ঋতুপর্ণ ঘোষ আমার বহুদিনের বন্ধু। ওর সঙ্গে আমার যখন প্রথম আলাপ হয় তখন আমি সবে বি. এ. পরীক্ষা দিয়েছি আর ঋতুপর্ণ কলেজের শেষ বছরে সম্ভবত। (Little Magazine)
আমি ছিলাম লরেটো কলেজের ছাত্রী আর ঋতুপর্ণ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। দু’জনের জগৎ ছিল আলাদা। দেখা হয় নাটকের রিহার্সালে। আমার নাটকের পরিচালক ছিলেন তমাল রায়চৌধুরী, যাঁর বাড়ির কাছাকাছি থাকত ঋতুপর্ণ এবং সেই সুবাদে ও তমালদা’র গ্রুপে সাহায্য করতে আসে। সাহায্য মানে আমাকে দিয়ে ডায়ালগ মুখস্থ করানো। আমরা তখন গ্যেটের ফাউস্ট নাটকের বাংলা ভার্সন করছি ম্যাক্স ম্যুলার ভবনের হয়ে। বঙ্গানুবাদ করেছেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। কাব্য নাটক, তাই ডায়ালগ মুখস্থ চায়। যেহেতু আমি লরেটো কলেজে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়েছিলাম, তাই অনেকেরই ধারণা ছিল আমার বাংলা খুব কাঁচা হবে এবং আমার উচ্চারণও একটু বিদেশি ধরনের হবে; ঋতুকেও সেইরকমই আভাস দেওয়া হয়েছিল বোধহয়। তাই প্রথমেই ও আমাকে উচ্চারণ নিয়ে জ্ঞান দিতে শুরু করে, আর এতে আমি বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হই। ও কে, যে উচ্চারণ শেখাবে আমাকে? আমি গোখলে মেমোরিয়ালে পড়েছি, ক্লাস সিক্স অবধি পুরোপুরি বাংলা মিডিয়ামে, আমার উচ্চারণ কি করে বিদেশি হয়? এ নিয়ে খুব জোর তর্কাতর্কির পর আমি যখন পড়তে থাকি লাইন, ঋতু স্বীকার করে নেয় ওর ধারণাটা ভুল ছিল। ঋতুপর্ণর একটা বড় গুণ ছিল ভুলটা মেনে নিতে পারার ক্ষমতা। অন্তত বন্ধুদের ক্ষেত্রে।
সেই কলেজের পর আমরা যে যার কেরিয়ার গড়তে বেরিয়ে পড়ি নিজ নিজ ক্ষেত্রে। আমি সাংবাদিকতা করা শুরু করি আর ঋতুপর্ণ বিজ্ঞাপনের জগতে ঢুকে পড়ে। প্রায় বছর দশেক পরে নব্বইয়ের দশকের প্রথমে আবার ঋতুপর্ণের সঙ্গে দেখা।
ততদিনে আমি সানন্দা পত্রিকার সহকারী সম্পাদক আর ঋতুপর্ণ তার প্রথম ছবি ‘হীরের আংটি’ তৈরি করে ফেলেছে, কিন্তু ছবি মুক্তি পাচ্ছে না তাই মনে মনে গুমরে মরছে। কিন্তু কাজ বা চিন্তা ভাবনা ওর থেমে নেই। প্রথম ছবি মুক্তি পাচ্ছে না বলে বসে থাকলে চলবে? ও ততদিনে ‘উনিশে এপ্রিল’-এর চিত্রনাট্য তৈরি করে ফেলেছে এবং অপর্ণা সেন-কে সেটা শুনিয়ে এতটাই মুগ্ধ করে ফেলেছে, যে রীনাদি অর্থাৎ অপর্ণা সেন ও তার বান্ধবী রেণু রায় এই ছবিটি প্রযোজনা করবেন বলে ঠিক করেন। অপর্ণা সেন তো অভিনয়ে ছিলেনই সঙ্গে দেবশ্রী রায় আর দীপঙ্কর দে-কেও দুটি চরিত্রে নেয় ঋতুপর্ণ। দেবশ্রী তখন বাণিজ্যিক ছবির এক নম্বর নায়িকা, কিন্তু ঋতুপর্ণ জানত ওর মধ্যে অভিনয়ের ক্ষমতা রয়েছে। ‘36 চৌরঙ্গী লেন’-এ রীনাদি-ই ওকে নিয়েছিলেন। ‘উনিশে এপ্রিল’ শুরু হয়। খুব বাঁধা বাজেটের ছবি হবে, রেণুদি একটি পুরোনো বাড়ি জোগাড় করেন নিউ আলিপুরে। বিভিন্ন বন্ধুদের বাড়ি থেকে আসে প্রপ ও আসবাব। বাড়িটা যেন একেবারে রুচিশীল এক নৃত্য শিল্পীর বাড়ি বলে মনে হয়। সেট নিয়ে ঋতুপর্ণর যে মাতামাতি ছিল তা এই ছবিতে আমি চাক্ষুষ করি। বাড়িটার প্রতিটি ঘর কি দারুণ সাজানো, যেন আমার স্বপ্নের বাড়ি, কোথাও সেই অর্থে ফিল্মি কিছু নেই, স্বাভাবিক বাড়ির অন্দরসজ্জা, কিন্তু রুচিশীল।
‘উনিশে এপ্রিল’-এর শুটিং যখন শুরু হয় আমি তখন সানন্দা পত্রিকায় কাজ করছি। তাই প্রায় এক পাতার লে-আউট নিয়ে ঋতুর শুটে রীনাদির সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। শুটিং-টা ছিল একটা উৎসবের মতো। অভিনেতারা এবং কলাকুশলীরা সবাই কাজ করছে না আনন্দ করছে তা বোঝা দায়! ঋতুর মুড এরকমই হত, অন্তত আমি যে সময় পর্যন্ত কাজ করেছি সেই সময় অবধি। একদিন শুটে গিয়ে দেখি প্রচণ্ড সমস্যা চলছে, ঋতুপর্ণ দেবশ্রী রায়কে বিশাল একটা চশমা দিয়েছে যাতে আলো পড়ে গ্লেয়ার হচ্ছে, সব কিছুর প্রতিচ্ছবি পড়ছে, আর যেহেতু ছোট ঘরেতে শুটিং হচ্ছে তাই আলো রাখার জায়গা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, চশমার কাঁচে বারবার আলো পড়ছে। কি হবে? হঠাৎ ঋতুই বলল একটা কাজ করা যাক, চশমার ফ্রেমটা থেকে কাঁচ দুটো খুলে নাও । তাও কি হয় নাকি, সবাই বুঝতে পারলে কি বলবে? ঋতু দৃঢ় কণ্ঠেই বলে, না কেউ বুঝবে না, আমি বলছি। পরিচালক যখন বলেছে, তাই করা হল। প্রায় পুরো ছবিতে দেবশ্রী অভিনয় করলেন কাঁচ ছাড়া চশমা পরে। পরবর্তী সময় যখন ছবিটা মুক্তি পায় তখন কেউ কোনোদিন চশমার কাঁচ নেই একথা বলেনি। খুব অল্প বয়সে জীবনের প্রথম থেকেই ঋতুপর্ণর মধ্যে যেটা ছিল তা হল আত্মবিশ্বাস। ও কি করবে, কি শট নেবে, কোন রি-টেক হবে কোনটা হবে না সেই ব্যাপারে ওর কোনো দ্বিমত বা দোনামনা ছিল না।
‘উনিশে এপ্রিল’ শেষ হল ১৯৯৪ সালে, সেন্সর ও হল। ততদিনে আমি অডিও ভিস্যুয়াল জগতে কাজ শুরু করেছি। যদিও তখনও অপর্ণা সেনের সঙ্গে কাজ করি। ঋতুপর্ণ একদিন বলল ও একটা ক্লোজড ডোর শো করছে NT1 – এ বন্ধুদের জন্য, আমাকে দেখতে আসতে বলল। গেলাম দেখতে উনিশে এপ্রিল। আমার পাশে বসেছিল আমারই স্কুলের বান্ধবী মমতা শঙ্কর। ছবি শুরু হওয়ার পর আমরা কেমন ধীরে ধীরে রীনাদি ও দেবশ্রীর মধ্যেকার সম্পর্কে ডুবে যেতে থাকি। বহু বছর পর একটা বাংলা ছবি দেখে আমরা ছবির চরিত্রদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ি। ছবি শেষ হওয়ার পর মমতা আর আমি দুজনেই লজ্জা পেয়ে যাই, কারণ দুজনের চোখে তখন জল। বেরিয়ে এসে ঋতুপর্ণকে কিছু বলতেই পারিনি— এতটাই ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম। অফিসে এসেই বসে পড়ি ছবিটা নিয়ে লিখতে। লিখে যাই আমারই এক বন্ধুর কাছে যে তখন দৈনিক পত্রিকার ফিচার বিভাগ দেখাশোনা করছে। তাকে বলি এই ছবিটা নিয়ে লিখেছি, প্লিজ তোর পাতাতে একটু জায়গা দে। তখনও ঋতুপর্ণকে কেউ চেনে না । তাই আমাকে বলা হল অপর্ণা সেন আর দেবশ্রী রায়ের সাক্ষাৎকার আগে নিয়ে এসো এই ছবিটা নিয়ে, তারপর ছাপাব। আমি করলামও তাই। তারপর রোজই শুনি পরের সপ্তাহে ছাপাবে, এ সপ্তাহে জায়গা নেই। এটা হয়, কারণ আমিও তো খবরের কাগজে কাজ করেছি, সেখানে জরুরি খবরের পাশে নতুন পরিচালকের ছবির খবর ততটা জরুরি নয়। কিন্তু, এর মধ্যেই যখন উনিশে এপ্রিল জাতীয় পুরস্কার পেল, স্বর্ণকমল যখন ঋতুর ঘরে এল আর দেবশ্রী রায় সেরা অভিনেত্রীর শিরোপা পেলেন, বাক্সের তলা থেকে আমার লেখাটাই বার করে ঝেড়ে মুছে প্রকাশিত হল। তখন ঋতুপর্ণ আর অনামী বন্ধু নয়, জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী পরিচালক। তবে উনিশে এপ্রিল-এর সাফল্য শুধু জাতীয় পুরস্কারেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ১৯৯৫ সালে যখন ছবিটি হলে মুক্তি পায়, শহুরে বাঙালি মধ্যবিত্ত যারা হল বিমুখ হয়েছিলেন, উনিশে এপ্রিল দেখতে ফিরে আসেন। মিনার-বিজলি-ছবিঘরের সামনে গাড়ির লাইন লেগে যায়। বাঙালি আবার এমন ছবি পায় যার মধ্যে গল্প আছে, কিছু বক্তব্য আছে, ইমোশন আছে আর এক ধরনের স্বপ্ন পূরণ আছে— যা আর পাঁচটা বাণিজ্যিক ছবির থেকে আলাদা। ঋতুপর্ণই খুলে দেয় সেই দরজা যা আবার আমাদের মতো বহু পরিচালককে ছবি করার জন্য উজ্জীবিত করে…
(বানান অপরিবর্তিত)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।