(Israel-Palestine)
যুদ্ধ হচ্ছে। মরছে মানুষ। মৃত সাগরের এক অচিন আকাশের নিচে। জগৎ চলছে নিজের ছন্দে। যার ঘরে যন্ত্রণা, দুঃখ তার। যার দেশে হাহাকার, শোক তার। সমাজ মাধ্যমে আসছে টুকিটাকি খবর, ছবিও। কিন্তু জীবন জোয়ারের মুখে ভেসে যাচ্ছে তা খড়-কুটোর মতো। আবার সোচ্চারে মুখ খুললেও সমস্যা। এম.আই.টি.র মেঘা ভেমুরি অন্যায়ভাবে বিতাড়িতা হল তার সমাবর্তন অনুষ্ঠান থেকে, শুধু প্যালেস্টাইনকে সমর্থনের জন্য! (Israel-Palestine)
আরও পড়ুন: রানিক্ষেতের দেড়শ বছরের হোম ফার্ম হেরিটেজ
দীর্ঘ বৈরির ইতিহাস ইজরায়েল-প্যালেস্টাইনের। আরম্ভ হয়েছিল ব্রিটিশের আগ্রহে উনিশ শতকের শেষার্ধে, ইহুদিদের তাদের নিজের দেশ দেওয়ার জন্য। ব্রিটেনের সমর্থনে ইজরাইলিরা দখলদারি নিলে বিরোধিতা বাধে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে। ১৯৪৭-এ ইজরায়েল ও প্যালেস্টাইনের সীমানা ভাগ হলে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ১৯৪৮-এ যুদ্ধ শেষে তারা অর্ধেকের বেশি প্যালেস্তানীদের তাড়িয়ে দেয় সে দেশ থেকে। গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক মিশর ও জর্ডানের আয়ত্তে ছিল, ১৯৬৭-র ছয় দিনের যুদ্ধে সেগুলিরও দখল নেয় ইজরায়েল। (Israel-Palestine)

অশান্তি চলতেই থাকে। এদিকে আক্রমণাত্মক ইজরায়েল তার সামরিক বাহিনী তৈরির পাশাপাশি সাজিয়ে তুলতে থাকে শত্রুপক্ষ থেকে বাজেয়াপ্ত অংশকেও। আমার পরিচিত একজন ওয়াইজম্যান ইনস্টিটিউট থেকে যাওয়া রিট্রিটে, জর্ডন নদীর ধারের পাহাড়ি উপত্যকার গোলান হাইটসে রাত কাটিয়েছিল এক বিশাল বিলাসবহুল সাততারা রিসোর্টে। অপরদিকে সামরিক বাহিনীও তৈরি করে এমন করে, যা না দেখলে বিশ্বাসযোগ্য নয়। সে দেশের প্রত্যেকটি ১৮ থেকে ২৬ বছরের ছেলে ও মেয়েকে বাধ্যতামূলকভাবে মিলিটারি ট্রেনিং নিতে হয়, কোনও অজুহাতে সেখানে ছাড় নেই। আমি তেল অভিভের নানা জায়গায় এমন বহু সুন্দরী ইহুদি মেয়ে ও ছেলেদের পুরোদস্তুর মিলিটারি ইউনিফর্মে আসা যাওয়া করতে দেখেছি। যুদ্ধের সাজেই থাকে ইজরায়েল। অকারণে আকাশে প্লেনের কুচকাওয়াজ চলে। থেকে থেকে বেজে ওঠে সাইরেন। এ কয়েকবছর আগের অভিজ্ঞতা। (Israel-Palestine)
“সেই যুদ্ধ আর যেন থামে না, দিন মাস বছর পেরিয়ে যায়। নির্মমভাবে মারছে প্যালেস্টাইনিদের। প্রায় পঞ্চান্ন হাজার সাধারণ মানুষকে মেরেছে তারা। “
তার পাশে রয়েছে বজ্র আঁটুনি নিরাপত্তা। তাদের সাধের ওয়াইজম্যান ইনস্টিটিউট শলাখার বেড়াজালে ঘেরা। মিলিটারি পাহারার মূল গেট বাদে অন্য সব বড় লোহার গেট বন্ধ। ওখানের শিক্ষক ছাত্রদের কাছে ম্যাগনেটিক কার্ড থাকে, যার সাহায্যে একপাশের ছোট্ট লৌহকপাট অল্প ফাঁক হয়, কোনওরকমে একজন মানুষ ঢোকার মতন। সে আবার অন্যকে দিলে তার সঙ্গী ঢুকবে। তাড়াহুড়োয় নিজের কার্ড ভুলে এসে কতসময় অপরিচিত কাউকে দাঁড়িয়ে অন্যের কার্ড নিয়ে ঢুকতে চাওয়ার অনুনয় করতে দেখেছি। আর দেখেছি শহরতলীর ছোট্ট রিওভট স্টেশনে টিকিট কেটে ট্রেনে চড়তে যাওয়ার আগে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো কড়া সিকিউরিটির বেড়াজাল। এমন আরও কত কিছু! (Israel-Palestine)

সেই ইজরায়েলে আবার হামাসের জঙ্গি হামলা হল ৭ অক্টোবর ২০২৩-এ। যে দেশ ছুঁচও গলতে দেয় না সহজে, সেখানে এ ঘটনা ঘটল কেমন করে? তবে কি এ হেন নিরাপত্তার ঘেরাটোপেও অভ্যন্তরীণ বুদ্ধিমত্তা বিফল হল? সেই যুদ্ধ আর যেন থামে না, দিন মাস বছর পেরিয়ে যায়। নির্মমভাবে মারছে প্যালেস্টাইনিদের। প্রায় পঞ্চান্ন হাজার সাধারণ মানুষকে মেরেছে তারা। আহত অসংখ্য। গাজা শহরের ছবি দেখলে পারমাণবিক বোমায় নিঃশেষিত হিরোশিমা বলে ভ্রম হয়। (Israel-Palestine)
“‘হোলোকাস্ট’কে সামনে রেখে ইজরায়েল ও ইহুদিরা বিশ্বের অনেক সহানুভূতি কুড়িয়েছে, অথচ বহুদিন যাবৎ নিজেরাই তার পুনরাবৃত্তি করছে না কি? একেই হয়তো বলে ‘প্যারাডক্স’!”
মানবতার প্রতিমূর্তি যিশুর কথা মনে করলে তাঁর বংশোদ্ভূত এই অদ্ভুত প্রজাতির কথা চিন্তায় ফেলে। সাহিত্য জগতের মহীরুহ শেক্সপিয়র দুনিয়ায় এত জাতি থাকতে কেন ইহুদিকেই শাইলকের জন্য বেছে নিয়েছিলেন? কেনই বা হিটলারের জাত আক্রোশ জন্মেছিল শুধু এই প্রজাতির প্রতি, যাদের নির্বংশ করার রোখ তাকে আরও টেনে নিয়ে গিয়েছিল পতনের দিকে! বাইবেলে বর্ণিত ইহুদিদের পূর্বপুরুষের জমির সূত্র ধরে এ দেশে এলেও এই ইহুদিরাই যিশুকে ধরিয়ে দিয়েছিল শত্রুর হাতে। যিশুকে কেন্দ্র করে তাদের কোনও সংবেদনশীলতা নেই। আমার থাকাকালীন সেবার ইস্টারের পাশাপাশি তাদের পেশা (পাসওভার) উৎসবে দেখেছি মদ মাংস সহযোগে, সানন্দে পালন করতে। (Israel-Palestine)

এমনিতে বুদ্ধিমান ও সপ্রতিভ জাতি ইহুদিদের ভিতরের সেই আদিম ক্রুরতার প্রতিফলনই যেন দেখা দিয়েছে এই যুদ্ধে। ঘৃণ্য পরিসরে নিয়ে গেছে তারা একে। মানুষ মারছে নানা প্রক্রিয়ায়। খাদ্য বন্ধ করে আকালের সৃষ্টি করেছে। হাজারে হাজারে বাচ্চারা অভুক্ত থেকে প্রাণ হারাচ্ছে। ত্রাণ দেওয়ার অছিলায় ডাকছে। ত্রাণের বাটি সামনে ধরলে জুটছে গুলি, মৃত্যু। হাসপাতাল লক্ষ্য করে করে বোমাবর্ষণ করেছে। হাসপাতাল পরিষেবা নিঃশেষিত। ভষ্মে ঢেকে দিয়েছে শত্রুদেশকে। মদত রয়েছে আমেরিকার। তাই আরও বেপরোয়া, আই.সি.জে.-র মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার কথাও মানছে না। উদ্দেশ্য একটা আছে বৈকি। এদের পিষে শেষ করে সবটা জবর দখল করার। বিশেষজ্ঞদের মতে এটা যুদ্ধ নয়, ‘জেনোসাইড’! (Israel-Palestine)
‘হোলোকাস্ট’কে সামনে রেখে ইজরায়েল ও ইহুদিরা বিশ্বের অনেক সহানুভূতি কুড়িয়েছে, অথচ বহুদিন যাবৎ নিজেরাই তার পুনরাবৃত্তি করছে না কি? একেই হয়তো বলে ‘প্যারাডক্স’! (Israel-Palestine)
আরও পড়ুন: অপরাজেয় ডাক্তার হৈমবতী সেন
এভাবেই কি শেষ হয়ে যাবে সব? জানা নেই। তবে একটা আশার রশ্মি দেখা দিচ্ছে। অশান্তি বাঁধছে ইজরায়েলের নিজেদের মধ্যে। অনেক অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা আর মিলিটারি ট্রেনিং নিতে চাইছে না। এর জন্য তাদের পড়াশোনার বয়সও পিছিয়ে যায়। তা সে যাই হোক, তারা আপোষ করতে চাইছে না আর। তাহলে কি এই অভ্যন্তরীণ বগাবতই একদিন থামাতে বাধ্য করবে ইজরায়েলিদের নৃশংসতাকে? সত্যিই কি বিচার হবে কোনওদিন, মানবতার দরবারে? (Israel-Palestine)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
বিশ্বভারতী থেকে ভূগোলে স্নাতকোত্তর ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট।
পেশায় লেখক। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত বাংলা ও ইংরেজি পত্র পত্রিকায় নিয়মিত লেখা প্রকাশ। তা ছাড়া পনেরটি বাংলা ও একটি ইংরেজি বই প্রকাশিত। বিবেকানন্দ-নিবেদিতা গবেষক। এই বিষয়ে এবং আরো অন্যান্য বিষয়ে আমন্ত্রিত বক্তৃতা দিয়ে থাকেন।