‘বাজার’ শব্দটির সঙ্গে যেভাবে জড়িয়ে থাকে পুঁজিবাদ কিংবা অর্থনীতি, একই ভাবে জড়িয়ে থাকে নস্টালজিয়াও। বাজারি প্রোডাক্টের নানাকিছুই পাকাপাকি জায়গা করে নেয় আমাদের স্মৃতিতে। প্যাকেজিং থেকে নামের লেটারিং, সবকিছুই স্থায়ী ভাবে বসে যায় মনের ভিতরে। আর এ কথা অনস্বীকার্য যে বাজারি প্রোডাক্টের বিস্তর সম্ভারের মধ্যে অন্যতম হল কসমেটিকস। কসমেটিকস মানেই যেন ‘সুন্দর’ হয়ে ওঠার হাতছানি, সকলের চুল, সকলের ত্বকই একরকম করে তোলার চেষ্টা, ত্বক-চুলকে পোষ মানিয়ে রাখার বন্দোবস্ত! তবে এ সকল প্রসাধনীর পূর্ব-নারীদের কথায় যদি যাই তাহলে জ্বলজ্বল করে ওঠে যে ক’টি নাম তার মধ্যে অন্যতম হল ‘আফগান স্নো।’ যে নামটির সঙ্গে সত্তরের দশক অবধিও পরিচিত ছিলেন ভারতবর্ষের মহিলারা। পুরনো গল্প কথায় মেয়েদের স্নান, সাজ তাদের ব্যবহারের প্রসাধনী এই সবকিছুই যেমন হয়ে উঠত আলোচ্য বিষয়, তেমনই যেন এক গল্পকথার মতো এই আফগান স্নো-এর ইতিহাস।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে রাজস্থানের রাজপুত ঘরানার এক যুবক, ইব্রাহিম সুলতানালি পাটানওয়ালা প্রথম পা রাখেন মুম্বই অর্থাৎ বম্বে শহরে। কিছু কিছু মানুষের কপালে কিছু আশ্চর্য কাজ লেখা থাকে, নসিব লিখে দেন হয়ত কোনো ওপরওয়ালা, আর তাই ইব্রাহিম নিযুক্ত হন এক আশ্চর্য চাকরিতে…সুগন্ধী তৈরি করার চাকরি। বিচক্ষণ, সৎ ও বুদ্ধিদীপ্ত ইব্রাহিম সহজেই সুখ্যাতি লাভ করেন তাঁর কর্মস্থলে। সেই সাফল্যের উপর ভরসা করে তিনি শিগগিরই শুরু করেন নিজস্ব ব্যবসা।
ব্যবসার শুরুতেই আবিষ্কার করে ফেলেন একটি চুলের তেল, যার নাম দেন ‘অত্ত দুনিয়া।’ সেই তেল প্রশংসিত হয় এবং বাণিজ্যের নিরিখেও সফল হয়। কিন্তু তখনও তাঁর দুচোখে অসংখ্য স্বপ্ন। এরপরই তৈরি করে ফেলেন তাঁর নিজস্ব ল্যাবরেটরি। ১৯০৯ সালে এই ল্যাবরেটরিতে তৈরি তেল থেকে সুগন্ধী সবকিছুরই রপ্তানি শুরু হয়। এখনকার যে কোনো প্রোডাক্টের যেমন থাকেন কোনো ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর, তেমনই তৎকালীন বেশ কিছু রাজা মহারাজারা হয়ে ওঠেন ইব্রাহিমের ব্র্যান্ডের পৃষ্ঠপোষক! এই সাফল্যের ডানায় ভর করে ইব্রাহিম এইবার পৌঁছে যান ইয়োরোপের মাটিতে। সেখানকার সবচেয়ে বড় সুগন্ধীর ব্যবসায়ী সুইৎজারল্যান্ডের লিঁঅ জিভাউদানের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে জানা হয়ে যায় সুগন্ধী তৈরির অনেক গোপন তথ্য। তার পরেই ইব্রাহিম তৈরি করে ফেলেন এক আশ্চর্য ক্রিম। বলাই বাহুল্য ইব্রাহিমের নজর ছিল অন্যরকম। সেই ক্রিমের কৌটো আসে জার্মানি থেকে, উপরের নাম লেখা লেবেল আসে জাপান থেকে।

এই ক্রিম তখন প্রায় তৈরি। ইতিমধ্যে আফগানিস্তানের রাজা এলেন ভারত ভ্রমণে। ইব্রাহিমের সমস্ত প্রোডাক্টই তাঁকে উপহার দেওয়া হল। সবকিছুর মধ্যে এই ক্রিমের কৌটো রাজার ভয়ানক মনে ধরল! কৌটো হাতে নিয়ে রাজা হঠাৎ বলে ফেললেন “আফগানিস্তানের বরফের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।” রাজার এই নস্টালজিয়া দেখে চটপটে ইব্রাহিমের মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি খেলে যায়। আরে! এক ঢিলে দুই পাখি! রাজাকেও খুশি করা যাবে আর ক্রিমের হবে নয়া ব্র্যান্ডিং! তাই সই। জার্মানি নয়, জাপান নয়, আফগানিস্তানের রাজার কথায় ভারতবর্ষের প্রথম বিউটি ক্রিমের নাম হল ‘আফগান স্নো।’ ১৯১৯ সালে ভারতীয় বাজারে এল এই ক্রিম। আফগান স্নোয়ের সে অর্থে এ বছরই একশো বছর পূর্ণ হল ভারতের মাটিতে।
এখনও অনলাইন সাইটে পাওয়া যায় এই আফগান স্নো। রিভিউ দেখে বোঝা যাচ্ছে, কেনেনও কিছু মানুষ। আর যাঁরা কেনেন না, হয়তো তাঁদেরও স্মৃতিতে উজ্জ্বলভাবে রয়ে গেছে আফগান স্নো, যার ওপর ভিত্তি করে আগামী দিনের সমস্ত সৌন্দর্যের ক্রিম, এমনকি কেবলমাত্র ‘স্নো’ বলে কিছু ফর্সা হওয়ার প্রসাধনীও বাজারে আজও পাওয়া যায়। সত্তরের অনেকটা পরেই আমার জন্ম বলে, ব্যক্তিগত স্মৃতি তেমন নেই। কিন্তু খুব ছোটবেলার স্মৃতি হাতড়ে মনে পড়ে দিদিমা বা ঠাকুমা কখনো বলছেন ‘স্নো’ মাখার কথা। সেটা বিশেষত নেমন্তন্ন-বাড়ি যাওয়ার আগে। স্মৃতির খোলসে ঢুকে একমনে ভাবলে মনে হয়, ‘স্নো’ শব্দের মধ্যে আসলে লুকিয়ে আছে সেই ফর্সা ও কালোর এক সুপ্ত রাজনীতি। কিন্তু নস্টালজিয়ার এমনই জোর যে রাজনীতি চাপা পড়ে যায়। জেগে ওঠে কেবল টুকরো টুকরো স্মৃতি। যে স্মৃতি হয়ত আমার নয়, কিন্তু হয়তো সমগ্র ভারতীয় নারীসত্ত্বার। যে স্মৃতির ভারে যে কোনও ক্রিমই একটা প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠেছিল ‘স্নো!’

বিজ্ঞাপনের মতো করে ভাবতে ইচ্ছে করে, কলকাতার এই অল্প শীতে যাদের দিন কেটে যেত, বরফ দেখতে যাওয়া হত না মোটেই, জাপানের লেবেল সহ জার্মানির কৌটো খুলে তাঁরা গায়ে মেখে নিতেন আফগানিস্তানের রাজার দেওয়া নামের বরফ…আর ত্বক হয়ে যেত নরম, উজ্জ্বল…!
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে অবধি আফগান স্নোয়ের কৌটোর গায়ে লেখা থাকত আফগানিস্তানের রাজার কথা। বছরকয়েক আগে মণিপুর ঘুরতে গিয়ে বিশেষ অনুমতি নিয়ে ঘণ্টা তিনেকের জন্য বার্মা যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। মণিপুরের গল্পকথায় দুটি চরিত্রের কথা উল্লেখযোগ্য, খাম্বা ও থৈবী। তাঁদের নিয়ে নানা গল্প, এমনকী মণিপুরী নৃত্যেও তাঁদের উল্লেখ আছে। বার্মায় ঢুকে একটি পুকুরের সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম থৈবীর ছবি। আমাদের গাইড বললেন “এইটাই হচ্ছে থৈবীর স্নান করার পুকুর।” আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, কাঁটাতার পড়ে গেছে মাঝখানে, সে তো কবেই! তবু পুরাণের রাজকন্যার স্নানের জায়গা পড়ে রয়েছে অন্য এক দেশে। থৈবী কি ‘স্নো’ মেখেছেন কখনো ? কে জানে…পুরাণের চরিত্রদের বয়স জানা যায় না যে!
আজ এ লেখা শেষ করতে করতে ভাবছি, পৃথিবীর নিরিখে যদি ভাবি, এই একটি মাত্র আফগান স্নোয়ের গায়ে কতগুলো কাঁটাতার! একদিকে জার্মানি, একদিকে জাপান আবার আরেকদিকে আফগানিস্তান ! ‘বাজার’ আসলে সত্যিই সেই আশ্চর্য জায়গা, যেখানে কাঁটাতার পেরিয়ে পেরিয়ে ঢুকে পড়ে দ্রব্য, কিংবা দ্রব্যের ধারণা। অর্থনীতি, পুঁজিবাদ কিংবা লিঙ্গ-রাজনীতি এসবকিছু ছাপিয়ে একদিন সেই দ্রব্যের গায়ে চেপে বসে নস্টালজিয়া। আফগান স্নো-এর একশো বছরে ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে গাঁথা আছে এর নস্টালজিয়া অথচ কত দেশের চিহ্ন জুড়ে রয়েছে এর গায়ে। ফর্সা হওয়ার যে কোনও ক্রিমের বিরুদ্ধে যেমন আমার রাজনীতি তেমনই নস্টালজিয়ার ইতিহাসের সামনে যে কোনো রাজনীতিই বিপর্যস্ত! ভারতবর্ষের মেয়েদের আফগান স্নো কিংবা থৈবীর স্নানের পুকুর, এসবই আসলে দেশ আবার দেশভাগও…।
আমার চুপি চুপি সাল তারিখ গুলিয়ে দিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে কাবুলিওয়ালা মিনিকে তার বিয়ের দিন একটা আফগান স্নো উপহার দিয়েছিল। তবে না গল্প! তবে না ইতিহাস! তবে না স্বপ্ন! বরফের মতো…সাদা… ঠাণ্ডা…শিরশির…!
কবি ও গদ্যকার। পত্র পত্রিকার জন্য লেখালেখি ছাড়াও বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য গল্প লেখেন। ওঁর লেখা 'খেলনাবাটির দিন শেষ', 'বৃষ্টিরাশির মেয়ে', 'বেহায়া একুশি' পাঠকদের মধ্যে সমাদৃত।