(Little Magazine)
কবিতা বড্ড একঘেঁয়ে— গ্রীসের লোকে বলে। কবিতা ঘ্যানঘেনে, কবিতা একটা হাই-ক্লাস আর্ট, কবিরা আইভরি প্যালেসে থাকে—জীবন আর বাস্তবের সঙ্গে কোনো লেনাদেনা নেই। আপনাদের বলতে কোনো কিন্তু নেই, আমি কবিতা লিখি—কাউকে বলতে অস্বস্তি হয়। তারা ধরেই নেয় আমি সেই সংবেদনশীল যুবক, যে লেখে প্রেম আর গোলাপ, প্রেম আর চাঁদনি, প্রেম আর সূর্যাস্ত, প্রেম আর তুষার, প্রেম আর প্রেম নিয়ে। তাই লোকে যখন জিজ্ঞেস করে কী করি, সাধারণত বলি— বেকার (সত্যি তো আমার বয়সী তিরিশ শতাংশ লোক বেকার)। কখনও বলি আমি একজন সম্পাদক। কজনই বা জানেন, সম্পাদকের কী কাজ! (Little Magazine)
আরও পড়ুন: ‘সূত্রপাত’ পত্রিকা নবপর্যায়: চতুর্থ সংখ্যা: সম্পাদকীয়
অনেকে ভাবে কঠোর শ্রম ছাড়া কবিতা হয় না; যেন বিদ্যালয়ে পড়বার বিষয় বা গোপন অন্তর্দৃষ্টির জন্যে হাপিত্যেশ করে থাকার ব্যাপার। নিত্যদিনের জীবন থেকে কবিতা কত দূরে, লোকে কবিতার খোঁজ এত কম করে, এমনটাই মনে হয়। কবিতার এই দশা ছিল না সবসময়, অন্তত গ্রিসে; জনজীবন হোক বা ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে কবিতার একটা উঁচু আসন ছিল। জন্ম মৃত্যু, বিবাহ শ্রাদ্ধ, উৎসব অনুষ্ঠানে লোকে কবিতা আবৃত্তি করে নিজের অনুভব সাকার করে তুলত। ৫০-৬০-৭০-এর দশকে প্রভুত্ববাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কবিতা ছিল জোরালো প্রতিবাদের অস্ত্র— এমন একটা শিল্পমাধ্যম যা অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিল হাজার হাজার জনতাকে। (Little Magazine)
আজকে কবিতার এই আপেক্ষিক অনুপস্থিতি আমাদের ব্যাপারে তো কথা বলেই, স্বয়ং কবিতার ব্যাপারেও কিছু বলে। গত শতক কাব্য-উৎপাদনের বিস্ফোরণ লক্ষ্য করেছে, সাথে সাথে বিমূর্ততার দিকে— ডেভিড কাপলানের উদ্ধৃতি অনুযায়ী ‘সাধনমগ্ন অনুভূতিপ্রবণতা’র দিকে—রীতিমতন সিদ্ধান্ত নিয়ে কবিতার বাঁকবদলও নজর এড়ায়নি। যেমনটা কবি আদ্রিয়ান মিচেল খেয়াল করছেন, ‘বেশিরভাগ মানুষ কবিতাকে এড়িয়ে গেছে কারণ বেশিরভাগ কবিতা বেশিরভাগ মানুষকে এড়িয়ে গেছে’। (Little Magazine)
২০০৭-এ যখন কবিতা লিখতে শুরু করি, কবিতাবিষয়ক সবকটা স্টিরিওটাইপ সম্বন্ধে সচেতন ছিলাম; কিন্তু জানতাম না যে গ্রিসের বেশিরভাগ কবি এই ঘেরাটোপগুলোয় নিরাপদ বোধ করে, সেগুলোকে পুনঃ পুনঃ প্রতিষ্ঠা করতেও তাদের কিচ্ছু মনে লাগে না।
২০০৭-এ যখন কবিতা লিখতে শুরু করি, কবিতাবিষয়ক সবকটা স্টিরিওটাইপ সম্বন্ধে সচেতন ছিলাম; কিন্তু জানতাম না যে গ্রিসের বেশিরভাগ কবি এই ঘেরাটোপগুলোয় নিরাপদ বোধ করে, সেগুলোকে পুনঃ পুনঃ প্রতিষ্ঠা করতেও তাদের কিচ্ছু মনে লাগে না। (Little Magazine)
আমি দেখলাম গ্রিক সাহিত্য ও প্রকাশনার জগৎ আসলে এর ওর জায়গীর; প্রভাব খাটানো, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা আর কাঠি করা—এইসব নিয়ে দমবন্ধ করা আবহাওয়া। কবিতা এক্ষেত্রে ছাগলের তৃতীয় সন্তান, যেই কবিতা লিখুক সে যদি কোনো না কোনো ফ্র্যাকসনের না হয় তার কবিতা পাবলিশিং সিস্টেম ছুঁড়ে ফেলে দেবে। (Little Magazine)
আজকের গ্রিসের আপনি যদি কবিতার বই করতে চান, প্রকাশনা সংস্থাকে টাকা দিতে হবে। প্রকাশনাগুলি নিজেদের ব্র্যান্ড বিক্রি করে; বই করতে তারা ২০০০, ৩০০০, ৫০০০ ইউরো কি তার বেশিই নেবে আপনার থেকে। মানেটা দাঁড়াল, গ্রিসের বইবাজার ডুবে গেছে কিন্তু প্রকাশনার ব্যবসা দিব্বি চলছে, কারণ পয়সা ঢেলে নিজের বই করানো লোকের অভাব নেই। মেইনস্ট্রিম প্রকাশনাগুলি ভ্যানিটি প্রেসের মতোই কাজ করে এখানে। মানেটা আরো স্পষ্ট, গ্রিসে যারা কবিতা ছাপায় তাদের বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত শ্রেণির। শ্রমজীবী জনতার বই ছাপিয়ে খরচ করার মতো টাকা নেই— কথাটা চেপে রেখেই এসব চলে। বেশিরভাগ সাহিত্য পত্রিকা আর ওয়েবসাইট এই ব্যবস্থাকে সমর্থন করে, প্রোমোট করে। মোদ্দা কথা হল— আপনি যদি এই ঘোঁটের বিচারে সুপাত্র না হন অথবা তেল মারামারির দলে না পড়েন— আপনার লেখা যত ভালই হোক, এইসব পত্রপত্রিকায় ছাপা হবে না। কিছু ছাড় অবশ্যই আছে, অতি অল্প। (Little Magazine)
পাঁচ বছর আগে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিলাম একটা কবিতা আসরে, সেখানে ছজন নবীন কবি নিজেদের কাজ তুলে ধরল। ছ’জনই পুরুষ। আমরা যখন সূত্রধর তথা আয়োজককে, যে নিজেও একজন পুরুষ, জিজ্ঞেস করলাম, একজনও মেয়ে কবিকে ডাকলে না কেন, সে ঘুরিয়ে জানতে চাইল আমরা কাদের কথা বলছি।
প্রকৃত প্রস্তাবে গ্রিসের কবিতা, ছোট বুর্জোয়া না হলেও মধ্যবিত্ত অবশ্যই। সেটা কবিতার বিষয় ও প্রকরণ হিসেবে কবিরা যা পছন্দ করে তাতেই প্রতিফলিত হয়। শুধু এইটুকু নয়। (Little Magazine)
শুনুন তবে একটা ছোট্ট গপ্পো বলি। পাঁচ বছর আগে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিলাম একটা কবিতা আসরে, সেখানে ছজন নবীন কবি নিজেদের কাজ তুলে ধরল। ছ’জনই পুরুষ। আমরা যখন সূত্রধর তথা আয়োজককে, যে নিজেও একজন পুরুষ, জিজ্ঞেস করলাম, একজনও মেয়ে কবিকে ডাকলে না কেন, সে ঘুরিয়ে জানতে চাইল আমরা কাদের কথা বলছি। আমরা ৩-৪ জন মেয়ের নাম বললাম যারা নতুন লিখছে আর তাদের লেখাও আমাদের পছন্দ। তার জিজ্ঞাস্য ছিল, কিন্তু এদের তো কোনো বই নেই! আসরটির জমকালো একটা নাম ছিল— ইতিহাস, আমরা এসেছি। গ্রিক ভাষায়, ইতিহাস, এই বিশেষ্যটি স্বয়ং স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ। (Little Magazine)
কথা হল, গ্রিক সমাজ বিকটরকম রক্ষণশীল, প্রতিক্রিয়াশীল এবং সেক্সিস্ট। অবশ্য তেমন মানুষও আছে যারা ফ্যাসিবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, যে ব্যবস্থা নিজেকে গণতান্ত্রিক হিসেবে তুলে ধরার ভান করে কিন্তু কড়া পুলিশি ব্যবস্থার মাধ্যমে কর্তৃত্ব ফলায় এবং যে কোনো বিরোধী স্বর আর অন্যমতকে স্তব্ধ করতে চায়। আমি বিশ্বাস করি গ্রিসে, কবিতা পারে ফ্যাসিবিরোধী ও শ্রমিকশ্রেণির প্রতর্কের অঙ্গ হতে। (Little Magazine)
আসল কথা, কবিতা সর্বদা গরীব, শ্রমজীবী, নিপীড়িত, পণ্যায়িত জনতার কন্ঠস্বর হয়ে থেকেছে।
আসল কথা, কবিতা সর্বদা গরীব, শ্রমজীবী, নিপীড়িত, পণ্যায়িত জনতার কন্ঠস্বর হয়ে থেকেছে। অদ্রে লর্ডের উক্তি ধার করে বলা যায়, ‘সমস্ত শিল্প প্রকরণের মধ্যে কবিতাই সবচেয়ে সস্তা। কবিতাই সবচেয়ে গোপন, কবিতার জন্য সবচেয়ে কম মালপত্র লাগে, লেখাও যায় দুই শিফটের মাঝে, হাসপাতালের রান্নাঘরে, সাবওয়েতে, ফেলে দেওয়া কুচো কিংবা বাড়তি কাগজে।’ (Little Magazine)
ভাগ্য ভাল, আমি জানি, এই ধারণা পোষণ করার মতো এখানে অনেকে আছে। ২০০৮-এ কয়েকজন বন্ধু আর আমি মিলে একটা ষান্মাসিক কবিতার কাগজ বের করি— টেফলন। কাগজটা পঞ্চদশ সংখ্যায় পৌঁছে গেছে। ১০০০ কপি বিতরণ হয়, বিনামূল্যে, কোনো স্পনসর নেই, বিজ্ঞাপনও থাকে না। কাগজটা তৈরি করা, খরচ করা, বিতরণ করা সবই করে পত্রিকার সম্পাদক-দল, বন্ধুরা আর গ্রাহকরা। (Little Magazine)
গ্রিক সাহিত্য পত্রিকা আর প্রকাশনাগুলি যাকে প্রতিষ্ঠান বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, শুরু থেকেই আমরা তাকে পাশ কাটিয়ে চলার চেষ্টা করেছি। আমরা নবীন কবিদের সমর্থন করতে চেয়েছি, তুলে ধরতে চেয়েছি বর্তমানের মৌলিক ভাবনাগুলি, কবিতাকে মেলাতে চেয়েছি আজকের গ্রিক সমাজের হালচালের সাথে। প্রকাশ করতে চেয়েছি, সমর্থন করেছি পরীক্ষামূলক কবিতা আর সেইসব কবিদের যাঁরা ভাষার ক্ষমতাকে ভেঙেচুরে দিয়ে ভাষাকে সত্য প্রকাশে বাধ্য করছেন। আমরা এমন একটা পত্রিকা প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম যাতে এমন কবিতা ও গদ্য ছাপা হবে যেগুলির মধ্যে নিহিত থাকবে পুঁজিবাদ-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি। (Little Magazine)
এখনও পর্যন্ত সারা পৃথিবীর ষাটের বেশিজন কবিকে প্রকাশ করেছি। আমাদের বেশিরভাগ কাজ গবেষণাধর্মী, বিশেষ করে ৬০ এবং ৭০ দশকের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন যে প্রবীণ কবিরা তাঁদের উপর কাজগুলি। আমরা লেখকদের সমাজরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে গভীর গবেষণা চালাই, কারণ আমরা মনে করি কবিতা নিপীড়িত ও অদৃশ্যমানদের ভাষা দেয় এবং বর্ণবাদী প্রচার ও বয়ানের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
এখনও পর্যন্ত সারা পৃথিবীর ষাটের বেশিজন কবিকে প্রকাশ করেছি। আমাদের বেশিরভাগ কাজ গবেষণাধর্মী, বিশেষ করে ৬০ এবং ৭০ দশকের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন যে প্রবীণ কবিরা তাঁদের উপর কাজগুলি। আমরা লেখকদের সমাজরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে গভীর গবেষণা চালাই, কারণ আমরা মনে করি কবিতা নিপীড়িত ও অদৃশ্যমানদের ভাষা দেয় এবং বর্ণবাদী প্রচার ও বয়ানের বিরুদ্ধে লড়াই করে। আমরা বিশ্বাস করি, কবিতা আমাদের আগের দিনের সঙ্গে বর্তমানের ফ্যাসিবাদ ও লিঙ্গঘৃণা (সেক্সিজম) যে নিরবিচ্ছিন্ন ধারায় যুক্ত, সে সম্পর্ক বুঝতে সাহায্য করে। (Little Magazine)
উদাহরণস্বরূপ, আমরা অনুপ্রাণিত হতে পারি ১৯৭০-এর দশকের সেই ইতালীয় শ্রমিকশ্রেণীর দ্বারা, যাদের বর্ণনা দিয়েছেন ন্যানি ব্যালেস্ত্রিনি। অনুপ্রাণিত হতে পারি ৬০-৭০ দশকের কৃষ্ণ শ্রমজীবীদের সংগ্রামের দ্বারা— যা বর্ণিত হয়েছে নিক্কি জিওভানি এবং ‘দ্য লাস্ট পোয়েট’দের কাজকর্মে। আমাদের অনুপ্রাণিত করতে পারে লিওনেল ফোগার্টি এবং মুদ্রুরুর বর্ণনায় ধৃত অস্ট্রেলিয়ার উপজাতি (আদিবাসী)দের লড়াই। প্যাট পার্কার আর চেরিল ক্লার্কের মতো আমেরিকীয় কালো-লেসবিয়ানদের সাহস আর সংগ্রামী জেদ আমাদের প্রেরণা হতে পারে। বর্ণবাদ, লিঙ্গঘৃণা (সেক্সিজম) এবং সামরিক আগ্রাসন(মিলিটারিজম)এর বিরুদ্ধে তীব্র সহনশক্তি এবং সম্মানকে পুঁজি করে যে লড়াই লড়েছেন সুহেইর হাম্মাদ, মোহ্জা ক্বাফের মতো আরব-আমেরিকান কবিরা, তা আমাদের প্রেরণা দিতে পারে বৈকি! (Little Magazine)
পত্রিকাটি সেইসমস্ত মানুষেরা আপন করে নিয়েছেন যাঁরা ফাঁকা বাড়ি বা একটুকরো জমি দখল করে রাষ্ট্রের চোখে বেআইনিভাবে টিঁকে আছেন, কাছে টেনে নিয়েছেন স্ব-সংগঠিত সামাজিক কেন্দ্রগুলি এবং ফ্যাসিবিরোধী গোষ্ঠীরা।
পত্রিকাটি সেইসমস্ত মানুষেরা আপন করে নিয়েছেন যাঁরা ফাঁকা বাড়ি বা একটুকরো জমি দখল করে রাষ্ট্রের চোখে বেআইনিভাবে টিঁকে আছেন, কাছে টেনে নিয়েছেন স্ব-সংগঠিত সামাজিক কেন্দ্রগুলি এবং ফ্যাসিবিরোধী গোষ্ঠীরা। আমরা খুঁজে পাচ্ছি গ্রিসে এমন প্রচুর মানুষ আছেন যাঁরা কবিতা পছন্দ করেন এবং আমাদের সাথে একমত যে, গ্রিক সমাজে বিস্তার লাভ করা ফ্যাসিবাদ, বর্ণবাদ এবং জাতীয়বাদী প্রবণতা, এজিয়ান সাগরে অভিবাসীদের সলিলসমাধি কিংবা আমাদের জীবন ও শ্রমের সস্তা হতে থাকা ঘিরে জমে ওঠা নৈঃশব্দ ভেঙে ফেলতে পারে কবিতা। (Little Magazine)
অনুবাদ : ইমন সাঁতরা
(Little Magazine)
(বানান অপরিবর্তিত)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।