অঘ্রাণ ফুরিয়ে পৌষ পড়ল। ব্যস্ত শহর আর শহরতলি পেরলেই ঘরে ঘরে এখন ধান ঝেড়ে বেছে ঘরে তুলবার ব্যস্ততা। ইতু পুজোর ডালিখানা দেখে দেখে এই কৃষি জীবনের ফেলে আসা অতীতের খানিক খানিক মালুম হয়। কেবল তো অঙ্কুরিত শস্যের বন্দনা না! সূর্যালোকের কাছে, সালোকসংশ্লেষের কাছে মানুষের এই ফিরে যাওয়া। এসব কেবল যদি নিয়মরক্ষায় এসে থিতু হয় সে বড় দুঃখের। তবু তো দেখি এখনও গাঁ-ঘরে নতুন চালের নবান্ন হয়, চাল কোটা হয়, এমনকী সে চাল দিয়ে নিজের হাতে পিঠে গড়েও খেতে হয়। নিজের অভিজ্ঞতাকে একটা যাপনের সাক্ষী করে তোলার এক আশ্চর্য পার্বণ! আসলে, অন্ন সংস্থানের যে ক্রিয়া পরম্পরা তাকেই একবার তলিয়ে দেখবার রীতি এসব। এমনটাই আমার মনে হয়। সেই রীতির প্রতি তুমি আরও খানিক শ্রদ্ধাশীল হও, যত্নশীল হও এই তো! ঢেঁকিতে ছাঁটা নতুন চাল ভেজাতে হবে, বাটতে হবে, সেই নরম মসৃণ চালবাটা সারারাত ধরে হিমের পরশে মজে উঠবে, তবে না পিঠের রূপকথা লেখা হবে! এসব নিয়ম দিনেকালে হারিয়ে যাচ্ছে, যাবেও হয়তো বা। নিয়মের দায় যদি কেবল মেয়েলি হয়ে ওঠে, এ যুগে সে ভারী বেয়াক্কেলে। নিয়মেরা তাই ছায়ার মতো দেওয়ালে মিশে যেতে যেতে অদৃশ্য হয়ে যায়।

মণীন্দ্র গুপ্তের গদ্য শরীরের মতো এমন করে কে আর তাদের উত্তাপ বিলোবে? কে আর কাকভোরে নবান্নের পানীয় দিয়ে কলস সাজাবে? এসব ভেবে দেখতে গিয়ে দেখেছি পৃথিবী আসলে অনেক বড়। কে যে কেমন করে পৃথিবীর গল্প বলতে চায় তা বুঝে ওঠা সহজ না। আমি হয়তো কেবলই ভেবেছি কল্পনা পিসির কথা। সেই আমাদের তন্বী কল্পনা পিসি, যশোর থেকে আসা মুখরা মাঝবয়সী। কী চমৎকার পিঠে বানাত। চিন দেশের মানুষেরা কত যত্নে মুন কেক (moon cake) বানান। আমার কেবলই মনে হতো কল্পনা পিসির অমন ধবধবে পিঠে যেন চাঁদের স্পর্শ পেয়েছে। ওই যেন আমাদের মুন কেক। কাঠের উনোনে সামান্য চাটুতেই সেই পিঠে কী অসামান্য হয়ে ধরা দিত। আমরা জানতাম এই গুড়ের গন্ধই আলাদা। এ গুড় বিনয়কাকুর তৈরি। এই নারকেল আমাদের দিক্ষিণের বাগানের, এর স্বাদ মিঠে। এই নিয়েই ছিল আমাদের ‘ফার্ম টু টেবিল’এর শৈশববেলা। সে জীবনে মানুষের মতো করে বাঁচার অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন ছিল না, স্লোগান ছিল না। সেই মেটে উনোনের উত্তাপ মোড়া জীবনে আমরা অ্যালিসকে চিনতাম না। কল্পনা পিসিকে চিনতাম।
অ্যালিস ওয়াটারসকে (Alice Waters) চিনতে আরও অনেকটা পথ পেরতে হয়েছে। সেই যে, যিনি বিশ্ব রাজনীতির মুখ হয়ে উঠেছেন ক্রমে, যিনি আমেরিকার প্রথম মহিলা যিনি ফার্ম টু টেবল-এর (farm to table) প্রবক্তা। ক্রমে আমরা জানব ‘স্লো-ফুড’ (slow food) নিয়ে অ্যালিসের পথ চলার কথা, গল্প বলার কথা। খাদ্য-খাবারে মানুষের অধিকার কতখানি, কাকেই বা বলে খাদ্যনীতির ‘গোল্ডেন রুল’ সেসব বুঝতে আমাদের অনেকটা পথ পেরতে হলো। অ্যালিস অবশ্য ওঁর কাজ শুরু করেছিলেন সেই কবেই, ১৯৭১ এ। সেই সময়েই ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে অ্যালিস গড়ে তোলেন ওর রেস্তোরাঁ – Chez Panisse। আমেরিকায় সেই ফার্ম টু টেবিল’এর শুরু। আসলে ভিয়েতনামের যুদ্ধ, যুদ্ধবাজ মানুষের আগ্রাসন এ সমস্তই তখন আমেরিকার যুব সমাজকে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছিল।

অ্যালিস আসলে ১৯৬৫ নাগাদ কিছুদিনের জন্য ফ্রান্সে গিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি দেখেন মানুষের খাদ্যাভ্যাসের যাপিত বিন্যাস আমেরিকার চেয়ে ভারী অন্যরকম। দেশে ফিরে ওঁর তাই ইচ্ছে হয় নিজের মতো করে কিছু করবার। রান্নাবান্না নিয়েও যে রাজনৈতিক অবস্থানে অটল থাকা যায় সেকথা অ্যালিস বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন। সেই প্রথম কোনও রেস্তোরাঁর মেনু কার্ডে লেখা হলো, কোন ফসল কোন মাখন কার খামার থেকে এসেছে। অ্যালিস নিজেও জানিয়েছেন, আসলে ব্যক্তি মানুষের একটা বদল ঘটে গিয়েছিল ওঁর নিজের ভিতরে। তিনি তাই বলেছেন – ‘I had gone to France in 1965, and when I got back from the trip, I wanted to eat like the French. I wanted to go to farmer’s market…’ (১৯৬৫ সালে আমি ফ্রান্সে বেড়াতে গেছিলাম। ফিরে এসে আমার কেবলই ফরাসিদের মতো করে খেতে ইচ্ছে করত, চাষিদের কাছ থেকে সবজি কিনতে ইচ্ছে করত…) এত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাটা ওঁর ক্ষেত্রে গভীর ভাবে কাজ করেছে। ওঁর রান্না, ওঁর ব্যক্তিত্বকে ছাপিয়ে গেছে ওঁর এই জীবন দর্শন।
যাঁরা তাবড় পৃথিবীর রান্নাঘরের খোঁজ রাখেন, তাঁরা জানেন অ্যালিস কত বড় রাঁধিয়ে, কত বড় শ্যেফ। আসলে ভাল রান্না করাটাই এ ক্ষেত্রে একমাত্র বড় কথা নয়। অন্যভাবে জীবনকে দেখতে শেখার যে প্রেরণা অ্যালিস নিজের ভিতরে ভিতরে অর্জন করেছে সেটাই ওঁকে এত বড় করে তুলেছে বলে আমার বিশ্বাস। এত বছর ধরে চাষাবাদের বিবর্তন, খাদ্যাভ্যাসের বদল, রান্নাঘরের চারিত্রিক ভিন্নতাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন অ্যালিস। শুধু আসলে অ্যালিস না, দেখেছেন ওঁর সহকর্মীরাও। সেই ভাবনার অনেকটাই ধরা পড়েছে ওঁর লেখালেখিতেও। অ্যালিসের খুব উল্লেখযোগ্য একটি বই – We Are What We Eat: A Slow Food Manifesto। ১৯৭১’এ যে উদ্যোগ নিয়ে অ্যালিস (Alice Waters) ওর রেস্তোরাঁ শুরু করেছিল, তার চেয়ে ওর আজকের ভাবনা যে অনেকখানি বদলে গেছে । এই বদল আসলে অনিবার্য। আসলে আমি নিজে ঠিক কী খাই সেটা যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, ততখানিই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের যাপিত জীবন দিয়ে আমরা আসলে ঠিক কোন খাদ্যচক্রকে ক্রিয়াশীল করে তুলতে চাইছি সেই ভাবনাটিও।

আমাদের দেশঘরের ইতিহাসে সেই ভাবনাগুলো এক সময়ে যত্নের সঙ্গেই লালিত হতো। ইতুপুজো থেকে সরুচাকলির গোলায় সেই বিশ্বাস ছিল অটুট। বড়দিনের রান্নায়, মাংস রোস্ট করার মশলায় যাঁরা সজনে গাছের ডাল সর্ষের সঙ্গে বেটে দিতেন তারা আসলে প্রকৃতিকে নিজেদের যাপিত জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে শিখেছিলেন। কল্পনা পিসির মতো সেই মশলা, সেই রান্নাঘর আর নেই। আছে কেবল অ্যালিসের মতো কিছু কিছু জীবনদর্শন। তাকেও আসলে অন্তহীন আন্দোলন বললেই ভাল হয়। চিপকো আন্দোলনের মতোই রান্নাঘরকে আগলে রাখার এও এক প্রয়াস আর কী। অনেকেই এতে সামিল হয়েছেন, হচ্ছেন। অ্যালিস একা নন সে কথা সত্য। কিন্তু ওঁর ম্যানিফেস্টোর পাঠক সীমিত, এ কথাও সত্য। ঠিক যেমন কল্পনা পিসির মতো পিঠে সহজে আর করে উঠতে পারে না কেউ! তেমনই। তবু, নতুন ধান উঠলে পিঠে করতে ইচ্ছে করে, অ্যালিসের বই পড়তে ইচ্ছে করে। যে বই পড়ে সে চাইলে পিঠেও রাঁধে। পৃথিবীর এই যে স্লো-ফুড মুভমেন্ট (slow food movement) এর একটা লোগো আছে, ভারী সুন্দর। একটি ছোট্ট শামুক– শম্বুক গতির প্রতীক। কে বলতে পারে আপনাদের সঙ্গে তার একদিন দেখা হয়ে যেতেও পারে।
ছবি সৌজন্য: Wikipedia
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।