আচমন একটি অনুসন্ধানকামী সাহিত্যপত্রিকা, পাশাপাশি বর্তমানে অতিক্ষুদ্র এক প্রকাশনাও বটে। সম্পাদক গৌরবকেতন লাহিড়ী। প্রকাশ অনিয়মিত। ২০১৮ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত প্রকাশিত সংখ্যা মাত্র তিনটি, সঙ্গে একটি ই-সংকলন, এবং কবিতার আচমন-এর একটি সংখ্যা। আচমন-এর চতুর্থ সংখ্যা এবং কবিতার আচমন-এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যা আপাতত যন্ত্রস্থ। এ বছরে প্রকাশিত হবে আশা করা যায়। মূলত হাওড়া, কদমতলা থেকে প্রকাশিত হলেও সম্প্রতি কলেজস্ট্রিটে আক্ষরিক-এর দপ্তরে আচমন-এর একটি আবাস রচিত হয়েছে। এছাড়া কলেজস্ট্রিটের দে’জ, দে বুক স্টোর, ধ্যানবিন্দু, মান্দাস, ধানসিড়ি, লালন, বৈভাষিক, প্ল্যাটফর্ম ও বাংলাদেশের বাতিঘর ইত্যাদি প্রকাশনার দোকানে আচমন প্রকাশিত বইপত্র ও পত্রিকা পাওয়া যায়। (Little Magazine)

সম্পাদকীয়: পূর্বশ্লোক
“হে আলেখ্য, অপচয় চিরকাল পৃথিবীতে আছে।
এই যে অমেয় জল, মেঘে মেঘে তনুভূত জল—
এর কতটুকু আর ফসলের দেহে আসে, বলো।”
(বিনয় মজুমদার)
মাসাচ্চিও চলে গেছিলেন সাতাশ বছর বয়সে; ভ্যান গঘ সাঁইত্রিশে; তুলনায় ললিতমোহন সেনের ছাপ্পান্ন বছরের আয়ুষ্কাল অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ দেখালেও জীবৎকালের শেষ দশ বছরে তাঁর সৃজনশীল সত্তা যে পূর্ণতায় পৌঁছেছিল—তার ভিত্তিতে বলাই যায়, আরো এক-দু’দশক তিনি জীবিত থাকলে ভারতীয় শিল্প হয়তো অনেক বেশি সমৃদ্ধ হতে পারত। শিল্পীসুলভ আত্ম-উপেক্ষার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় ললিতমোহনকে—ঠিক। কিন্তু তাঁর ৬৫-তম তিরোধান দিবস অতিক্রম করে এসে আজ যদি পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়ানো যায়, তবে বাঙালির আত্ম-উপেক্ষার ক্ষতচিহ্ন তার চেয়েও বেশি প্রকট হয়ে ধরা পড়ে! শেষ পঁয়ষট্টি বছরে ললিতমোহন সেনের মতো একজন ‘আন্তর্জাতিক’ মানের শিল্পীকে নিয়ে বাংলা ভাষায় কী-কী উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছে তার হিসেব দিতে গেলে সত্যিই লজ্জায় পড়তে হয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গুটিকয়েক লেখা; ললিতমোহনের জন্মস্থান শান্তিপুর, নদিয়া থেকে প্রকাশিত একটি ছোট পত্রিকার ‘বিশেষ ক্রোড়পত্র’; শান্তিপুর থেকে প্রকাশিত একটি জীবনীমূলক পুস্তিকা (শেষ কয়েক বছরে বইটি ছাপাখানার মুখ দেখেনি); রাজ্য চারুকলা পর্ষদ, পশ্চিমবঙ্গ দ্বারা প্রকাশিত একখানা ছোট বই—শেষ অর্ধশতাব্দীকালব্যাপী সময়ে এই হল বাংলা ভাষায় ললিতমোহন সেনের সামগ্রিক মূল্যায়ন। শিল্পীর পরিবারের তরফ থেকে অবশ্য বাৎসরিক একটি স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা হয়ে থাকে, যদিও তার খবর সুদূর শান্তিপুর থেকে রাজ্যের সাংস্কৃতিক রাজধানী কোলকাতায় এসে পৌঁছতে-পৌঁছতে পথেই অনেকটা গুরুত্ব হারিয়ে ফিকে হয়ে যায়। শিল্পী ললিতমোহন সেনের প্রকৃত অকালপ্রয়াণ বোধহয় এখানেই—যা ১৯৫৪ সালে তাঁর শারীরিক মৃত্যুর তুলনায় অনেক গুণ বেশি ‘অপচয়’।
একজন শিল্পীর প্রকৃত মূল্যায়ন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর কাজের বিশ্লেষণ; শিল্পকৃতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা অন্তর্গূঢ় ভাব-অভিব্যক্তির অনুসন্ধান করা। উত্তরপ্রদেশ রাজ্য ললিত কলা অ্যাকাডেমি থেকে ললিতমোহন-বিষয়ক দু’টি ক্ষুদ্র সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল হিন্দি ভাষায়। তার অধিকাংশ রচনাই স্মৃতিচারণধর্মী; কোথাও শিল্পীর কাজের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ নেই। আশ্চর্য লাগে, যে মানুষটা সারা জীবন ধরে ‘জীবন’-কে চিত্রিত করে গেলেন—তাঁর বিষয়ে লিখতে গিয়ে শুরু করতে হচ্ছে ‘মৃত্যু’ থেকে, একের পর এক ‘নেই’ থেকে—সম্পাদককৃত্যের বিড়ম্বনা বৈকি! সত্যি বলতে, শিল্পী হিসেবে ললিতমোহন সেনের কীর্তি বর্ণনা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। কিন্তু, একজন সংবেদী দর্শক হিসেবে তাঁর ছবির ‘প্রাণের স্পন্দন’-কে, ‘স্ফূর্তির ব্যাপকতা’-কে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতাও যে আমার নেই—সেজন্যেই হয়তো এই সংখ্যার অবতারণা।
ইতিপূর্বে এমন নির্দিষ্ট একটি ব্যক্তিত্ব-কেন্দ্রিক সংখ্যা ‘আচমন’ করেনি। ফলত প্রথাগত বিভাগগুলির ক্ষেত্রে লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছে এই সংখ্যায়। একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হবে বলেই কবিতার বিভাগ ‘অনুষ্টুপ ছন্দ’ এই সংখ্যায় অনুপস্থিত। ‘প্রারম্ভপীঠ’ বিভাগটি বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ললিতমোহনের কাজের একটি পুনর্মূল্যায়ন বলা যেতে পারে। ‘সংস্মরণ’ বিভাগটি মূলত পূর্বে প্রকাশিত রচনার একটি সংকলন—পাঠকের সুবিধার্থে এই বিভাগের প্রত্যেকটি রচনার লেখক পরিচিতি এবং মুদ্রণকাল যথাসাধ্য উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। চর্বিতচর্বণ যাতে না হয়ে ওঠে তাই বহু লেখার মধ্যে থেকে নির্বাচিত কয়েকটি রচনাই মুদ্রিত হয়েছে এই বিভাগে। হিন্দি ভাষায় প্রকাশিত রচনাগুলি বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। ‘প্রিয়বরেষু, ললিত’ বিভাগে ললিতমোহন সেনকে লিখিত বেশ কিছু চিঠিপত্র সংকলন আকারে রাখা হয়েছে। চিঠিগুলি অপ্রকাশিত। প্রেরকের পরিচিতি এবং যেখানে আবশ্যক মনে হয়েছে, প্রয়োজনীয় পাদটীকা সংযোজন করা হয়েছে চিঠিগুলির সাথে। এই সংখ্যার প্রেক্ষিতে দেখলে নীরস ‘ডকুমেন্টেশন’ ব্যতীত চিঠিগুলির অন্য কোনও মূল্য হয়তো নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, সাল-তারিখ অনুযায়ী পড়া গেলে একটা বিরাট বিস্মৃত সময়কাল পর্দা সরিয়ে উন্মুক্ত হয় পাঠকের চোখের সামনে। অপরপক্ষে শিল্পী বীরেশ্বর সেন, শিল্পী সুধাংশুশেখর চৌধুরী, কবি সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের মতো বাঙালির ইতিহাস থেকে মুছে যাওয়া চরিত্রগুলির ক্ষণিকের জীবন-প্রাপ্তির দিকটিকেও একেবারে অস্বীকার করা যায় না। আত্মমগ্ন ললিতমোহন ডায়ারি ছাড়া সেভাবে কিছুই লেখেননি। তবু তাঁর স্বল্প কিছু লেখাপত্র—যা পাওয়া সম্ভব হয়েছে—সংকলিত হয়েছে ‘প্রকাশিত-অপ্রকাশিত রচনাসমূহ’ বিভাগে। পূর্বোক্ত বিভাগদুটির ক্ষেত্রে মূল পাণ্ডুলিপির বানান ও যতিচিহ্ন অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ‘নির্বাচিত শিল্পকর্ম’ বিভাগে রয়েছে শিল্পীর নিজের সংকলিত দুটি গুরুত্বপূর্ণ ছবির সিরিজ এবং শিরোনামহীন বেশ কয়েকটি ছোট-ছোট সিরিজ। এছাড়াও ‘চারুকলা’ বিভাগে আলাদা করে ললিতমোহনের বারোটি বিভিন্ন সময়কালে ও বিভিন্ন মাধ্যমে অঙ্কিত ছবির রঙিন প্রিন্ট মুদ্রিত হয়েছে।
ললিতমোহন সেনের অধিকাংশ শিল্পকৃতিই ১৯৬০ সালে গোমতীর বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু রয়ে গেছে লক্ষ্ণৌতে তাঁর বন্ধু-বান্ধব-প্রতিবেশী-ছাত্র-সহকর্মীদের কাছে। গত কয়েক দশক যাবৎ এই বিষয়ে অনুসন্ধান করে চলেছেন শিল্পী অধ্যাপক শ্রী জয়কৃষ্ণ আগরওয়াল। দিল্লি আর্ট গ্যালারির শ্রী আশিস আনন্দ একই পদ্ধতিতে সংগ্রহ করেছেন বেশ কিছু ছবি। তা সত্ত্বেও এখনও বহু কাজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মিউজিয়াম ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পরিসরের কথা ভেবে ললিতমোহন সেনের অসংখ্য স্কেচ ও খসড়া ছাপা গেল না এই সংখ্যায়। সেগুলি সংযোজন করতে গেলে পত্রিকার বহর ও মূল্য দুই-ই দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়াত। কাজেই এই সংকলন যে ললিতমোহনের কাজের সম্পূর্ণ সংকলন এমন দাবি করা সঙ্গত নয়। বিশেষত ‘আলোকচিত্রী’ ললিতমোহনের কথা একরকম অনুল্লিখিতই থেকে গেল এই সংখ্যায়। তাঁর বিপুল সংখ্যক আলোকচিত্রের সম্ভার পরে কখনও প্রকাশ করার ইচ্ছে রইল। সেই অর্থে দেখতে গেলে একজন শিল্পীর অস্তিত্বকে পুনরাবিষ্কার এবং তাঁর কাজের পুনর্মূল্যায়নের প্রেক্ষিতে এই সংখ্যা আদপে একটি পদক্ষেপ, একটি সম্ভাবনাকে উসকে দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ মাত্র।
প্রায় দশ মাস সময় অতিক্রান্ত হল এই সংখ্যার প্রস্তুতিতে—এই সময়কালের মধ্যে বহু মানুষ নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করে গেছেন। বিশেষত ললিতবাবুর ভ্রাতুষ্পৌত্র শ্রী প্রবর্তক সেন এবং অগ্রজতুল্য শ্রী দীপঙ্কর পাড়ুই—এই দুজনের অফুরন্ত উৎসাহ এবং সহযোগিতা না থাকলে এই সংখ্যা প্রকাশ করা হয়তো সম্ভবপর হত না। প্রবর্তকবাবু তথা ললিতমোহন সেনের পরিবার যেভাবে দিনের পর দিন আমাদের অত্যাচার সহ্য করেছেন—তার পরেও যথেচ্ছ প্রশ্রয় দিয়েছেন, আতিথেয়তা ও আন্তরিকতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন তা কহতব্য নয়।
স্বর্গত শ্রী ললিতমোহন সেনের ১২১-তম জন্মতিথি উপলক্ষে ‘আচমন: আচার্য ললিতমোহন সেন সংখ্যা’ প্রকাশিত হতে চলেছে। আশা করি, সংখ্যাটি শিল্পপ্রেমী পাঠকের সমাদর লাভ করবে।
সকলে সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন… ধন্যবাদ।
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।