বাংলায় অভিনেত্রীদের প্রথম দেখা গিয়েছিল থিয়েটারের মঞ্চে। তখনকার অবস্থা অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবেই এঁরা এসেছিলেন বারাঙ্গনা-সমাজ থেকে। এঁদের নাচে গানে অভিনয়ে আলোড়িত হয়েছিলেন মানুষ। ক্রমশ দিন এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ ঘরের মেয়েরাও আসতে লাগলেন অভিনয়, গানের দুনিয়ায়। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় রেকর্ড ও তার পরের কয়েক দশকের মধ্যে একে একে রেডিও ও সবাক চলচ্চিত্রের আগমন শিল্পসংস্কৃতির ক্ষেত্রকে অনেক প্রসারিত করে দিল। যদিও নির্বাক পথে চলচ্চিত্রের আগমন অনেক আগেই ঘটেছে। কিন্তু ছবি কথা বলে ওঠার পরে এর জনপ্রিয়তা কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় অনেক শিল্পীদের উত্থান হতে লাগল এই জগতে। যার মধ্যে অভিনেত্রীরাও ছিলেন।
আরও পড়ুন: বিস্মৃত নারী শোভনাসুন্দরী
সবাক চলচ্চিত্র যখন দানা বেঁধে উঠছে, সেই ১৯৩০-৪০ দশকের সময়ের সমাজ, রাজনীতির অবস্থাটা ছিল ঘটনার ঘনঘটায় ভরা। বিশেষ করে, ১৯৪০ দশক। যা ‘উত্তাল চল্লিশ’ নামে চিহ্নিত হয়ে আছে। গোটা দশক জুড়ে দুর্ভিক্ষ, কাপড়-কয়লা সংকট, ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, দেশভাগ, কাতারে কাতারে শরণার্থীদের আসা ইত্যাদিতে জেরবার ছিল কলকাতা তথা বাংলা। এর মধ্যেই এল স্বাধীনতাও। সব মিলিয়ে চরম ঘটনাবহুল সময়। শুধু বাংলা কেন, গোটা দেশে, বিশেষ করে পঞ্জাবকে কেন্দ্র করে উত্তর ভারতের একটা বড় অংশের ছবি দেশভাগের ফলে বদলে গেল অনেকটাই। যার মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের মর্মান্তিক আঘাত তো ছিলই। এসবের প্রভাব অনেক কিছুর মতো চলচ্চিত্র, সংগীত ইত্যাদি জগতের ছবিকেও পালটে দিয়েছিল এক লহমায়। সে এক বিস্তারিত আলোচনার বিষয়, যা এই নিবন্ধের উপজীব্য নয়। এরকমই একটা সময়ে পর্দায় দেখা গিয়েছিল অভিনেত্রী মীরা মিশ্রকে (Mira Mishra)। যাঁর পেশাদারি পথে চলচ্চিত্রাভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পেছনে তখনকার সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার অন্যতম এক মর্মান্তিক ফলশ্রুতির সরাসরি প্রভাব ছিল। নিজের শিল্পীজীবন নিয়ে তাঁর ভাবনাচিন্তাকে যা আমূল বদলে দিয়েছিল।

মীরা মিশ্র-র (Mira Mishra) আদি বাড়ি ছিল বাঁকুড়ায়। কিন্তু তিনি ১৯২৪ সালের জুন মাসে জন্মেছিলেন কানপুরে। কারণ, তাঁর বাবা জ্ঞানচন্দ্র রায়ের চাকরিস্থল তখন সেখানেই। পড়াশোনাতে ভালো ছিলেন মীরা। বি.এ পাশ করেছিলেন। যা একজন মেয়ে হিসেবে, সেইসময়ের নিরিখে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত তো বটেই।
বাড়িতে ছোট থেকেই মীরা পেয়েছিলেন শিক্ষা-সংস্কৃতির পরিবেশ। স্নাতক হওয়ার পর হঠাৎ ছবিতে অভিনয়ের ব্যাপারে ইচ্ছে জাগল। কিন্তু পুরোটাই ছিল শখের টান। সেইসময় একদিন খবরের কাগজে চোখে পড়ল একটি বিজ্ঞাপন। বিখ্যাত ‘বম্বে টকিজ’ তাদের আগামী ছবি ‘নৌকাডুবি’র জন্যে নতুন নায়িকা চাইছে। একে রবীন্দ্রনাথের কাহিনি, তায় এত বড় সংস্থার ছবি, উপরন্তু পরিচালক প্রখ্যাত নীতিন বসু। কী মনে হল, মীরা আবেদনপত্র পাঠিয়ে দিলেন নিতান্তই ক্যাজুয়াল মানসিকতায়। কিন্তু অভাবনীয়ভাবে ডাক এল সেখান থেকে। যথারীতি হাজিরা দিলেন এবং ছবির অন্যতম নায়িকা ‘কমলা’-র চরিত্রে মনোনীতও হয়ে গেলেন। শুধু বাংলাতেই নয়, ছবিটির হিন্দি ভার্শনও তৈরি হল একইসঙ্গে। বাংলা ছবির নাম ‘নৌকাডুবি’। যেখানে নায়ক ‘রমেশ’-এর চরিত্রে রূপদান করলেন অভি ভট্টাচার্য। হিন্দিতে নাম ‘মিলন’। নায়ক দিলীপকুমার। দুটিই মুক্তি পেল ১৯৪৭-এ। দুটিতেই প্রধান দুই নারী চরিত্র ‘কমলা’ ও ‘হেমনলিনী’-র ভূমিকায় যথাক্রমে মীরা মিশ্র ও মীরা সরকার। দুজনেরই প্রথম ছবি।

নীতিন বসুর দক্ষ পরিচালনায় নির্মিত এই ছবিতে সংগীত পরিচালনা করলেন অনিল বিশ্বাস। বাংলা ছবিটিতে থাকা ৬ টি রবীন্দ্রসংগীতের প্রত্যেকটিই গাইলেন তখনকার অন্যতম অসামান্য কণ্ঠশিল্পী পারুল ঘোষ (আরেকটি ছিল মাঝির গান, লিখেছিলেন স্বয়ং সংগীত পরিচালক)। ইনি ছিলেন একাধারে সুরকার অনিল বিশ্বাসের সহধর্মিণী ও সংগীতাচার্য পান্নালাল ঘোষের বোন। হিন্দি ভার্শন ‘মিলন’-এ ছিল আটটি গান, যার মধ্যে চারটি গাইলেন পারুল ঘোষ, দুটি গীতা রায় (দত্ত) ও একটি শঙ্কর দাশগুপ্ত। দারুণ জনপ্রিয়তা পেল দুটি ভার্শনই।
প্রথম ছবিতেই সবার নজর কাড়লেন মীরা মিশ্র। এরই ফলস্বরূপ তিনি শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’-র হিন্দি ভার্শন ‘সব্যসাচী’-তেও ‘সুমিত্রা’-র ভূমিকায় নির্বাচিত হলেন এবং অভিনয়ে নজর কাড়লেন সবার। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪৮ সালে। এটিও হিট। ফলে, চলচ্চিত্র জগতে পা দিয়েই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলেন মীরা মিশ্র। কিন্তু তখনও তাঁর মনে অভিনয়কে পুরোপুরি পেশা হিসেবে গ্রহণ করার বাসনা জাগেনি। ছিল নিছক এক নেশা মাত্র।
প্রসঙ্গত, ছবিতে নামার আগেই মীরার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল কৃপাসিন্ধু মিশ্রের সঙ্গে। ইনি ছিলেন আই. সি.এস এবং দিল্লিতে উচ্চ সরকারি পদে কর্মরত। তিনি ছিলেন মুক্তমনের, সত্যিকারের শিক্ষিত মানুষ। স্ত্রীকে এককথায় অনুমতি দিয়েছিলেন ছবিতে অভিনয়ের ব্যাপারে। বিয়ের আগে ছিলেন মীরা রায়। বিয়ের পর ‘মিশ্র’ হয়ে স্বামীর অনুমতিকে সম্বল করে অভিনেত্রী হলেন মনের খুশিতে। কিন্তু হঠাৎই এমন এক ভাগ্যবিপর্যয় ঘটল, অভিনয়কে আর শখের জায়গায় রাখা গেল না। একে পুরোপুরি পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হলেন। সময়টা ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের ঠিক পরে পরেই। এ ব্যাপারে অনুমান করাই যায়, শুরু থেকেই ছবির জগতে পাওয়া প্রতিষ্ঠা মীরার এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়কও হয়েছিল। কী ছিল সেই বিপর্যয়ের কারণ, সে কথা আসবে শেষে। এখন দেখা যাক পেশাদারি পথে কীভাবে এগোলো তাঁর ছবির জীবন।

ছোট থেকে বাংলার বাইরে বেড়ে ওঠার ফলে, বলাই বাহুল্য, মীরা মিশ্র হিন্দি ভাষায় ছিলেন সাবলীল। তাই সফলতার সঙ্গে বেশ কিছু হিন্দি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন। প্রথমে উল্লিখিত দুটি বাদে, অন্যতম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করলেন ‘আজাদি কে বাদ’ (১৯৫১), ‘কাশ্মীর হামারা হ্যায়’ (১৯৫০) ছবি দুটিতে। নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সদ্য স্বাধীন ভারতের সমাজ-রাজনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করেই ছবিদুটি তৈরি। এর পর, ১৯৫২ সালে শরৎচন্দ্রের ‘বিন্দুর ছেলে’ অবলম্বনে মুক্তি পেল হিন্দি ছবি ‘ছোটি মা’। যেখানে মুখ্য চরিত্র ‘বিন্দু’-র ভূমিকায় মীরা মিশ্র অসামান্য অভিনয়ের নজির গড়লেন। তখনকার বিখ্যাত চলচ্চিত্র পত্রিকা ‘ফিল্মফেয়ার’-এ অকুণ্ঠ প্রশংসা করা হল তাঁর। এছাড়া, আরও বেশ কিছু হিন্দি ছবিতে তিনি কয়েক বছর ধরে ছোট-বড় চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
অভিনয় জীবনে হিন্দি ছবির সংখ্যা বেশি হলেও, জন্মসূত্রে বাঙালি মীরা মিশ্র অভিনয় করেছেন বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতেও। প্রথম ছবি ‘নৌকাডুবি’ ছাড়াও তাঁকে দেখা গেছে আরও ৬টি বাংলা সিনেমায়। সেগুলি হল, ‘আভিজাত্য’ (১৯৪৯), ‘কৃষ্ণা কাবেরী’ (১৯৪৯), ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ (১৯৪৯), ‘আবর্ত’ (১৯৫০), ‘একই গ্রামের ছেলে’ (১৯৫০) ও ‘সন্ধ্যাবেলার রূপকথা’ (১৯৫০)। এর প্রত্যেকটিতেই তিনি নায়িকা বা অন্যতম নায়িকা। বাংলা ছবির দুনিয়াতেও তিনি অভিনয়ের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন। যার মধ্যে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’-তে নামভূমিকায় মীরা মিশ্রের অনবদ্য অভিনয়ের কথা আজও কিছু প্রবীণের স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছে।

শেষে আসা যাক, মীরার জীবনে আসা সেই আকস্মিক বিপর্যয়ের কথায়। আমরা জানি, দেশভাগের প্রভাবে ও ফলে, ১৯৪৬ ও ১৯৪৭-এ কলকাতায় হওয়া সেই ভয়াবহ নৃশংস সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের কথা। ইতিহাসের অন্যতম অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে যা চিরকালের জন্যে চিহ্নিত হয়ে আছে। এও আমাদের জানা, এই দেশভাগে প্রধান ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, ভারতের দুটি অঞ্চল― বাংলা ও পঞ্জাব। ফলে, ঠিক কলকাতারই মতো ঐ ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের পঞ্জাব থেকে আসা শরণার্থী সমস্যাকে কেন্দ্র করে দিল্লিতে ঘটেছিল একইরকম মর্মঘাতী সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ। বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছিল সেই চরম অনভিপ্রেত ঘটনায়। সেইসময় কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যতম উচ্চ আধিকারিক হিসেবে সেখানে কর্মরত ছিলেন মীরা মিশ্রের স্বামী আই.সি. এস শ্রীকৃপাসিন্ধু মিশ্র। তিনি নিহত হয়েছিলেন ঐ সংঘর্ষে। যা এক লহমায় মীরার বর্ণাঢ্য জীবনকে বর্ণহীন করে দিয়েছিল। কিন্তু যা লক্ষ্যণীয়, এতে তিনি ভেঙে না পড়ে, শিরদাঁড়া আরও শক্ত করে এক মুহূর্তে অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিয়ে পুরোপুরি ডুব দিলেন সেই জগতে এবং দারুণভাবে সফল হলেন। এরকম একটি মর্মান্তিক ঘটনা যে সংগ্রামী চেতনার স্ফুরণ ঘটালো, তা থেকেই জন্ম নিলেন এক শিল্পী। এখানেই মীরা মিশ্র হয়ে ওঠেন এক অর্থে ব্যতিক্রমী। দেশভাগ তখন অনেককিছুকে ওলটপালট করে দিয়েছিল। যার মধ্যে ছিল চলচ্চিত্র ও শিল্প সংস্কৃতির অন্যান্য নানা ক্ষেত্রও। এরই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে মীরা মিশ্র-র শিল্পী হিসেবে হয়ে ওঠা।

পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিব মি. আর. গুপ্ত-র সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন মীরা মিশ্র। ১৯২৪-এ জন্মানো এই ব্যতিক্রমী দৃঢ়চেতা প্রতিভাময়ীকে তাঁর জন্মশতবর্ষে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
তথ্যঋণ :
১) সোনার দাগ― গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ
২) প্রসাদ, অভিনেত্রী সংখ্যা
৩) সাতাত্তর বছরের বাংলা ছবি― সংগ্রহ ও সম্পাদনা : তপন রায়
৪) শিল্পী অভিধান― সম্পাদনা : তপন রায়
৫) Bengali Film Almanac : A study of Gramophone Records, Vol 1(1932–1950)― Susanta Kr. Chatterjee & Sanjay Sengupta
ছবি সৌজন্য: লেখকের সংগ্রহ, Flickr
জন্ম ১৯৬৫-তে কলকাতায়। বেড়ে ওঠা চন্দননগরে। স্কুল জীবন সেখানেই। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে স্নাতক। ছোটো থেকেই খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ। গান শেখাও খুব ছোটো থেকেই। তালিম নিয়েছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। দীর্ঘদিন মার্কেটিং পেশায় যুক্ত থাকার পর, গত বারো বছর ধরে পুরোপুরি লেখালেখি, সম্পাদনার কাজে যুক্ত। পুরনো বাংলা গান, সিনেমা, খেলা ইত্যাদি বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়-সহ বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তমকুমারের "হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর", হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের "আনন্দধারা", রবি ঘোষের "আপনমনে", মতি নন্দীর "খেলা সংগ্রহ"। লিখেছেন "সংগীতময় সুভাষচন্দ্র" বইটি। সাত বছর কাজ করেছেন "মাতৃশক্তি" ও "জাগ্রত বিবেক" পত্রিকায়। বর্তমানে নিজস্ব লেখালিখি ও সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত।