সে এক অদ্ভুত মায়াবি, সুরেলা গ্রাম। এমনই সুন্দর, যেন পটে আঁকা। যেন রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা তার প্রতিটি আনাচ-কানাচ। ভোরের প্রথম আলো, মিছরির দানার মতো একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ে সেই গ্রাম জুড়ে। দূরে কোনও এক গুরুদ্বার থেকে ভেসে আসে ‘নামধারী’ কীর্তন…
সে গ্রামের দূরদূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে সর্ষের খেত। ফুটে থাকে সূর্যমুখী ফুল। এমন তীব্র হলুদ, যেন চোখ ঝলসে যায়৷ মাথার উপর গাঢ় নীল আকাশ। শরৎকালের পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাতাসে ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ। ধানের খেতে সরে সরে যায় মেঘের ছায়া। সেই অগ্নিবর্ণ সর্ষে খেতের মাঝে একফালি জমি। তার উপর বানানো ছোট্ট একটি বেদি।
[the_ad id=”266918″]
বেদির উপর সেতার হাতে বসে আছে এক বালক। অজিত সিং নামধারী। কতই বা বয়স তার! নয় কী দশ… রেওয়াজে বসেছে ছোট ছেলেটি। তার পরনে সাদা কুর্তা পায়জামা। মাথায় ছোট্ট, সাদা পাগড়ি। একা একাই সেতার হাতে রেওয়াজে বসেছে সে। ছোট্ট অজিতের কচি কচি আঙুলের ছোঁয়ায় কখনও ধরা দেয় ভৈরবী, কখনও বা গুর্জরি টোড়ি, ভাটিয়ার। সেই সুর পাক খায় আকাশে-বাতাসে। যেন সকাল অনুমতি পেল এই গ্রামে প্রবেশের। ছোটে ওস্তাদের সে দিকে খেয়াল নেই। সেতারের মীড় টেনে এবার সে ছুঁয়ে ফেলে কোমল ঋষভ আশাবরী…
***
পঞ্চ আব বা পাঁচটি নদীর দেশ পঞ্জাব। গুরু নানক, ভাই মর্দানা, গোবিন্দ সিং, বুল্লে শাহ, বাবা ফরিদের রাজ্য পঞ্জাব। তারই উত্তরে পঞ্জাবের ‘ম্যাঞ্চেস্টার’, শিল্পনগরী লুধিয়ানা। লুধিয়ানার ৩০ কিমি উত্তরে রয়েছে ছোট্ট সেই গ্রাম- শ্রী ভৈনী সাহিব। সেই গ্রাম, যার আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়ায় রাগ-রাগিণী… শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সে গ্রামের প্রতিটি বাড়ি, বাড়ির সদস্য, আট থেকে আশি, সকলেই গান গায়, বাজনা বাজায়, হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তাদের করায়ত্ত। আজ থেকে নয়, একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন “ভৈনী সাহিব”-এর বাসিন্দারা। “সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানে চলিতেছে।”
[the_ad id=”266919″]
শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি যে, লুধিয়ানার এই ছোট্ট জনপদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে শাস্ত্রীয় সংগীতের আবহ। ভৈনী সাহিবে এমন কোনও বাড়ি পাওয়া যাবে না, যেখানে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম দেওয়া হয় না। ‘নামধারী‘ শিখ সম্প্রদায়ের মানুষরা থাকেন এই গ্রামে। নামধারীদের সাধনার কেন্দ্রে নিহিত রয়েছে সংগীত। তাই আজও কোনও বাড়িতে শিশু জন্মালে, একটু বড় হতেই তার হাতে তুলে দেওয়া হয় তারই পছন্দের বাদ্যযন্ত্র। তাতে হারমনিয়াম, তবলা, খঞ্জনি, মঞ্জিরা, সেতার, তারসানাই, দিলরুবা, বাঁশি, রবাব, সরোদ কী নেই… এ এক অদ্ভুত সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য।

এখানকার মানুষ চলতে ফিরতে, উঠতে বসতে শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চা করেন। ভৈনী সাহিবে বসবাসকারী সাধারণ কৃষক বা দোকানদার, সুদের ব্যবসায়ী বা শিক্ষক, ক্রীড়াবিদ বা সাংস্কৃতিক কর্মী এমনকি সহায়সম্বলহীন কপর্দকশূন্য কোনও মানুষ বা পহেলওয়ান – সমাজের সর্বস্তরের প্রতিনিধিদের কণ্ঠে নিত্য-নৈমিত্তিকভাবে ধ্বনিত হয় চেনা অচেনা রাগ-রাগিনীর সুরমূর্চ্ছনা। পিছিয়ে নেই খুদেরাও। ছোট বয়স থেকেই তাদের দেওয়া হয় শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম। আজ থেকে নয়, বিগত ১০০-২০০ বছর ধরে চলে আসছে এই নিয়ম। নারী বা পুরুষ, শিশু বা বৃদ্ধ, ধনী বা দরিদ্র – শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম এই গ্রামে সকলের জন্য বাধ্যতামূলক। ‘নামধারী’ সম্প্রদায়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে সংগীত৷ আর তাই প্রবাহিত হয়ে চলেছে এই সুরপাগল গ্রামটির মধ্যে। বড় তো বটেই, গ্রামের খুদে সদস্যরাও এই নিয়ম মেনে চলে। ভৈনী সাহিবের খুদে সদস্যদের জন্য দেওয়া রয়েছে কড়া নির্দেশ। পড়াশোনা, হোমটাস্ক ও খেলাধুলার বাইরে নিতে হবে তালিম। এ সবই পরিচালনা করা হয় নামধারী সম্প্রদায়ের সদর কার্যালয় গুরুদ্বারা ভৈনী সাহিব থেকেই। ভূভারতে এমন নজির বিরল।

নামধারীরা বিশ্বাস করেন, সংগীতের মাধ্যমে সম্ভব ঈশ্বর দর্শন। ভক্তিমার্গই শ্রেষ্ঠ মার্গ। সাধনার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হল সংগীত। একজন মানুষ, মনুষ্যতর হয়ে ওঠে সংগীতচর্চার মাধ্যমে। তাই সংগীতের সাধনা করা জরুরি। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় ভৈনী সাহিবে গড়ে ওঠে প্রথম নামধারী শিখ সম্প্রদায়ের আখড়া। সনাতনী শিখ ধর্মের ভাবাদর্শ থেকে পৃথক অবস্থান নামধারীদের। মূলতঃ শিখ সম্প্রদায়ের ‘শিখর’ বিন্যস্ত তাঁদের দশজন শ্রদ্ধেয় গুরুর মধ্যে। সম্প্রদায়ের প্রাণপুরুষ সন্ত গুরু নানক দেব থেকে গুরু গোবিন্দ সিং পর্যন্ত। কিন্তু নামধারীরা মনে করে থাকেন নন্দেদ-এর যুদ্ধে মোগলদের হাতে গুরু গোবিন্দ সিং প্রাণ হারাননি, তিনি প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। একইসঙ্গে তাঁর উত্তরসূরী রূপে শিখদের একাদশ গুরু রূপে নিযুক্ত করেছিলেন গুরু বালক সিং-কে৷
[the_ad id=”270084″]
এই সময় থেকেই পৃথক শিখ শাখা নামধারীদের উৎপত্তি। দ্বাদশ গুরু রাম সিং নামধারীদের মূল শাখা শ্রী ভৈনী সাহিবে নিয়ে আসেন। শুরু হয় নামধারীদের পথ চলা৷ রাম সিং-এর পর এই নামধারী শিখদের নেতৃত্ব দিয়েছেন সদগুরু হরি সিং, গুরু প্রতাপ সিং, গুরু জগজিৎ সিং ও বর্তমানে সদগুরু উদয় সিং। এই নামধারী শিখরা নিরামিষাশী, গো-রক্ষক ও সাদা পোশাক পরে থাকা পছন্দ করেন। সাদা পোশাকের পিছনেও রয়েছে এক অদ্ভুত তথ্য৷ দ্বাদশ নামধারী শিখ গুরু রাম সিং-কে ব্রিটিশরা রেঙ্গুনে (অধুনা মায়ানমার) নির্বাসন দেয়। নামধারীরা মনে করেন একদিন ‘ঘরে’ ফিরবেন রাম সিং। তাই তাঁর প্রতি সমবেদনা ও আবেগ প্রদর্শন তথা শান্তি, মৈত্রী ও সৌহার্দ্যের কথা স্মরণ করে সাদা কাপড় পরে থাকেন। তাঁদের ভজন কীর্তনের জন্য নামধারীদের “কুকা” বলেও ডাকা হয়।
***
সদগুরু প্রতাপ সিং সংগীতচর্চাকে কেন্দ্র করে এই প্রাচীন জনপদ গড়ে তোলেন। ভৈনী সাহিব বহু অশ্রুত ইতিহাসের সাক্ষী৷ একদা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন মুক্তমনা, সংগীতপ্রিয় নামধারীরা। ভৈনী সাহিবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শহিদ হয়েছেন বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী। শিখ সম্প্রদায়ের কাছে এর স্থানমাহাত্ম্য ব্যাপক। তাই এই স্থানেই নামধারীদের প্রধান উপাসনাস্থল গড়ে তোলেন প্রতাপ সিং। ১৯৫৯ সালে তাঁর মৃত্যুর পর ভৈনী সাহিবের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন তারই সুপুত্র সদগুরু জগজিৎ সিং। বাবার গড়ে তোলা সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প নেন তিনি।

নামধারীদের ধর্মগুরু জগজিৎ শিখ ধর্মের পরমশ্রদ্ধেয় ‘গুরু‘দের অন্যতম হওয়ার পাশাপাশি একজন উচ্চমানের শাস্ত্রীয় সংগীতকার৷ ‘দিলরুবা’য় (এস্রাজের সমগোত্রীয়) সিদ্ধহস্ত তিনি। বাবার মতো জগজিৎও ছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীতের এক উচ্চমানের সমঝদার, শিক্ষক ও পৃষ্ঠপোষক। সেই সময় বহু খ্যাতনামা শিল্পী, পণ্ডিত রবিশংকর, আলি আকবর খান, বিসমিল্লাহ খান, বিলায়েত খান, আমজাদ আলি খান, জাকির হোসেন, শিবকুমার শর্মা, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া ও পণ্ডিত বিরজু মহারাজজির মতো কিংবদন্তিদের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায় সংগীতের সফর৷ তাঁর পূর্বজদের মার্গ অনুসরণ করে ভৈনী সাহেবের জল মাটি বাতাসে হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীতের জাদু মিশিয়ে দেন। তাঁর প্রয়াণের পর সেই ‘ট্র্যাডিশন’ বর্তমান সদগুরু উদয় সিং কৃতিত্বের সঙ্গে বহন করে চলেছেন।
[the_ad id=”270085″]
একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে ভৈনী সাহিব, লুধিয়ানার অদূরে নামধারীদের ছোট্ট জনপদ, আজও সেই স্বর্ণালি সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। হয়ে উঠেছে ভারতের একমাত্র গ্রাম যেখানে সুর লয় তাল ও রাগদারিই শেষ কথা বলে। যেখানে আট থেকে আশি, নারী বা পুরুষ সকলে হিন্দুস্থানী মার্গ সংগীতের দিকপাল। গ্রামের শিশুরা পর্যন্ত এই সাধনায় ব্রতী। আজও ভৈনী সাহিবের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে রয়েছে প্রচলিত-অপ্রচলিত রাগ-রাগিনীর সুরালেখ্য। এই রকম “গানপাগল” গ্রাম ভূ-ভারতে দ্বিতীয় আছে কিনা তা বলা খুব মুশকিল। আজ যখন পঞ্জাবের লোকসংস্কৃতি মাদকাসক্ত, ভাঙড়া ও চটুল গানের চক্রব্যূহে ঢাকা পড়েছে, তখনই নতুন করে শাস্ত্রীয় সংগীতচর্চার একনিষ্ঠ, ঐকান্তিক, আধ্যাত্মিকতার জাদুস্পর্শে তার জীবনদর্শনে সার্থকতার নব্যপাঠ পড়াচ্ছে লুধিয়ানা থেকে মাত্র ৩০ কিমি দূরের এই ছোট্ট ‘নামধারী’ জনপদ- ভৈনী সাহিব।
পেশায় সাংবাদিক প্রসেনজিতের জন্ম ১৯৮১-তে। লেখালেখির শুরু কবিতা দিয়েই। ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের ফেলো, প্রসেনজিতের গবেষণার বিষয় রাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব ও সঙ্গীততত্ত্ব। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে লেখা। অবসরে ভালোবাসেন সরোদ বাজাতে, পুরনো চিঠি ও বই পড়তে।
2 Responses
সম্পূর্ণ নতুন তথ্য জানলাম সহজ ভাবে লেখা এই প্রতিবেদন থেকে।
এত আনন্দ হচ্ছে এই প্রতিবেদনটি পড়ে!
এমন গুমোট সময়ে কী প্রাণবন্ত একটি গ্রামের এই উৎকৃষ্ট সংস্কৃতির কথা জেনে ভীষণ ভালো লাগছে। আছে আছে… থাকবেও প্রেম…প্রাণ.. সঙ্গীত সুধা।