কেমন যেন একটা গুমোট আজ আমাদের ঘিরে। চোখ না ঘুরিয়েই আমরা বুঝতে পারি কে কোথায় কতদূরে গাঢ় নৈঃশব্দ্য হয়ে আছি। এই ক্রমশ আবছা হতে থাকা দিনটির বাতাসে সেই নৈঃশব্দ্যের পাতাগুলি কেমন অমলিনভাবে দুলছে। কোনও কোনও দিন যেন এমনই হয়। মনে হয় গোটা শরীর যেন চক্ষুষ্মান। কত জোনাকির সমারোহ যেন শরীরে কীভাবে উড়ে এসেছে। এমন সময় খুব আকাশে তাকাতে ইচ্ছে করে। মনে হয় আহ্, কোনও দৈবনির্দেশে এই ছাদ বা চালের টোপর যদি দৃষ্টিপথ থেকে সরে যেত! জ্বলজ্বল করে উঠত শুধু নক্ষত্রের মালা পরা রাতের নগ্ন আকাশ! কোথাও দেখা যেত বালি খাদানে নামা লরির আলোর মতো প্রভা। সেটাই হয়তো জীবনের চিহ্ন। যে জীবনে অনেক, কাতারে কাতারে মানুষ। তাদের ঘরবাড়ির গন্ধ। পায়ু জরায়ু জঠর সব চিৎকার করছে। নখ গাল পিঠের জড়ুল সব চিৎকার করছে। ছিপছিপে ফুলের গাছ, পথবাতি বা ঘাসের হলুদ চিৎকার করছে। দু-একটা পলকা অপরাধ তো আজ আমার হাতে হয়েইছে। তোমার হাতেও কি হয় না? কারও আঠা আঠা কান্তিময় চুল কি মনে পড়ে না? কচি ধানের শিষ-আসা দুই বাহুর কথা? আমি জানি পড়ে। টিভিতে যে ভয়াবহ বিজ্ঞাপন হয় বা কণ্ঠার নীচে কোথাও যে বহুদূর অবধি নুড়িপাথর, পাড়ে উঠে গাছের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া যে-রাস্তা চিকচিক করে— তারই কারণে। তবে কী জানো, এমন পার্থিবে নৈঃশব্দ্যেরও একটা আয়ু আছে। ধোঁয়া-ওঠা চায়ের মতো সেও চুমুকে চুমুকে ফুরিয়ে যায়
আহ্, কোনও দৈবনির্দেশে এই ছাদ বা চালের টোপর যদি সরে যেত! আকাশে তারার পেছনে আমাদের কত প্রিয়জন থাকে! তাদের সঙ্গে যদি একবার সংযোগ হয়! আহা, কত কী দেখানোর আছে ওদের! এই একটু লম্বা গলার সাদা হাঁসের মতো বাড়িটি, এই যে একটা চকমকে বাড়ির গা ঘেঁষে আসা বিদ্যুতের তার, এই যে আজ্ঞাবহ জলের প্রতীক্ষা— এইসব, এইসব। এই যে তুমি আর একটু পরেই নৈঃশব্দ্য ফেলে উঠে যাবে, ভুউউস করে জ্বলে উঠবে নীলাভ শিখায় ওভেন— এইসবই তো। এই যে ফুটন্ত হাঁড়ির জলে কত দুষ্প্রাপ্য ফুল দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে যাবে, এই যে থালা-বাসনের দৌরাত্ম্যে কত অঙ্গাভরণ খসে যাবে বা নমিতমুখ হয়ে থাকার কারণে কত তুষারপাত দেখাই হবে না— সেসবও কি নয়? তারার আড়ালে আমাদের কত প্রিয়জনেরা থাকে ভাবো! কত প্রিয়জন, যারা তোমাকে ঝলমলে সকালের মতো দেখেছিল। যারা তোমাকে ঘোড়ার পিঠে উঠিয়ে প্রথম দাম্পত্য শিখিয়েছিল। আহ্! কী অদ্ভুত একটা কথা এই দাম্পত্য! যেন সেই কবিতায় বলা পারস্য গালিচা। কত পদচ্ছাপ! কখনও মানুষের, কখনও জন্তুর। কত রক্ত! কখনও আঙুলের, কখনও যোনির। এই যে ক্রমশ আবছা হতে থাকা দিনটি, এও কি আমাদের প্রিয়জন? এও কি তারার পেছনে গিয়ে আমৃত্যু আমাদের চুপ করে লক্ষ্য করবে? হয়তো করবে বা হয়তো করবে না। তবে আমরা তো আমৃত্যু এমনই থাকব। উত্তুঙ্গ ভাতের পাহাড় ভেঙে আবার সেই পুরোনো, থলথলে প্রায়ান্ধ বিছানা…
ছবি সৌজন্য: Flickr
জন্ম কোচবিহার জেলায়৷ বড় হয়ে ওঠা আলিপুরদুয়ার জেলার হ্যামিল্টনগঞ্জে৷ কলেজে পড়াকালীন লেখালেখির প্রতি আগ্রহ জন্মায় এবং লেখার হাতেখড়ি৷ স্থানীয় ছোট পত্রপত্রিকায় প্রথম লেখা প্রকাশ৷ এরপর লেখায় দীর্ঘ সময়ের ছেদ পড়ে৷ আবার গত তিনবছর ধরে লেখায় ফেরা৷ কাব্যগ্রন্থ 'কিছুক্ষণ থাকা অথবা অনন্তকাল' ২০২০ কলকাতা বইমেলায় 'শুধু বিঘে দুই' থেকে প্রকাশিত৷ মূলত কবিতা লিখতে পছন্দ করেন৷ একটু আধটু গদ্যচর্চাও হয়৷
 
								 
								 
								 
											 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								