(KIFF)
বারো মাসে তেরো নয়, বরং পার্বণের সংখ্যা বেড়ে চোদ্দো, পনেরো অথবা ষোলো। অসংখ্য মানুষের যাতায়াত-চলাচলের ভিতর দিয়ে অতিক্রান্ত আরেকটি পর্ব। আবারও শুরু অপেক্ষার, কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। প্রতিবছর অসংখ্য সিনেমাপ্রেমী বা অপ্রেমী, চলচ্চিত্র সমালোচক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, নবীন ও প্রবীণ পরিচালক থেকে শুরু করে বহু বহু মানুষের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ প্রশ্রয়ে কেটে যায় একটি সপ্তাহ। কলকাতায় শীত আসন্ন। প্রাক্শীতের মরসুমে ৩১-তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব বা KIFF পরিপূর্ণ হল বহু দেশের চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক আবহে। নভেম্বরের ৬ থেকে ১৩, উৎসবের উদ্বোধন থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত নানা মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইল কল্লোলিনী। (KIFF)
কখনও গড়িয়াটার মোড় না হলেও নন্দন চত্বরে অপেক্ষার সংখ্যাটা চোখে পড়ার মতো। প্রতিবছর সাধারণত যে যে প্রেক্ষাগৃহে সিনেমার প্রদর্শনী হয়, এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। অর্থাৎ; নন্দন ১, ২ এবং ৩, শিশিরমঞ্চ, রবীন্দ্রসদন— এই কয়টি হলে সিনেমা প্রদর্শনী তো হল বটেই, এর বাইরে আইনক্স সাউথ সিটি, পিভিআর মানি স্কোয়ার, নবীনা, রাধা স্টুডিও, বিনোদিনী থিয়েটার, নজরুল তীর্থ, রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবনের মতো বেশ উল্লেখযোগ্য কিছু প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হল দেশ বিদেশের হরেক কিসিমের ছবি। ফোকাল কান্ট্রি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছিলো পোল্যান্ডকে। (KIFF)
আরও পড়ুন: খসে পড়া তারা অথবা পুনর্জন্মের গল্প
লাইনে বহু মানুষের ভিড়, কারও গলায় ডেলিগেট কার্ড তো কেউ বা গেস্ট কিংবা জুরি মেম্বার। নবীন থেকে প্রবীণ, কার্ড যাঁরা পেলেন না, তাঁদের লম্বা লাইন পাস তোলার। লাইনের ভিতরে প্রেম, মান-অভিমানের পালা। অনেকেই বেলাইনে নিজেদের জায়গা নিশ্চিত করতে চাইলেন। তাতে বিতর্ক বাড়ল, দীর্ঘ কথা কাটাকাটি বা সাময়িক হাতাহাতিও বাদ গেল না! কেউ এরই মাঝে নিজের জায়গা পাকা করে নিতে সফল হলেন! সিনেমার ব্যাকরণ নিয়ে কিছু মানুষ ব্যস্ত, কিছু মানুষ তালিকা দেখে স্থির করলেন, কী দেখবেন এবং কী দেখবেন না। দেখা না দেখার মাঝে রয়ে গেল কিছু অমীমাংসিত প্রশ্নচিহ্ন। (KIFF)

প্রেক্ষাগৃহ পরিপূর্ণ, তিল ধারণের জায়গা নেই। তারই মাঝে কিছু নির্দিষ্ট আসন সংরক্ষিত জুরি মেম্বারদের জন্য। অবশ্য এই নিয়ম নতুন নয়, প্রতিবারে এমনই হয়। সিটের ভিতর অনেকটা যেন মিউজিকাল চেয়ার, কে আগে কোথায় গিয়ে বসতে পারে। তারপর কার জন্য জায়গা রাখা হল এবং কার জন্য হল না, সে নিয়ে কিছু অমীমাংসিত বাক-বিতণ্ডা। এভাবেই কিছু সময় কেটে যাওয়ার পর আলো নিভে যায় আস্তে আস্তে। জাতীয় সংগীত শুরু হওয়ার সময় কেউ কেউ চেয়ার ছেড়ে উঠতে চান না অবশ্য তাঁর বা তাঁদের পাশে বসা বিদেশিরা সম্মান জানাতে উঠে দাঁড়ান অনায়াসেই। আর আমরা বাঙালিরা তর্ক করি কেন সিনেমা হলে জাতীয় সংগীত বাজবে এবং সুপ্রিম কোর্ট কী রায় দিয়েছে সেই নিয়ে। এরপর থিম মিউজিক। সিনেমা শুরু হবে, তারই আগে ভেসে ওঠে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর মুখ এবং তাতে নবীন-নবীনাদের ব্যাপক টিটকিরি। (KIFF)

এইসব পর্ব-পর্বান্তর পেরিয়ে অবশেষে আসে সিনেমা দেখার পালা। তবে এখানেই শেষ হয় না; সিনেমা দেখার মাঝেই এক শ্রেণির দর্শক ছবি এবং ভিডিও তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেউ বাড়িতে নির্দেশ দেন, খাবার কোথায় রাখা আছে এবং রাতে কী রান্না হবে বা হতে পারে। কেউ কেউ আবার দৃশ্য বিশ্লেষণে বসেন, কোথায় কোন ক্যামেরা বসানো হয়েছে, ট্রলি ব্যবহার করা হয়েছে কি না, কোন দৃশ্য একেবারেই অবান্তর— এমন চুলচেরা বিশ্লেষণ চলতে থাকে ৩১-তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। সাবটাইটেল দেখতে দেখতে ক্লান্ত মনে হলে পাশের কারও নাক ডাকার আওয়াজ নিমেষে ক্লান্তি দূর করে দিতে পারে। (KIFF)
“সংখ্যালঘু মহিলাদের ভিতর শিক্ষা বিস্তার না হওয়া থেকে শুরু করে বিবাহ পরবর্তী পড়াশোনা, ধর্মীয় প্রভাবের মতো অতি প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় উঠে এসেছে এই চলচ্চিত্রে।”
আপাতভাবে একেই বলা চলে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের চরিত্র। KIFF যখন আসবে তখন নন্দন চত্বরে একেবারে সাজো সাজো রব। মুক্তমঞ্চে গানের অনুষ্ঠান, বাহারি ফুলের টব, খাবারের রকমারি আয়োজন, বইয়ের বিভিন্ন স্টল এবং ছবি তোলার হরেক কিসিমের ব্যবস্থা। কলকাতা এখনও কতটা রঙিন, তার একটা নজির অবশ্যই এই চলচ্চিত্র উৎসব। নভেম্বরের একটি সপ্তাহ যেন সহজেই অনেক মনখারাপের উপশম হয়ে ওঠে। (KIFF)

কয়েকটা দিন, হাজারো কাজের মাঝে যে যে সিনেমা ভাবিয়েছে, তাদের প্রসঙ্গে আসি। Francois Ozon-এর পরিচালনায় ফ্রান্সের চলচ্চিত্র ‘The Stranger’, আলবের কাম্যুর ‘The Outsider’ অবলম্বনে। ১২০ মিনিটের চলচ্চিত্র, ২০২৫-এ তৈরি হলেও মূল গল্পের সময়কে অবলম্বন করে সাদাকালো রঙের ব্যবহারে এক অদ্ভুত নির্মাণ। অনেকদিন পরে আবার সেই পুরোনো সময়ে নিয়ে যাওয়ার, টাইম ট্রাভেল হল বলে মনে হয়। তেমনই Alvaro Oimos Torrico-র নির্দেশনায় নির্মিত ছবি ‘The Condor Daughter’। এটিও ২০২৫-এর চলচ্চিত্র, সময় ১০৯ মিনিট। (KIFF)

সমসাময়িক প্রেক্ষাপটকে প্রাসঙ্গিক রেখেও বলিভিয়ার একটি জনজাতির বিশ্বাস কীভাবে সমাজে কার্যকরী হয়ে ওঠে, তার নির্মেদ রূপায়ন এই সিনেমাটি। স্বল্পদৈর্ঘ্যের সিনেমার ভিতর মহম্মদ জুলকামেন আহমেদের নির্দেশনায় ৪১ মিনিটের ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘Qubool Hain’ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক তুলে ধরেছে। সংখ্যালঘু মহিলাদের ভিতর শিক্ষা বিস্তার না হওয়া থেকে শুরু করে বিবাহ পরবর্তী পড়াশোনা, ধর্মীয় প্রভাবের মতো অতি প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় উঠে এসেছে এই চলচ্চিত্রে। প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য নির্দেশিত ‘নধরের ভেলা’ দেখার সুযোগ না হলেও আলোচনা থেকে সিনেমাটির বিষয়ে প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়েছে। শেষদিন জুরি নমিনেটেড সিনেমা হিসেবে David Bim-এর নির্দেশিত কিউবার চলচ্চিত্র ‘To The West In Zapata’ মন ছুঁয়েছে। মাত্র ৭৯ মিনিটের এই সিনেমায় ক্যামেরার ব্যবহারে কিছু দৃশ্য বহুদিন মনে থেকে যাবে। স্বল্পসময়েও যে কত কথাই বলা যায়, তার যথার্থ উপস্থাপন এই চলচ্চিত্র।
“যেহেতু উৎসবের কেন্দ্রস্বরূপ নন্দন ১-কেই প্রতিবছর ধরা হয়, তাই এই প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের ভিড়ও স্বভাবতই অনেক বেশি থাকে।”
সমসাময়িক পোলিশ সিনেমাগুলির ভিতর যে যে সিনেমা প্রদর্শিত হল, নজর কাড়ল, তার ভিতর উল্লেখযোগ্য ‘Chopin, A Sonata In Paris’, ‘On The Silver Globe’, ‘The Doll’-এর মতো বেশকিছু সিনেমা। কেবল পোলিশ সিনেমা নয় ইতালি, তিউনেশিয়া, ফ্রান্স, কিউবা, ইরান, জাপান, বলিভিয়াসহ বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ সমসাময়িক চলচ্চিত্রের নির্বাচন এবং প্রদর্শন অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। সরাসরি পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ, ফিল্ম তৈরির প্রেক্ষাপট, সেমিনারসহ নানা বিষয়ে সমৃদ্ধ হলেন বহু দর্শক, শ্রোতা। নন্দন ১-এর কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করতেই হয়। (KIFF)

পূর্ণদৈর্ঘ্যের সারা পৃথিবী থেকে নির্বাচিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হল নন্দন ১-এ। যেহেতু উৎসবের কেন্দ্রস্বরূপ নন্দন ১-কেই প্রতিবছর ধরা হয়, তাই এই প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের ভিড়ও স্বভাবতই অনেক বেশি থাকে। ৩১-তম চলচ্চিত্র উৎসবেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ৭ থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত সকাল ৯টা, বেলা ১১টা ৩০, দুপুর ২টো, বিকেল ৪টে ৩০ এবং সন্ধ্যে ৭টা; এই পাঁচটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রদর্শিত হল দেশ বিদেশের সিনেমা। নন্দন চত্বর হিসেবে পরিচিত যে এলাকাটি, সেখানে নন্দন ১ ব্যতীত নন্দন ২ এবং রবীন্দ্রসদনেও পূর্ণদৈর্ঘ্যের গুরত্বপূর্ণ কিছু সিনেমার ভিতর চিনের ‘Chang An Xian’ কিংবা জাপানের ‘Love On Trial’-এর কথা আলাদাভাবে বলা যেতে পারে। (KIFF)
আরও পড়ুন: স্বপ্নের চারাগাছে জল দেওয়ার গল্প ‘অঙ্ক কি কঠিন’
শিশিরমঞ্চ ও নন্দন ৩-এ বহু স্বল্প দৈর্ঘ্যের ফিল্মের প্রদর্শনী অবশ্যই নজর কেড়েছে। এরই সাথে উপরি পাওনা, প্রতিদিনের সিনেমা ও সিনেমা বিষয়ক আলোচনা সমৃদ্ধ রঙিন বুলেটিন। দেশ-বিদেশের সিনেমা ও সিনেমা বিষয়ক কাজের সম্পর্কে ধারণা তৈরিতে এই বুলেটিনগুলি অনবদ্য। (KIFF)
এক উৎসবের সমাপ্তি মানেই আরেক উৎসবের অপেক্ষা। কল্লোলিনীর ভিতর কিছু মানুষের ভিড়, আবারও ঠিক একটা বছর। প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের উত্তরণ। রঙিন শহরের বুকে দাপিয়ে বেড়াবে নবীন-প্রবীণের দল। সিনেমাকে ভালোবেসে সেই উৎসবে সামিল হব আমরা বা আমাদেরই মতো অনেকে। ভাবী প্রজন্মকে জানিয়ে দেব, আমাদের এক কলকাতা আছে, আছে সেই কলকাতা চলচ্চিত্রের কলকাতা আর তার ভিতর বসত করে এক অভূতপূর্ব উৎসব। (KIFF)
ডিজিটাল ও মুদ্রিত মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
বিতান দে, বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, অনুরাগী ও পাঠক। খাদ্য সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি ভালোবাসেন সিনেমা দেখতে ও খেলাধূলার চর্চা করতে। প্রকাশনা এবং কপি এডিটের নেশাকে পেশায় রূপদানের চেষ্টায় আছেন।
