(Aseema Bhattacharjee)
‘স্মৃতির আকাশ থেকে’-র একটি পর্বে, অভিনেতা পার্থ মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্কে লিখেছিলাম। এই পর্বে থাকছে তাঁর জীবনসঙ্গীনি অসীমা ভট্টাচার্যের কথা। কৈশোরেই অসীমা ভট্টাচার্যের নাম শুনেছিলাম। জানতাম তিনি আকাশবাণী কলকাতার উচ্চপদে কর্মরতা ছিলেন। সঙ্গীতশিল্পী তো ছিলেনই, তাছাড়া খুব ভাল সুরারোপও করতেন, ছায়াছবিতেও সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন, তার মধ্যে মহানায়ক উত্তমকুমার অভিনীত ছবি ‘চৌরঙ্গী’, ‘মেমসাহেব’ ইত্যাদি ছিল। ছায়াছবি প্রযোজনাও করেছেন। (Aseema Bhattacharjee)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: একটু উষ্ণতার জন্য
‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানের মহড়া নিয়ে অনেক গল্প শোনা যায়। কিন্তু ‘দুর্গা দুর্গতিহারিণী’ অনুষ্ঠানের মহড়ার বেশ কিছু গল্প শুনেছিলাম অসীমাদির কাছে, অনুষ্ঠানে উত্তমকুমারের ভূমিকা খুব অল্পই ছিল তাও কতৃপক্ষকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করে তিনি নিয়মিত রিহার্সাল দিতেন। অসীমাদির কাছে শুনেছিলাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিয়মিত ডা.ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তীর কাছে যেতেন, অনুষ্ঠানের সংস্কৃত শ্লোকের অংশ নিয়ে আলোচনা করতে এবং নিজে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন। (Aseema Bhattacharjee)

জনসাধারণ গোটা বিষয়টাকে সুনজরে দেখেনি এবং অতিবড় উত্তম বা হেমন্ত ভক্তরাও পুরোনো অনুষ্ঠানের পক্ষে ছিলেন। আসলে ওই অনুষ্ঠানের আবেদন স্বতন্ত্র। পুজোর আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে মহালয়ার সেই প্রভাতী অনুষ্ঠান, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। অসীমাদি বলেছিলেন তদানীন্তন সরকার বাঙালির সেন্টিমেন্টটা না বুঝেই নতুন কিছু পরীক্ষামূলকভাবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু হেমন্তদা বা পঙ্কজদার মধ্যে কোনওরকম রেষারেষির ব্যাপার মোটেই ছিল না। (Aseema Bhattacharjee)
বীরেনদা ও পঙ্কজদা উভয়ই দুঃখ পেয়েছিলেন। কিছু নিন্দুক এই সুযোগটা অন্যভাবে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। উত্তমকুমার অভিনীত আরও একটি জনপ্রিয় ছবি ‘বাঘবন্দি খেলা’, অসীমা ভট্টাচার্যের প্রযোজনাতেই মুক্তি পেয়েছিল। ছায়াছবি, সঙ্গীতজগৎ, আকাশবাণী ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও মানুষটি কিন্তু ছিলেন প্রচারবিমুখ! তপন সিংহর বিষয়ে কাজ করতে গিয়েই, পার্থদার সঙ্গে পরিচয় আর সেই সঙ্গে অসীমাদির সঙ্গেও পরিচয় হয়। (Aseema Bhattacharjee)
“বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও পঙ্কজ কুমার মল্লিককে অপমান করার অভিপ্রায় কারুরই ছিল না। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বাধ্য হয় তৎকালীন আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের কতৃপক্ষ।”
আমার মার সঙ্গে অবশ্য আগে থেকেই অসীমাদির পরিচয় ছিল। শান্ত স্বভাবের স্বল্পবাক মানুষটির, খুব মিষ্টি ব্যবহার ছিল। দেখা হলেই যে খুব আসর সাজিয়ে গল্প করতে বসতেন এমন নয়, কিন্তু যেটুকু কথা হত তার মধ্যে আন্তরিকতার ছোঁয়া পাওয়া যেত। যখনই ওঁর বাড়িতে যেতাম, না খাইয়ে ছাড়তেন না। প্রতিবারই মার সম্পর্কে খোঁজ-খবর করতেন। আমাদের অনেকগুলো অনুষ্ঠানে পার্থদার সঙ্গে এসেওছেন। দক্ষিণ কলকাতার বিড়লা একাডেমিতে আয়োজিত ‘হেমন্ত স্মরণ সন্ধ্যায়’ স্মৃতিচারণ করতে এসেছিলেন একবার অনুরোধ করতেই! পার্থদার সঙ্গে লেখালিখির বিষয় যখনই কাজ করতে বসেছি, তখনই দেখতাম প্রয়োজনীয় ছবি আর তথ্য যোগাড় করে দিতেন অসীমাদি খুব অল্প সময়ের ভেতরে। (Aseema Bhattacharjee)

সংবাদপত্রে কাজ করার সময়ে অতীতের সঙ্গীতজগতের সম্পর্কে জানার প্রয়োজন হলেই অসীমাদির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি এবং ওঁর সাহায্যও পেয়েছি। পার্থদা চলে যাওয়ার পরে বাসবী ঘটক অর্থাৎ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যার সঙ্গে যেদিন দেখা করতে গেলাম, অনেক গল্প করলেন এবং পুরোনোদিনের কথা বললেন। পরে মা’র সঙ্গে দেখা করতে আমাদের বাড়িতেও কয়েকবার এসেছিলেন। পুজোর আগে আমাদের সংবাদপত্রে দেবীপক্ষের প্রাক প্রত্তুষে আকাশবাণী কলকাতার বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠানের বিষয়ে একাধিক নিবন্ধ লেখার প্রয়োজনে অসীমাদির শরণাপন্ন হই। (Aseema Bhattacharjee)
আমার সহকর্মী ও বন্ধুকে নিয়ে ওঁর বাড়িতে সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ওঁর কাছে অনুষ্ঠানের নেপথ্যে ঘটে যাওযা অনেক ঘটনার কথা বলেছিলেন বিশেষ করে সত্তরের দশকে নির্মিত মহালয়ার দিনে প্রচারিত অনুষ্ঠান ‘দুর্গা দুর্গতিহারিণী’ কেন এবং কী কারণে করা হয়েছিল, সেই সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলেছিলেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও পঙ্কজ কুমার মল্লিককে অপমান করার অভিপ্রায় কারুরই ছিল না। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বাধ্য হয় তৎকালীন আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের কতৃপক্ষ। সেই বিষয়, বহু আলোচিত এবং সমালোচিত। বিষয়টি নিয়ে সিনেমাও তৈরি হয়েছে এবং অনেক শিল্পীকেই ভিলেন বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু অসীমাদির কাছে শুনেছিলাম আসল ঘটনা। সরকারি নির্দেশেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাধ্য হন নতুন অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিচালনা করতে। (Aseema Bhattacharjee)
“অসীমাদির মুখে কিন্তু কোনও শিল্পী সম্পর্কে কোনও সমালোচনা কোনওদিন শুনিনি। নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে আত্মপ্রচারের প্রবৃত্তিও তাঁর মধ্যে ছিল না।”
উত্তমকুমারও অনিচ্ছা নিয়েই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। সবটাই হয়েছিল সরকারি ইচ্ছানুযায়ী। কয়েকজন শিল্পী, যাঁরা আজ প্রয়াত, তাঁরা কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন মাধ্যমে নতুন অনুষ্ঠানের সমালোচনা করেছিলেন কিন্তু মজার ব্যাপার হল তাঁরাও কিন্তু নতুন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন, ঐতিহ্য রক্ষার জন্য প্রতিবাদ জানিয়ে কিন্তু রেডিও অপিস থেকে দূরত্ব বজায় রাখেননি! অসীমাদির কাছে এও শুনেছিলাম, যে ‘বাঘবন্দি খেলা’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনা নিয়েও বিতর্ক দেখা দেয়! এখন মনে মনে আপসোস করি যে সময় থাকতে কেন তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকবার বসে অতীতের আরও না জানা কথা রেকর্ড করে রাখিনি! আমি সংবাদপত্রে কর্মরত থাকাকালীন অসীমাদির বিরুদ্ধে লেখার জন্য জনৈক দু’একজন শিল্পী যোগাযোগ করেন এবং তার জন্য অর্থও দিতে প্রস্তুত ছিলেন তাঁরা। (Aseema Bhattacharjee)
আরও পড়ুন: অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়(১৯১৯-২০১৬): নদী থেকে সাগরে
অসীমাদির মুখে কিন্তু কোনও শিল্পী সম্পর্কে কোনও সমালোচনা কোনওদিন শুনিনি। নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে আত্মপ্রচারের প্রবৃত্তিও তাঁর মধ্যে ছিল না। বছরখানেক আগে নীরবেই চলে গেলেন অসীমাদি। রেখে গেলেন সঙ্গীতজগতে তাঁর অবদান। তিনিও আমার স্মৃতির আকাশের আর এক নক্ষত্র। (Aseema Bhattacharjee)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।