১৯৪২ সাল, ওয়ারশ। পোল্যান্ডের বিভিন্ন শহর তখন ছেয়ে যাচ্ছে ঘেটোয়। তার মধ্যে নৃশংসতম ঘেটো তৈরি হয় ওয়ারশতে। একটি সাত বছরের ইহুদি শিশু তার পরিবারের সঙ্গে ঢুকে যাচ্ছে ঘেটোর অন্ধকারে। কিন্তু ওর আঙুল যে ছুঁয়ে দেখতে চায় পিয়ানোর এক একটি রিডের স্পন্দন। সেখানেই তার জীবনের সুর। যুদ্ধের সাইরেনকে উপেক্ষা করে সূর্যের আলোর মধ্যে থেকে ও খুঁজে ফিরছে সুরের বর্ণালী। নাৎসি পার্টি পরিচয়পত্র চাইছে। ওর নামের সঙ্গে যে অভিশাপের মতো ঝুলে আছে ইহুদি পরিচয়। ছেলেটির মা ফেলিক্সা ক্রাউথমার বুদ্ধি করে কাগজের নাম রবার্ট আন্দ্রেজ ক্রাউথমার পাল্টে নতুন নামের জন্ম দিয়ে গেলেন— আন্দ্রে চেকভস্কি (Andre Tchaikowsky)। ভবিষ্যৎ পৃথিবী যাকে চিনবে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পোলিশ পিয়ানোবাদক রূপে। এই ভয়ানক জীবনই হয়তো তাঁকে আরও কাছে নিয়ে গেছে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের। শেক্সপিয়রের সাতটি সনেটে সুর ও কণ্ঠস্বর দিয়েছিলেন চেকভস্কি।
ইহুদি জীবনের যন্ত্রণার সুরের মধ্যে থেকেই একদিন ‘দ্য মার্চেন্ট অফ ভেনিস’— অপেরায় উঠে আসে। অপেরার প্রথম দুটি অংশ দুটি সিনের জন্য তৈরি করার কাজ চলেছিল ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত, কিন্তু হঠাৎ করে কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময় তিনি কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত। ডিরেক্টর হেয়ারউডের থেকে প্রত্যাখ্যানের চিঠি তাঁর জীবনে একটা আঘাতের মতো নেমে আসে। এর তিন মাস পরেই তিনি মারা যাবেন। মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ ইচ্ছে ছিল ‘দ্য মার্চেন্ট অফ ভেনিস’-এর অপেরাটি যেন একদিন মঞ্চের আলো পায়। প্রাণের নাটককারের মধ্যে দিয়ে তিনি ভাবতেন তাঁর কথাগুলো সুর হয়ে মানুষের শিরায় উপশিরায় পৌঁছে যাবে। এরপর তিনি একটি উইল তৈরি করেন যেখানে তিনি মেডিক্যাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য দেহ-দান করবেন, আর মাথার খুলিটা দান করবেন রয়্যাল শেক্সপিয়র কোম্পানিকে। পৃথিবীর সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একজন সংগীতশিল্পী, থিয়েটারের জন্য নিজের খুলি দান করেছেন— এমন ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে একটিও আর নেই।

খুলির ব্যবহার বলতে যে নাটকের কথা মাথায় আসে, তা অবশ্যই ‘হ্যামলেট’। রাজার বিদুষক ইয়রিকের খুলি হাতে হ্যামলেটের বিলাপ, “আহা রে জীবন! তোমাকে কতই না ভালবাসতাম আমি ইয়রিক।” জীবন কত নগণ্য! একদিন যে ইয়রিক সবাইকে আনন্দ দিয়েছে আজ তার স্থান ভাগাড়ের এক কোণায়। হ্যামলেটের বুকের কারাগার থেকে যে যন্ত্রণাময় ভাষ্য উঠে আসছে, চেকভস্কি তাঁর পিয়ানোর রিডগুলোর মধ্যে দিয়ে যেন সেই সুর শুনতে পেয়েছেন। একদিন স্বপ্ন দেখতেন থিয়েটারে অভিনয় করবেন, হল না জীবনকালে মঞ্চে ওঠার ইচ্ছাপূরণ। মাত্র ছেচল্লিশ বছরের জীবন, হ্যামলেট যেন ইয়রিকের খুলি হাতে চেকভস্কির জীবনের গল্প বলে চলেছেন। কিন্তু তিনি থেকে গেলেন রয়্যাল শেক্সপিয়র কোম্পানিতে, চরিত্র হিসাবে সশরীরে না হলেও মৃত্যুকে চরিত্রের সমান গুরুত্ব দিয়ে রয়ে গেলেন। যেন তাঁর খুলি হ্যামলেট নাটকের ‘এক অলৌকিক প্রপস’। তবে দান করার সঙ্গে সঙ্গেই নাটকে কিন্তু ব্যবহার করা হয়নি তাঁর খুলি। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল পঁচিশ বছর। পরিচালক গ্রেগ ডোরান প্রথম তাঁর খুলিকে মঞ্চে নিয়ে আসেন ২০০৮ সালে স্বয়ং শেক্সপিয়রের দেশ স্ট্রাডফোর্ড-আপন-এভনের কোর্টইয়ার্ড থিয়েটারে— যে নাট্যে হ্যামলেট চরিত্রে অভিনয় করেন ডেভিড টিন্যান্ট।
আরও পড়ুন: গণায়নের ‘জুলিয়াস সিজার’- রোমান নাটকে বাংলার বোল
২০০৮-এর জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত স্ট্র্যটফোর্ড রয়্যাল শেক্সপিয়র কোম্পানিতে চেকভস্কি-র খুলি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সেটাও একদম গোপনে। সেই বছর ডিসেম্বরে লন্ডনে নাটকটি প্রযোজিত হলে সত্যিকারের মানবখুলির প্রপসের বিষয়টা সংবাদমাধ্যমের কাছে জানাজানি হয়ে যায়। জনগণের উপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে কিংবা মূল নাট্য বাদে এই দৃশ্যটিকে নিয়ে যাতে অনর্থক হৈচৈ না হয় তাই এই খুলির ব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশ দেয় রয়্যাল শেক্সপিয়র কোম্পানি। চেকভস্কি-র খুলি নিয়ে শেষ পারফর্মেন্স হয় ১০ জানুয়ারি,২০০৯ সালে। তবে কিছু দিন পরেই বিবিসি এই নাটকটি ডকুমেন্ট করেও রাখে, এই ডকুমেন্টেড কপিতে আবার চেকভস্কির খুলি ব্যবহার করা হয়।

ভাবতে অবাক লাগে, পৃথিবীতে এমন কোনও নাট্যকার আছে যার নাটকে মৃতেরাও অভিনয়ের সুযোগ পান! সুযোগ পাওয়ার জন্য জীবিত মানুষ মৃত্যুর পরও অপেক্ষা করেন। চেকভস্কির এই খুলি-দানের ঘটনাই প্রথম নয় কিন্তু। প্রথম এই নাটকে মৃত ইয়রিকের অভিনয় করার জন্য ১৮০০ সালে ফিলাডেলফিয়া থিয়েটারে জন রিড নিজের দেহ দান করেন।
তার পর দ্য ওয়ালনাট স্ট্রিট থিয়েটার, ফিলাডেলফিয়ায়, একজন ফার্মেসি কর্মী একটি খুলি দান করেন। ওঁর নাম কারপেনটার। সেই খুলি নিয়েই উনিশ শতকের ন’জন প্রধান অভিনেতা ‘দ্য ওয়ালনাট স্ট্রিট থিয়েটার’- এ অভিনয় করেন।
চেকভস্কির খুলি নিয়ে কবরখানার দৃশ্যটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুবই অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন তাঁর এজেন্ট ও বন্ধু টেরি হ্যারিসন। তিনি বলেছিলেন,”আমি জানি শিল্পীরা অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ হন, সবার পক্ষে এমন একটি কাজ করাও সহজ নয়, কিন্তু ডেভিড টিন্যান্ট যে দক্ষতার সঙ্গে কাজটি করেছেন তা এককথায় অতুলনীয়।” তবে এই খুলির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পিছনে জাতি-বিদ্বেষের সুর যে একেবারেই নেই, একথা কিন্তু ফেলে দেওয়া যাবে না। একজন ইহুদির খুলি; ইংরেজ রঙ্গমঞ্চে আধিপত্য চালাবে এ কেমন করে হয়! যেখানে হ্যামলেট বড় করুণ কিন্তু বলিষ্ঠভাবে ইয়রিকের খুলির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করবে— কোথায় তার (ইয়রিকের) চাবুক-মারা ব্যঙ্গ, কোথায় তার সংগীত, উল্লফন, উল্লাস! আসলে, এই প্রশ্নগুলোই যদি একটি জাতির উদ্দেশ্যে সত্যি প্রকাশিত হয়ে যায়? রাষ্ট্রক্ষমতা কি তবে আন্দ্রের ভূত দেখেছিল? আবার সেই খুলিকে বড্ড আদরে গালে জড়িয়ে স্পর্শ করবে হ্যামলেট— এ তো ভয়ানক দৃশ্য হয়ে পৌঁছবে জনগণের কাছে। সূক্ষ্মভাবে কোথাও একটা ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যনসিং’-এর খেলা চলেছে ভিতরে ভিতরে, যেখানে আন্দ্রে চেকভস্কিকে ছাপিয়ে হয়তো প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছিল তার বহমান জাতিসত্তা কিংবা উত্তরাধিকার। একটি রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রশ্ন করে উৎখাত করে দেওয়ার জন্য উইলিয়াম শেক্সপিয়র এভাবেই যুগে যুগে কিংবদন্তি হয়ে থাকবেন।
পেশায় ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক। টেগোর রিসার্চ ইন্সটিটিউটে বর্তমানে পাঠরত।
থিয়েটার, শিল্প ও কবিতা-র ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন।
One Response
Lovly