জীবিত থাকলে আজ ৯৫ বছরের কোঠায় পা দিতেন তিনি। সুপুরুষ, সুকণ্ঠের অধিকারী অভিনেতা তো বটেই, তিনি ছিলেন রুচিসম্পন্ন, সংস্কৃতিবান বাঙালির এক আইকন; পঞ্চাশের দশকে যাঁর উত্থান হয়েছিল বাংলা ছায়াছবির জগতে। সময়ের সঙ্গে তিনি বাঙালি মধ্যবিত্ত এবং এলিট ক্লাসের কাছে হয়ে উঠেছিলেন এক গ্রহণযোগ্য মুখ। একজন প্রাচীন সংগ্রাহক এবং ইতিহাসপ্রেমী হিসেবে পেয়েছিলেন স্বীকৃতি। জীবনের প্রায় শেষ লগ্নে ভূষিত হয়েছিলেন কলকাতা শহরের আলঙ্কারিক শেরিফ পদে। সেই প্রথিতযশা মানুষটির নাম বসন্ত চৌধুরী।
জন্মসূত্রে তিনি হাওড়ার আন্দুল গ্রামের ভরদ্বাজ গোত্র কনৌজিয়া কায়স্থ ‘দত্তচৌধুরী’ জমিদার বংশের সন্তান। প্রপিতামহ অপূর্বকৃষ্ণ দত্তচৌধুরী ‘দত্ত’ উপাধি ত্যাগ করে পশ্চিমে নাগপুর শহরে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেটা ১৮৮৬ সাল। বসন্ত চৌধুরীর জন্ম ১৯২৮ সালে। স্কুল এবং কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে সিনেমার অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ২২ বছরের এক কিশোরের কলকাতায় আগমন ঘটেছিল পঞ্চাশ দশকের শুরুতে। ঘরের কাছে ফিল্মের মায়ানগরী মুম্বাই থাকা সত্ত্বেও কেন তিনি কলকাতার পথে পাড়ি জমালেন সে অবশ্য জানা যায় না। স্বাধীনতাপূর্ব কালে হীরালাল সেনের রয়্যাল বায়োস্কোপ, জে এফ ম্যাডানের ম্যাডান ফিল্ম কোম্পানি, ১৯৩০-এ বীরেন্দ্রনাথ সরকার প্রতিষ্ঠিত নিউ থিয়েটার্স প্রভৃতির হাত ধরে কলকাতা তখন ভারতীয় চলচিত্রের মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছিল, এর আকর্ষণেই হয়তো-বা!
সুপুরুষ, সুকণ্ঠের অধিকারী অভিনেতা তো বটেই, তিনি ছিলেন রুচিসম্পন্ন, সংস্কৃতিবান বাঙালির এক আইকন; পঞ্চাশের দশকে যাঁর উত্থান হয়েছিল বাংলা ছায়াছবির জগতে। সময়ের সঙ্গে তিনি বাঙালি মধ্যবিত্ত এবং এলিট ক্লাসের কাছে হয়ে উঠেছিলেন এক গ্রহণযোগ্য মুখ। একজন প্রাচীন সংগ্রাহক এবং ইতিহাসপ্রেমী হিসেবে পেয়েছিলেন স্বীকৃতি।
আসলে পঞ্চাশের ওই সময়ে বাংলা সিনেমা একটা নতুন বাঁক নেওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে। উত্তমকুমার তখন দু একটি ছবিতে কাজ করে ফেললেও দর্শক-স্বীকৃতি সেভাবে মেলেনি। এর ঠিক আগের দশকের তিন অভিনেতা ধীরাজ ভট্টাচার্য, ছবি বিশ্বাস ও জহর গাঙ্গুলির বয়স বেড়ে গেছে। রবিন মজুমদার ও অসিতবরণ— তাঁদেরও তারুণ্য বিগতপ্রায়। বিকাশ রায় নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করলেও তাঁর রোমান্টিসিজম সেভাবে দর্শকমনে দাগ কাটতে পারেনি। নিউ থিয়েটার্স, যা গত দু’দশকের সময়কালে বাংলা, হিন্দি এবং উর্দু ছবি বানিয়ে অখণ্ড ভারতবর্ষের সিনেমা বাজারে বাজিমাত করেছে, কালের নিয়মে তার চলনে এবং পরিচালনে এসেছে এক ধরনের শ্লথতা। তাদের বেশ কিছু ছবি ফ্লপ হতে শুরু করেছে। আর্থিক অবস্থা মন্দার দিকেই। সুতরাং সেদিক দিয়ে বসন্ত চৌধুরীর কলকাতা আগমন এক হিসেবে এক নতুন যুগের সূচনা, এ কথা বলা যেতেই পারে।

তবে শুরুর এই গল্পটা সহজ ছিল না মোটেই। যদিও বসন্তবাবু তাঁর আভিজাত্যমণ্ডিত চেহারা, বাচনভঙ্গি, পোশাক-আশাক ইত্যাদির সঠিক মেশালিতে বেশ কয়েক যোজন এগিয়ে ছিলেন সেই সময়ের সাপেক্ষে। এছাড়াও ছিল তাঁর বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি— এই তিন ভাষার উপর দখল এবং অভিনেতাসুলভ চাহনি ও সাবলীলতা। সব মিলিয়ে তিনি যে ‘এক দিন কা সুলতান’ নন তা বোঝা গিয়েছিল।
কলকাতায় এসে ইস্তক ফিল্ম স্টুডিওর দরজায় ঘোরা তাঁর অভ্যাস ছিল। এক বন্ধু, রবি দে চাকরি করতেন একটি ল্যাবরেটরিতে। লোয়ার সারকুলার রোডের মুসলিম পাড়ায় তিনি সেই ল্যাবরেটরির অফিসঘরের একটি টেবিলে রাতে বসন্তের শোয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সারাদিন স্টুুডিও পাড়ায় ঘুরে বিভিন্ন পরিচালক প্রযোজকদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, রাস্তার কোনও পাইস হোটেলে খাওয়াদাওয়া সেরে, রাতে সেই টেবিলেই শুয়ে পড়তেন। এই স্ট্রাগলটা ছিল মোটামুটি এক বছরের। কিন্তু এই স্ট্রাগল ব্যাপারটা নিয়ে শোনা যায় বসন্ত ছিলেন ভারী নির্লিপ্ত। বলতেন “পাস্ট ইস পাস্ট; স্মৃতি হিসেবে আঁকড়ে থেকে নিজেকে জাহির করা আমি পছন্দ করি না!” বলতেই হয় এ তাঁর বাস্তববোধের পরিচয়।
‘কালভৈরবী’ নামে একটি ছবিতে তাঁর প্রথম অভিনয়, কিন্তু সে ছবি পরে বাতিল হয়ে যায়। এরপর সুযোগ আসে সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্টুডিয়ো ‘রাধা ফিল্মস’-এর হাত ধরে। এই রাধা স্টুডিয়ো পরবর্তীকালে বন্ধ হয়ে গেলে কলকাতা দূরদর্শনের প্রথম সম্প্রচার কেন্দ্র এখানেই তৈরি হয়েছিল; আজ সেখানে ‘চলচ্চিত্র শতবার্ষিকী ভবন’। মাধব ঘোষাল তাঁদের নতুন ছবি ‘মন্দির’-এর নায়কের চরিত্রে নির্বাচন করলেন বসন্তকে। ছবির পরিচালক ছিলেন দেবকী বসুর ভাইপো তথা সহকারী চন্দ্রশেখর বসু। তিন হাজার টাকার পারিশ্রমিক আর কনট্র্যাক্ট সই হওয়ার পর তিনশো টাকা অগ্রিম।

‘মন্দির’-এর শুটিং শুরু হয়েছে দিন-দুয়েক হল। ভালোই এগোচ্ছে কাজ। ওদিকে তখন আরেক কাণ্ড। স্টুডিও পাড়ায় তদ্বির তদারক করবার সময়ে বসন্ত প্রথমে পৌঁছেছিলেন নিউ থিয়েটার্সে। কারণ সেসময় এন টি স্টুডিও’র ভারতজোড়া নাম। সেই সূত্র ধরে, ঠিক এই সময়ে শিল্প নির্দেশক সৌরেন সেনের সুপারিশে নিউ থিয়েটার্স থেকে ডাক এল বসন্তের। ছবি ‘মহাপ্রস্থানের পথে’, প্রবোধকুমার সান্যালের উপন্যাস অবলম্বনে। ছবির পরিচালক কার্তিক চট্টোপাধ্যায় তখন মেতে উঠেছেন এক জোড়া নতুন মুখের খোঁজে, ছবির প্রধান দুই চরিত্র প্রবোধ ও রানির জন্য। অনেক বাছাবাছির পরে দুজন নায়ক বসন্ত চৌধুরী ও বীরেন চট্টোপাধ্যায় এবং দুজন নায়িকা অরুন্ধতী মুখার্জি ও নীলিমা সান্যালকে পাওয়া গেল। শুরু হল মহড়া। কখনও বসন্ত বনাম নীলিমা বা অরুন্ধতী, কখনও বীরেন বনাম অরুন্ধতী বা নীলিমা। অবশেষে পছন্দ হল বসন্ত ও অরুন্ধতী জুটি। আরেক বিপদ, বসন্ত চৌধুরীর সেই যাযাবর জীবনের ঠিকানা তখনও জানা নেই কারোও। খবর জানানো হবে কীভাবে তাঁকে?
অবশেষে সহ-পরিচালক ঢুলুবাবু একদিন ট্রামে করে যেতে যেতে দেখতে পান বসন্তকে। ট্রাম থেকে নেমে ছুটে গিয়ে পাকড়াও করে সুখবর শোনান তিনি।

কথায় বলে ‘উপরওয়ালা যব ভি দেতা হ্যাঁয়, ছাপ্পড় ফারকে দেতা হ্যাঁয়’, এও হল খানিক তেমনই। কাজের জন্য যে মানুষ গত এক বছর ধরে এর-ওর দরজায় ঘুরে বেড়ালো তাঁর সামনে এখন দুটো অফার। কিন্তু গোল বাধল অন্য জায়গায়। এন টি স্টুডিয়োর ছবিতে কাজ করলে আর কোনও ছবিতে কাজ করা যায় না। ওখানে এক্সক্লুসিভ হিসাবে কাজ করতে হয়। সেটাই শর্ত। সেক্ষেত্রে মাধব ঘোষালের ছবি ‘মন্দির’ থেকে বিদায় নিতে হয় বসন্তকে। মাধববাবুর দাদা কেশববাবু (মতান্তরে কানাইবাবু) রাজি ছিলেন ‘ডেট অ্যাডজাস্ট’ করতে, কিন্তু নিউ থিয়েটার্স অপারগ, কারণ ছবিটি ছিল দ্বিভাষিক (হিন্দিতে ‘যাত্রিক’) এবং তার সঙ্গে ছিল প্রচুর আউটডোর। অতএব অভিনেতাদের নিয়মিত উপস্থিত থাকতে হবে স্টুডিওতে। কেশববাবু তিন দিনের হয়ে যাওয়া শুটিংয়ের যাবতীয় খরচ (প্রায় তিন হাজার টাকা) ক্ষতিপূরণ হিসেবে দাবি করে বসলেন। সঙ্গে অগ্রিম দেওয়া তিনশো টাকা। বসন্তর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
অবশেষে অনেক চেষ্টায় ও দেবকী বসুর (তিনি তখন রাধা ফিল্মসের অ্যাডভাইসর পদে) মধ্যস্থতায় ছাড়া পেয়েছিলেন বসন্ত। শুটিংয়ের খরচ দিতে হয়নি বটে, তবে অগ্রিম হিসেবে পাওয়া তিনশো টাকা তিনি ফেরত দিয়েছিলেন। এন টি স্টুডিয়োতে তাঁর মাস মাইনে হল তিনশো টাকা, যা পরে বেড়ে হয় পাঁচশো। কার্যত ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ হেঁটেই বসন্ত চৌধুরী প্রবেশ করলেন বাঙালি দর্শক মনে! সালটা ১৯৫২।
এন টি স্টুডিয়োর ছবিতে কাজ করলে আর কোনও ছবিতে কাজ করা যায় না। ওখানে এক্সক্লুসিভ হিসাবে কাজ করতে হয়। সেটাই শর্ত। সেক্ষেত্রে মাধব ঘোষালের ছবি ‘মন্দির’ থেকে বিদায় নিতে হয় বসন্তকে। মাধববাবুর দাদা কেশববাবু (মতান্তরে কানাইবাবু) রাজি ছিলেন ‘ডেট অ্যাডজাস্ট’ করতে, কিন্তু নিউ থিয়েটার্স অপারগ, কারণ ছবিটি ছিল দ্বিভাষিক (হিন্দিতে ‘যাত্রিক’) এবং তার সঙ্গে ছিল প্রচুর আউটডোর। অতএব অভিনেতাদের নিয়মিত উপস্থিত থাকতে হবে স্টুডিওতে। কেশববাবু তিন দিনের হয়ে যাওয়া শুটিংয়ের যাবতীয় খরচ (প্রায় তিন হাজার টাকা) ক্ষতিপূরণ হিসেবে দাবি করে বসলেন। সঙ্গে অগ্রিম দেওয়া তিনশো টাকা।
সৌম্যকান্তি চেহারার কারণেই হয়ত বা দেবকী বসু চৈতন্যদেবের চরিত্রে বসন্ত চৌধুরীকে নির্বাচিত করেছিলেন। সেটা ছিল বসন্তবাবুর দ্বিতীয় ছবি। বিপরীতে সুচিত্রা সেন। শোনা যায় দেবকী বসু নাকি নিজে ছিলেন বৈষ্ণব সাহিত্যে প্রাজ্ঞ এবং যার ফলে ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’ ছবির স্ক্রিপ্ট শোনানোর পরে বেশ কিছুদিন বসন্ত চৌধুরীকে চৈতন্যদেব সম্পর্কে তিনি একটি ধারণা দিয়েছিলেন যা সিনেমায় চরিত্রায়নে সাহায্য করেছিল তাঁকে। ১৯৫৪-তে নীরেন লাহিড়ির ‘যদুভট্ট’-তে বসন্ত পার্শ্বচরিত্রে। ১৯৫৫ সালে তাঁর পাঁচটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল— ‘দুজনায়’, ‘ভালোবাসা’, ‘দেবীমালিনী’, ‘অপরাধী’ এবং ‘পথের শেষে’। এর মধ্যে ‘ভালোবাসা’ ছবিতে সুচিত্রা সেন ছিলেন নায়িকা হিসেবে। পরিচালক দেবকী বসু। বসন্ত চৌধুরীকে ঘিরে সাময়িক একটা আগ্রহ পরিচালকদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল বটে, তবে এই পর্বটি ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী। ১৯৯৩ অবধি প্রায় ৭২ টি ছবিতে কাজ করে গেছেন তিনি, যার মধ্যে হিন্দি ছবির সংখ্যা সাত।

উত্তমকুমার এবং বসন্ত চৌধুরী— এই দুজন ছবির আঙিনায় মোটামুটি সমসাময়িক, যদিও বা বয়সের দিক দিয়ে বসন্ত ছিলেন বছর দুয়েকের ছোট। দুজনের সাজসজ্জা, বাচনভঙ্গি, শরীরীভাষা— এক কথায় যাকে বলে স্ক্রিন প্রেসেন্স, তার মধ্যে বেশ মিল থাকলেও দর্শক স্বীকৃতির সাপেক্ষে তাঁরা তৈরি করতে পেরেছিলেন দু’ধরনের সিনেমাটিক ইমেজ। নিউ থিয়েটার্স-পরবর্তী যুগে বাংলা সিনেমার গতিপ্রকৃতি বদলের সঙ্গে উত্তমকুমারের জনপ্রিয়তা এক অন্য পর্যায়ে উন্নীত হলেও বসন্ত চৌধুরী বাংলা সিনেমায় ‘স্টার’ নন, আভিজাত্যে ভরা এক অভিনেতা হিসেবে মান্যতা পেয়ে গিয়েছেন তাঁর অভিনয় জীবনে।
বসন্ত-উত্তমের ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপরে তাঁদের এই পেশাগত টানাপোড়েন কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব চিরকাল অটুট থেকেছে। উত্তমকুমার স্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর যেসব ছবিতে দুজনে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই বসন্ত চেষ্টা করেছেন নিজস্ব এক অভিনয়শৈলীকে কাজে লাগাতে। সফলও হয়েছেন ক্রমশ। বসন্তের কথায়, তিনি নির্দিষ্ট কোনও ইমেজ তৈরি করতে চেষ্টা করেননি কখনও। বলেছেন, “বারবার ব্যবহারে কোনও অভিনেতা তাঁর নিজস্ব ‘টাইপ’-এ অনেক সময়ে একটি ‘ইমেজ’-এ আবদ্ধ হয়ে যান।” দুজনের এই পেশাগত রেষারেষির ব্যাপারটা বোঝাতে গিয়ে ‘শঙ্খবেলা’ ছবির উদাহরণ দিয়েছেন:
“ছবির রোমান্টিক পোর্শান উত্তমের। কিন্তু আমি জানতাম আমার যা চরিত্র (ডাক্তারের) তাতে হাজার চেষ্টা করলেও আমাকে মেরে বেরিয়ে যেতে পারবে না।” বিপরীতে উত্তমকুমারও ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। ১৯৬৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘রাজা রামমোহন’, অসাধারণ অভিনয় বসন্তের। মহানায়কের বাড়ির আড্ডায় কোন এক স্তাবক মন্তব্য করে বসলেন, “রামমোহনে বসন্তের অ্যাক্টিং নিয়ে কেন যে এত হইচই হচ্ছে তা বুঝি না বাবা! দাদা ওই রোলটা করলে এর চেয়ে অনেক ভাল করতেন, একবারে ফাটিয়ে ছেড়ে দিতেন।” এই মন্তব্যে নাকি উত্তম রীতিমত রুষ্ট হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান এবং পরে বলেন, “বইয়ের পাতায় রামমোহনকে যেমন দেখেছি, তাঁর সম্পর্কে যা পড়েছি, বসন্ত যেন সেখান থেকেই হুবহু উঠে এসেছে।” প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই ছবির জন্যই বসন্ত চৌধুরী ‘বিএফজেএ’ শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান।
কলকাতার পাবলিক থিয়েটারেও বসন্ত চৌধুরী অভিনয় করেছেন পঞ্চাশের দশক থেকেই। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরোগ্য নিকেতন’ নাটকে নবীন চিকিৎসকের প্রধান চরিত্র দিয়ে তাঁর থিয়েটার জীবনের সূচনা হয়। ‘পরমা’, ‘দেনা পাওনা’, ‘বিপ্রদাস’, ‘অগ্নিবন্যা’-সহ বহু নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। স্টারে ‘কালবৈশাখী’ ও ‘ক্ষুধা’ ৫০০ রজনী চলেছিল। ষাটের দশকে ‘শ্রেয়সী’ নাটক দর্শককে মাতিয়ে রাখত। আকাশবাণীতেও তাঁর কণ্ঠ শোনা যেত সেসময়ের বেতার নাটকে। এক সময়ে নট্ট কোম্পানির হয়ে যাত্রা করেছেন নিয়মিত। শ্রীরঙ্গমে (যা পরে বিশ্বরূপা) একবার শিশির ভাদুড়ির পরিচালনায় নাটক করবার সুযোগ পেয়েও তা হয়ে ওঠেনি সিনেমার কাজের ব্যস্ততায়। এ নিয়ে তাঁর আফসোস ছিল দীর্ঘদিন। বসন্ত চৌধুরীর কণ্ঠ-মাধুর্যে যেকোনও আবৃত্তি অথবা পাঠ এক অন্য মাত্রা পেত।
একবার জ্ঞানমঞ্চে রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ উপন্যাস একটু এডিট করে পাঠ করেছিলেন, শুনে সাহিত্যিক সন্তোষ কুমার ঘোষ যারপরনাই উল্লসিত। কে এডিট করেছে জানতে চেয়ে যখন জানলেন এ বসন্তের নিজের হাতে করা, জড়িয়ে ধরে বললেন, “দারুণ এডিট করেছ তুমি, সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’-র চেয়েও ভালো হয়েছে তোমার ‘নষ্টনীড়’!” শুনে লজ্জায় জিভ কেটে বসন্ত বললেন, “দোহাই সন্তোষদা এই কথাটা বাইরে বলে বেড়াবেন না। মানিকদার ছবিতে চান্স পাইনি, এসব শুনলে ভবিষ্যতে আর পাব না!”

অভিনেতা জীবনের সমান্তরালে বসন্ত চৌধুরীর ইতিহাসচর্চা উল্লেখের দাবি রাখে। তাঁর অসমবয়সি বন্ধু তথা দীর্ঘদিনের কাজের সঙ্গী আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল গৌতম সেনগুপ্ত ধরিয়ে দেন, “বসন্ত চৌধুরী আভিজাত্য, বনেদিয়ানা নিয়ে কেবলমাত্র একজন অভিনেতা ছিলেন না। ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের ব্যাপারে কলকাতার এক কিংবদন্তি চরিত্রও তিনি। ত্রিপুরা, কোচবিহার, আরাকান-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পুরনো রাজতন্ত্র ও প্রত্নতত্ত্বের তিনি বিশেষজ্ঞ ছিলেন।” প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহ এবং সে বিষয়ে গবেষণা ছিল তাঁর এক ধরণের প্যাশন। কোনও প্রত্যন্ত মফঃস্বল গ্রামে গিয়ে ইতিহাসের সূত্র ধরে তা অনুসন্ধানের জন্য হাজার ব্যস্ততার মাঝেও সময় করে নিয়েছেন। প্রযোজকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ছুটি নিয়েছেন। কিন্তু এসবের মধ্যে ছিল না অর্থ উপার্জনের কোনও উদ্দেশ্য। সবটাই করেছিলেন প্রাণের টানে ও শিল্প-চেতনার তাগিদে। ২০০০ সালে মৃত্যুর আগে তাঁর অসাধারণ গণেশ মূর্তির সংগ্রহ থেকে ১০১ টি দিয়ে যান কলকাতার ভারতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের হাতে। জাদুঘরের অফিসার সত্যকাম সেন সেদিন গেছিলেন অসুস্থ মানুষটিকে তাঁর রিজেন্ট গ্রোভের বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে। “ঐ শারীরিক অবস্থাতেও ধুতি পাঞ্জাবী পরিহিত মানুষটি অ্যাম্বুলেন্স চড়ে এলেন, তৎকালীন রাজ্যপাল বীরেন শাহ মহাশয় ট্রাস্টি বোর্ডের প্রধান হিসেবে তাঁর হাত থেকে গ্রহণ করেছিলেন গণেশের কালেকশান, যেগুলো পরে স্থান পেয়েছিল ব্রোঞ্জ গ্যালারিতে।”
আসলে বসন্ত চৌধুরী শুধু একজন গুণী মানুষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন গুণগ্রাহী, এবং সেটা বোধহয় সম্ভব হয়েছিল তাঁর শিক্ষাদীক্ষা, অভিনয় পারদর্শিতা, শিল্পমনস্কতা এবং বিনয়ী মনোভাবের এক অদ্ভুত মিশেলের কারণে। দীর্ঘ অসুস্থতার পর ২০০০ সালের ২০ জুন তিনি চলে যান সেই চিরবসন্তের দেশে।
তথ্য ঋণ: ‘সাত রঙ’ প্রথম খণ্ড, রবি বসু
‘রোদনভরা বসন্তে স্বাভিমানী এক অভিনেতা’, সুদেষ্ণা বসু
ছবি সৌজন্য: সঞ্জিত চৌধুরী, Wikipedia
সপ্তর্ষি রায় বর্ধনের জন্ম, কর্ম এবং বর্তমান ঠাঁই তার প্রাণের শহর কলকাতায়। প্রথাগত ছাত্রজীবন কেটেছে কলকাতার পাঠভবন স্কুল, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে। লেখাজোকা, ছবি তোলা, নাট্যাভিনয় আর হেরিটেজের সুলুক সন্ধানের নেশায় মশগুল। সঙ্গে বই পড়া, গান বাজনা শোনা আর আকাশ পাতাল ভাবনার অদম্য বাসনা। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন- "রূপকথার মতো- স্মৃতিকথায় প্রণতি রায়", "খেয়ালের খেরোখাতা" এবং "চব্য চোষ্য লেহ্য পেয়"।
One Response
অপূর্ব লাগলো। র ও ভালো লাগলো আমার বাবার লেখা ও নির্দেশনা র নাটক পরমার নাম দেখে। সেই সময়ের অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেলো।