ফ্যাশন হ’ল চলতি হাওয়ার পন্থি। স্টাইল হ’ল ব্যক্তিত্বের পরিচয়। ফ্যাশনের কাল পরিবর্তন হয়। স্টাইল চিরকালীন। আশি-নব্বই দশকের বাঙালি পরিবারে পোশাক আশাক নিয়ে চিন্তাভাবনা খুব সীমিত ছিল। সকল পরিবারেই দেখেছি পয়লা বৈশাখে একটা সুতির ফ্রক, হাফ শার্ট হাফ প্যান্ট বাচ্চাদের জন্য পাড়ার কোনও দোকান থেকে নেওয়া। আর মহিলাদের জন্য ছাপা শাড়িই যথেষ্ট। পুজোর আগে কোনও বস্ত্রালয়ে ঢুকেই দোকানির পরামর্শ মতো সে বছরের তৈরি হয়ে আসা পোশাকের সম্ভার থেকে নিজের বাজেট অনুযায়ী কেনাকাটা করা। মূলত পরিবারের রোজগেরে পুরুষ সদস্যই সবার জন্য পুজোর বাজার করে আনতেন। সারা বছরের পরিধান নিয়ে ব্যাস এটুকুই চিন্তাভাবনা। জীবন যেমন সহজ ও মাপা ছিল, সরকারি চাকুরে বাবার মাপা আয়ের মতো, তেমনই ছিল সাধারণ পরিধানে পুজো কাটিয়ে দেওয়ার সাদা সরল সময়। (Pujo Fashion)
আরও পড়ুন- বাঙালির ফ্যাশন: অদলবদলের তেত্রিশ বছর
আমার মায়ের আলমারি ঘাঁটলে দেখেছি তাঁতের পাঁচ ছয়টা শাড়ির পাশে সিল্কের ছাপা শাড়ি, যেগুলো মা বছরে দু একবারের বেশি পরত না। দামি শাড়ি বলতে বেনারসি, একাধিক ছিল— ঐ দিয়েই বছরের পর বছর বিয়েবাড়ি পার করত মা। একটু বড় হতেই বিয়েবাড়ি এলে আমার খুব শখ হত মায়ের শাড়ি পরার। তখন ওই বেনারসিরই পাট ভাঙা হত। বেশ কিছু সুতির ছাপা শাড়িও ছিল, রোজকার চাকরিতে বেরোনোর পোশাক হিসেবে মায়ের প্রথম পছন্দ। পুরনো ছাপাগুলো বাড়িতে পরে কাটিয়ে দিত। একবার পুজোয় বাবা মসলিনের শাড়ি কিনে আনল মায়ের জন্য। তাঁতের শাড়ির মতোই দেখতে। স্বচ্ছ শাড়ি। আমি জানতাম বাবার বাংলাদেশের মসলিন শাড়ির প্রতি বেশ একটা উচ্চ ধারণা ছিল। আমাকে ছোটবেলায় গল্প করে অনেকবার সেই তাঁতি শিল্পীদের দক্ষতার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করত। একটা শাড়ি এমন সূক্ষ্ম সুতো দিয়ে বোনা যে তাকে একটা দেশলাই বাক্সে ভরে দেওয়া যেত। তাই যেবার বাবা সেই নামেরই শাড়ি দোকানে দেখেছে, এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে যে আনন্দ করে মায়ের জন্য একাধিক কিনবে না! ঐ শাড়ি আমিও বড় হয়ে স্কুলের অনুষ্ঠানে পরেছি, মনে আছে।

এমন সময়েই একটা ঝড় এল, “কবুতর যা যা যা”— পুজোয় ঠাকুর দেখব কি, চারদিকে তো নানা রূপে, নানা মাপে ভাগ্যশ্রী ঘুরে বেড়াচ্ছে! সেই গলাবন্ধ সাদা কামিজ, যার একপাশ দিয়ে নেমে গেছে নীল রঙের বড় বড় ফুলের অ্যাপ্লিক। সেই প্রথম বুঝলাম কাকে বলে ফ্যাশনের ট্রেন্ড। আমি চিরকালই স্টাইলের পক্ষপাতি। বুঝে, বা না বুঝে। ততদিনে কেমন পোশাক পছন্দ করি তার একটা সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি হচ্ছে। মা বাবার সঙ্গে এ বিষয়ে কোনও বিরোধ ছিল না ভাগ্যক্রমে। তাই ওরা নিজেরা পছন্দ করে কিনে আনলেও, সেটা আমার মনোমতোই হত এবং অবশ্যই কোনও ট্রেন্ডকে খুব একটা গ্রাহ্য না করেই।
কিন্তু তবুও সূক্ষ্মভাবে ফ্যাশন ট্রেন্ডের প্রভাব আমাদের সকলের উপরেই পরে। যেমন, খেয়াল করে দেখলে দেখতে পাব, বিরাট আর অনুষ্কার বিয়ের জন্য প্রখ্যাত ডিজাইনার সব্যসাচী হালকা পিচ রঙের পোশাক পরিকল্পনা করেছিলেন। তারপর থেকে বিয়ের আসরে এই হালকা রঙের প্রাধান্য দেখতে পাই। তার আগে বিয়ে বলতে লালরংই বুঝতাম।

এখন আমরা পোশাক বিষয়ে অনেক সচেতন, প্রতিটা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে পোশাক বাছি। তার রং ও আনুষঙ্গিক সাজ কেমন হবে সবই খেয়াল রাখা হয়। এই সচেতনতার একটা পজিটিভ দিক হ’ল এর ফলে পোশাক শিল্প উত্তরোত্তর দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে প্রসারিত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির উপরও এর প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই।
এখন ফ্যাশন ডিজাইনিং একটি আকর্ষণীয় পেশা। বহু ছেলে-মেয়ে বেশ কিছু বছর এ নিয়ে রীতিমতো পড়াশোনা করে নিজেদের জন্য সম্মাননীয় উপার্জন করছে। এ ছাড়াও বহু প্রতিভাময়ী মহিলা, এমনকি পুরুষও নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী নিজস্ব ডিজাইনে তৈরি পোশাক পরিকল্পনা করছেন ও তা প্রদর্শন করছেন। তাদের বুটিক থেকে সেই পোশাক কিনছেনও বহু মানুষ। পুরুষদের পোশাক নিয়েও যে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করা যায় তা প্রথম দেখিয়ে ছিলেন আর এক প্রখ্যাত ডিজাইনার শর্বরী দত্ত। তার সেই চিন্তাভাবনা কাকে না ছুঁয়ে গেছে! ভারতের এমন কোনও বিখ্যাত পুরুষ নেই যিনি তার পরিকল্পিত পোশাক পরেননি।

দেখা যাচ্ছে যে ফ্যাশন এমন একটা নৈপুণ্য (art) যা ক্রমশ একটা শিল্পে ( industry) পরিণত হয়েছে। ভারতের ইতিহাসে আমরা প্রাচীনকাল থেকেই পোশাক নিয়ে বহু পরীক্ষানিরীক্ষা দেখেছি। তার ফলে নানা প্রদেশের নানারকম হাতে বোনা বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্যাটার্ন তৈরি হয়েছে, যা একবার দেখেই বলে দেওয়া যায় তা ভারতের কোন অঞ্চলের পোশাক। সূচীশিল্পও যে উৎকর্ষতায় পৌঁছেছে তা সারা বিশ্বে স্বীকৃত। এই শিল্পীরা সময়ের সঙ্গে হারিয়েই যেতে বসেছিলেন। ফ্যাশন দুনিয়ায় সাম্প্রতিক বিপ্লব ঘটে যাওয়ার পর এখন আমরা আবার সেই পুরনো শিল্পমাধুর্যকে পুনরুদ্ধার করতে পারছি এটাই আশার কথা।
পুজোর চারদিন যদি এবারের চলতি ফ্যাশনের নিরিখে সাজতে হয় তাহলে ষষ্ঠীর দিন সকালে সাজুন রেশম কোটায় ব্লকপ্রিন্ট শাড়িতে। সন্ধ্যায় পরা যায় আজরাখের কলিদার কুর্তি। সপ্তমীর সকালে বাংলার হাতে বোনা সুতির শাড়ি, সন্ধ্যায় পরুন জড়ি-চুমকি দিয়ে কাজ করা পিওর ক্রেপের ডিজাইনার স্যুট। অষ্টমীর সকালে অঞ্জলি দেওয়ার জন্য লাল সাদা হালকা কাজের কাঞ্জিভরম ভক্তি কিছুটা বাড়িয়েই দেবে। সন্ধ্যায় অরগ্যাঞ্জা বেনারসির চমক চাই-ই চাই। নবমী সকালে চান্দেরি বাটিক শাড়ি বেশ মানানসই হবে। সন্ধ্যায় তসরে দুর্গা কাঁথা সবার নজর কাড়বে। দশমীতে মাকে বরণ করুন লাল-সাদা হাফ তসরের আলপনা আঁকা শাড়ি পরে। (Pujo Fashion)

তারপর আর কি, চোখের জলে মাকে বিদায় দিয়ে, আসছে বছর আবার হবে এই আশায় দিন কাটাই।
সবশেষে আসল কথা, ফ্যাশনে থাকুন, স্টাইলে থাকুন। মুখ ও মুখোশ দুই নিয়েই আমাদের চলা।
*ছবি সৌজন্য: Adobe stock, Wikibio, Facebook
সুস্মিতা (চৌধুরী) দত্ত পেশাগত পরিচয়ে পোশাক পরিকল্পক। ভালবাসেন ছবি আঁকতে, চিত্রকলা বিষয়ে পড়াশোনা করতে। সিনেমা ও গ্রুপ থিয়েটার নিয়েও আগ্রহ রয়েছে। যুক্ত রয়েছেন নানা সামাজিক কল্যাণমূলক কাজকর্মের সঙ্গে। আর অবসর সময় কাটে সাহিত্যচর্চা ও বাগান করে।