২০১৯, করোনাকালের ঠিক আগের দুর্গাপুজো।
আমাকে যিনি ফটোগ্রাফির প্রাথমিক পাঠ শিখিয়েছেন, তাঁর কাছে পুজোর কিছুদিন আগে দেখা। সম্প্রতি কী ছবি তুলেছি, দেখতে চাইলেন। আমি কুণ্ঠিতভাবে মোবাইলের গ্যালারি খুলে কয়েকটা ছবি দেখালাম। (World Photography Day)
“এগুলো তো মোবাইলে তোলা!”
অশোকদা’কে কখনোই রাগ প্রকাশ করতে দেখিনি। কিন্তু বুঝতে পারলাম উনি বেশ অসন্তুষ্ট।
“ক্যামেরায় না তোলা হলে আর আমায় দেখিও না।”
“দাদা, আসলে বিশেষ কোথাও তো যাওয়া হয় না, শুধু অফিস আর বাড়ি। তাই ক্যামেরা বার করা হয় না।”
বেজায় মিছে একটা অজুহাত চট করে মুখে এসে গেল। পাঁচ বছর আগেকার ডি.এস.এল.আর ঘরে পড়ে থাকে, আর আমি দেশ বিদেশ যেখানেই যাই, মোবাইলে ছবি তুলেই তুষ্ট থাকি।
“আহা, ছুটির দিনগুলোয় তো বেরোতে পারো ক্যামেরা নিয়ে।” এবার একটু নরম সুরে বললেন।
“দুর্গাপুজোর ছবি?” আমি ভিড়ে ছবি তুলতে একদমই যে আগ্রহী নই, আমার কথাতেই প্রকাশ পেল।
“পুজো আসছে, এমন ছবি বেশি তোলে না কিন্তু কেউ। সবাই ব্যস্ত কুমোরটুলি’তে আর তারপরেই পুজোর চারদিনে।”
এটা তো ভেবে দেখিনি আগে! সোৎসাহে মাথা নাড়লাম।
বাধ সাধল বৃষ্টি। কয়েকদিন একটানা বৃষ্টির জেরে জেরবার কলকাতা। তারপর পুজোর দিনগুলোতেও বৃষ্টির পূর্বাভাস। তাই ক্যামেরা নিয়ে ছবি শিকারে বেরিয়ে পড়লাম চতুর্থীতে। সকালে একটু বেলা করে, তারপর আবার সন্ধায়। বেশ গরম, তাও অনেকক্ষণ বাইরে কাটালাম, এসি-তে অভ্যেসের কষ্টকে ছাপিয়ে বেশ আনন্দ পেলাম ঘেমে নেয়ে ছবি তুলে। তার সাথে কানেও এল কিছু কথা… সেদিনের কথাই বলি।

। সকাল ।
বেরোনোর আগে টুকিটাকি কিছু কেনাকাটা ছিল বাড়ির জন্য। সাতটা নাগাদ দোকানের সামনে যখন দাঁড়িয়ে আছি, লক্ষ করলাম, দোকানদার বিরক্ত মুখে বারবার আমার কাঁধ পেরিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করছেন। পেছন ফিরে দেখি দুটো ছেলে নিশ্চিন্তে ক্রিকেট পিচের আদলে চুন ছড়াচ্ছে রাস্তায়। দোকানদার এবার হাঁক দিলেন,
“কী রে, আজ আবার ক্রিকেট! এই তো রোববার টুর্নামেন্ট খেললি!”
“আরে, সেদিন সেমি ছিল কাকু, আজ ফাইনাল।”
“অটোওয়ালারা মেন রোডে খেলতে দেবে তো?”
“আজ তো অটো বন্ধ, দুপুর দুটো থেকে।”
“কেন রে? নামকরা কেউ মরল নাকি! জানি না তো?” আমার দিকে উনি প্রশ্নসূচক একটা দৃষ্টি হানলেন। আমি তো পারতপক্ষে টিভি দেখি না, তাছাড়া বেরোনোর আগে বাড়িতে খবরের কাগজ ল্যান্ড করেনি। আমি ভুরু, ঠোঁট আর কাঁধ একসাথে নাচালাম। “কলকাতায় অটো দুপুরের পর থেকে বন্ধ থাকে শুধু ষষ্ঠী থেকে!”
এবার অন্য ছেলেটা একটা বল হাতে লুফতে লুফতে বলল,
“কেউ মরেনি কাকু। আজ, গান্ধী চতুর্থী!”
। প্রায় দুপুর ।
এক মাঝারি বিখ্যাত প্যান্ডেলে ঢুকছি। সামনে বিশাল ভিড়। লোকে এত আগে থেকে ঠাকুর দেখতে বেরোয় তা আন্দাজ করিনি! দেখি প্যান্ডেলের পাশের মঞ্চে প্রায় জনাদশেক বয়োজ্যেষ্ঠা দাঁড়িয়ে আছেন সারি দিয়ে। দূর থেকে দেখে ভাবলাম হয়তো কোনও বিউটি পেজেন্ট হচ্ছে সিনিয়র সিটিজেনদের। আমার সামনে কমবয়সীদের একটা দল ছিল, প্রায় জনা দশেকের। তারা পাশাপাশি না হেঁটে একের পেছনে এক হাঁটছিল। চাইনিজ হুইস্পারের মতন সামনে থেকে পেছনে কথার ব্যাটন পাস হয়ে আসছে! আমি শেষের ছোকরাকে অনুরোধ করলাম জানতে, কী হচ্ছে। তার কাছে খবর আগেই চলে এসেছে মনে হয়, বলল,
“স্বয়ম্বর সভা, দাদা!”
“এটা কি এখানকার পুজোর থিম?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম। আজকাল অভিনব সব ব্যাপার দেখা যায় পুজোয়।
“না, না থিম নয়।” ছোকরা একটু মুচকি হেসে বলল, “এক দাদুর স্বয়ম্বর!”
ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে কৌতূহলী চোখ রেখে এগোচ্ছি, টেলিলেন্স তাক করছি একবার প্যান্ডেল আবার একবার স্টেজের দিকে। স্টেজে এত মহিলার মধ্যে আস্তে আস্তে আড়াল থেকে প্রকট হলেন একজন। বিশাল মালা পরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি – মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী!

। বিকেল ।
ছবি তোলার পক্ষে আদর্শ, ‘কনে দেখা’ আলোয় মা দুর্গার ছবি তুলব। বাড়ির আশেপাশের ছোটো প্যান্ডেলগুলো ঘুরে ফিরে দেখছি, যদি কোথাও কোনও মায়ের মুখে সূর্যের আলো পড়ে। সব জায়গায় দেখি মা স্পটলাইটকেই ভরসা করে বসে আছেন, ছোটো বড়ো সব প্যান্ডেলে! বাধ্য হলাম বিষয় বদলাতে। ঠিক করলাম সন্ধ্যায় আলোর খেলার ছবি তুলব।
অন্ধকার নেমে এসেছে। একটা ছোটো প্যান্ডেলে চেয়ারে বসে লেন্স পাল্টাচ্ছি, পাশে খোশগল্পে মশগুল একদল তরুণ তরুণী।
“অ্যাই জানিস, রনি আমায় একটু আগে প্রপোজ করেছে ফেসটাইমে!” একটা মেয়ে এটা বলার সাথে সাথেই সবাই হাঁ হাঁ করে উঠল। বক্তব্য – হতেই পারে না! মেয়েটাও প্রতিবাদে নাছোড়বান্দা। ক্যান্ডিড ছবির আশায় লেন্স ছেড়ে ওদের দিকে ফিরলাম। শোরগোল থামাতে এক মাতব্বর দাঁড়িয়ে পড়ল, মেয়েটার কাঁধে একটা সমবেদনার হাত রেখে বলল,
“বস, পাস্ট রেকর্ড বলে – পেটে জল না পড়লে রনি কাউকে প্রপোজ করে না! মানবি তো?”
মেয়েটা কোনও উত্তর দিল না। আলতো করে ঘাড় নাড়ল সম্মতির।
“এইবার পথে আয়… আজ ড্রাই ডে!”
“কেন রে?”
মেয়েটার থুতনিটা ডান হাতের আঙুলগুলো দিয়ে নেড়ে দিয়ে ছেলেটা বলল,
“আজ সেকেন্ড অক্টোবর, সোনা!”
। রাত।
সারাদিন যা হেঁটেছি, নিজেকে মনে হচ্ছিল ডান্ডি মার্চের এক বিশাল উদ্বুদ্ধ পদযাত্রী। মনে পড়ল সেই ফুটেজ, যেখানে গান্ধীজিসহ সব আন্দোলনকারী প্রায় দৌড়নোর মতো জোরে হাঁটছে। বাড়ি ফিরছি মোটামুটি বেশ কয়েকটা নামজাদা প্যান্ডেল ঘুরে। পাড়ার কাছে, শ্রীমোহন লেনে এসে দেখলাম, মা এসে গেছেন। প্রতি বছর এরা খুব সুন্দর মূর্তি আনে, তাই আবার ক্যামেরা বার করলাম। ছবি তুলছি, একজন লোক হাজির তার পরিবার নিয়ে। দেখে আর কথা শুনে মনে হল আমাদের গ্রামের দিকের (বর্ধমান)। বাবা, মা, মেয়ে আর বয়স্কা একজন। মেয়ের বয়স নয়-দশ, দম্পতি তিরিশের ঘরে।
মেয়ে বলল “মা দ্যাকো, মা দুর্গার হাতে কোনও অস্ত্র নেই।”
“কারোর হাতেই নেই কো।” ওর মা’ও বেশ অবাক।
“বলো দেকি, কেন?” ওর বাবা বেশ চোখ নাচিয়ে বলল।
“এবার বেশিরভাগ ঠাকুর অহিংসে থিম করচে, দেকলে না।” মা অনায়াসে যুক্তি খাড়া করল।
বাবা বেশ একচোট হাসল। “দূর, তোমারও যেমন গিয়ে বুদ্ধি। দ্যাকোগে, কেমন সব হাত মুঠো – অহিংসে থিম না আরো কিছু!”
“হ্যাঁ, তুমি তো সবজান্তা! তুমিই বল দিকিন…”
বাবা এবার মেয়ের দিকে ফিরে বলল, “আজ তো গান্ধীজির জন্মদিন, তাই অস্ত্র দেয়নি কো। উনি অহিংসেতে বিশ্বাস করতেন কিনা!”
প্রান্তিক বিশ্বাসের জন্ম কলকাতায়। স্কুলে থাকতে লেখা শুরু। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ পর্যন্ত কালান্তর সংবাদপত্র, সময় ও গ্রন্থন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গল্প, কবিতা ও রম্যরচনা। তারপর ২০০০ সাল থেকে দীর্ঘ পনেরো বছরের বিরতি লেখায়। ফিরে আসা ছোটগল্প, অণুগল্প, নিবন্ধ ও উপন্যাসে। তথ্যপ্রযুক্তির কর্মী, বর্তমানে কর্মরত কলকাতায়। লেখা ছাড়া ঘুরতে, ছবি তুলতে আর আঁকতে ভালোবাসেন।