(Ali Akbar Khan)
রাসবিহারী এভিনিউ, গড়িয়াহাট মোড়ে যেখানে গিয়ে মিশেছে, তার কিছুটা আগেই গড়িয়াহাট মার্ট। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি যে ওই মার্কেটে বেশিরভাগ দোকানেই উলের জিনিস বিক্রয় করা হত। বর্তমানে সেখানকার কী অবস্থা, আমার জানা নেই। ওই গড়িয়াহাট মার্টের মধ্যে দিয়ে ঢুকলেই কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকে একটা বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে সোজা তিনতলায় পৌঁছে, বাঁদিকের দরজায় চোখ পড়লেই দেখা যেত নেমপ্লেটে লেখা রয়েছে বিশ্বনাগরিক ওস্তাদ আলী আকবর খানের নাম। (Ali Akbar Khan)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: প্রিয় মৃণালদা
হ্যাঁ, বছরের বেশিরভাগ সময়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকলেও শীতের সময়টা মাস দু’য়েক তিনি থাকতেন কলকাতায় আর তখন তাঁর ঠিকানা হত গড়িয়াহাট মার্টের এই বাড়ি! সেই বাড়িতেই তাঁর সঙ্গে থাকতেন পুত্র ধ্যানেশ খান এবং অন্যান্যরা। শহরের কোনও পাঁচতারা হোটেল নয়, এই সাধারণ বাড়িতেই খাঁ সাহেব স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দিতেন দিন। (Ali Akbar Khan)

ওঁর আরেক পুত্র আশীষ খান, মার্কিন মুলুকেই থাকতেন। আরেক পুত্র, আলমের কথা তখনও জানা ছিল না। আশীষকাকু আর ধ্যানেশকাকু ছিলেন আমার বাবা অঞ্জন মৈত্রর বন্ধু। ধ্যানেশকাকুকে দেখেছি মাঝে-মধ্যেই সকালের দিকে আমাদের বাড়িতে আসতেন এবং বাবার সঙ্গে গল্প করতেন। সেই সূত্রে আলী আকবর খাঁ সাহেবের সঙ্গে বাবার চেনা-পরিচয় ছিল। (Ali Akbar Khan)
“মনে আছে, আশীষকাকু আমাকে অঞ্জনদার ছেলে বলে পরিচয় করাতে খাঁ সাহেব হেসে বলেছিলেন, ‘একদম বাপের মতো দেখতে ওকে।”
বাবার কাছেই শুনেছিলাম যে নিউ আলিপুরে ‘কিরণ ল্যাম্পের কর্ণধার মি.দত্ত এবং ওঁর স্ত্রী ইভা দত্ত, দুজনেই ছিলেন মার্গসঙ্গীতের অনুরাগী ও সমঝদারও বটে। ওঁদের বাড়িতে সেই সময়কার অনেক বিশিষ্ট শিল্পীরা আসতেন অনুষ্ঠান করতে। তাঁদের মধ্যে আলী আকবর খাঁ সাহেবও ছিলেন। এছাড়াও অনুষ্ঠান করতে আসতেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর, মহাপুরুষ মিশ্র প্রমুখ। সেইসব জলসা শুনতে ওখানে হাজির হতেন আমার বাবা আর তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু অনন্তরাম চ্যাটার্জী, সঙ্গে ধ্যানেশকাকু আর আশীষকাকু তো থাকতেনই। (Ali Akbar Khan)

১৯৮৬ সালের এক শীতকালে যখন আলী আকবর খাঁ সাহেব কলকাতায় এলেন, তখন আমি বাবার কাছে আবদার করে বসলাম, খাঁ সাহেবের অটোগ্রাফ নেব, ব্যবস্থা করে দিতে। বাবা একদিন আমাকে নিয়ে খাঁ সাহেবের গড়িয়াহাটের বাড়িতে গেল কিন্তু সেইদিন উনি ওঁর কলকাতার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে বসে রেওয়াজ করছিলেন, তাই একটা অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য ওঁকে কোনওভাবেই বিরক্ত করা চলে না। ধ্যানেশকাকু আমাকে বললেন খুব আস্তে করে গিয়ে মানে কোনও সাড়া-শব্দ না করে যে ঘরে খাঁ সাহেব বসেছিলেন, সেখানে গিয়ে বসতে। (Ali Akbar Khan)
“সম্ভবত সেবারই খাঁ সাহেবের পুরোনো ছবিগুলোর প্রিন্ট ওঁর হাতে তুলে দিয়েছিলাম। এর বছরখানেকের ভেতরেই উনি চলে গেলেন সুরলোকে। “
অটোগ্রাফ নাই বা পেলাম কিন্তু ভারতীয় রাগসঙ্গীতের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্রকে অত কাছে বসে দেখাটাও ভাগ্যের ব্যাপার! চলে আসার সময় ধ্যানেশকাকু বললেন বাবা এখনও কলকাতায় বেশ কিছুদিন থাকবেন, একদিন সকালের দিকে চলে এসো। কিছুদিন পরে গেলাম, সেদিন আশীষকাকুও ছিলেন, ধ্যানেশকাকু খাঁ সাহেবকে আমার কথা বলাতে ভেতরে ডাকলেন। মনে আছে, আশীষকাকু আমাকে অঞ্জনদার ছেলে বলে পরিচয় করাতে খাঁ সাহেব হেসে বলেছিলেন, ‘একদম বাপের মতো দেখতে ওকে।’ (Ali Akbar Khan)

সই নেওয়া হলে আমাকে বাবার কথা, নিউ আলিপুরের ইভাদিদার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, জানতে চাইছিলেন ইভাদিদার বাড়ির অনুষ্ঠানগুলোর কোনও ছবি বাবার কাছে আছে কী না? উনি জানতেন বাবা খুব ভাল ছবি তুলতেন। বাড়ি এসে বাবাকে সেই কথা বলাতে উনি খুঁজে বেশ কিছু ছবি বার করে দিলেন। ধ্যানেশকাকুকে ফোন করে আবারও একদিন গেলাম খাঁ সাহেবের কাছে। ছবিগুলো দেখালাম, খুব খুশি হলেন, বললেন, ‘যদি সম্ভব হয়, কয়েকটা প্রিন্ট করে দিও।’ (Ali Akbar Khan)
সেদিন সঙ্গে করে ওঁর দুটো রেকর্ড নিয়ে গিয়েছিলাম, খুব খুশি হয়েই সেই দুটোর ওপরে সই করে দিলেন। এর মাঝে একদিন আই.টি.সি সঙ্গীত রিসার্চ একাডেমিতে গিয়ে ওঁর বাজানো, ‘মালকোষ’ শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তার আগে তো তপনদার ‘ক্ষুধিত পাষান’-এ খাঁ সাহেবের সুরারোপিত আবহসংগীত শুনে আমি আর সেই রেশ থেকে বেরোতে পারছিলাম না। (Ali Akbar Khan)

একদিন ওঁর বাড়িতে গিয়ে দেখলাম এক ভদ্রলোক এসেছেন একটি প্রস্তাব নিয়ে, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় খাঁ সাহেবকে সম্মানিত করতে চায় কিন্ত উনি যে কোনও কারণেই হোক, সেই সম্মান গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। আমার শৈশবের বন্ধু অমৃত বর্ধণের ছোটকাকা অর্ণব বর্ধণও খাঁ সাহেবের একজন অনুরাগী, যখনই ওঁদের বাড়িতে যেতাম, তখনই ওঁর বাজনা নিয়ে আলোচনা হত। (Ali Akbar Khan)
তখনও লংপ্লে রেকর্ডের যুগ চলছিল। খাঁ সাহেবের নতুন রেকর্ড বাজারে এলেই আমি আর অর্ণবকাকু সেটা কিনে রাখতাম, আমাদের যেন তর সইত না। ধ্যানেশকাকুর কাছে শুনলাম যে খাঁ সাহেব বাজাতে যাবেন শান্তিনিকেতনে। গেলেন, দেখলেন আর জয় যে করলেন, সেটা বলাই বাহুল্য। ফিরে আসার পরে একদিন বাবা আর আমি ওঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম, ওইদিন বিশ্বভারতীর অতিথিগৃহ ‘রতনকুঠি’-তে ওঁর থাকার অভিজ্ঞতা শুনে আমাদের হাসি চাপাই কঠিন হয়ে উঠল। (Ali Akbar Khan)

বললেন, ‘বাথরুমে গিয়ে দেখলাম বেসিনের ওপরে থাকা আয়নাটা বেশ উঁচুতে রয়েছে, কিছুতেই নাগালের মধ্যে আসছে না। শেষে উটের মতো গলাটা উঁচু করতে হল।’ শান্ত প্রকৃতির মানুষ কিন্ত খুব রসিক ছিলেন। ১৯৯৭ সালে কলকাতা দূরদর্শন ওঁর ওপরে একটি তথ্যচিত্র করার প্রস্তাব পাঠায় আমার মা মধুশ্রী মৈত্রর মাধ্যমে, আগের কোনও একটা লেখায় বলেছিলাম, যে মা কলকাতা দূরদর্শনের অনুষ্ঠান আধিকারিক ছিলেন। প্রস্তাবে উনি সায় দিয়েছিলেন। ঠিক হল বিশিষ্ট তালবাদ্যশিল্পী পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী সাক্ষাৎকার নেবেন। মনে আছে সেইবার খাঁ সাহেব গড়িয়াহাটের বাড়িতে না উঠে লেক রোডের একটি ফ্ল্যাটে উঠেছিলেন। (Ali Akbar Khan)
আমার ওপরে দায়িত্ব পড়েছিল স্থিরচিত্র গ্রহণ করবার। আমার কাকা অটল মৈত্র আর আমি ওঁর বিভিন্ন মুডের ছবি তুলেছিলাম সারাদিন ধরে। তখন কিন্তু ফিল্ম ক্যামেরার যুগ চলছে। আমরা কাকা-ভাইপো মিলে অনেক ধরণের ছবি তুলেছিলাম যেগুলো পরে দূরদর্শনের তথ্যচিত্রে ব্যবহার করা হয়েছিল। আজও সেইসব ছবির প্রিন্ট আর নেগেটিভ যত্ন করে রাখা আছে আমার সংগ্রহতে। (Ali Akbar Khan)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: একটু উষ্ণতার জন্য
শুটিংয়ের সময় মায়ের কাছে জানতে চাইলেন আমার বিয়ে দিচ্ছেন কবে, ইতিমধ্যেই বিয়ের দিনও ঠিক হয়ে গেছে জেনে খুশি হলেন। বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে কৌতুক করে আমায় কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। শুটিং-এর দিনটা ছিল সরস্বতী পুজোর আগের দিন, শুনেছিলাম ওঁর বাড়িতে নাকি সরস্বতী পুজো হত! শেষবার যখন কলকাতায় ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স-এ বাজাতে আসেন, তখন ওঁর শরীর বেশ খারাপ। অনুষ্ঠানের আগে, খাঁ সাহেবকে রূপোর সরোদ উপহার দিয়ে সম্মানিত করা হয়। পরে সেদিন ওঁর বাজানো রাগমালা শুনে ওঁর অসুস্থ শরীরের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম! সম্ভবত সেবারই খাঁ সাহেবের পুরোনো ছবিগুলোর প্রিন্ট ওঁর হাতে তুলে দিয়েছিলাম। এর বছরখানেকের ভেতরেই উনি চলে গেলেন সুরলোকে। (Ali Akbar Khan)
ছবি সৌজন্য- লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।