এখন খুব ভোরবেলা, মানে সেই বিহানকালে মাঠের প্রান্তে দাঁড়ালে শিশিরে জবুথবু ধান আর কুয়াশায় মিশে একখানা ছবি মনে হয় ফুটে উঠছে প্রতিদিন। এই ছবি রোজ দেখলেও পুরনো হয় না। কেবলই মনে হয় এই আমার দেশ, এই আমার মাটি। মাটির ভিতরে যে অপার সম্ভাবনা, তাকে সেই কবেই যেন আবিষ্কার করেছিল মানুষ। আমাদের কেন, সারা পৃথিবীর রূপকথায় সেই মায়াকল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাকে যত চিনি ততই অবাক হই। সে যেন আস্ত একখানা গল্পের মাকু। সে যেন ফুরিয়েও ফুরোয় না। এই মাটিকে দেশ গাঁয়ের মানুষ এক ভাবে আবিষ্কার করেছে প্রতিদিন। বিশেষত মেয়েরা এই মাটির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে প্রতিদিনের কাজের মধ্য দিয়ে। সে চেনে কোনও মাটি দিয়ে উনোন নিকোতে হয়, কখন মাঠে মাঠে কেঁচোরা মাটি তোলে। মাটির গল্পে তার যে পুরনো দখলদারি সে কথা এ পৃথিবী ভুলেছে বোধহয় কিন্তু ইতিহাসে তার ছাপ রয়ে গেছে আজও। আজ থেকে প্রায় বারো হাজার বছর আগে যে কৃষির উদ্ভব হয়েছিল, তারও মূলে ছিলেন মেয়েরাই। এ’কথা নৃবিজ্ঞান স্বীকার করেছে কবেই। লাঙল আসার আগে পর্যন্ত কৃষির পুরোটাই ছিল মেয়েদের হাতে। এখনও তারাই ধান রোয়া করেন, ধান কাটেন, সেদ্ধ করেন। কেবল লাঙলে তাঁদের অধিকার নেই।
কৃষিবিজ্ঞান আর মাটির গল্পে কেমন করে তারা জড়িয়ে ছিলেন সে আলেখ্য ধরা পড়েছে বিভিন্না দেশের বা আঞ্চলিক লোকগানে লোকছড়ায়। চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘নারীর গান শ্রমের গান’ বইতেও ভারী যত্নে সেসব সংগ্রহ লিপিবদ্ধ করেছেন। সেসব গান পড়তে পড়তে টের পাই মেয়েদের ঘর গেরস্থালির যাপনে মাটিকে ছুঁয়ে থাকার আলপনা সে আজকের নয়। এমনকী দক্ষিণ ভারতীয় আলপনায় বা প্রতিদিন সকালে গৃহদ্বারে যে কোলাম দেওয়ার রীতি সেখানেও মিলেমিশে আছে চারিপাশের প্রকৃতির প্রতি যত্ন আর আদর। পোকা পিঁপড়ে থেকে শুরু করে পাখি বা কীট পতঙ্গদের উদ্দেশ্যেই এই তর্পণ। আর কী আশ্চর্য দেখুন, প্রথমে আঁকা হয় কয়েকটি বিন্দু, সেই বিন্দু থেকে ছড়িয়ে পড়ে গোটা আলপনা। প্রাচীনেরা জানতেন, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের জ্যোতির্মণ্ডলী আর নীহারিকার কত আলোক বিন্দুর ভাষা ধরা আছে সেসব আলপনার জ্যামিতিক নকশায়। সেসব নিয়ে গণিতবিদরা কাজ করেছেন, গবেষণা করেছেন। এসব যত জেনেছি ততই মনে হয়েছে এই জল মাটি আলো হাওয়াকে আমাদের ঘর গেরস্থালি যত সহজ করে প্রতিদিন আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে তা বোধহয় ততখানি সহজ সরল নয়। বহু বছরের যাপিত জ্ঞান এসে থিতু হয়েছে আমাদের মাটির দেওয়াল আর বিহানবেলার গোবর ছড়া বা মারুলিতে। সেই ভাবনার স্রোতকে বিশ্বায়ন এক ভাবে ধুয়ে মুছে চাইছে বৈকী! কত কত উপভাষা আর যাপনের গল্প তাই তামাদি হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। এই ধুয়ে মুছে ফেলার গল্পে কত কত মুখ ভোরের সূর্যমুখীর মতো ফুটেও উঠছে আবার। এই যেমন আমাদের অনুজ্ঞা নূতন ধ্যানেশ্বর (Anujna Nutan Dnyaneshwar)। আমার কিন্তু মনে হয় মেয়েদের ঘর-গেরস্থালির পুরনো গল্প থেকেই ও জানি কেমন করে উঠে এসেছে।

আদতে ও একজন আর্কিটেক্ট (architect)। প্রাথমিক ভাবে আর্কিটেকচার নিয়েই ওর শিক্ষানবিশি এবং কাজকর্মও। ক্রমে আমাদের দেশীয় ইকোলজি ওঁকে নানা ভাবে আকর্ষণ করে। আদতে মহারাষ্ট্রের পুনার বাসিন্দা হলেও অনুজ্ঞা দেখে বেড়িয়েছে আমাদের দেশীয় ঘর গেরস্থালির বিজ্ঞানকে। ওঁর কথা শুনলে টের পাওয়া যায়, আমাদের মতো রোদ্দুরের দেশে কত কত বছর ধরে মানুষ রোদ, হাওয়া আর ছায়াকে চিনেছে। বাড়ির নকশায় ফুটিয়ে তুলেছে সেই জলবায়ুর উপযোগী নকশা। সেটা কোনও আদিবাসী গ্রামের রান্নাঘর হতে পারে, কোনো পার্বত্য গ্রামের গোয়ালঘর হতে পারে, অথবা সকালের আলো এসে খেলে বেড়ানোর দাওয়া। আলো হাওয়া আর ছায়ার বাস্তুতন্ত্রকে যাঁরা আয়ত্ত করেছিলেন তাঁরা এখনও শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের স্পর্শ বাঁচিয়ে টিকে আছেন। তাঁদের গেরস্থালি, খাদ্যাভ্যাস এবং সংরক্ষণের কার্যপ্রণালীকে আমরা সাবলটার্ন বা নিম্নবর্গের যাপন বলে দাগিয়ে দিয়েছি কবেই। আঞ্জুনা কিন্তু তেমন করে ভাবেননি। ওঁর ভিতরে আশ্চর্য একটি তৃতীয় নেত্র কাজ করেছে। সে ভারতীয় উপমহাদেশের ইকোলজিকে চিনতে চেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যার পাশাপাশি লোকবিজ্ঞানকে ও চিনেছে। তাই তো এমন করে পারিবেশ বান্ধব মাটির বাড়ির ছবি আঁকতে পারে ও। প্রচণ্ড গ্রীষ্মেও বাইরের উষ্ণতার চেয়ে প্রায় তেরো চোদ্দ ডিগ্রি কম উষ্ণতায় যে বাড়ি মানুষের যাপনকে আরামদায়ক করে তুলতে পারে এতখানি তাকে কি নিছক মেটে বাড়ি বলে সরিয়ে রাখব আমরা! অনুজ্ঞা সে কথাই বলতে চায় ওর তৈরি ঘর-গেরস্থালির নকশায়। কিন্তু এমন নকশা তো ছেলেভুলানো ছড়া নয়! এমন নকশা যিনি আঁকেন, তাঁকেও চিনতে হয় মাটি জল আর স্বাভাবিক উদ্ভিদের ভাষা। ছায়াবাজি তো নয় এসব! কোন গাছের ছায়া কেমন, কোন পাতার হাওয়া মিঠে এসবও বহু বছর ঘরে মানুষ শিখেছিল। সেই শিখন সেই মেধার কাছে যাঁরা ফিরে যেতে চেয়েছেন অনুজ্ঞা তাঁদেরই একজন।

শহর থেকে দূরে গ্রামাঞ্চলে এমন বাড়ি করে অনেকেই থাকেন। অনুজ্ঞা দেখালেন শহরের মধ্যেই দোতলা মাটির বাড়ি বানানো সম্ভব। খুব সামান্য সিমেন্টের ব্যবহার আর মাটির ইটের ব্যবহারে যে বাড়ি তৈরি করেন অনুজ্ঞা তার রক্ষণাবেক্ষণ শুধু পরিবেশবান্ধবই নয়, তাতে খরচও অনেক কম। অনুজ্ঞার করা দোতলা মাটির বাড়ি দেখে অনেকেই খানিকটা অবাক হয়েছেন, ভুরুও কুঁচকিয়েছেন। বিশ্বায়ন আসলে সব কিছুকেই খুব এক রকম করে দেখতে শেখায়,সেই তার স্বভাব। এসবের বিপ্রতীপে আছেন অনুজ্ঞারা। কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার কব হাউস নিয়ে আসলে আমরা ঠিক যতটা উত্তেজিত ততটা আগ্রহ বা উৎসাহ নিয়ে আমরা গ্রাম ভারতের স্থাপত্যকে দেখিনি। অবশ্য আবাস যোজনার টাকায় যে ছোটো মোটো ইঁট কাঠের বাড়ি গড়ে তুলছে গ্রাম ভারত তাতে আরাম কমছে গরম বাড়ছে প্রতিদিন। যে মেটে দাওয়ার যাপনকে দেখে নিম্নবর্গের যাপন বলে দাগিয়ে দিয়েছে বিশ্বায়ন, সেই তো ভুলিয়েছে –‘পান্তা ভাতের জল/ তিন পুরুষের বল।‘ ভুলে যাওয়ার গল্প গুলো জুড়লে আস্ত একখানা রূপকথা হয়ে যায় বোধহয়। অনুজ্ঞা এগুলো জানে। জানে বলেই না, এমন করে এই কাজে এত আগ্রহী ও! যে গ্রাম ভারত প্রতিদিন তার নিজস্ব অবয়বখানা ধুয়ে মুছে আধুনিক হতে চাইছে তাতে কি বৈশাখের খরা তেঁতুল পাতার ছায়া বুলিয়ে দেবে অবশেষে? দেবে না, দিতে পারবে না। এই বিরাট একটা ‘না’ এর বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে আছে অনুজ্ঞা। ওঁর তৈরি একেকটা বাড়ির নক্সা দেখে আমার তাই কেবলই মনে হয় ও বুঝি সেই কোন বিহানবেলায় বসে বসে আস্ত একখানা চাল পিটুলির আলপনা দিচ্ছে। পাখি ফড়িং আর নীলমাছিরা উড়ে এসে বসুক এদিক সেদিকে, – হারিয়ে ফেলা মাটির গল্প আবার জেগে উঠুক রূপকথার মায়ায়। অনুজ্ঞারা আরও অনেক অনেক দিন ধরে মাটির গল্প বলে যাক নিজের মতো করে।
ছবি সৌজন্য: অমৃতা ভট্টাচার্য
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।