(Bengali Culture)
সামাজিক জনতত্ত্বের দৃষ্টিতে চড়ক হল আদিম কৌম সমাজের ভূতবাদ ও পুনর্জন্মবাদ বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত এক লোকায়ত সংস্কৃতির অঙ্গ। চড়ক পূজারীরা আজও আমাদের সমাজের অনাচরণীয় স্তরের। এক সময়ে গাজনের সঙ্গে জড়িয়ে সং সেজে যাত্রাপালার পিছনেও রয়েছে বিচিত্র সব পৌরাণিক কাহিনি৷ গাজনের শিবকেন্দ্রিক কাহিনিগুলিও মজার৷ এক কাহিনিতে বলা হয়, একবার পার্বতী অনেক দিনের জন্য শিবকে ছেড়ে বাপের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন৷ পার্বতীর বিহনে কাতর শিব নন্দীকে পাঠালেন পিত্রালয় থেকে পার্বতীকে নিয়ে আসতে৷ এদিকে ঘরণী-বিহনে কাতর শিবকে দেখে চিত্রলেখা নামে স্বর্গের এক অপ্সরার খুব মায়া হল৷ সে তখন পার্বতীর শিবালয়ে ফিরে আসা অবধি ছদ্মবেশে (সং) নাচে-গানে শিবকে মজিয়ে রাখল৷ (Bengali Culture)
শিবের গাজনে সং সেজে যারা বেরোন সেখানে সব সময়েই দু’জন শিব-পার্বতী অবশ্যই সাজেন।
শিব প্রসন্ন হলেন চিত্রলেখার ওপর৷ সেইজন্য শিবের গাজনে সং সেজে যারা বেরোন সেখানে সব সময়েই দু’জন শিব-পার্বতী অবশ্যই সাজেন। এছাড়াও সাঙ্গোপাঙ্গর দলে নন্দী, ভৃঙ্গী, ভূতপ্রেতের দল নাচাকোঁদা করেন৷ কিন্তু আপামর জনসাধারণের মনোরঞ্জনের উপাদান এই লোকনাটকের মূল কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকে উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের একটা প্রচ্ছন্ন প্রতিবাদী হাতিয়ার৷ আপাতভাবে হাসি-মশকরা বা রঙ্গ-কৌতুকের মাধ্যমে নির্মল আনন্দ পাওয়ার মাধ্যম মনে হলেও প্রয়োজনে তাদের প্রতিবাদের ভাষা সরব হয়ে উঠত, উনিশ শতকের সঙের গান তার প্রমাণ। সে সময় সঙের মিছিলে এবং গানে রস-পরিহাসে, রঙ্গ-ব্যাঙ্গে সমাজের অসঙ্গতিকে তুলে ধরা ছিল আসল উদ্দেশ্য। (Bengali Culture)

এমনকি স্ত্রীশিক্ষা, স্ত্রী-স্বাধীনতাও বাদ পড়েনি সেখানে। বুক চিতিয়ে মাথা উঁচু করে তারা বলতে পেরেছিল, ‘আমরা সবাই শিবের চেলা(আমরা) ভূত গাজনের সং/ বছর ভরে তা ধেই তা ধেই নাচছি জবর জং/ (মোদের)এক চোখেতে মায়ার কান্না, এক চোখেতে হাসি। (আমরা)ঝগড়াঝাঁটি কুৎসা হুজুগ স্বার্থ ভালবাসি।’ মোক্ষম সার কথাটি আছে এই গানের শেষে:
‘সাহিত্য সমাজে ঘরে/ সং নাচে পুরো বহরে,/ সংয়ের সং আজ এক নজরে,/দেখুন ডডং ডং॥’ (Bengali Culture)
সং নামের এই লোকসংস্কৃতির মধ্যে একটা সর্বগ্রাসী বিদ্রুপের কৌতুকবাহী অভিব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। সঙের গান যেন সম্বৎসরের খতিয়ান। সমাজের আনাচেকানাচে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে লোকশিক্ষা দেওয়া।
উৎসবে-পার্বণে এ-দেশে সং প্রদর্শন বহু প্রাচীন প্রথা। কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম পেঁচার নক্শাতেও নানা কিসিমের সঙের বর্ণনা আছে।
সেখানে গল্পের শুরুই কলকাতার চড়ক পার্বণে ঢাকের বাদ্যি বাজিয়ে, সং সেজে… টুনোয়ার টপ্পা গান দিয়ে।
“কহই টুনোয়া শহর শিখাওয়ে কোতোয়ালী”
বাবুদের বাড়ির গাজনে আত্মহারা ছুতোর থেকে গয়লা, গন্ধবেনে থেকে কাঁসারীরা। (Bengali Culture)
আরও পড়ুন: মুক্তিরূপেণ সংস্থিতা
এক নিপাট বর্ণনা পাওয়া যায় হুতোমের লেখায়।
“আজ অমুকের গাজনতলায় চিৎপুরের হর। ওদের মাটে সিংগির বাগানের প্যালা। ওদের পাড়ার মেয়ে পাঁচালি। আজ শহরের গাজনতলায় ভারি ধুম, চৌমাথার চৌকিদারদের পোহাবারো। মদের দোকান খোলা না থাকলেও সমস্ত রাত্তির মদ বিক্রি হবে, গাঁজা অনবরত উড়বে… আজ কার সাধ্য নিদ্রা যায়- থেকে থেকে কেবল ঢাকের বাদ্যি, সন্ন্যাসীর হোররা ও ‘বলে ভদ্দেশ্বরে শিবো মহাদেব’ চিৎকার।” (Bengali Culture)
(Bengali Culture) যাত্রার আসরেও সং আসত। প্রায় দু’শ বছর পূর্বে বাংলায় যেসব সং বের হত তার অধিকাংশ ছিল অশ্লীল। গিরিশচন্দ্র ঘোষ উল্লেখ করেছেন:
‘থিয়েটারের প্রাদুর্ভাবের পূর্ব্বে কবি, হাফ-আকড়া, পাঁচালী ও যাত্রার প্রাদুর্ভাব ছিল। হাফ-আকড়া, কবি ও পাঁচালীতে গালি-গালাজ চলিত এবং ঐ সকল গালি-গালাজ লইয়া সমাজে সকলে বিশেষ আনন্দ করিত। যাত্রায় বড় একটা কথাবার্তা ছিল না, দু-একটা কথার পর ‘তবে প্রকাশ করে বল দেখি?’ বলিয়া গান আরম্ভ হইত। সেই গানের কতক আদর ছিল, কিন্তু বিশেষ আদর সঙের। সং হালকা সুরে গাইত, অপেক্ষাকৃত ভারী অঙ্গের পালার সুর হইতে সঙের সুরের আদর অনেকের নিকট হইত। সং গালাগালি দিত। তাহা লোকের প্রিয় হইত।’ (Bengali Culture)
হালকা সুরে গাইত, অপেক্ষাকৃত ভারী অঙ্গের পালার সুর হইতে সঙের সুরের আদর অনেকের নিকট হইত।
রসরাজ অমৃতলাল বসু তাঁর সরস রচনায় জেলেপাড়ার সঙের সবিশেষ গৌরব বৃদ্ধি করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রশ্ন চুরি নিয়ে জেলেপাড়ার সঙের জন্য গান লিখেছিলেন প্রবাসী পত্রিকায়।
“বিদ্যার মন্দিরে এ সিঁদ কেটেছে কোন চোরে;
সখী নেকী নাকি পড়লো ফাঁকি
কেউ দেখেনি ঘুমের ঘোরে।।”
(Bengali Culture)

সে কালের চড়কে সন্ন্যাসী এবং সঙের মিছিলের একটি ছবি এঁকেছিলেন বিদেশি চিত্রকর স্যর চার্লস ডি’অয়লি। লন্ডনের ডিকিনসন অ্যান্ড কোম্পানি ছবিটি ছাপিয়েছিলেন। এ ছবিতে আছে সং, বসা সং অর্থাৎ মাটির পুতুল-সহ বিরাট শোভাযাত্রার দৃশ্য। সে কালে সঙের মিছিলে ইংরেজরাও যোগ দিতেন। চৈত্র সংক্রান্তিতে কলকাতায় গাজনের দলের পথে পথে ঢাক ও কাঁসর বাজিয়ে ঘোরা এবং সং বেরনো ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। জীবনযাত্রার অঙ্গ। তাদের শব্দভান্ডারে শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত শব্দ ছিল না। শিবপুর, খুরুট, মেদিনীপুর, ঢাকা, হাওড়ার রাধাপুর, শ্রীরামপুর, কলকাতার তালতলা, বেনেপুকুর, খিদিরপুর, কাঁসারিপাড়া আর জেলেপাড়া— এ সব নানা জায়গা থেকে সং বেরোত। (Bengali Culture)
(Bengali Culture) উত্তর কলকাতার বারাণসী ঘোষ স্ট্রিট থেকে বেরোত কাঁসারিপাড়ার সং। এদের উৎসাহদাতা ছিলেন প্রখ্যাত ধনী তারকনাথ প্রামাণিক আর ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’-এর সম্পাদক কৃষ্ণদাস পাল। বিশেষভাবে তৈরি ঘোড়ায় টানা ‘কাটরা গাড়ি’ করে কাঁসারিপাড়ার সং পথে পথে ঘুরত। তা ছাড়া হার্ড ব্রাদার্স অথবা কুক কোম্পানির মোষে টানা ট্রাকেও সং বেরোত। উত্তর কলকাতায় সং বেরনোর আগেই রাস্তার দু’পাশের বাড়ির বারান্দা দর্শকদের ভাড়া দিয়ে গৃহস্বামীদের রোজগার হত। এক মাইল দীর্ঘ সঙের মিছিলে থাকত নাচ, গান, হাসি, মজা আরও কত কী! সংযাত্রার দু’পাশে প্রায় সব বাড়িতে তৈরি হত শরবত, ব্যবস্থা থাকত পান ও তামাকের আর শিশুদের দুধের। আবার দর্শকদের জন্য অনেক বাড়ির সামনে শামিয়ানা টাঙানো হত। অমৃতবাজার পত্রিকা ১ বৈশাখ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে লিখেছিল, চৈত্রসংক্রান্তিতে নানা কার্টুন আর ব্যঙ্গচিত্রে সঙের মিছিল ছিল অভিনব। কার্টুনের মধ্যে অন্যতম ছিল ‘গ্রাম উন্নয়ন’, ‘হাতুড়ে ডাক্তার’, ‘পশারহীন উকিল’, ‘আধুনিক যুবক’, ‘মোহন্ত আর তার বউ’ ইত্যাদি। ঠিক যেন পটচিত্রের গান। সমাজের দর্পণ লোকসম্মুখে তুলে ধরা। (Bengali Culture)
আরও পড়ুন: বীরভূমের হারিয়ে যাওয়া নৌবন্দর সুপুরে
চৈত্র সংক্রান্তির দিনে জেলেপাড়ার সং বেরোত। অনেকদিন আগে থেকেই পালা ও গান লিখে সুর দিয়ে নিয়মিত মহড়া চলত। গোড়ার দিকে সেসব গান ও পালা রচনা করতেন রূপচাঁদ পক্ষী, গুরুদাস দাস, নেপালচন্দ্র ভট্টাচার্যরা। সঙেরা যে সব সমাজচেতনার গান গাইত তার আবেদন ছিল যথেষ্ট। আবার সঙের দল হাস্যকর অঙ্গভঙ্গীর সঙ্গে ছড়া বললে জনতার মধ্যে হাসির রোল উঠত। সং ছড়া কাটত,
‘হাসি হাসব না তো কি/ হাসির বায়না নিয়েছি/ হাসি ষোল টাকা পণ/ হাসি মাঝারি রকম/ হাসি বিবিয়ানা জানে/ হাসি গুড়ুক তামাক টানে/ হাসি প্যরা গুড়ের সেরা/ হাসি হুজুর করে জেরা।’
(Bengali Culture)
লোকের মুখে মুখে ফেরা জেলেপাড়ার সঙের গান আবার উদ্যোক্তারা কখনও বই আকারে ছেপে বিক্রিও করতেন। ষোলো থেকে আটচল্লিশ পাতার সে পুস্তিকার দাম ছিল দুই থেকে পাঁচ পয়সা।
তার মধ্যে আবার বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির জাতীয়তাবাদী ভাবধারার বিকাশও চোখ এড়ায়নি জেলেপাড়ার সঙেদের। ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকা ১৪ এপ্রিল ১৯৩০ সংখ্যায় লিখেছিল, ‘জেলেপাড়ার সং সম্প্রদায় জাতীয় ভাবের প্রচারের প্রচেষ্টা করিয়াছেন দেখিয়া সকলেই যারপরনাই সুখী হইয়াছেন।’ ক্যাথরিন মেয়োর ‘মাদার ইন্ডিয়া’ বইটিতে ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা করা হলে, এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী পত্রিকা সোচ্চার হয়ে কড়া সমালোচনা করেছিল জেলেপাড়ার সঙের ছড়ার মধ্যে দিয়ে— ‘সাগর পারের নাগর ধরা/ স্বেচ্ছাচারিণী / তারাই হল ভারত নারী কেচ্ছাকারিণী।’ একবার জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবসে জেলেপাড়ার সঙের জন্য ছড়া লিখলেন দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্রপণ্ডিত। এ ছাড়াও ছড়া, গান ও পালা লিখতেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে অন্যতম রসরাজ অমৃতলাল বসু, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, সজনীকান্ত দাস, রসময় লাহা, বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ, মনোমোহন গোস্বামী, নিত্যবোধ বিদ্যারত্ন প্রমুখ। লোকের মুখে মুখে ফেরা জেলেপাড়ার সঙের গান আবার উদ্যোক্তারা কখনও বই আকারে ছেপে বিক্রিও করতেন। ষোলো থেকে আটচল্লিশ পাতার সে পুস্তিকার দাম ছিল দুই থেকে পাঁচ পয়সা। এই সব ছোটখাটো বইতে সোডা লেমনেড কিংবা আয়ুর্বেদীয় ঔষধের বিজ্ঞাপনও জুটত বৈকি। এই কাণ্ডকারখানা সঙের গানের চূড়ান্ত জনপ্রিয়তার প্রমাণ। (Bengali Culture)

(Bengali Culture) খিদিরপুরের সঙের মিছিল বেরোত চৈত্র সংক্রান্তি, ১ বৈশাখ ও ২ বৈশাখ। ২ বৈশাখের সং ছিল বাসি সং। মুসলিম কোচোয়ান, গায়ক ও বাদকের দল যোগ দিত এখানে মনসাতলার সঙের মিছিলে।
এদের একটি বিখ্যাত ছড়া ছিল— ‘বছরের শেষে গাও ভাই হেসে হেসে/ স্বরাজের গান হয়ে এক প্রাণ/ গোলামী আর সহনা।’
ঝাড়ুদার ছিল খিদিরপুর সঙের মুখ্য বিষয়। জমাদার এখানে সমাজের জঞ্জাল দূর করার প্রতীক। ঝাঁটা-বুরুশ, কোদাল-ঝুড়ি, ময়লা ফেলার গাড়ি সব ছিল সঙের নিজস্ব জিনিস। সঙের দল গাইত ‘ধাঙ্গড় মেথর আমরা মশাই থাকি শহরে,/ বাবুয়ানা করে মশাই আমাদের মেরে।’
এখানে পয়লা ও দোসরা বৈশাখ সং বেরোত সন্ধের পর আর চৈত্র সংক্রান্তির দিন দুপুরবেলায়। স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে ওই অঞ্চলে লোকের মুখে মুখে ঘুরত— ‘বউমা আমার সেয়ানা মেয়ে/ চরকা কিনেছে। ঘরের কোণে আপন মনে/ সুতো কেটেছে।’
১৮২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, ‘সমাচার দর্পণ’ থেকে জানা যায়, সে বছর সরস্বতী পুজোর প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রায় সঙের মূল বক্তব্য ছিল অন্যায়কারী, ক্ষমতাবানের ঔদ্ধত্য দেখানোর বিরুদ্ধে সাধারণের প্রতিবাদ। এই পত্রিকার খবর অনুযায়ী সঙের মিছিলের আয়োজককে পুলিশ গ্রেফতার করে আদালতে তুললে বিচারকর্তা তাঁকে বলেন, ‘তুমি তোমার দেবতার সামনে এ রকম কদর্য সং করেছ তা অতি মন্দ কর্ম।’ ‘বাইরে কোঁচার পত্তন ভিতরে ছুঁচোর কেত্তন’, ‘ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে’, ‘মদ খাওয়া বড়ো দায় জাত থাকার কি উপায়’— সংযাত্রায় এ সব নাম দেখলে বোঝা যেত বিদ্রুপের মুখ্য লক্ষ্যবস্তু কে বা কারা। (Bengali Culture)
সেকেলে কলকাতার ভৌগোলিক পরিসর ছিল ছোট। বছরের শেষ দিন থেকে বহু বিচিত্র সঙের শোভাযাত্রায় হাসি, গানে, মজায়, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-শ্লেষে মুখর হয়ে উঠত শহর কলকাতা।
বিশ শতকের গোড়ায় কলকাতার তালতলা অঞ্চলের হাঁড়িপাড়া থেকে সং বেরোত। হাঁড়িপাড়া ছিল বিরাট এলাকা, সেখানে অনেক জায়গায় খোলার বস্তি, মাটির ঘর। হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলমান সকলের এক সঙ্গে বাস। এই তালতলায় গাজনের সন্ন্যাসীরা নানা রকম সং সেজে ঘুরতেন, আবার জোড়া গির্জার পর নোনাপুকুর ট্রামডিপোর পিছনে বেনেপুকুর পল্লির সং বেরোত রাতে। চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন। সঙ্গে হত লীলাবতীর গান। হরগৌরীর সঙ্গে আরও বিচিত্র সং সেজে লোকে এখানে পথে নানা রঙ্গরসের অবতারণা করত। সেকেলে কলকাতার ভৌগোলিক পরিসর ছিল ছোট। বছরের শেষ দিন থেকে বহু বিচিত্র সঙের শোভাযাত্রায় হাসি, গানে, মজায়, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-শ্লেষে মুখর হয়ে উঠত শহর কলকাতা। (Bengali Culture)

আঠারো শতকের শেষ থেকে পাক্কা একশো বছর বঙ্গদেশে দুর্ভিক্ষ, মহামারি, কৃষক বিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহের মতো নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। কোলাহলমুখর নানা বিতর্কে মুখর ছিল বাঙালি সমাজ। পশ্চিমি শিক্ষাদীক্ষায় প্রাণিত নব্য শিক্ষিত ভদ্রলোকরা সঙের গানে তথাকথিত অমার্জিত টিকা-টিপ্পনি, রঙ্গ তামাশা মেনে নিতে পারেনি। তাই অনেক সংবাদপত্রে তা বন্ধ করে দেওয়ার দাবি ওঠে। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর টাউন হলে ভদ্রজন একত্র হয়ে ‘সোসাইটি ফর দ্য সাপ্রেশন অব পাবলিক অবসিনিটি’ প্রতিষ্ঠা করে। অশ্লীলতা নিবারণী সভা-র অনুরোধে সরকার এক সময়ে তারকনাথ প্রামাণিকের উৎসাহে প্রাণিত কাঁসারিপাড়ার সঙের মিছিল বন্ধ করে। সামান্য লোকের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে এ সভ্যতা দেখানোয় ‘বসন্তক’ পত্রিকা অবশ্য তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। তা ছাড়া কাঁসারিপাড়ার সঙের মিছিল বন্ধ করতে চেষ্টা করেছিলেন হগসাহেব নিজে। (Bengali Culture)
‘শহরে এক নূতন/ হুজুগ উঠেছে রে ভাই/ অশ্লীলতা শব্দ মোরা আগে শুনি নাই।/ বৎসরান্তে একটি দিন/ কাঁসারিরা যত/ নেচে কুঁদে বেড়ায় সুখে/ দেখে লোকে কত।/ যদি ইহা এত মন্দ/ মনে ভেবে থাকো/ নিজের মাগকে চাবি দিয়ে বন্ধ করে রাখো।’
সে দিন সঙের দল গান বেঁধেছিল ‘শহরে এক নূতন/ হুজুগ উঠেছে রে ভাই/ অশ্লীলতা শব্দ মোরা আগে শুনি নাই।/ বৎসরান্তে একটি দিন/ কাঁসারিরা যত/ নেচে কুঁদে বেড়ায় সুখে/ দেখে লোকে কত।/ যদি ইহা এত মন্দ/ মনে ভেবে থাকো/ নিজের মাগকে চাবি দিয়ে বন্ধ করে রাখো।’
(Bengali Culture)
‘এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই’ ধরনের নৈরাজ্যের এই অবস্থায় নিজস্ব ভঙ্গিতে, হাসি-হুল্লোড়ে, সঙের মতো লৌকিক সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন অশিক্ষিত, গরিব মানুষের দল। ভণ্ডামি, নষ্টামি, দালাল, মাতাল, গুলিখোর-সঙের গানে উপহাসে বিদ্রুপে সবার বিরুদ্ধে অস্ত্র শানানো ছিল তাদের লক্ষ্য।
ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় জেলে পাড়ার সংকে ‘সমাজের বিবেক’ আখ্যা দেন। “জেলেপাড়ার সঙের স্মরণ উৎসব প্রসঙ্গে” একটি পুস্তিকায় ‘সং (সং) শব্দের ব্যুৎপত্তি প্রসঙ্গে তাঁর ব্যাখ্যাটি প্রণিধান যোগ্য।
আর তাই বুঝি ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় জেলে পাড়ার সংকে ‘সমাজের বিবেক’ আখ্যা দেন। “জেলেপাড়ার সঙের স্মরণ উৎসব প্রসঙ্গে” একটি পুস্তিকায় ‘সং (সং) শব্দের ব্যুৎপত্তি প্রসঙ্গে তাঁর ব্যাখ্যাটি প্রণিধান যোগ্য। “বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের পোষাক পরিয়া অঙ্গভঙ্গি সহযোগে গান, ছড়াকাটা প্রভৃতির দ্বারা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের একটি পরিহাসোজ্জ্বল অনুকৃতিকে ‘সমাঙ্গ’ অর্থাৎ ‘অনুরূপ অঙ্গ’ বলা হইত। এই সংস্কৃত শব্দ হইতে উত্তর ভারতের হিন্দি প্রভৃতি ভাষায় (সওঁ আঙ্গ), এবং বাংলায় ‘সবঙ্গ’> সং বা সং। ছদ্মবেশ অর্থে ‘সং’ শব্দ বাঙ্গলা দেশে খৃষ্টীয় আঠারো শতকের শেষ দশক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। (Bengali Culture)
বাংলা নববর্ষ বরণে বাঙালি একেবারে সিদ্ধহস্ত। পয়লা বোশেখ এখন পণ্য সংস্কৃতির বানভাসি জোয়ারে ভাসছে। আবার ইংরেজি নতুন বছরেও পার্ক স্ট্রিট কার্নিভ্যাল তো বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের তালিকায় স্বমহিমায়। কিন্তু বাংলা নববর্ষের বর্ষবরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চৈত্র সংক্রান্তির মতো উৎসব যা সারাটা চৈত্রমাস ধরে চলে চড়ক আর গাজনকে কেন্দ্র করে। সংক্রান্তিতে হয় তার উদযাপন।
আরও পড়ুন: রসনার বশে বিভূতিভূষণ
চৈত্র সংক্রান্তিতে উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটের চড়কের মেলার কথা আমরা শুনলেও ছেলেপুলেদের বড় একটা সেসব মেলায় নিয়ে যাই না। পার্কস্ট্রিট কার্নিভাল বরং প্রায়োরিটি লিস্টে থাকে। চড়কের ঘূর্ণিকে কেন্দ্র করে জমে ওঠা এই মেলা কিন্তু শতাব্দী প্রাচীন। কলকাতার সীমানা ছাড়িয়ে এই চড়ক বা গাজনের উৎসব কিন্তু আদতে গ্রামবাংলার নিজস্ব লোকসংস্কৃতিরই অঙ্গ। নিম্নবিত্ত প্রান্তিক মানুষজনের কাজের সন্ধানে কলকাতায় যাতায়াতকে কেন্দ্র করেই মূলত শহরের ‘কালচার’-এ এক সময়ে স্থান করে নেয় এই উৎসবগুলি। (Bengali Culture)
‘সং’ যার আক্ষরিক অর্থ কৌতুকাভিনেতা বা ভাঁড় হলেও, অভিধানের গণ্ডী পেরিয়ে ‘সং’ আজকে বাঙালির জীবনের এক ভুলতে বসা অধ্যায়।
আর এই চড়ক বা গাজনের সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে ‘সং’ যার আক্ষরিক অর্থ কৌতুকাভিনেতা বা ভাঁড় হলেও, অভিধানের গণ্ডী পেরিয়ে ‘সং’ আজকে বাঙালির জীবনের এক ভুলতে বসা অধ্যায়। লোকনাট্য হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়া সং প্রদর্শন বহুদিন ধরেই দুই বাংলার বিভিন্ন পুজোপার্বণের রীতি হলেও চৈত্র মাসের গাজন উৎসবকেই সঙের উৎপত্তিস্থল হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।
আবারও মনে পড়ে ছোটবেলায় শোনা সেই ছড়া…
“খড়কে ডুরে শাড়ি পরে খুকুমণি যায় / চড়ক পুজোর ঢাক বাজে ঐ গাঁয়ের কিনারায়
পাশের গাঁয়ের বাঁশের সাঁকো, চলছে খুকু থামছে নাকো / ঘুমুর ঝুমুর ঘুঙুর বাজে আলতা পরা পায়”
তথ্যসূত্র:
হুতোম প্যাঁচার নকশা- কালীপ্রসন্ন সিংহ
স্বপন বক্সী- সঙের সেকাল-একাল। পুরশ্রী। কলকাতা। ২০০৯। পৃ. ২২।
বাংলার সং-এ অশ্লীলতার রঙ্গরস (Anudhyan: An International Journal of Social Sciences (AIJSS) – অতনু মিত্র
বাঙালির ইতিহাস – ডঃ নীহাররঞ্জন রায়
“সঙের গানেই ধরা পড়ত সমাজের অসঙ্গতি” – শম্পা ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা ১৬.৫.২০২১
“বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে মহাদেব”- গৌতম বসুমল্লিক, এইসময় অনলাইন
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।