একটা বছর শেষ হয়ে এল, আরও একটা বছর। আলভিদা, ২০২০, আর দেখা হবে না। যদিও, আর দেখা না হওয়াই সমীচীন। তোমার মতো নিষ্ঠুর করোনা-বছর যেন না আসে আর। তবুও তো, চলে গেলে! বছর শেষ হয়ে কোথায় যায়? বছরদেরও কি একটা আর্কাইভ-নগর থাকে, যার অডিটোরিয়ামে বসে রি-ওয়াইন্ড করে দেখা যায় সেই ছায়াছবি, শুধরে নেওয়া যায় ছোটোখাট ভুল…. বছরদের কি থাকে এক আফটার-লাইফ, যেখানে পদার্পণ করলে জীবনের চরিত্ররা হাত নেড়ে উঠে কাছে এসে বলে — “এলে ? আবার এলে তবে আজ?” বছর একটা সময়কে ধরার নাম্বার, কিন্তু সময়কে কেউ কোনওদিন ধরতে পারে না।
[the_ad id=”270088″]
এই শীতল আলস্য, ঝিমধরা প্রাচীন বিকেলে শহরের শরীরে এঁকে দেয় কাটাকুটি-খেলা, কোন সে ডিসেম্বর থেকে উড়ে আসে কালো কার্ডিগান, হাত নেড়ে চলে যায় অচেনা আলোর দিকে। সব রাস্তা পাথুরে, সব গাছ জুনিপার মুখার্জি হয়ে গেছে এখানে। একটা ঠান্ডা, কালো, স্যাঁতস্যাঁতে বিকেল হারানো কাঠের বাংলোর বারান্দায় বসে মাউথ-অর্গ্যান বাজায়। ভেজা রাস্তায় ছায়া হাঁটে — লং কোট, চোখ অবধি নামানো টুপি, ঠোঁটে লম্বা সিগারেট, কারুর মুখ ঠিক করে দেখা যায় না, বিষণ্ণ নিয়নের নীচে জ্বলে-নেভে পুরনো লিপস্টিক, ওয়াইন শপের সামনে ‘কিউ’, কিন্তু ওয়াইন শপের ভেতরে কেউ নেই, কিছু নেই। শুধু সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লস্ট ক্রিসমাস; এই বড়দিনে, ছোট মন বড় করে দিন, যিশু – আমেন। মিথ্যে হাসির দিনে কেউ এসেছিল, সত্যি কান্নার দিনে, হেসে চলে গেছে, অদৃশ্য গ্রামোফোনে বেজে ওঠে তার কণ্ঠস্বর, একটা ভায়োলেট মাফলার শহরের স্কাইলাইন ছাড়িয়ে দূরে উড়ে যায়, উড়ে উড়ে মিলিয়ে যায় কোথাও — পাহাড়ি, গ্রামীণ হাটে কেনা সেই প্রিয় মাফলার, মৃদু আবদার — আজও মনে আছে…

একটা বটম’স আপ ডিসেম্বর থাম্বস আপ জানায় শহরকে, আর দূরের রেলব্রিজের ওপর তখন গোধূলিরঙা শার্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকে হারানো যুবক। দূরত্ব, বড় কঠিন এক পাহাড় — ট্রেক করে ফেলব মনে করলেও তত সহজে করা যায় না। যেমন হিপ-ফ্লাস্ক আর আইলাইনারের মধ্যে কোনও স্ট্র্যাপলেস যাতায়াত সহজে ধরা যায় না। এই পার্টি-সিজনে পকেটে জ্বরের ওষুধ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে বালক, ভিক্টোরিয়ার পরি তার মাথায় বুলিয়ে দেয় ম্যাজিক-পোশন, বলে– সেরে ওঠ…। গ্যালিফ স্ট্রিটের দিকে তখন উড়ে যায় অশরীরী ঘোড়া। একটা বটম’স আপ ডিসেম্বর আর একটা থাম্বস আপ শহরের মধ্যে একটা ডাকবাংলোপাড়া, একটা সাঁওতালি সন্ধে থাকে। শৈশবের লন্ঠন হাতে হেঁটে আসে দাদু, বীরভূমের লাল মাটি পেরিয়ে কেউ এসে দাঁড়ায় দেশের বাড়ির উঠোনে, কুয়ো থেকে জল তোলে চাঁদ। সামপ্লেস এলস থেকে রক্সি হয়ে যখন টাকিলা শট-সময় প্রাইভেট পার্টির দিকে গাড়ি ছোটাচ্ছে শিকড়হীন কলকাতা, তখন আঙুলের ডগায় এক ফোঁটা নুন নিয়ে শিকড়ের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকে মহাকাল। ওই নুনটুকু ছাড়া সমস্ত টাকিলা-চুমুক চিরতার জল হয়ে যায়, যার নুন খেয়েছে তাকেই হত্যা করে হেসে ওঠে ক্ষণজন্মা রোবট-জীবন…
[the_ad id=”270086″]
কী প্রমাণ এটা ২০২০ ছিল? হতে পারে এটা ছিল ১৯২০… বছরের শেষ দিনের এলানো রোদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে হয়, বছর এক জেদি, তার-কেটে যাওয়া প্রেমিকা, যে একবার গেলে আর ফিরে আসে না কখনও। পার্ক স্ট্রিটের ঝলমলে রাস্তায়, ভিড়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পাই, বহুদূরে স্কাইলাইন পেরিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চলে যাচ্ছে ভুবন সোমের ছায়া, একদিন অচানক যার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল ব্যস্ত শহরের অলি-গলি পেরিয়ে কৃষ্ণচূড়ার তলায়। সে কোন বছরের ধূসর ঠিকানা হয়ে রয়ে গেছে, তা আর মনে পড়ে না। নিউ ইয়ার্স ইভ, কালো ব্যাকলেস টপের দিকে লক্ষ রাখা রেড ওয়াইনের বোতল আর নাগরিক ডান্স-স্টেপের মধ্যে অদৃশ্য নাবিকের মতো দাঁড়িয়ে থাকে কেউ, কেউ ভাবে একটা বছর শেষ হয়ে কোথায় যায়, মহাকাল এক একটা বছরকে খেতে খেতে কি খেয়ে ফ্যালে মুখ, চুম্বন, আলোছায়া দিনের কার্নিশে পড়ে থাকা কান্না… এই আলোকিত রাস্তাঘাট, অলি-পাবের পুরোনো গেট-কিপার, পিটার ক্যাটের বাইরে একটু আলোর জন্যে দাঁড়িয়ে থাকা ‘কিউ’ — এই সবকিছু ছাড়িয়ে কেন মনে হয় আগামীকাল , কালো সানগ্লাস চোখে একটা ভাসমান মঞ্চে দাঁড়িয়ে গেয়ে উঠবেন স্টিভি ওয়ান্ডার – “নো নিউ ইয়ার্স ডে / টু সেলিব্রেট… নো ফার্স্ট অফ স্প্রিং / নো সং টু সিং / ইন ফ্যাক্ট ইটস জাস্ট আনাদার অর্ডিনারি ডে ….আই জাস্ট কলড টু সে আই লাভ ইউ / আই জাস্ট কলড টু সে হাউ মাচ আই কেয়ার …”
নাহ , স্টিভি ওয়ান্ডার কলকাতায় আসবেন না। একটা বছর শেষ করে আর একটা বছরে সবাই ঢুকে পড়ুন আনন্দ করতে করতে, এত ভেবে কী লাভ… হ্যাপি নিউ ইয়ার! তবে, একটু সামলে, মুখে মাস্ক, পকেটে স্যানিটাইজার — মানে আমাদের যুগল রক্ষাকবচ যেন থাকে। তারপর রাম ভরোসে, কিংবা যিশুর ভরসায়… সেরে ওঠ, নীল গ্রহ।
এই সময়ে যাঁরা বাংলা কবিতা লিখছেন , তাঁদের মধ্যে সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। সৌভিকের কাব্যভাষা স্বকীয় ও স্বতন্ত্র - নাগরিক বিষন্নতা , সমাজসচেতনতা , মাঝে মাঝে কালো ঠাট্টা বা শ্লেষ ও নস্টালজিয়া তাঁর কবিতায় নানাভাবে ফিরে ফিরে আসে। লিখেছেন ছোট-বড় প্রায় সমস্ত বাণিজ্যিক ও লিটল ম্যাগাজিনে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা তেরো, ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে 'কবিতাসমগ্র ১'। কবিতার জন্যে ভাষানগর-মল্লিকা সেনগুপ্ত পুরস্কার, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার সহ পেয়েছেন আরও একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। গদ্যকার হিসেবেও উজ্জ্বল, এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত গদ্যের বইয়ের সংখ্যা তিন । বড় পর্দাতে অভিনেতা হিসেবেও তাঁকে মাঝে মাঝে দেখা যায়।