে তপন সিংহ’ শীর্ষক একটি বইয়ের কাজ করতে গিয়ে, নির্মলদার সঙ্গে পরিচয়। আগেই বলেছি উনি সহজে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হতেন না কিন্তু বিষয়টা তপন সিংহ কেন্দ্রীক শুনে এক কথায় সম্মতি দিলেন। সেই সূত্রে ওঁর বাড়িতে গেলে যত না সাক্ষাৎকার দিলেন তার থেকেও বেশি আড্ডা দিলেন। কত কথা, কত স্মৃতিচারণ, কত গল্প। সেইসব কথায় ও গল্পে তপন সিংহ ছাড়াও এল রাধামোহন ভট্টাচার্য, তরুণ মজুমদার, উত্তমকুমার, সত্যজিৎ রায়, দীপ্তি রায়, মধু বসুর প্রসঙ্গ। শুটিং-এর নেপথ্যের হাজারও গল্প। (Nirmal Kumar)

নির্মলদা ছিলেন তপনদার খুব কাছের একজন মানুষ এবং বন্ধুস্থানীয়। দু’জনের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ছিল দেখার মতো। একবার কলকাতার চ্যাপলিন হলে বিমল রায় মেমোরিয়াল কমিটির এক অনুষ্ঠানে বিমল রায়ের কন্যা রিঙ্কি ভট্টাচার্যের ইচ্ছে তপনদাকে নিয়ে আসার কিন্তু তপনদা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না কারণ ওঁর শারীরিক অসুস্থতার জন্য যদি কেউ অসুবিধায় পড়েন, সেই কারণেই উনি বেশি কোথাও যেতে চাইতেন না। (Nirmal Kumar)
পার্থদা আমায় বললেন, ‘পুরো বিষয়টা নির্মলদাকে জানাও, উনি বললে তপনদা মনে হয় রাজি হবেন আর সম্ভবত উনি গেলে নির্মলদার সঙ্গেই যাবেন। তবে আমি তোমায় এ কথা বলেছি, সেটা নির্মলদাকে বলার দরকার নেই।’
অভিনেতা এবং তপনদার আরও একজন স্নেহভাজন পার্থ মুখোপাধ্যায়কে জানালাম, রিঙ্কি ভট্টাচার্য তপনদাকে বিমল রায়ের স্মৃতি পুরস্কার দিতে চাইছেন কিন্তু তপনদা বাড়ির বাইরে কোথাও গিয়ে পুরস্কার গ্রহণ করতে নারাজ। সেই সময় উনি কিছুটা অসুস্থও ছিলেন। পার্থদা আমায় বললেন, ‘পুরো বিষয়টা নির্মলদাকে জানাও, উনি বললে তপনদা মনে হয় রাজি হবেন আর সম্ভবত উনি গেলে নির্মলদার সঙ্গেই যাবেন। তবে আমি তোমায় এ কথা বলেছি, সেটা নির্মলদাকে বলার দরকার নেই।’ (Nirmal Kumar)

আমি পার্থদার কথা অনুযায়ী নির্মলদাকে পুরো ব্যাপারটা জানাবার পরে ওঁর সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘ঠিক আছে, দেখছি, কি করা যায়।’ বিকেলে অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি ঠিক সময় মতো নির্মলদার সঙ্গে তপনদা এসে হাজির। এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায় নির্মলদা তপনদার কতটা কাছের ছিলেন। উনি যেমন তপন সিংহর ছবিতে কাজ করেছেন তেমন আবার তপনদার ছবিতে ভাষ্যপাঠের কাজও করেছেন। ছবি কাবুলিওয়ালা, প্রথম দৃশ্য, পাহাড়ী পথ দিয়ে লাইন করে একদল উট হেঁটে চলেছে, তার সঙ্গে সামঞ্জশ্য রেখে ভাস্যপাঠ, ‘কাবুল, কান্দাহর থেকে উটের দল এগিয়ে চলেছে হিন্দুস্তানের দিকে, যেখানে আকাশ হতে আকাশে তার ছুটোছুটি।’ গলাটি ছিল নির্মলদার। (Nirmal Kumar)

যখনই নির্মলদার সঙ্গে দেখা হয়, তখনই পুরোনো গল্প আর স্মৃতিচারণ! কয়েক বছর আগে ‘চৌরঙ্গী’ পত্রিকা বিশেষ নির্মলকুমার সংখ্যা প্রকাশ করে নির্জণ একক নির্মলকুমারকে পৌঁছে দিয়েছে সবার কাছে। করোনাকালে ওঁর বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে দেখেছি নিজের বাড়ির বারান্দায় আনমনে নির্মলদা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আজও যখনই ওঁর কাছে যাই, তখনই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ‘ক্ষণিকের অতিথি’ ছবির বিভিন্ন দৃশ্য। যেখানে অন্তহীন ধূসর পথ দিয়ে বাস এগিয়ে চলেছে তিলপাড়া, সিউড়ি, দুবরাজপুরের দিকে, সেই পথের পাশে এক নির্জণ গ্রামীণ হাসপাতালের ডাক্তার নির্মলদা। (Nirmal Kumar)

সেখানেই একদিন এসে পৌঁছালো তাঁর জীবনের ফেলে আসা প্রেম! সেই প্রেমের কোনও পরিণতি ছিল না কিন্তু বালি ব্রিজের ওপর দুই মানব-মানবীর ভালোবাসা অটুট ছিল! আকাশবাণীর নির্মলকুমারকে আমি দেখিনি কিন্তু যৌবনের কোনও এক বিকেলে গড়িয়াহাটের ভিড়ে একজনকে দেখে চোখ আটকে গেল, কিছু সময়ের পরে বুঝলাম উনি নির্মলকুমার! এখনও যখন শীতের সন্ধায় ওঁর জন্মদিনে শুভেচ্ছা আর প্রণাম জানাতে যাই, তখন কিছু কিছু কথা হয় ৯৭টি বসন্ত পেরিয়ে আসা মানুষটির সঙ্গে। এখন মনে একটাই আকাঙ্খা। নির্মলদার উপস্থিতিতে আর মাত্র দু’বছর পরে যেন ওঁর ১০০তম জন্মদিনটা পালন করতে পারি। স্বর্ণযুগের বাংলা ছবির তিনিই একমাত্র প্রতিনিধি যিনি আজও আমাদের মধ্যে রয়েছেন। (Nirmal Kumar)
ছবি ঋণ: লেখক
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।
