অঞ্জন দত্তর (anjan dutt) লেখালেখি নিয়ে একটা আলোচনা আয়োজনের উদ্যোগ চলছিল অনেকদিন ধরেই। কেন অঞ্জনের লেখালেখি হঠাৎ? কারণ গত চার-পাঁচ দশক ধরে নানা মাধ্যমে লাগাতার কাজ করে গেলেও তাঁর লেখা নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা প্রায় নেই। বরং অনেক বেশি তাঁর গান ও সিনেমার জনপ্রিয়তা নিয়ে কথা বলা হয়েছে। অথচ সেই জনপ্রিয় কাজের আড়ালেই নানা কার্তুজ বুনে রেখেছেন অঞ্জন। সত্তর দশকের জঁ জেনে, ব্রেখটের থিয়েটারই হোক বা নয়ের দশকে সুমনের পাশাপাশি নিজের ধারার গান বা আজকের প্রজন্মের ফিল্মমেকারদের পাশেও নিজের ধারার সিনেমা-অঞ্জন লড়ে গেছেন ও যাচ্ছেন। এতগুলো কাজ একসাথে করে যেতে পারেন পাল্লা দিয়ে এমন মানুষ আমাদের সময়ে বিরল। বিরল, এতগুলো দশক জুড়ে নিজের নিজস্বতাকে এভাবে ধরে রাখাও। তবু আধুনিক গান, সিনেমা বা নাটকের আলোচনায় কোথাও যেন তিনি ব্রাত্যই থেকে গেছেন৷ থেকে গেছেন তাঁর তৈরি মেরি অ্যান, আলিবাবা বা জেরমির মতই অপাংক্তেয়ও। তাই আমরা ভেবেছিলাম তাঁর শিল্পচর্চার এই আকাশকে আবহমান শিল্পের নিরিখে যদি পড়ে উঠতে পারি একবার।
বারো পার্বণের আয়োজন সে কথা মাথায় রেখেই। মূল উদ্যোগটা নিয়েছিলেন অগ্রজ বন্ধু অভিজিৎ বসু। ঠিক হয়েছিল, আমি সঞ্চালনা করব। প্রত্যেক মাসে সন্তোষপুরের একটি বই দোকানকে ঘিরে চলবে এমনই নানা ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আলোচনা, যার শুরুটা হবে অঞ্জনকে দিয়ে। দোকানের মালিক ভাস্কর পালিত আমাদের সহযোগিতা করছিলেন। সম্প্রতি মুক্তি পাচ্ছে অঞ্জনের ছবি ‘চালচিত্র এখন’। তাঁর আজীবনের গুরু মৃণাল সেনকে উৎসর্গ করেই এ ছবি বানিয়েছেন তিনি। এ দিন তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি ছবিটির ঝলক দেখাবারও পরিকল্পনা ছিল আমাদের। ছিল অঞ্জনের সদ্য লেখা গোয়েন্দা কাহিনিগুলি নিয়ে আলোচনাও। সামগ্রিক আলোচনা পরে বই আকারে প্রকাশিত হবে।
আরও পড়ুন: নিশিকান্তই কি দরজা খুললেন জটায়ুর? (প্রথম পর্ব)
কানাডা সফর থেকে ফিরে ছবির প্রচারে খুবই ব্যস্ত ছিলেন অঞ্জন (anjan dutt)। তবু নির্ধারিত রবিবার বিকেলে যথা সময়ে বাড়িতে পৌঁছনোর পর, খুব বেশি দেরি করলেন না বেরোতে৷ এর আগে এ অনুষ্ঠান নিয়ে বেশ কয়েকবার বসেছিলাম আমরা। অঞ্জনদার সাথে নানা কাজে জড়িয়ে থাকি বলে জানি, দুম করে কিছু করেন না তিনি। প্রস্তুতি নেন, অপেক্ষা করেন, সময় নেন- যে গুণগুলি আজকের সমাজের অন্য শিল্পীদের ক্ষেত্রে বিরল। নিত্য এইসব কথাবার্তা থেকেই কাজে ঢুকে পড়েন অঞ্জন৷ তাই একটা দীর্ঘমাত্রার প্রবাহ জারি থাকে অনেক দিন ধরে, যা একটা ঘোর তৈরি করে। এ ক্ষেত্রেও আমাদের ঘোরটা ছিল। জানতাম, একটা অন্য রকম ঘটনা ঘটতে চলেছে৷ তাই গাড়িতে ওঠার আগে যখন জানতে চাইলেন, ‘গিটারটা নেব? পোস্টারে তোমরা গিটারের ছবি ছেপেছো দেখলাম।’ আমাদের বলতে দেরি হয়নি, ‘আমাদের তরফে গিটারের আয়োজন আগেই করা আছে৷ অসুবিধা হবে না।’
গত চার-পাঁচ দশক ধরে নানা মাধ্যমে লাগাতার কাজ করে গেলেও তাঁর লেখা নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা প্রায় নেই। বরং অনেক বেশি তাঁর গান ও সিনেমার জনপ্রিয়তা নিয়ে কথা বলা হয়েছে। অথচ সেই জনপ্রিয় কাজের আড়ালেই নানা কার্তুজ বুনে রেখেছেন অঞ্জন।
অঞ্জনদাকে সাধারণভাবে দেখলে মনে হয় না তিনি অঞ্জন দত্ত৷ এতটাই সাধারণভাবে থাকেন আমাদের প্রজন্মের অন্যতম এই কিংবদন্তী। মানসপুত্রর বেঁচে থাকা আর শিল্পে ছত্রে ছত্রে এভাবেই মিশে আছেন মৃণালবাবুও। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে মনে হবে, কত সাধারণ লোকটা। তবু কোথায় যেন আলাদা, কোথায় যেন আন্তর্জাতিক! আর এ কারণে তাঁর শিল্পেও পদে পদে এই সারল্য রেখেছেন অঞ্জন আজীবন। রেখেছেন ভালোবাসা। কোথাও দাগিয়ে বুদ্ধিজীবী প্রমাণ করেননি। আর পাঁচ জনের মত চাইলেই মৃণালবাবুর মত সিনেমা বা সুমনের মত গান লিখতে পারতেন, লেখেননি। বরং পছন্দ হয়নি বলে বহু বড় বড় কাজ প্রত্যাখ্যান করেছেন৷ অথচ তাঁর কাজ বলেছে একই রাজনীতির কথা, একই সময়ের কথা, একই প্রান্তিকতা ও লড়াইয়ের গল্প , তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য কিংবদন্তীদের মতই; কিন্তু নিজের ঢঙে। কীভাবে বানালেন এই নিজস্বতা তিনি? জানতে চাইলাম প্রথমেই এদিন।
দোকানটি ইতিমধ্যেই লোকে ঠেসে গেছিল। সন্ধ্যা নেমে গেছে শহরে৷ উদ্যোক্তাদের তরফেও অগণিত লোককে কীভাবে জায়গা দেবেন তা নিয়ে চিন্তা ছিলই আগে থেকে। কিন্তু নানা বয়সী প্রবীণ ও নবীন ব্যতিক্রমী মানুষের জমায়েতে কী আবেগ যে খেলে গেল চকিতে। অঞ্জন আমার প্রশ্নের উত্তরে বলছিলেন – যখন নাটক করতে এলেন সত্তর দশকে, কীভাবে অজিতেশ বা উৎপলদের নাটকগুলো তাঁর ইন্টারপ্রিটেশানে অন্য অর্থ নিয়ে আসছিল। কীভাবে সত্যজিৎ বা সন্দীপনদের লেখা অনুপ্রাণিত করলেও শব্দ ও ইমেজগুলো নিজের জীবন থেকে মরিয়া হয়ে খুঁজছিলেন তিনি। কীভাবে নিজের শহরের কোনও রাস্তাতেই খুঁজে পেয়েছেন দুনিয়াকে, একই শব্দ যখন লিখেছেন ও ছবি করেছেন কীভাবে বদলে গেছে ওজন। বলছিলেন, মৃণালবাবুর কথামত জীবনে ও শিল্পে অল্প টাকার ওপর আস্থা রাখায় কীভাবে মৌলিকতার স্বাধীনতা ক্রমশ খুলে গেছে তাঁর জীবনে…

দর্শকদের মধ্যে নবীন প্রজন্মের অনেক মানুষ ছিলেন, প্রবীণদের পাশেই। কেউ লেখক, কেউ সাংবাদিক, তো কেউ শিক্ষক বা চলচ্চিত্রকার। নানা বয়সী এই ভিড় থেকে প্রশ্ন আসছিল নানা রকমের। অঞ্জনের চার দশকব্যাপী কাজকে এমন বিস্তারিতভাবে তল্লাশি করতে বহুদিন দেখিনি৷ এত এনগেজড, গঠনমূলক, তীক্ষ্ণ কথাবার্তাও আজকাল বিশেষ শোনা যায় না। তাই আলোচনাটা শেষ হলেও সন্ধ্যার সন্তোষপুরের রাস্তায় সিগারেট খেতে খেতে অঞ্জনকে ঘিরে জারি ছিল আমাদের জমায়েত। খুব আবেগপ্রবণ লাগছিল সবার৷ অধ্যাপক অভীক মজুমদার তো বলেই ফেললেন, ‘মরা কলকাতায় অনেকদিন পর একটা বিকেল নামল মনে হল। এবারে মনে হচ্ছে, খেলা ঘুরবে।’…

মৃণালবাবুকে নিয়ে তাঁর ছবি ঘিরেই আপাতত ক’দিন মজে থাকবেন অঞ্জনদা। ফেরার পথে গাড়িতেও বলছিলেন, নব্বইয়ের গিটার নিয়ে বেপরোয়া কলকাতার ইতিউতি অনুষ্ঠান করে বেড়ানোর দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে বারবার তাঁর। আমাদের ভালো লাগছিল কথাটা শুনতে৷ মনে হচ্ছিল, তাহলে হয়ত পারা গেল কিছুটা৷ বড় মানুষদের তো খুব আকাল আজ, সবাই কোথাও একা। অঞ্জনদাকে ঘিরে জড়ো হওয়া এ শহরের কিছু ভালো মানুষদেরকে এভাবে যদি জড়ো করা যায়, তাহলে হয়ত কিছুটা কাটতে পারে আমাদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক হতাশা। আমরা আবার উঠে দাঁড়াতে পারি কিছুক্ষণের জন্য। শেষে যেভাবে অঞ্জন গিটার তুলে সপাটে শোনালেন তাঁর নতুন গান, কলকাতার গান, কোথায় হারিয়ে গেল তাঁর বয়স। মনে হল, ওই মুহূর্তের পর মৃণালবাবুর কথা ধার করেই বলা যেতে পারে, কলকাতাটা এখনও এলডোরাডো…
ছবি সৌজন্য: লেখক
পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।